Wednesday, September 14, 2011

উইকিলিকস ঝড় by রাশেদ মেহেদী

মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিস্ময় উইকিলিকস। মহাক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন থেকে শুরু করে বিশ্বের ছোট-বড় সব রাষ্ট্রের 'ব্ল্যাকবক্স' ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে উইকিলিকসের ক্ষিপ্রতা। যে অন্ধকারে আগে কখনও কেউ চোখ রাখতে পারেনি, সেখানে চোখ রাখছে উইকিলিকস। অবস্থা এমন যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাষ্ট্রযন্ত্রের মহানায়করা তটস্থ মনে চোখ রাখেন উইকিলিকসের পাতায়, সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে জেনে নেন অজানাকে। উইকিলিকসের এ ঝড় বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর দিয়েও।
বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় বেরিয়ে আসছে প্রতিদিন। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি, উভয়ের নেতারাই মনে করেন, এটি দেশ, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র। উদ্দেশ্যমূলক কোনো কারণে একটি বিশেষ মহল এসব করছে বলে তারা বিশ্বাস করেন। দেশের সুশীল সমাজ অবশ্য মনে করেন, উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন গোপন তারবার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের দৈন্য প্রকাশ পেয়েছে।
তারা বলেন, রাজনীতিবিদরা দেশের মানুষের কাছে না গিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেন। তাদের কাছে তদবিরে ব্যস্ত থাকেন ছোট-বড় সব দলের নেতারা। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, এভাবে গোপন দলিল প্রকাশ অনৈতিক ও অপরাধ। এদিকে উইকিলিকসের দাবি অনুযায়ী তাদের হাতে আছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রায় ৩০ লাখ গোপন নথি। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ইরাক যুদ্ধের গোপন নথিই রয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ। বাংলাদেশ সম্পর্কে ২ হাজার ১৮২টি গোপন নথি আছে উইকিলিকসের হাতে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০টি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া এসব প্রতিবেদন এখন সংবাদপত্রে পাঠকদের মূল খোরাক। সবকিছু ছাপিয়ে এখন উইকিলিকসের ফাঁস করা প্রতিবেদনের ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন পাঠক।
২০১০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে উইকিলিকস ঝড়ের সূচনা হয়েছিল ইরাক আর আফগান যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন গোপন নথি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে সাড়ে ৪ লাখ গোপন নথি আর আফগান যুদ্ধ নিয়ে ৯২ হাজার নথির সঙ্গে দুর্লভ ভিডিওচিত্র। গোটা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে দেখল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের গোপন নথির গোপনীয়তার গর্ব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন এ ধাক্কা সামলাতে যখন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে কাবু করার উপায় খুঁজছিল ঠিক তখন চীন, রাশিয়াসহ একাধিক ক্ষমতাধর দেশের গোপন নথি ফাঁস করে নতুন আলোচনার ঝড় তুলল উইকিলিকস। এরপর একের পর এক নতুন চমক, নতুন আঘাত। উইকিলিকসের দুনিয়া কাঁপানো সেই ঝড় আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ঘুরে এখন জোর দাপটে বাংলাদেশের সীমানাতেও বয়ে যাচ্ছে। বিশিষ্টজনদের মুখে এমনও শোনা যাচ্ছে, সিডর কিংবা আইলার মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে; কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় থাকা কিছু ভাগ্যবান, সিডর কিংবা আইলা যাদের নিরাপদ সুরম্য প্রাসাদ কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি, তারা এখন বিধ্বস্ত উইকিলিকস ঝড়ে। এ ঝড় সাধারণ মানুষের জন্য কোনো বিড়ম্বনা বয়ে আনেনি, বরং চোখ খুলে দিচ্ছে প্রতিদিন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় কোন নেত্রীর মনে কী ছিল, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কোন চোখে কাকে দেখেছে, তারেক রহমানকে নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা কী ছিল, বর্তমান সরকারের কোন মন্ত্রী পর্দার আড়ালে অদক্ষতা এবং সততার অভাবের সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, জামায়াতের গোপন মিশনের লক্ষ্য কী_ কোনো কিছুই এখন আর অজানা নয় দেশের সাধারণ মানুষের। অনেকে বলছেন, আর কিছু না হোক দেশের রাজনীতিকদের বিষয়ে উইকিলিকস অন্তত বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিয়েছে।
অনেকে মন্তব্য করেছেন, উইকিলিকসে প্রকাশিত নথির তীর যখন সরকারি দলের দিকে থাকে তখন বিরোধী দল উইকিলিকসের ভক্ত হয়ে যায়, আর তীর যখন বিরোধী দলের দিকে তখন সরকারি দল মুচকি হাসে। এক কথায় তারা বলছেন, ক্ষমতার ছায়ায় থাকা এসব ব্যক্তির সবাই উইকিলিকসের ভক্ত, আবার বিরোধী_ দুটিই।
যুক্তরাষ্ট্রের নথি প্রকাশ করার মুহূর্ত থেকেই বৈরী পরিবেশের মুখে পড়ে উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ, এমনকি আন্তর্জাতিক মাস্টার কার্ড ব্যবহারে বিনা নোটিশে নিষেধাজ্ঞা, প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা, উইকিলিকসের ডোমেইনে এক ডজন হ্যাকারের ধারাবাহিক হামলা। অবশ্য কোনোকিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি উইকিলিকসকে। বরং আরও বেশি উদ্যম, আরও বেশি বেপরোয়া উইকিলিকস। জামিনে বের হয়ে যুক্তরাজ্যে গোয়েন্দাদের ২৪ ঘণ্টা নজরদারির মধ্যে কাটাচ্ছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, আর উইকিলিকসের পাতায় সেই গোয়েন্দাদের পাঠানো গোপন তারবার্তা দিব্যি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ-মার্কিন সম্মিলিত গোয়েন্দা শক্তি যেন হার মেনেছে উইকিলিকসের সাইবার বোমার কাছে। সবার মাঝে এখন একটিই প্রশ্ন, উইকিলিকসের এই যাত্রার শেষ কোথায়? আরও কী চমক দেখাবে উইকিলিকস?
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম উইকিলিকসের দখলে
উইকিলিকসের পাতায় বাংলাদেশের স্থান হয়েছিল ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত গোপন নথির বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার কথা। এর কিছুদিন পরই হরকাতুল জিহাদ বা হুজিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আনতে চেয়েছিল বলে তথ্য প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দেয় উইকিলিকস। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির পাঠানো তারবার্তা নিয়ে প্রথমদিকে উইকিলিকসের পাঠানো তথ্যগুলো ছিল ইসলামী দল এবং তাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ঘিরেই। ক্ষমতার বৃত্তের কাছাকাছি থাকা দলগুলোর মধ্যে বিএনপির চারদলীয় জোটের প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে চায় এবং এ উদ্দেশ্যে নেওয়া তাদের গোপন মিশন নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে উইকিলিকস। তখনও ক্ষমতার পালাবদলের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির গায়ে উইকিলিকসের আঁচড় লাগেনি।
গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সারাদেশে বেহাল সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। ঠিক সে মুহূর্তে উইকিলিকসের তীরও বিদ্ধ করল তাকে। উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেল, ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস আরও কয়েক মাস আগেই যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তার সততা বিশ্বাসযোগ্য নয়_ এমন মত দিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছে ওয়াশিংটনে। পরদিনই সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রমাণিত সৎ ব্যক্তি, উইকিলিকসের তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। উইকিলিকস নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও বললেন, এসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তখন থেকেই বাংলাদেশের সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতার গুরুত্বপূর্ণ শিরোনামে চলে এলো উইকিলিকস। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদ সংস্থায় বিশেষ জায়গা করে নিল উইকিলিকসের ফাঁস করা প্রতিবেদন।
এরপর একের পর এক বাংলাদেশ বিষয়ক তথ্য ফাঁস হতে থাকলে সংবাদপত্রের প্রথম ও শেষ পাতায় উইকিলিকস কর্নার চালু হলো। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পৃথক শিরোনাম দিয়ে উইকিলিকসের খবর প্রচার শুরু করল। এখানেও শেষ হলো না। এখন কোনো কোনো সংবাদপত্রে উইকিলিকস নিয়ে পৃথক পাতা আর টেলিভিশনে চার-পাঁচটি প্যাকেজ নিয়ে 'উইকিলিকস বিশেষ' প্রচারিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে সংবাদমাধ্যমগুলোর দায়িত্বশীলদের বক্তব্য হচ্ছে, পাঠক কিংবা দর্শক চায় বলেই এত গুরুত্ব দিয়ে উইকিলিকসে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকাশিত তথ্যকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন সংখ্যায় উইকিলিকসের তথ্য নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি মতামত আসছে, রেটিং আসছে। সবকিছু মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পাঠকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে উইকিলিকস।
উইকিলিকসের পাতায় ওয়ান-ইলেভেনের অজানা অধ্যায়
ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়ে অনেক অজানা তথ্য প্রতিদিন প্রকাশ করছে উইকিলিকস। প্রতিটি তথ্যের উৎস যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের গোপন তারবার্তা। এ তথ্যগুলোই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রধান আকর্ষণ। মাঠের ভাষণে রাজনীতিবিদরা কী বলেন আর পর্দার আড়ালে কী করেন, উইকিলিকসের তথ্য থেকে সে সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। 'ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বিগ্ন, বিএনপি চেয়ারপারসন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শান্ত ছিলেন', 'তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে রাজনীতিতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র', 'খালেদা জিয়া নিজে রাষ্ট্রপতি আর তার ছেলে বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন', 'খালেদা জিয়ার বড় ব্যর্থতা তারেকের দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া', 'যেভাবে ভেস্তে গেল মাইনাস টু ফর্মুলা', 'গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূস চেয়েছিলেন দুই নেত্রী সরে যান', 'জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করেছিল ফখরুদ্দীন সরকার', 'বিডিআর বিদ্রোহের সময় পরিস্থিতি সামলাতে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমানে অর্থমন্ত্রী) প্রণব মুখার্জির পরামর্শ চেয়েছিল বাংলাদেশ সরকার' প্রভৃতি সংবাদ শিরোনাম বাংলাদেশে এখন তুমুল আলোচিত। যোগাযোগমন্ত্রীর সততা এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার ব্যাপারে উইকিলিকসে তথ্য প্রকাশের পর বিএনপি নেতারা বেশ খুশি হয়েছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, দেশের মন্ত্রীদের সততা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠলে তা খুবই দুঃখজনক। তারেক রহমান আর খালেদা জিয়াকে ঘিরে একের পর এক তথ্য ফাঁস হলে সেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই বললেন, উইকিলিকসের তথ্যের বাস্তব ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যার যার স্বার্থে উইকিলিকসের তথ্য ব্যবহার করতে চেয়েছে। এখন উইকিলিকসের আঘাত বড় দু'দলের জন্যই বিব্রতকর হয়ে উঠছে। তাদের মতে, উইকিলিকস চোখ খুলে দিচ্ছে।
ক্ষমতাধর দেশের নতুন মাথাব্যথা উইকিলিকস
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নতুন মাথাব্যথা এখন উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে এভাবে গোপন দলিল প্রকাশকে অনৈতিক ও অপরাধ বলে মন্তব্য করেছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব রবার্ট গিবস তার এক বিবৃতিতে বলেন, এভাবে গোপন নথি প্রকাশ বড় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সেভাবেই বিষয়টিকে দেখছে। আইনগত ব্যবস্থা কী নেওয়া যায় তাও ভাবা হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, উইকিলিকসের এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না, কোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রভাব পড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রকাশিত গোপন নথির সত্যতা সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে সুইডেনের এক নারীকে ধর্ষণের দায়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর অনেকের মত ছিল, এটি যুক্তরাষ্ট্রের পাতানো মামলা। পরে সে মামলায় অ্যাসাঞ্জ গ্রেফতারও হলেন। শেষ পর্যন্ত জামিনও পেলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে জব্দ হলো উইকিলিকসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। আন্তর্জাতিক মাস্টার কার্ড পরিচালনায় যুক্ত সংস্থাগুলোও উইকিলিকসকে দেওয়া কার্ড ফেরত চাইল। এর বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দিল উইকিলিকস। এর পরের অধ্যায়ে হ্যাকারদের হামলা শুরু হলো উইকিলিকসের প্রতি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এক ডজন হামলা হলো। হ্যাকারদের তীব্র উৎপাতের পর উইকিলিকস কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত বিকল্প ডোমেইনের মাধ্যমে নতুন করে তাদের ওয়েবসাইট চালু করল গত ফেব্রুয়ারিতে।

উদ্দেশ্যমূলক

বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিকল্প ধারার গণমাধ্যম উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া বাংলাদেশ সম্পর্কিত তথ্যগুলোকে উদ্দেশ্যমূলক বলে উল্লেখ করেছেন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারা। তারা মনে করছেন এসব তথ্য যে সময়ে প্রকাশ হয়েছে তা রীতিমতো উদ্দেশ্যমূলক। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে 'পানি ঘোলা' করার উদ্দেশ্যেই কোনো একটি মহল এমনটি করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কিত তথ্যগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিলেও এর সত্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা বলেছেন, উইকিলিকসে প্রকাশিত সব তথ্যই যে সঠিক ও বাস্তবসম্মত এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। মার্কিন তারবার্তার তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতারাও। তারা বলেছেন, এর ফলে দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়বে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলের নেতারাই মনে করেন, এটি নতুন ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিদ্যমান নিবিড় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব প্রচার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রচার হওয়ার পর বিএনপি সাধুবাদ জানিয়ে বলেছিল, উইকিলিকসের তথ্যেই সরকারের দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। বিএনপি সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম বললেন, 'এর বাস্তব ভিত্তি নেই'। গতকাল মঙ্গলবার সমকালকে দেওয়া পৃথক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার আলোকে মার্কিন দূতাবাসের গোপন তারবার্তার বরাত দিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। এ নিয়ে খুব বেশি 'উল্লসিত' কিংবা 'বিমর্ষ' সর্বোপরি 'মাতামাতি'রও কিছু নেই।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য : দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যের সত্যতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, সেখানে অন্য নেতানেত্রীদের কার সম্পর্কে কী বলা হয়েছে সেগুলো নিয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। তবে তার (আমু) সম্পর্কে যে ঘটনা ও তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কেননা যে তারিখ উল্লেখ করে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে; সেই তারিখে তিনি দেশেই ছিলেন না। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, যে বা যারা বাংলাদেশ সম্পর্কিত ঘটনা কিংবা তথ্য প্রকাশ করছেন, সেসবের সত্যতা প্রমাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদেরই।
আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের পেছনে এক ধরনের 'অসৎ উদ্দেশ্য' অবশ্যই আছে। মহৎ উদ্দেশ্যে নয়, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করা তথা 'পানি ঘোলা' করে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্য নিয়েই কেউ কেউ এসব করছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, উইকিলিকসে আমাদের দেশ কিংবা নেতানেত্রী সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা মার্কিন দূতাবাস থেকে সেই দেশের সরকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে আসছে। এগুলো এখানকার সংশ্লিষ্ট ওই দূতাবাসটির নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। এর মধ্যে কিছু তথ্য আছে, যেগুলো নিঃসন্দেহে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব ঘটনা আমাদের অনেকেরই আগে থেকে জানাও ছিল। সব প্রতিবেদন কিংবা এতে প্রকাশিত সব তথ্যই যে বাস্তবসম্মত কিংবা সত্য হবে_ এটা অবশ্য মনে করার কোনো কারণ নেই।
এদিকে দলটির অনেক নেতা উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যগুলোকে 'স্পর্শকাতর' বলে উল্লেখ করেছেন। তারা এ নিয়ে মন্তব্য করতেও অনীহা প্রকাশ করেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য বলেন, 'কোথাকার কোন রাষ্ট্রদূত তার দেশের সরকারের কাছে কী পাঠিয়েছেন, তাই নিয়ে মাতামাতির কিছু দেখছি না। এ নিয়ে মন্তব্য করারও কিছু নেই।'
বিএনপি নেতাদের বক্তব্য : দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জেমস এফ মরিয়ার্টি বাংলাদেশে আসেন ২০০৮ সালের শেষদিকে। অথচ ২০০৫-০৬ সালের ঘটনা তার বরাত দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই সময় যিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তার দায়িত্ব ছিল স্টেট ডিপার্টমেন্টে মতামত পাঠানো। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সময়ের মিল না থাকায় উইকিলিকসের তথ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নেতাদের নিয়ে যেসব মতামত পাঠিয়েছেন, তা তার ব্যক্তিগত মতামত। কারণ তিনি যে সূত্র থেকে তথ্য জানাচ্ছেন, সে সূত্র সত্য নাও বলতে পারে। মোশাররফ আরও বলেন, ঢালাওভাবে বিএনপিকে নিয়ে তারবার্তার তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ উদ্দেশ্যমূলক। এসব শুরু হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব প্রচার করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, এসব তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কিছুর সত্যতা রয়েছে। সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সময়ের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। মাহবুব বলেন, তার সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের কথোপকথন দিয়ে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে, তা সঠিক নয়।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের মতামতে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটি শুধু ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভিত্তিতে পর্যালোচনা।
এদিকে সোমবার বিএনপিকে নিয়ে উইকিলিকসের তথ্য সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উইকিলিকসের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয়, এসব তথ্যের 'বাস্তব ভিত্তি' নেই। দলটির দাবি, এটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির নিবিড় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি অপকৌশল মাত্র। একই সঙ্গে দেশকে রাজনীতিশূন্য এবং বিএনপিকে হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রেরও অংশ।
ফখরুল বলেন, তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্র সফর সম্পর্কে গীতা পাসির বরাত দিয়ে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যটি বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কয়েকটি বার্তায় যে সময়ের কথা এসেছে, তা মরিয়ার্টির কার্যভার নেওয়ার অনেক আগে।

তত্ত্বাবধায়কের ওপর দায় চাপালেন মইন by নিখিল ভদ্র

০০৭ সালের ২০ আগস্ট। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনা সদস্যদের সঙ্গে ছাত্রদের কথা কাটাকাটি ও বচসা হয়। আপাত এই সামান্য ঘটনা এরপর বিরাট আকার নেয়। ক্যাম্পাসজুড়ে ছাত্র বিক্ষোভ বাড়তে থাকলে শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন। পরের দুই দিন ধরে থেমে থেমে চলতে থাকে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা ছড়িয়ে পড়ে। জারি করা হয় কারফিউ। গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয় ছাত্রদের পাশাপাশি কয়েকজন শিক্ষককেও।

ওই ঘটনার তদন্তে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেওয়া সাক্ষ্যে তাঁর বা সেনাবাহিনীর দায় অস্বীকার করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপকমিটির কাছে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি বলেন, 'তখন যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারাই নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী সরকারকে সহযোগিতা করেছে মাত্র।' তবে মাঠপর্যায়ের নিম্নপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও থাকতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। উপকমিটি জানায়, মইনের অনেক বক্তব্যে তারা সন্তুষ্ট নয় এবং তিনি সুকৌশলে অনেক প্রশ্ন এড়িয়েও গেছেন।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে সংসদ ভবনের একটি কক্ষে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম এই সাক্ষ্যগ্রহণ। এতে অংশ নেন স্থায়ী কমিটির প্রধান ও উপকমিটির আহ্বায়ক রাশেদ খান মেনন, সদস্য মির্জা আজম, বীরেণ শিকদার ও মো. শাহ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং ওই সময়ে নির্যাতিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুজন অধ্যাপক হারুনুর রশীদ ও অধ্যাপক সদরুল আমিন।
কনফারেন্স সূত্র জানায়, সাক্ষ্যে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মইন ২০০৭ সালের ২০ থেকে ২২ আগস্টে সংঘটিত সংঘর্ষ ও পরবর্তী সময়ে নির্যাতনের বিষয়ে সেনাবাহিনী জড়িত ছিল না বলে দাবি করেছেন। কিন্তু কমিটির সদস্যরা তাঁর বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ উপকমিটির এ তদন্তে নির্যাতিত ছাত্র-শিক্ষকসহ অনেকেই ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন।
কমিটির একাধিক সদস্য জানান, জেনারেল মইন কমিটির সদস্যদের ২০-২২টি প্রশ্নের উত্তর দেন। তবে স্পর্শকাতর কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। শুরুতে তিনি ওই ঘটনায় তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেন। কমিটির সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে মইন বলেন, 'ওই ঘটনায় সেনাবাহিনীর ওপরের সারির কেউ জড়িত নন। তবে মাঠপর্যায়ের কোনো কোনো সদস্য জড়িত থাকলেও থাকতে পারেন। তবে সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।' তাঁর এ বক্তব্য শুনে কমিটির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে কি ওই সময়ে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ছিল না? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান।
সেনাবাহিনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিপক্ষ মনে করে কি না জানতে চাইলে মইন বলেন, 'এটা ঠিক না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর আত্মীয়স্বজনও লেখাপড়া করে।' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সহমর্মিতা থাকা প্রয়োজন বলে মইন মন্তব্য করেন।
কনফারেন্স সূত্র জানায়, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় মইন সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলে কমিটি তাঁকে বলে, বেশ কিছু সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, তাঁরা কেবল ওপরের নির্দেশ পালন করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? উত্তরে মইন বলেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করেছে মাত্র। যা কিছু হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তে হয়েছে। কমিটি টিএফআই (টাস্ক ফোর্স ইনটেলিজেন্স) সেলে শিক্ষকদের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে মইন এ বিষয়টিও এড়িয়ে যান।
জানা গেছে, এর আগে কমিটিকে দেওয়া ছাত্র-শিক্ষকদের সাক্ষ্য এবং গতকাল মইনের বক্তব্যে কমিটি নিশ্চিত যে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। এ জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা ও সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়ী। গতকাল মইনের সাক্ষ্যগ্রহণের সময় উপস্থিত শিক্ষক প্রতিনিধিরা আবারও বলেন, সেই কালো অধ্যায়ের জন্য সেনা কর্মকর্তারা দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হারুনুর রশীদ ও অধ্যাপক সদরুল আমিন কমিটিকে বলেন, ওই সময়ে মেজর কামরুল নামের এক সেনা কর্মকর্তা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। সেনা সদস্যরা প্রকাশ্যে নির্যাতন চালান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক তাঁদের বক্তব্য সমর্থন করেন। উপকমিটি তাঁদের এ অভিযোগ আমলে নিয়েছে।
কনফারেন্স শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, জেনারেল মইন কমিটির সব প্রশ্নের জবাবেই তৎকালীন উপদেষ্টা পরিষদকে দায়ী করেছেন। ওই বক্তব্যে কমিটি সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেন, 'কমিটির কাছে মইন বলেছেন, সেনাবাহিনী তৎকালীন সরকারকে সহযোগিতা করেছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তিনি থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে ছিলেন না।'
মেনন বলেন, 'কমিটিতে এর আগে যেসব বক্তব্য এসেছে তাতে দেখা গেছে, ওই ঘটনার পর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনাছাউনি প্রত্যাহার, আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা।' উপদেষ্টাদের সেই বৈঠকে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা_ ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। তাঁরা বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ চারটি বিষয় বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জেনারেল মইনকে জিজ্ঞাসা করা হলে এটাও তিনি এড়িয়ে গেছেন।
স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেনন জানান, কমিটির কাছে নির্যাতিত যেসব শিক্ষক বক্তব্য দিয়েছেন তাতে দেখা গেছে, টিএফআই সেলে ভারত ও শেখ হাসিনার সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে শিক্ষকরা আওয়ামীপন্থী কি না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। কমিটির এই প্রশ্নও মইন এড়িয়ে গেছেন বলে তিনি জানান।
মেনন আরো জানান, সাবেক চিফ অব জেনারেল স্টাফ সিনা ইবনে জামালি কমিটিতে বলেছিলেন, ওই সময় প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাছাউনি স্থাপন করা হয়েছিল। এ বিষয়েও মইনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে মইন বলেন, সেনাক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।
টেলিফোনে কমিটির সদস্যরা মইনকে বলেন, জরুরি অবস্থার সময় ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী দল গঠন করে মিছিল করলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অথচ জরুরি অবস্থা ভাঙার দায়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হয়। কেন এটা করা হয়? এ প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে গেছেন মইন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ওই সংঘর্ষের পরে নির্যাতনের ঘটনাটিকে অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন জেনারেল মইন। কমিটিতে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মইনকে কমিটির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মইন টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রদান করলেও সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে কমিটির আহ্বানে এখনো সাড়া দেননি। তিনি শুধু ই-মেইল বার্তায় কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মেনন বলেন, 'গণতন্ত্র ও সংসদের প্রতি তাঁর যদি সম্মান থাকে তবে তিনি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তিনি যোগাযোগ করলে তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। তবে এ বিষয়ে কমিটি আর নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ নেবে না। তিনি যোগাযোগ না করলে তাঁর বক্তব্য ছাড়াই তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে।' সংসদের আগামী অধিবেশনেই মইনের বক্তব্যসংবলিত তদন্ত প্রতিবেদন সংসদে উত্থাপন করা হবে বলে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
যেভাবে কনফারেন্সের আয়োজন : সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সংসদীয় কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুই দফা আমন্ত্রণ জানানো হলেও নির্ধারিত দিনে হাজির হননি জেনারেল মইন। এরপর তিনি গত আগস্টে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে সংসদীয় কমিটির কাছে চিঠি পাঠান। গত ২৩ আগস্ট উপকমিটির নবম বৈঠকে টেলিকনফারেন্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদ সচিবালয়ে এর প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। বৈঠকের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের চতুর্থ লেভেলের ২ নম্বর স্থায়ী কমিটির কক্ষে অতিরিক্ত চারটি ল্যান্ডফোনের সংযোগ দেওয়া হয়। টেলিকনফারেন্স শুরুর আগে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে মইনকে ফোন করে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বলা হয়। এর আগে এ বিষয়ে স্পিকারের অনুমতি গ্রহণ করে উপকমিটি।
উল্লেখ্য, চার বছর আগের ওই ঘটনার বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে গত বছরের ১৯ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ উপকমিটি গঠন করা হয়। ওই সহিংসতা ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় ছয় বিভাগীয় শহরে কারফিউ জারি করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৩টি মামলা করে। ওই ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বিচারে আটক ও নির্যাতন করা হয় ছাত্রদের।
মেজর কামরুলকে ডাকবে তদন্ত কমিটি : ছাত্র-শিক্ষকদের নির্যাতনের সঙ্গে মেজর কামরুলের সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারে তদন্ত কমিটি। শিগগিরই তাঁকে কমিটির বৈঠকে ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। রাশেদ খান মেনন বলেন, 'ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন মেজর কামরুল। তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও নির্যাতনের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি।'
অসুস্থতার কথা জানালেন মইন : মইন টেলিকনফারেন্সের শুরুতেই নিজের অসুস্থতার কথা জানান। তিনি বলেন, 'আমি ভীষণ অসুস্থ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাইলোমা নামের এক ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ জন্য সপ্তাহে দুই দিন কেমোথেরাপি নিতে হয়।' টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় তিনি কমিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর এ কথায় কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর সুস্থতা কামনা করা হয়।