Saturday, September 17, 2011

ফুটপাত থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পর্যন্ত মাদকের থাবা by পারভেজ খান

রাজধানীর হাজারীবাগের গৃহবধূ জোবায়দা সোলায়মান বলছিলেন, তাঁর চার ছেলে আগে গাঁজা সেবন করত। এরপর হেরোইন, ফেনসিডিল হয়ে ধরে ইয়াবা। আর এখন তো তারা সেসব নেশার সঙ্গে যুক্ত করেছে আরো নানা আজব নেশা; যেগুলো দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। জোবায়দার স্বামী ট্যানারি ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আমার মতো অনেক বাবা-মা সন্তানদের মাধ্যমে ঘরে বসেই টের পাচ্ছেন, মাদক কতটা ভয়াবহতার পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।' আবু সোলায়মান মনে করেন, সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে জাতিকে মাদকের থাবা থেকে মুক্তি দিতে না পারা।
রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক অবাধে বেচাকেনা বা সেবন চলছে না। মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়েছে ফুটপাত থেকে স্কুল পর্যন্ত। নেশা এবং নেশার কারণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ঢাকার ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর এখানে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনেছেন, মূলত হতাশা থেকেই তাদের বেশির ভাগ নেশায় আসক্ত হয়েছে। এই হতাশার সৃষ্টি হয়েছে পারিবারিক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক কারণে। আবার নেশায় আসক্তদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নেশা যারা গ্রহণ করে তারা শুধু শারীরিক নয় মানসিকভাবেও অসুস্থ। ফলে তাদের কাছে অপরাধ কোনো ব্যাপার নয়। আর নেশার অর্থ জোগাতেও তারা ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ইদানীং নারী ও শিশুদের মধ্যেও এই ইয়াবা সেবনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তাঁর প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে কিছু নামিদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রী আসছে, যা দেখে তিনি নিজেও বিস্মিত। একটি সুসংগঠিত চক্রই বিশেষ করে বিত্তবান পরিবারের শিশুদের টার্গেট করেছে।
বিভিন্ন সূত্র মতে, এখন রাজধানীতে খুচরা মাদক বেচাকেনা বেশি হয় কোতোয়ালি, শাহবাগ, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, মোহাম্মদপুর, নিউ মার্কেট ও হাজারীবাগ থানা এলাকায়। আর তা নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী। এরা হচ্ছে হাজারীবাগ, লালবাগ ও চকবাজার থানার পুলিশের সোর্স এবং কমপক্ষে ১৫টি করে মামলার আসামি আজমল ও তার ভাই অসিম, হাজারীবাগের নাটকু সোহেল, সোর্স আজমলের স্ত্রী পপী, হেরোইন সম্রাজ্ঞী হিসেবে পুলিশের নথিতে চিহ্নিত জমিলা ওরফে জামিলা, বেড়িবাঁধের নোনা চোরা, বিজু ও তার ভাই সেলিম, মুসলিম ও ভাগলপুর লেনের লতিফ। কামরাঙ্গীরচরের আনন্দ ওরফে মুহুরী আনন্দ ওরফে দাদা আনন্দ, জেলখানা ঢালের বেগম, আম্বিয়া, ফুলবাড়িয়া নিমতলী এলাকার আনন্দবাজার বস্তির রিপন ও লাভলু। এই চক্রের নেতা হচ্ছে হাজারীবাগ পার্ক এলাকার কালা বাবু। সে মাদক সর্দার হিসেবে চিহ্নিত। কয়েক মাস আগেও সে আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। এখন জামিনে বের হয়ে এসেছে। এই চক্রের হয়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে পলাশ, আরিফ ও চপল নামের হাজারীবাগ এলাকার তিন ব্যক্তি। এরা এলাকায় রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী এবং পুলিশের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এই চক্র এখন রাজধানীতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এসব এলাকায় রয়েছে ৫৫টির মতো মাদক ও নেশাজাত দ্রব্যের আড়ত। এসব আড়তে নেশাজাত দ্রব্য সরবরাহ করে আমিনবাজারের সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী টিক্কার স্ত্রী কল্পনা। কল্পনা ও টিক্কা এখন নগরীর বাড্ডা এলাকায়ও মাদক ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে।
সূত্র মতে, রাজধানীর পাইকারি মাদক বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি হয় মিরপুরের গাবতলী, ১ নম্বর গুদারাঘাট, মতিঝিলের কলোনি এলাকা, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর বাজার, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড. বাসাবো, কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশের মেথরপট্টি, মুগদাপাড়া, সবুজবাগ, মাদারটেক, নন্দীপাড়া, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, নয়াবাজার, ধলপুর, দনিয়া, নারিন্দা, সিদ্দিকবাজার, মহাখালী, প্রগতি সরণি, কুড়িল, জোয়ারসাহারা, আশকোনা ও বাড্ডা এলাকায়।
সূত্র মতে, প্রকাশ্যে বা খোলা রাজপথে মাদক সেবন সবচেয়ে বেশি চলে চানখাঁরপুল, নয়াবাজার আর কারওয়ান বাজার এলাকায়। কোনো গোপনীয়তা বা রাখঢাক নেই এই এলাকার মাদকসেবীদের। তবে এসব এলাকার মাদকসেবীদের বেশির ভাগই বেকার, টোকাই, রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক ও ছিঁচকে অপরাধীসহ সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। অভিজাত এলাকায় প্রকাশ্যে নেশাদ্রব্য বেচাকেনা বা গ্রহণ খুব কম হয়। তবে ইদানীং 'সিসা' বা হুক্কা নামে এক ধরনের নেশা অভিজাত এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই হুক্কা বা সিসার আসর বসে মূলত অভিজাত পাড়ার কয়েকটি রেস্টুরেন্টে। এই নেশায় আসক্তদের বেশির ভাগই নগরীর বিভিন্ন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এবং অভিজাত পাড়ার ধনী পরিবারের ছেলেমেয়ে। তবে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সাম্প্রতিক সময়ে এই নেশা গ্রহণের প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অস্ত্র, ডাকাতি, খুন, ছিনতাইসহ দেশে প্রতিনিয়ত যেসব অপরাধ ঘটে চলছে সেগুলোর বেশির ভাগের পেছনেই রয়েছে মাদক। তিনি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পৃথক একটি সংস্থা আছে। পাশাপাশি পুলিশ ও র‌্যাব তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে তাদের বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
বেশ কয়েকজন নেশাগ্রস্ত তরুণ-তরুণী এবং ঢাকার ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে বের হয়ে এসেছে নেশার নানা উপকরণের বিষয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়েও এই নেশা গ্রহণের নানা দৃশ্য চোখে পড়েছে। এর মধ্যে কিছু এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
ককটেল : এটিকে ফেনসিডিলের সহজ সংস্করণ বা লোকাল ফেনসিডিলও বলে অনেকে। আর্থিক কারণে যারা ফেনসিডিল কিনে খেতে পারে না, তারাই ঝুঁকছে এর প্রতি। নগরীর বিভিন্ন অলিগলির ছোটখাটো ওষুধের দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এই ককটেল তৈরির উপাদান। ককটেলের উপকরণ নেশায় আসক্তরা আলাদাভাবে কিনে নিয়ে যায়। এর দাম পড়ে বোতলপ্রতি বড়জোর ৩০ টাকা। বিক্রেতারা পরিচিত এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতা ছাড়া অন্য কারো কাছে এগুলো বিক্রি করে না।
সাত রাস্তার মোড় : পুরান ঢাকায় এর প্রচলন কিছুটা বেশি। প্যাথিডিন, মরফিন বা ফ্যানারগান-জাতীয় তরল ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরের জঙ্ঘার (কুঁচকি) কাছে রগে নেওয়া হয়। রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকার ওষুধের মার্কেটের সামনে দেখা গেল একটি ট্রাকের আড়ালে দুজন এই ইনজেকশন নিচ্ছে। তাদের ভাষ্য, কুঁচকি সাতটি রগের মিলনকেন্দ্র। তাই নাম দেওয়া হয়েছে সাত রাস্তার মোড়। ইনজেকশনগুলো তারা হাসপাতালের কর্মচারীদের কাছ থেকে জোগাড় করে বলেও জানায়।
টাইটানিক : জিহ্বা বা তালুতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্যাথিডিন-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করা। এর প্রবণতা পুরান ঢাকাতেই বেশি। নয়াবাজার ইউসুফ মার্কেটের পেছনে গিয়ে এই নেশায় আসক্তদের কয়েকজনকে পাওয়া যায়। তাদের মতে, সদরঘাটের কিছু নৌযান শ্রমিকের মাধ্যমে এ নেশাটি ঢাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। নদীপথের শ্রমিকরা এ নেশায় আসক্ত বেশি। তাই এর নাম হয়েছে টাইটানিক।
পুলিশ ভাজা বা টিকটিকি ফ্রাই : টিকটিকির শরীরের উপকরণ নিয়ে বানানো হয় বলেই এমন নাম। সায়েদাবাদ টার্মিনাল এলাকার পরিবহন শ্রমিক রাজু ও কামাল এই প্রতিবেদককে জানায়, তারা নিছক মজা করতে করতেই এ নেশায় জড়িয়ে গেছে। মোবারক নামের তাদেরই আরেক বন্ধু জানায়, এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সে এই নেশা নিতে শিখেছে। পুলিশকে তাদের অনেকে টিকটিকি বলে। আর এ কারণেই তারা মজা করে এই নেশাকে পুলিশ ভাজাও বলে। রাজধানীতে এ ধরনের নেশাখোরের সংখ্যা হাতে গোনা। সায়েদাবাদ, নিমতলী, ফুলবাড়িয়া ও গাবতলী এলাকায় কয়েকজন পরিবহন হেলপার আছে, তারা প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চারবার এই নেশা নিয়ে থাকে।
জিনের বাদশা : কারওয়ান বাজার এলাকার এক বালক। বয়স খুব বেশি হলে ১২ বছর। কাঁচামালের বোঝা টানার কাজ করে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকেও দেখা গেল মসজিদ গলিতে বসে নেশা করছে। তবে একা। পাশে গোল হয়ে বসে আরো দুই বালক তার এই নেশা গ্রহণের দৃশ্য দেখছে। জটলা দেখে এগিয়ে যাওয়ার পর ওই বালকেরই এক বন্ধু জানাল, 'স্যার, ওরে জিনের বাদশা ধরছে।' নেশা গ্রহণকারী ওই বালক জানায়, তার নাম সামসু। গত এক বছর ধরে সে এই নেশা গ্রহণ করে। পলিথিনের ভেতর পানির সঙ্গে এক ধরনের আঠা মিশিয়ে ঝাঁকিয়ে এই নেশাদ্রব্য তৈরি করা হয়। ছেলেগুলো বলে, এই নেশা নিলে শরীরটা অনেক হালকা হয়-মনে হয় আকাশে জিন-পরীর মতো উড়ছে। তাই নাম জিনের বাদশা। রাজধানীর বস্তি বা টার্মিনাল এলাকায় পলিথিনে ঢুকিয়ে এই নেশা শ্বাসের সঙ্গে নিতে দেখা যায়।
স্যান্ডউইচ : জেলির সঙ্গে এক ধরনের মলম ও বিশেষ কালি মিশিয়ে এক ধরনের পেস্ট তৈরি করা হয়। এরপর পাউরুটিতে মাখিয়ে স্যান্ডউইচের মতো গ্রহণ করা হয়। তিন-চার বছর হলো গণকটুলী সুইপার কলোনির মাদক বিক্রেতারা স্যান্ডউইচ নাম দিয়ে এই নেশা চালু করেছে। এগুলো সাধারণত কিনতে পাওয়া যায় না। সেবনকেন্দ্রে গিয়ে অর্ডার দিলে পরিবেশন করা হয়। গণকটুলী সুইপার কলোনি এবং ধলপুর সিটি পল্লীতে এ ধরনের কয়েকজন নেশায় আসক্তকে পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ধনাঢ্য পরিবারের অনেক সন্তান এখনো ইয়াবা গ্রহণ করছে। বাবা, লাল জবা, লাল গোলাপ, চামেলী, ক্রেজি, ক্যান্ডি, চকোলেট_নানা নামে নেশাটি প্রচলিত। যথারীতি আছে ফেনসিডিল। ফেনসি, ডাইল, ফেন্টুস, মধু বা ইঞ্চিসহ নানা নামে এটি পরিচিত। আরো আছে হেরোইন ও গাঁজা। দুটিই মূলত পুরিয়া নামে প্রচলিত।