Wednesday, July 27, 2011

সাংবাদিকরা মাইনষের জাত নাঃ তাহের @কারাগারে ‘বড় মিয়া’র বিলাসী জীবন by কামরুল হাসান ও এম জে আলম

কারাগারে বসেই বাড়ির রান্না করা খাবার খাচ্ছেন। প্রতিদিন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করছেন। দরকার হলে মোবাইল ফোনে কথাও বলছেন। তাঁর ইচ্ছাই যেন সেখানকার নিয়ম। লক্ষ্মীপুর কারাগারে এমনই জীবন যাপন করছেন একাধিক খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি ‘বড় মিয়া’।

এই বড় মিয়া হলেন এ এইচ এম বিপ্লব। লক্ষ্মীপুরের পৌর মেয়র আবু তাহেরের বড় ছেলে। শুধু তাহেরের বড় ছেলে বলেই নয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লক্ষ্মীপুরের অপরাধ জগতের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ হিসেবে বিপ্লবকে সমীহ করে বড় মিয়া ডাকেন সাঙ্গপাঙ্গরা। কারাগারে বড় মিয়ার সঙ্গে আছেন তাঁর আরেক ‘গুণধর’ ভাই আবদুল জব্বার ওরফে লাবু (তাহেরের পালিতপুত্র)। লাবু পাঁচটি খুনের মামলার আসামি, দুটিতে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।
বহুল আলোচিত নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মওকুফ করেছেন। এ খবর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়ার পর আবার আলোচনায় আসেন লক্ষ্মীপুরের একসময় ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত তাহের ও তাঁর ছেলে বিপ্লব। এ অবস্থায় বড় মিয়ার কারাগারের বিলাসী জীবনযাপন যাতে সাংবাদিকদের নজরে না পড়ে, সে জন্য লক্ষ্মীপুর কারাগারের সামনে তাহেরের লোকজন দিনের বেলায় পাহারা বসিয়েছেন বলে স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়। অচেনা কেউ কারাগারের সামনে গেলে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক বলেছেন, এই পাহারা পেরিয়ে সংবাদ সংগ্রহে কারাগারের দিকে যেতে সাহস করছেন না তাঁরা।
অবশ্য গত সোমবার বেলা সোয়া দুইটার দিকে এই প্রতিবেদক কারাগারে গেলে পাহারায় থাকা তাহেরের লোকজন বাধা দেননি।
জেলারসহ কারাগারের সব কর্মকর্তাকে বলে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেন তাহেরপুত্র বিপ্লব নিয়ে কোনো তথ্য না দেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিপ্লবের কারাজীবন, মামলার সাজা ইত্যাদি বিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো তথ্য না দিতে বিপ্লবের পক্ষ থেকে লক্ষ্মীপুর কারাগারের কর্মকর্তাদের বলে দেওয়া হয়েছে। ফলে কয়েক দিন ধরে কারা কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।
এই প্রতিনিধি বিপ্লবের কারাগারের জীবন ও সাজা সম্পর্কে জানতে লক্ষ্মীপুর কারাগারে গিয়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও কারও কাছ থেকে কোনো তথ্য পাননি। সরাসরি গিয়ে ব্যর্থ হয়ে টেলিফোনেও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুতেই কথা বলতে রাজি হননি জেলার আখতার হোসেন। তাঁর মোবাইলে ফোনে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলে, তাঁরও কোনো জবাব দেননি তিনি।
তবে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, একটি মামলার ফাঁসির দণ্ড মওকুফ পাওয়ার পর বিপ্লব বাকি দুটি হত্যা মামলার দণ্ড মওকুফের জন্য চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজা মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন তাঁর বাবা তাহের। এটার ফয়সালা হলে অপরটির জন্য আবেদন করা হবে বলে জানা গেছে।
তাহের নিজেও প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরখাস্ত একটা করছি, অ-ন কী অবস্থায় আছে জানি না, খোঁজও নেই না।’
বিপ্লবের নাম শুনলে মানুষ আঁতকে ওঠে, এর কারণ জানতে চাইলে আবু তাহের বলেন, ‘এগুলো সব মিডিয়ার সৃষ্টি। আপনারা সাংবাদিকেরা বানাইছেন। আমার কোনো ছেলে সন্ত্রাসী না। তারা কারোরে খুন করেনি।’ তিনি সাংবাদিকদের প্রতি কটাক্ষ করে বলেন, ‘সাংবাদিকেরা মাইনষের জাত না। কয় একটা আর লেয় আরেকটা।’
বিপ্লব ভালো ছেলে হলে এতগুলো খুনের মামলার আসামি হলো কেন—এই প্রশ্নের জবাবে তাহের বলেন, সব মিথ্যা মামলা। দলের কিছু লোক ও বিএনপির লোক ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ধ্বংস করার জন্য এ ষড়যন্ত্র করেছে। তাঁর দাবি, ‘আমার হুতেরা (ছেলেরা) খুন করতেই পারে না।’
তাহলে পুলিশের তদন্ত, অভিযোগপত্র, আদালতের রায়, সবই কি মিথ্যা? জবাবে তাহের বলেন, ‘কে বড়, সিআইডি নাকি থানার পুলিশ? নাসিমের (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) আমলে সিআইডি নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিল। আর এখন নাইস্যা (মোহাম্মদ নাসিম) কয়, এডা নাকি নিয়মমতো অয় ন।’
তাহেরের দাবি, ‘আমি মক্কা শরিফ ছুঁইয়ে বলেছি, আমি নুরুল ইসলামের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। যারা জড়িত আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন। পাপ হুতেরেও (ছেলেরে) ছাড়ে না।’
লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাহের ও তাঁর ছেলেরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে নানা অপরাধ করে। আর ক্ষমতা থেকে চলে গেলে তারা আত্মগোপন করে। কিন্তু ভোগান্তি পোহাতে হয় দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের।
নিহতদের পরিবারের শঙ্কা: লক্ষ্মীপুরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাহেরপুত্র ও তাঁর লোকজনের হাতে খুন হওয়া কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুনের মামলায় বিপ্লবের ক্ষমা লাভের ঘটনায় তাঁরা শঙ্কিত।
‘মরইন্যারে তো হিরি হামু না। বিপ্লইবা বাইর অইলে তো আর যে দুগা হুত আছে এগুনরেও মারি হালাইব। আঁই কিয়া করুম, চোকেও কিচু দেহি না’ (যে মরে গেছে, তারে তো ফিরে পাব না। বিপ্লব বের হলে তো যে দুই ছেলে জীবিত আছে, তাদেরও মেরে ফেলবে। তখন আমি কী করব, চোখেও কিছু দেখি না)। দক্ষিণ মজুপুরের বাড়িতে গেলে এভাবেই প্রথম আলোর কাছে উদ্বেগের কথা বলছিলেন নিহত কামালের বৃদ্ধ মা আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, দুই ছেলেকে তিনি বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।
বিএনপির কর্মী কামালকে ১৯৯৯ সালের আগস্টে হত্যা করা হয়। তাঁর ভাই আবদুর রহিম বলেন, কামাল হত্যার ঘটনায় তিনি আবু তাহের ও তাঁর তিন ছেলে বিপ্লব, টিপু ও লাবুসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। এই মামলায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল টিপু ও লাবুকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। আর তাহের ও বিপ্লবের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বিপ্লব ও আরেক আসামি খালেদ ছাড়া বাকি চারজন পরে হাইকোর্ট থেকে খালাস পান।
কামালদের পাশেই ফিরোজ আলমের বাড়ি। ফিরোজ খুন হন ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর। নিহত ফিরোজের ভাই রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তাহের বাহিনী ও তাঁর ছেলেদের অত্যাচারে তিনি তখন বিদেশে পালিয়েছিলেন। বিপ্লব গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন।
রেজাউল বলেন, বিপ্লব ও লাবুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ফিরোজকে ধরে নিয়ে খুন করে। ফিরোজ তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। এ মামলাটি এখন বিচারাধীন। তিনি বলেন, তাঁরা এখন আতঙ্কে আছেন, বিপ্লব কখন যে বেরিয়ে আসে। তাই রেজাউল তাঁর আরেক ভাইকে বিদেশ পাঠিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
একই আতঙ্কের কথা বলেছেন সদর থানার বনগাঁও শিবপুরের আমান উল্লাহ। তিনি নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, তাঁর ছেলে মহসিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। মহসিনকে ২০০০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর শহরের বিপ্লব, বাবু, রিংকু, লাবুসহ কয়েকজন মিলে প্রকাশ্যে খুন করে।
আমান উল্লাহ বলেন, মহসিন খুনের ঘটনায় তাহেরপুত্র লাবুসহ পাঁচজনের ফাঁসি ও বিপ্লবসহ সাতজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
এই মামলায় বিপ্লবের দণ্ড মওকুফ চেয়ে তাহের রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন বলে শুনেছেন আমান উল্লাহ। ক্ষুব্ধ এই পিতা বলেন, ‘এত বড় খুনিদের যদি মাফ করে দেওয়া হয়, তাহলে চোর-ডাকাতদের আটকে রাখার দরকার কি, তাদেরও ছেড়ে দেওয়া হোক।’