Saturday, December 04, 2010

রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা প্রয়োজনঃ ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতি

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন-দিন সংঘাতময় হয়ে উঠছে। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে অনেকেই শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। রাজধানীর ব্যবসায়ী সমাজের সংগঠন মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের এক সভায় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের তেমন উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উঠে এসেছে। বিষয়গুলোর প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া উচিত।
প্রধান অতিথি হিসেবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি হিসেবে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশিও ছিলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। সভায় জানানো হয়েছে, পাকিস্তানের মতো রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দেশেও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের হার মাথাপিছু ৩২ মার্কিন ডলার কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র সাত মার্কিন ডলার।
অবশ্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কম আসার আরও কতকগুলো কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে: সুশাসনের অভাব, প্রশাসনিক ঘুষ-দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, অকার্যকর নীতিকাঠামো এবং জ্বালানিসংকট। সভাটির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু উল্লিখিত দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতাগুলো শুধু যে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে, তাও নয়। স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিও এসব কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ আমাদের বেশির ভাগ বিনিয়োগই স্থানীয় বিনিয়োগ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অতি সামান্য। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এমন যে শুধু বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যেই নয়, স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর পথ সুগম করতেও উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান যেমনটি বলেছেন, দেশে অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেরও বড় সুযোগ রয়েছে। অথচ সঞ্চয়ের অর্থ যাচ্ছে শেয়ারবাজারে, হাজার কোটি টাকার প্রবাসী-আয়ও বিনিয়োগ না হয়ে ব্যয় হচ্ছে ভোগবিলাসে ও আবাসন খাতে। বিনিয়োগনীতির দুর্বলতা রয়েছে বলে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বিনিয়োগবান্ধব শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন এবং মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের শিল্পনীতি কীভাবে কার্যকর হবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার যথার্থই মন্তব্য করেছেন, স্থানীয় বিনিয়োগকে এড়িয়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর জোর দিলে চলবে না, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ এলে দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া যাবে। জ্বালানিসংকট লাঘবের ব্যাপারে কিছু আশাব্যঞ্জক খবর জানানো হয়েছে, সেসব বাস্তবায়িত হলে দেশি-বিদেশি উভয় প্রকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গতিসঞ্চার ঘটতে পারে।
তবে সব আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির প্রত্যাশার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির শঙ্কাও রয়ে যাচ্ছে, যা দূর করার দায়িত্ব প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলোর। ব্যবসায়ীদের অনেকেই উভয় বড় দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এমনকি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠনগুলোতেও প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা রয়েছেন। বিনিয়োগবান্ধব ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে দলগুলোর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্তত সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এমন এক ন্যূনতম মতৈক্য গড়ে তোলা জরুরি যে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষতিকর হয়, এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি সবাই পরিহার করবেন।

No comments:

Post a Comment