Thursday, June 09, 2011

কর ও ভ্যাটের আওতা না বাড়ানোর প্রস্তাব বিএনপির

দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেছেন, গত দুই দশকে কোনো অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো এতটা বিপর্যয়ে আর পড়েনি। এর জন্য তিনি গত বছর বিএনপির প্রস্তাব না মানাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাব দেওয়া হলেও সরকার একে গুরুত্ব দেয় না। খালেদা জিয়া আরো বলেছেন, অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থার মূলে আরো আছে মূল্যস্ফীতি, সার, চালের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া, শেয়ারবাজারে বিপর্যয় ইত্যাদি বিষয়।

গতকাল বুধবার রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে (সাবেক শেরাটন) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর বাজেট প্রস্তাবে এসব কথা বলেন। ওই প্রস্তাবে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার এক দিন আগে এই প্রস্তাব তুলে ধরল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
গত বছর বাজেটের আগে এ ধরনের বাজেট প্রস্তাব দেওয়ার রীতি চালু করে বিএনপি। তবে গত বছর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বাজেট ঘোষণার তিন দিন আগে। গতকাল প্রস্তাব ঘোষণার অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
গত বছর পেশ করা তাদের বাজেট প্রস্তাব পুরনো হয়ে যায়নি উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোকেই আবার তুলে ধরেন। এর সঙ্গে যুক্ত করেন নতুন কিছু প্রস্তাব। এবারের প্রস্তাবে করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ টাকা করা, বিদেশগামীদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়া, আইলাবিধ্বস্ত এলাকায় পুনর্বাসন বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ, বস্ত্র খাতে নগদ সহায়তার হার বাড়ানো, তাঁতিদের ১৫ শতাংশ নগদ ভর্তুকি ও কৃষকদের জন্য সমবায় ব্যবস্থা গঠনে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি করা হয়।
এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর কর্তন রহিত করে সুদের হার পুনর্নির্ধারণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থোক হিসাবে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগ কমানো, ভ্যাটের আওতা আর সম্প্রসারণ না করা, ডাক্তারের ফি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি, বাড়িভাড়া/স্থাপনা ও যাত্রীভাড়ার ওপর থেকে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার, প্রতি উপজেলায় প্রাথমিকভাবে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি করে বয়স্ক নিবাস নির্মাণ, সারা দেশের জন্য ডে-কেয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন প্রস্তাবের কথা বলা হয় বিএনপির বাজেট প্রস্তাবে।
অবকাঠামো উন্নয়নে বিএনপি বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হলো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সব বিভাগীয় শহরের উচ্চগতির ট্রেন চালু করা, ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে ছয় লেন মহাসড়ক নির্মাণ, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং রেল যোগাযোগসহ দ্বিতীয় যমুনা সেতু নির্মাণ। বিএনপি রেল যোগাযোগসহ দ্বিতীয় যমুনা সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করছে বলেও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
খালেদা জিয়া শুরুতেই বলেন, 'আমাদের এ বাজেট প্রস্তাবনা উত্থাপনের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণা তুলে ধরা। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতির সামনে একটি দিকদর্শন তুলে ধরা আমরা দায়িত্ব মনে করি। সেই চিন্তা থেকেই আমরা গত বছর বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার আমাদের ধারণাগুলোকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। যার ফলে আজ সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এক কথায় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে।'
বিএনপির বাজেট প্রস্তাবে 'সংকট ঘনীভূত হচ্ছে' শীর্ষক একটি অনুচ্ছেদ রাখা হয়। সেখানে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকটের আশঙ্কা করা হয়। বলা হয়, চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের চিত্র নৈরাশ্যজনক। এটা কোনো আশার আলো দেখায় না। সরকারি মহল দাবি করছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৭ শতাংশ। অথচ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রাক্কলন অনুযায়ী এই প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশের বেশি নয়। দেশীয় একটি সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকও প্রায় একই ধরনের প্রাক্কলন করেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হিসাব বারবার সংশোধন, তথ্যের অসামঞ্জস্য ও হিসাবপ্রক্রিয়ার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বলে প্রস্তাবে দাবি করা হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়, প্রবৃদ্ধির যে হার দাবি করা হচ্ছে, পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে, দীর্ঘমেয়াদে এই প্রবৃদ্ধিও টেকসই হবে না। সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, সরকার যে প্রবৃদ্ধির হার দাবি করছে সেটাও পরিসংখ্যানে কারচুপির ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের প্রতি জনৈক মন্ত্রীর রক্তচক্ষু প্রদর্শন সর্বজনবিদিত।
পরিবহন ও জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' বলে অভিহিত করেন খালেদা জিয়া। জনগণের বিপুল অংশের নিট আয় আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪১ শতাংশ, একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৫১ শতাংশ। বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থেও (রেমিট্যান্স) নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি হিসাবে জুনের শেষে ঘাটতি দেখা দেবে, লেনদেনের ভারসাম্যেও ঘাটতি দেখা দেবে।
খালেদা জিয়া বলেন, 'সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবি করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করা হচ্ছে বিশালভাবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রশ্নে সরকারের দুজন মন্ত্রীকে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা গেছে। তাহলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হলো কী করে?'
শেয়ারবাজারের বিপর্যয় থেকে ফায়দা লুটকারী গোষ্ঠীর পাচার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচারের কারণে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে যেখানে মার্কিন ডলারের মূল্যমান কমছে, সেখানে বাংলাদেশে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যমান বাড়ছে।
খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচক নেতিবাচক হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত ভোগতাড়িত হওয়ায় ভঙ্গুরতায় ভুগছে। মূল্যস্তর, বিনিয়োগ, সঞ্চয়, বাজেট ঘাটতি, শিল্পোৎপাদন, বিদেশি মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার, বিদেশি মুদ্রার মজুদ এবং কর্মসংস্থান সবই নেতিবাচক। বিগত দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ এবারই সবচেয়ে সংকটজনক অবস্থায় পড়েছে।
বাজেটের আকার বাড়লেও সে হিসাবে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে না উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি সরকারের শেষ বাজেটের তুলনায় বর্তমান বাজেট ১২০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় পাঁচ বছরে বেড়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। ফলে বাজেটে উন্নয়ন প্রাধান্য ধীরে ধীরে কমছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ বলে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় আগামী বাজেটের জন্য ঘোষিত ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি খুব বেশি নয় বলে উল্লেখ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তবে এর অর্থসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ওপর ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির চাপ বেড়ে গেলে রাষ্ট্র ভয়াবহ রাজস্ব আয়ের সংকটে পড়বে। ফলে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মোকাবিলা করতে হবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। বেসরকারি খাত ঋণ-দুর্ভিক্ষে নিক্ষিপ্ত হবে, সামগ্রিক উৎপাদন ব্যাহত হবে।
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সরকার কৃত্রিম পরিসংখ্যান দিয়ে কারসাজি করছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, গত বছর সরকার বলেছিল দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৩৭.৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। এক বছর পর সরকার বলছে, দারিদ্র্যের হার ৩১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা বলছে, ২০১০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে নতুনভাবে ১.৫৯ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রবেশ করেছে।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে উল্লেখ করে খাদে জিয়া বলেন, চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে রেখে ধীরে ধীরে তা কমিয়ে আনার কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রতিশ্রুতির ধারেকাছেও নেই। সর্বশেষ এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৫৪ শতাংশ। গ্রামে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বেশি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মার্চের হিসাবে মোটা চালের দাম ৩২ শতাংশ, আটার দাম ৫০ শতাংশ, ভোজ্য তেলের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের ৩৩ শতাংশ আয় দিয়ে চাল কিনতে হয়।
সারের দাম বাড়ানোর সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ইউরিয়ার দাম কেজিপ্রতি আট টাকা বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে ৪০ শতাংশ। এতে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির লোকসানের বোঝা দিন দিন বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয় বিএনপির প্রস্তাবে। সেখানে বলা হয়, বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ফলে জাতীয় বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তাদের ওপর ভর্তুকির দায়ও চাপানো হচ্ছে।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়, কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাবে। অপরিকল্পিতভাবে তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় তরল জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে জাতীয় বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে।
খালেদা জিয়া আরো বলেন, কোনো টেন্ডার ছাড়াই বিদ্যুৎ সেক্টরে কুইক রেন্টাল পাওয়ার কেন্দ্রের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে সরকারদলীয় ব্যবসায়ীদের। এসব জায়েজ করার জন্য পাস করা হয়েছে ইনডেমনিটি অ্যাক্ট এবং সংশোধন করা হয়েছে পিপিআর অ্যাক্ট। টিসিবির ডিলারশিপ, খোলাবাজারে বিক্রি কর্মসূচির (ওএমএস) ডিলারশিপ ও সার বিতরণের জন্য ডিলার নিয়োগ দিয়ে দলীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সুযোগ বিতরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একটি ব্যক্তি-উদ্যোক্তাগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, বিএনপির লক্ষ্য হলো, এদের কার্যকর নীতি-সহায়তা দিয়ে স্বাবলম্বী ও আত্মমর্যাদাবোধে বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা।

মূর্ত-বিমূর্তের কবি by কাইয়ুম চৌধুরী

বেশ কয়েক দিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়াকে আমরা বোধ হয় আর ধরে রাখতে পারব না। বাসা আর হাসপাতাল—এই দুয়ের মধ্যে ছোটাছুটি। কষ্ট হচ্ছিল। হূদ্যন্ত্র খুব দুর্বল। নিঃশ্বাস পরিপূর্ণভাবে নিতে পারছেন না। ফুসফুসে পানি জমে যাচ্ছে। সব সময় অস্থির। বিছানায় বসিয়ে দিতে বলছেন। আবার পরক্ষণেই বলছেন শুইয়ে দিতে। দুই হাতের মধ্যে হাত টেনে নিলাম। চোখ খুলে তাকালেন। বললেন, ‘কাইয়ুম, বড় একা, একা লাগে।’ সান্ত্বনাবাক্য নেই। এই একাকিত্বের জন্য তো আমরাই দায়ী।

একবার দেখতে গেছি তো আর দেখা নেই। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে কী ভালোই না বাসতেন। কত কথা শিল্প সম্পর্কে, শিল্পী সম্পর্কে। শিল্প আছে বলেই তো পৃথিবীটা বাসযোগ্য। পৃথিবীকে, মানুষকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে সুন্দর সৃষ্টি দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়াই তো শিল্পীর কাজ।
আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে খুব ধীর লয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাইয়ুম, আমি কি কিছু করতে পেরেছি?’ জীবনসায়াহ্নে এসে কিবরিয়া সাহেব কি নিজেকে মূল্যায়ন করতে চাইছেন? জীবনের হিসাব-নিকাশ এই সময়ে কেন? তিনি কি অনুভব করছেন, তাঁর আর কিছু করার নেই? ঘর্মাক্ত হাতটি টেনে কপালে রাখলাম। বললাম, ‘কী বলছেন আপনি? বাংলাদেশের চিত্রভুবনে আপনি একটি নতুন শৈলীর জন্ম দিয়েছেন। বেগবান করেছেন চিত্র-আন্দোলনকে। আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে আপনারই অনুসারী আছে। আর তো কারও নেই।’
বাংলাদেশের চিত্রকলাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন, কিবরিয়া সাহেব তাঁদের অন্যতম। আমাদের চিত্রভুবন সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর চিত্রের মাধ্যমে। বিমূর্ত চিত্রকলাকে একটি নতুন মাত্রায় উপস্থাপিত করেছেন ক্যানভাসে। কিন্তু শুরুটা তাঁর এ রকম ছিল না। তাঁর বিষয়ভিত্তিক রচনা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন নবাবপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছেন, থাকতেন আজিমপুর সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মিত কোয়ার্টারে। একটি কক্ষে সাত-আটজনের সঙ্গে তাঁর বসবাস। কাঠের চৌকির মাথায় বংশদণ্ডের সঙ্গে বাল্ব ঝুলিয়ে মেঝেতে চটের ওপর বসে চৌকির গায়ে ক্যানভাস ঠেকিয়ে ছবি আঁকতেন। বাল্বের চারদিকে কাগজের ঘেরাটোপ, রুমমেটদের যাতে অসুবিধা না হয়। এঁকেছেন ‘পাখি হাতে বালক’, ‘চন্দ্রালোকে ঘোড়া’, ‘সাঁতার’, ‘মা ও ছেলে’ প্রভৃতি ছবি। বেশির ভাগ ছবির রং তখন অনুজ্জ্বল, বিষাদগ্রস্ত। বীরভূম থেকে চলে এসেছেন পূর্ব বাংলায়। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, একাকী। একটা ছবির কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে—কয়েকটা সদ্য নির্মিত কবরের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন, তিনি কিবরিয়া। প্রশ্ন রেখেছিলাম, কেন এই বিষণ্নতা? মৃদু স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘প্রতিবছরই পরিবারের কেউ না-কেউ আমাদের ছেড়ে চলে যেত। একটা নিঃসঙ্গতাবোধ ভেতরে কুরে কুরে খেত।’
সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি ও পাজামা, পায়ে স্যান্ডেল—এই বেশে কিবরিয়া সাহেবকে প্রথম দেখি। মৃদু কণ্ঠ, আগ বাড়িয়ে কথা বলেন না। জয়নুল আবেদিন যখন তাঁকে আর্টস্কুলে চাকরিতে নিয়ে এলেন, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। যাঁর মুখ দিয়ে কথা সরে না, যিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, তিনি ছাত্রদের কী করে আঁকা শেখাবেন? জয়নুল আবেদিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘কিছু না হোক, পরিবেশ তৈরি হবে।’ জবাবটা যে শতভাগ সত্যি, আমরা যাঁরা আর্টস্কুলে ছিলাম, তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছি।
বৃত্তি নিয়ে জাপান গেলেন কিবরিয়া সাহেব। বছর তিনেক বোধ হয় ছিলেন। ফিরে এলেন নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে। চমৎকার লিথোগ্রাফির কাজ আমরা দেখলাম। দেখলাম, নিজেকে বদলেছেন ছবির আঙ্গিকেও। বিষয়বস্তু উধাও ক্যানভাস থেকে। ফর্ম, স্পেস, টেক্সচার নিয়ে এক নতুন মাত্রার ছবি। কথা কম বলেন, ভেতরে ভেতরে একজন রসিক ব্যক্তি। তাঁর সান্নিধ্য আমরা উপভোগ করতাম। আর্টস্কুলের হোস্টেলে থাকতেন। বারান্দায় চেয়ার পেতে আড্ডা জমত। চা, চানাচুর, পনির চলত।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা হোস্টেলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দৈবক্রমে কিবরিয়া সাহেব বেঁচে যান। ২৭ মার্চ সকালে হোস্টেল ছেড়ে কিবরিয়া সাহেব আমার বাসায়। আমি তখন আজিমপুরে থাকি। দরজা খুলে কিবরিয়া সাহেবকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। রক্তশূন্য একজন মৃত মানুষের মুখ যেন আমি প্রত্যক্ষ করছি। আমার সঙ্গেই ছিলেন সে সময়ের বিভীষিকাময় কটি দিন। আমি বাসা ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছি, কিবরিয়া সাহেব আমার সঙ্গে। সেই একাত্তরেই নিঃসঙ্গতা কাটালেন কিবরিয়া সাহেব। নিঃসঙ্গ জীবনের একজনকে জীবনসঙ্গিনী করে নিলেন। গ্রাফিক ডিজাইনার আঞ্জুম কিবরিয়া, বড় ছেলে নাশরিদ ও ছোটজনকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। হাসপাতালে বারবার ডাকছেন ছেলেকে, ‘বাবু, আমাকে বসিয়ে দাও। বাবু, আমাকে শুইয়ে দাও।’ সবার স্নেহ, ভালোবাসা ও ভক্তি উপেক্ষা করে কিবরিয়া সাহেব চলে গেলেন। বাংলাদেশের শিল্পভুবন, সমগ্র সাংস্কৃতিক ভুবন আজ শোকাচ্ছন্ন, অন্ধকারাচ্ছন্ন।

শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া- মাটির রং থেকে মাটির ঘরে

দেশের মাটিকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতেন মাটির ধূসর, গৈরিক, পাটকিলে, ছাই রঙের বৈচিত্র্য। সেই সব রং তুলে আনতেন তাঁর ছবিতে অসাধারণ ‘টেক্সচার’, সুষমামণ্ডিত সমন্বয় আর অনিন্দ্য বিন্যাসে। শুধু রঙেরই ছবি। আর কিছু নেই। তবু সেই ছবির দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।

জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন তাঁর কবিতায়, ‘আমার মতো আর কেউ নেই’, তিনিও আমাদের দেশের চারুকলার ভুবনে ছিলেন ঠিক তেমনই। তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনি মোহাম্মদ কিবরিয়া। গতকাল মঙ্গলবার তিনি চলে গেলেন মাটির ঘরে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে।
বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং দেশের নির্বস্তুক চিত্রকলার পথিকৃৎ এই বরেণ্য শিল্পী ল্যাবএইড হাসপাতালে সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত মাসের মাঝামাঝি অবস্থার অবনতি হলে জাতীয় হূদেরাগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে গত ৩১ মে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর হূদ্যন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের কার্যক্ষমতা কমে গিয়েছিল। শেষ দিকে ফুসফুসেও সংক্রমণ দেখা দেয়।
শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কনিষ্ঠ পুত্র জুনের কিবরিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১০ জুন শুক্রবার সকাল নয়টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হবে সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এরপর চারুকলা অনুষদ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হবে। বাদ জুমা এখানে জানাজার পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে দাফন করা হবে।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদে শিল্পী ও কলারসিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ল্যাবএইড ও বারডেমে দেশের দেশবরেণ্য শিল্পী, শিল্পশিক্ষক, তাঁর অনেক ছাত্র ও শিল্পানুরাগী উপস্থিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পকলা চর্চায় তাঁর অবদান জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শোকবাণীতে বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে দেশের শিল্পক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
চারুকলা চর্চায় মোহাম্মদ কিবরিয়া একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত চিত্রকলার এই ধারা পরিচিত ‘কিবরিয়া ধারা’ বলে। গত পাঁচ দশকের চিত্রকলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ধারাটির প্রভাবই সব থেকে গভীর ও ব্যাপক। তাঁর অনুসারীর সংখ্যাও সে কারণে সর্বাধিক। প্রথম পর্যায়ের কাজে তিনি অবয়ব ও জ্যামিতিক বিন্যাস নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তাঁর কাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি নির্বস্তুক ছবির চর্চায় নিবেদিত হন।
শিল্পকর্ম রচনা ছিল তাঁর কাছে গভীর সাধনার বিষয়। নীল, কালো, ধূসর, পাটকিলে—এ ধরনের কিছু রং নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। তাঁর ছবি স্নিগ্ধ, মাধুর্যমণ্ডিত। বিনম্র। একধরনের নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্নতার দ্যোতনায় উদ্ভাসিত তাঁর চিত্রতল। তাতে গভীর আবেগের কোমল সঞ্চার। প্রকৃতির অন্তর্গত সত্তার স্বরূপ উন্মীলনে উন্মুখ। দর্শকের সংবেদনশীলতাকে খুব সহজ সাবলীলতায় স্পর্শ করে যায় সেই ছবি। দৃষ্টিকে আটকে রাখে।
জীবনপঞ্জি: মোহাম্মদ কিবরিয়ার জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিঁউড়ি গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ রফিক, মা সায়েরা বেগম। বীরভূম জেলা স্কুলে পাঠ শেষে ১৯৪৫ সলে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এখান থেকে স্নাতক হন। পরের বছর ১৯৫১ সালে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকায় এসে নওয়াবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৪ সালে যোগ দেন সরকারি চারুকলা ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপচিত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৮৭ সালে তিনি অধ্যাপক হন এবং ১৯৮৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন, ২০০৮ সালে তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হন। স্ত্রী আনজুম কিবরিয়া, দুই পুত্র নাশরিদ কিবরিয়া ও জুনের কিবরিয়া।
প্রদর্শনী: দেশ-বিদেশে তাঁর অনেক একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এককের মধ্যে আছে: ১৯৬০ সালে টোকিওর গ্যালারি ইয়োসিদো, ’৬৩ সালে বিজুতসু শিপ্পানায়, ’৭৯ সালে দিল্লিতে দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে তাঁর ২০টি ছবির বিশেষ প্রদর্শনী, ঢাকায় ২০০০ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে। এ ছাড়া জাপানের মারুচিনি ও যুগোস্লাভিয়ার দ্যে যোশেফ ব্রজ টিটো গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, লাহোর, করাচি, কলকাতা, জাপান বিভিন্ন স্থানে তাঁর যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে।
পুরস্কার: ১৯৫৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত প্রথম তরুণ শিল্পী প্রদর্শনীতে ‘স্টারলেম’ পুরস্কার। ’৬০ সালে সর্বজাপান প্রিন্ট প্রদর্শনীর পুরস্কার, ’৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক, ’৮৫ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং ২০০২ সালে পেয়েছেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ সম্মাননা।
মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনেকেই এসেছিলেন ল্যাবএইড ও বারডেম হাসপাতালে।
কাইয়ুম চৌধুরী: বাংলাদেশের শিল্পজগতে অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী। অনেক উত্তরসূরি তৈরি করে গেছেন। নির্বস্তুক চিত্রকলার পথিকৃৎ তিনি। নতুন একটি শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত ধারার চর্চা করলেও তাঁর কাজে বাংলাদেশের সত্তাকে পাওয়া যেত।
রফিকুন নবী: তাঁর খ্যাতি আমাদের দেশ, উপমহাদেশ বা কেবল এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বহু বিখ্যাত গ্যালারিতে তাঁর কাজ সংগৃহীত আছে। আমাদের দেশে তিনিই প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান শিল্পী। নম্র, বিনয়ী, নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য মিশে ছিল কাজে। জাপান থেকে ফেরার পর তাঁর বিমূর্ত ধারার কাজ আমাদের অবাক করে দিয়েছিল। রঙে-রেখায় টেক্সচারে প্রতিটি কাজ আলাদা।
মনিরুল ইসলাম: ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তিনি যত বড় শিল্পী, মানুষ হিসেবে তার চেয়েও বড়। কোনো দিন কারও নামে নিন্দা, বিষোদগার করতে শুনিনি। কাছে গেলে অন্তর থেকেই তাঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধা উঠে আসত। শিল্পী হিসেবে তাঁর একটি নিজস্ব শিল্পজগৎ ছিল। অনেকেই ছবি আঁকেন, কিন্তু নিজস্ব শিল্পভুবন না থাকলে শিল্পী হওয়া যায় না। কোনো অবয়বের আভাস নেই তাঁর কাজে। পেইন্টিং বা ছাপচিত্র সব ক্ষেত্রেই তিনি একেবারে শুদ্ধ নির্বস্তুক। তাঁর ছবি দর্শককে আটকে রাখে। কোনো চড়া, ঝলমলে রং নেই, তবু অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকা যায় তাঁর ছবির দিকে।
শহীদ কবির: অনেক লম্বা সময় তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর মতো নিবেদিতপ্র্রাণ শিল্পী আমাদের দেশে আর একজনও নেই। শুধু শিল্পকর্মের জন্যই সারা জীবন ব্যয় করেছেন। মাটির প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা, গভীর আবেগ। বহুবার দেখেছি বিভিন্ন ধরনের মাটি এনে তার রং, ভেতরের সত্তার বিষয়টিকে তিনি আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। সংগীত ও সাহিত্যেও ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। কোনো গোঁড়ামি ছিল না। ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি তাঁর প্রিয় ছিল। একবার আমাকে বলেছিলেন, এই গানটি শুনলে মনে হয় মাটির সঙ্গে বুক মিলিয়ে শুয়ে থাকি। একটা মরমি ব্যাপার ছিল তাঁর।
মাহমুদুল হক: আমাদের চিত্রকলায় তাঁর যত অনুসারী তৈরি হয়েছে, আর কারও এত অনুসারী সৃষ্টি হয়নি। এ থেকেই আমাদের চিত্রকলায় তাঁর প্রভাব ও অবদান বোঝা যায়।
আবুল বারক আলভী: তিনি ছাত্রদের সব সময় উৎসাহ দিতেন। খুব বেশি ভুল ধরতেন না। কিন্তু উপযুক্ত পরামর্শটি দিতেন। শুধু ছাত্ররাই নয়, অনেক শিক্ষকও তাঁদের কাজ দেখাতে আনতেন কিবরিয়া স্যারের কাছে।
নিসার হোসেন: সব ধরনের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে থেকে শিল্পচর্চা করেছেন। আমাদের চারুকলায় তিনি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আরও উপস্থিত ছিলেন গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান, চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষক আনিসুজ্জামান, জয়া শাহরীন, শিল্পী রফি হক, আহমেদ নাজিরসহ অনেকে। সবাই বলছিলেন, ইহজাগতিক নিয়মে মোহাম্মদ কিবরিয়া চলে গেলেন বটে, তবে বাংলাদেশের চিত্রকলা তাঁকে সঞ্জীবিত করবে নিঃসন্দেহে।