Saturday, January 29, 2011

বই এবং খানিকটা অথবা অনেকটা সংশয় by শান্তনু কায়সার

র তিন দিন পর ১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১১। বইমেলা নিয়ে ‘সাহিত্য সাময়িকীর’ বিশেষ আয়োজন
Remember
First to possess his books, for without them
He is but a sot, as I am.
(The Tempest/Act 3, Scene 2)
উদ্ধৃতাংশটি ক্যালিবান বলছে প্রসপেরোর শত্রুদের উদ্দেশে, কী করে তাকে জব্দ করা যায়।
অন্যদিকে প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে ক্যালিবানই তার প্রভু প্রসপেরোকে বলছে—You taught me language, and/My profit on’t/Is, I know how to curse। অর্থাৎ আপনি আমাকে ভাষা শিখিয়েছেন, তাতে সুবিধা হচ্ছে, আমি এখন জানি কীভাবে অভিশাপ দিতে হয়। এ থেকে বইয়ের দ্বান্দ্বিক সত্যকে বোঝা যায়। ভাষা নিজে ভালো বা মন্দ না হলেও বই কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক অথবা নিরপেক্ষ নয়। আমাদের একুশের গ্রন্থমেলার বয়স যেহেতু এখন খুব একটা কম নয়, সেহেতু এটাকে নিয়ে খানিকটা ভাবনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে।
তার আগে বলি, বাংলা একাডেমীর একুশের ঐতিহ্যের রয়েছে দ্বান্দ্বিক চারিত্র্য। কী করে ভুলি, একজন পরিচালককে (তখনো মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি) তাঁর ভুল ভূমিকার জন্য এবং ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিতা যিনি লিখেছেন, সেই রকম একজনকে স্বৈরাচারী শাসকের মন্ত্রী হওয়ার কারণে বটতলার অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে স্বৈরাচারী ওই আমলে আহমদ শরীফ বেশ কয়েকবার ২০ ফেব্রুয়ারির বৈকালিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে নির্জলা যে সত্য কথা বলতেন, তাতে তৎসম-কণ্টকিত দুরূহতা অতিক্রম করে তা জনসাধারণের এতটাই সানন্দ অনুমোদন পেত যে সমস্ত প্রাঙ্গণ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
বই যতই প্রিয় হোক, হোক তা পাঠকের প্রেরণা ও অনুপ্রেরণার উৎস, সবাই ত্যাগ করলেও বইয়ের মতো বন্ধু যে পাঠককে ত্যাগ করে না, বরং তাকে ভরিয়ে তোলে; তা সত্ত্বেও প্রকাশকের কাছে বই একটা পণ্যও বটে। তিনি হিসাব করে দেখেন, কী বই, কত দিনে বিক্রি হবে; তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ কত দিনে ফেরত পাওয়া যাবে, আদৌ অথবা কতটা মুনাফা পাবেন এবং এ বই তাঁকে আর কী কী ও কী পরিমাণ দেবে। আমাদের যতই ভালো লাগুক, বাজার অর্থনীতিতে বই তো আর আলাদা কিছু হতে বা পেতে পারে না।
যে প্রকাশক বলেন তিনি মানসম্মত বই প্রকাশে আগ্রহী, তিনিই আবার নানা চাপ ও স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। যে প্রকাশকেরা বলেন, তাঁদের প্রকৃত প্রকাশকের সংখ্যা ৭০-৭২ বা বড়জোর ১০০, তাঁরা একুশে গ্রন্থমেলার আগে দ্বিগুণ/তিনগুণে কী করে পৌঁছান; সেই প্রকাশকেরা যেসব সময় নীতি মেনে চলেন, তা-ও নয়। চাণক্যনীতির সুযোগ নিতে তাঁরাও খুব পিছিয়ে থাকেন না।
সেদিন এক প্রকাশক বলেন, লেখক যদি প্রকাশকের সঙ্গে লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে বই না দেন, তাহলে তিনি কী করে আইনি অধিকার দাবি করতে পারেন। কিন্তু আমরা জানি, লেখক দুর্বল পক্ষ। বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটেকে যেমন জিম্মি হয়ে থাকতে হয়, সাধারণভাবে লেখকের অবস্থাও তা-ই। আর যেসব লেখক ক্ষমতাবান অর্থাৎ অসম্ভব জনপ্রিয়, তাঁদের রয়্যালিটির টাকা তো প্রকাশকেরা বাড়িতে গিয়ে আগামও দিয়ে আসেন। লেখক হলেও তাঁরা ব্যতিক্রম।
মানসম্মত নয় এমন বই প্রকাশ করা আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মুদ্রণ-বিস্ফোরণের এই সময়ে এর প্রকাশ রুদ্ধ কিংবা অন্তত সীমিত করা যে অসম্ভব, সেকথা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই স্বীকার করবেন। এখন বঙ্কিমের যুগ নয় যে ‘লেখক’রা ‘যশের জন্য লিখিবেন না।’ এই ধরনের ব্যক্তিরা বিশ্বাসও করেন না যে ‘তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না।’ বঙ্কিম যে বলেছিলেন, ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না, কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন’—সেই ধৈর্যও সবার নেই। এত সুযোগ থাকতে গ্রন্থকার না হওয়াই বরং মূর্খের কাজ!
অতএব যা ঘটার তা-ই ঘটে। আবুল মনসুর আহমদ ভোট-ভিক্ষুকদের কথা বলেছিলেন, আমরা প্রায়ই বই-ভিক্ষুকদের দেখা পাই। লাইন ধরে তাড়া খাওয়া গ্রন্থকারেরা যেভাবে নিজের বইয়ের কথা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে বলেন, তাতে খাঁটি পাঠকের লজ্জার শেষ থাকে না।
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যেভাবে ‘ভালো’ ফল করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে, তাতে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার বাস্তব পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে, তার নির্মোহ জরিপ হলে বোঝা যেত, সাধারণত পাঠকেরা কী পড়েন বা পড়তে চান। এ অবস্থায় বইয়ের ভালো কাটতি আমাদের সৃজন ও মননচর্চায় কতটা ভূমিকা রাখে বা রাখতে পারে, সে ভাবনাকেও তুচ্ছ করে দেখা যায় না।
অর্থনীতির গ্রেশামস ল যে বলে মন্দ টাকা ভালো টাকাকে তাড়িয়ে দেয়, আমাদের গ্রন্থমেলারও সেই চারিত্র্য দাঁড়াচ্ছে কি না, এখন থেকেই বুঝি তা একটু একটু করে দেখা দরকার। আর এই ফাঁকে সারপ্লাস ভ্যালু তথা উদ্বৃত্ত মূল্য কোথায়, কার পকেটে ঢুকছে, সেটাও জনস্বার্থে দেখা প্রয়োজন।
দুই.
সারা দেশেই নানা গ্রন্থাগার রয়েছে। গ্রন্থাগারগুলো কতটা ভালো চলছে কিংবা সৎ ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত নিচের পর্যায়ে গ্রন্থাগারের প্রকৃত ভূমিকার কথা কেউ আর ভাবেই না। দুর্বৃত্তায়িত নানা পথে এসব ক্ষেত্রে যে বইগুলো কেনা হয়, শিক্ষার্থীদের বোধহয় সেসব বই না পড়াই ভালো। তাতে অন্তত তাদের পক্ষে দূষণমুক্ত হওয়া অথবা থাকা সম্ভব। আর সাধারণ ও গণগ্রন্থাগারগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাছে পঠন-পাঠন কোনো বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও কর্তৃত্বের প্রকাশ।
কিন্তু কী হওয়া উচিত ছিল বা কী হতে পারত, তার একটি পুরোনো উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এর সভাপতি ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১১ সাল থেকে আমৃত্যু এই গ্রন্থাগারের সহসভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র বইয়ে শ্যামল চক্রবর্তী প্রফুল্লচন্দ্র সংগৃহীত বইয়ের যে তালিকা ও বিবরণ দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, তিনি রোমান্টিক কবিদের ও নন্দনতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থাবলি অত্যন্ত খুঁটিয়ে পড়ছেন এবং মার্জিনে এ বিষয়ে মন্তব্য লিখে রাখছেন।
তাহলে প্রশ্ন, একুশ শতকে এসে আমরা কি এগিয়ে, না পিছিয়ে গিয়েছি অথবা যাচ্ছি?
তিন.
তবুও একুশে গ্রন্থমেলার সার্থকতাই আমাদের কাম্য। অনেক অপূর্ণতা থাকলেও বাংলাদেশ যেমন আমাদের অনেক দিয়েছে, বইয়ের জগতে এসেও তেমনি আমাদের প্রাণ ভরে যায়। বই হাতে নিয়ে এটিকে দেখতে দেখতেও আমরা অন্তত এই মেলার অনেক অপূর্ণতার কথা ভাবতে পারি। আর সৎভাবে অপূর্ণতার কথা ভাবলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনার কথাও আমাদের না ভেবে উপায় নেই। পরিমাণগত বাস্তবতাই একসময় আমাদের গুণগত পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। যাবেই। এ ছাড়া তো আমাদের ভিন্ন কোনো পথ নেই।

সূচক আশাজাগানিয়া তবু অর্থনীতি মন্থর

র্থনীতির ক্ষেত্রে চাপের মধ্যে রয়েছে সরকার। পণ্যবাজারের অস্থিরতার মধ্যে দুই বছর আগে দায়িত্ব নিয়েছিল সরকার। কিছুদিন নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সেই অস্থিরতা আরো বেড়েছে। ঘনীভূত হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। চলতি বছরটা শুরু হয়েছে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ ধস দিয়ে।
এসব চাপ সামলে দেশের অর্থনীতির গতিধারা বজায় রাখা, বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির কোনো সহজ পথ বাতলাতে পারেননি অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির মূল সূচকগুলো বেশির ভাগই ইতিবাচক থাকলেও মূল অর্থনীতিতে তেমন গতি নেই। বিনিয়োগের প্রস্তাব বাড়লেও বাস্তবায়ন কম। বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি গোল্ডম্যান স্যাক্স ও মুডিস বাংলাদেশকে ভারতের পরেই এ অঞ্চলে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) পরিচালিত এক জরিপে ২৮তম অবস্থান থেকে ২০১০ সালে ১৫তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বড় বড় কম্পানি বাংলাদেশকে বিনিয়োগের বিকল্প স্থান হিসেবে মনে করছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসেনি। এর মূল কারণ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা হিসেবে জমির অভাব। সমস্যাটি ভবিষ্যতে শিল্পায়ন, আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে দাবি করছেন মন্ত্রীরা। কিন্তু এর জন্য যে উদ্যোগ প্রয়োজন, তা নেই। মন্ত্রীদের এমন দাবির ভিত্তি হচ্ছে গত ছয় মাসে রপ্তানি আয়ে ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ নিবন্ধন বেশি হওয়া। কিন্তু এ কয়েকটি সূচক বাদে বাকি দিকগুলোতে দুর্বলতা রয়েই গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা খারাপ হচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া, বিদেশ থেকে লোক ফেরত আসা বেড়ে যাওয়া ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ায় সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে মানুষকে সস্তায় খাদ্য দেওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আগামী গরমে লোডশেডিং নিয়ে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে-এমন আশঙ্কা রয়েছে। শেয়ারবাজার ও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে ইতিমধ্যেই মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে সরকার।
এসব বিষয়ে আগামী দিনে সরকারকে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, তা সরকারকে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। শেয়ারবাজারের দরপতন যেমন একটি সমস্যা, তেমনি বিদ্যুৎ সংকটও একটি সমস্যা। কাজেই সমস্যাগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করার ওপরই আগামী দিনে সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভর করবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের বিষয়ে নিঃসন্দেহে সরকার বেশ চাপেই আছে। শেয়ারবাজারে যা ঘটেছে, তা থেকে সরকারকে অবশ্যই সতর্ক হয়ে শিক্ষা নিতে হবে। পাশাপাশি এসইসি, বিনিয়োগকারী সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। ড. মোস্তাফিজ বলেন, বিশ্ববাজারের পাশাপাশি পণ্যের দাম স্থানীয় বাজারেও বাড়ছে। তবে সব কিছুর পরও নিত্যপণ্য স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়াতে হবে। রেশনিং অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকারি খাতে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকির মতো বিষয়কেও মেনে নিতে হবে।
দ্রব্যমূল্যে নাকাল : ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সরকারের মেয়াদ দুই বছর পার হওয়ার পর এখনো এক নম্বর সমস্যা হিসেবেই তা রয়েছে। সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচন ও কয়েকটি আসনে উপনির্বাচনে বিরোধী দল প্রচারণার ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ২০১০ সালে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সরকারি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকায়ও দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় পণ্যের দাম অনেক বেশি। টিসিবির সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, গত এক বছরে চারটি প্রধান পণ্য-মোটা চালের দাম ৩৩.৩৩ শতাংশ, আটার দাম ৪৩.৭৫ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম ৩৬.৪৯ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ২৪.৫৬ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের মন্ত্রীরাও স্বীকার করছেন, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তবে তাঁদের ভাষ্য, প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য কম।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন কমে যাওয়া ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে এ অস্থিরতার হাওয়া লাগবে বাংলাদেশেও। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘খাদ্য পূর্বাভাস’ নামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার ৬ শতাংশ কম খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজারে আসবে। আর সরবরাহ কমায় এরই মধ্যে খাদ্যের দাম ৪.২ শতাংশ বেড়েছে। এফএওর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্য বাড়ায় বাংলাদেশসহ ৭৭টি খাদ্য ভর্তুকির দেশকে অতিরিক্ত ১২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বার্ষিক গড় হিসাবে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির ভয়ের দিক হলো, খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেশি এবং শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বেশি হারে। এরই মধ্যে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
গ্যাস-বিদ্যুতে আলো জ্বলছে না : বিগত দুই বছরে ১০২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ২০৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করেছে দাবি করছে সরকার। তবে ১০২১ মেগাওয়াটের মধ্যে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ বর্তমান সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব কাজ করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রথম বছর পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় বছর সিদ্ধান্ত ও চুক্তি করতেই পার করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ২৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ১৬টি কুইক রেন্টালসহ ৩৩টি চুক্তি করা হয়েছে। এর অধিকাংশ হয়েছে ২০১০ সালে। এ ছাড়া ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে চুক্তি, ২৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতীয় এনটিপিসির সঙ্গে চুক্তি এবং বৃহৎ ও মাঝারি আকারের বেশ কয়েকটি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজের অগ্রগতি হতাশাজনক। এখন পর্যন্ত তিনটি ছাড়া বেশির ভাগ কেন্দ্র নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনে আসতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস উৎপাদন বাড়লেও বর্তমানে মোট উৎপাদনের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। গত বছর এ সময়ে দৈনিক ১৯৭ থেকে ১৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হলেও তা এখন নেমে এসেছে ১৯৪ থেকে ১৯৬ কোটি ঘনফুটে। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন, ক্ষেত্র উন্নয়ন ও সংস্কারে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় গ্যাস ঘাটতি আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রথম বছরে সরকার ফার্স্ট ট্র্যাক কর্মসূচি নিলেও তা যথাসময়ে বাস্তবায়নে হাত দিতে পারেনি। এতে চলতি বছরেও চটজলদি পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ শিল্প খাতে বিনিয়োগ হতে হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এ পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে সক্ষম। এ জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকে কাজ করতে হবে।
এডিপি বিশাল, বাস্তবায়ন কম : চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ৩৮ হাজার কোটি টাকা। আকারে বিশাল হলেও বাস্তবায়ন হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম। ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ২৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ২৯ শতাংশ। এ সময়ে ৯১৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা ছাড় করা হলেও ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মাত্র এক-চতুর্থাংশ এডিপির বাস্তবায়ন হওয়ায় বাকি সময়ে অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হলে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি কাজ না হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগও থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজ এডিপির বাস্তবায়ন হার নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন যথাসময়ে না হলে তা মানসম্পন্ন হবে না। অনেক প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আর তা হলে সরকারি উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গতি নেই : গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এর সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পে অস্তিরতার কারণে শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এর বিপরীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে ১০ লাখ। ফলে ১০ লাখ লোক নতুন করে বেকারত্বের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দারিদ্র্য কমাতে বেশকিছু অঙ্গীকার করেছিল। এর মধ্যে ছিল প্রতি পরিবারে একজনকে কাজ দেওয়া। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি হাতে নেয়। এখনো এটি কুড়িগ্রাম ও গোপালগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিলুপ্ত হওয়া একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। বিএনপি সরকারের সময় বন্ধ থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ বর্তমান সরকারের সময় চালু করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষিতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা কঠিন। মানুষকে কাজ দিতে শিল্পায়ন বাড়াতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ নিবন্ধন বাড়লেও গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কারখানা চালু হচ্ছে না।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর এই ১১ মাসে মোট এক হাজার ৬২৭টি প্রকল্পে ৬২ হাজার ৫৬৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করেছেন উদ্যোক্তারা। এতে মোট চার লাখ ১২ হাজার কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু এসব বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নে গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা নেই এখনো।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, প্রতিবছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে। দেশে বর্তমান দুই কোটি ৭০ লাখ বেকার ছাড়াও কর্মবাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
রেমিট্যান্স-প্রবাহ ধীরগতি, জনশক্তি রপ্তানি কমেছে : জনবল রপ্তানি কমে যাওয়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও গতি হারিয়েছে। ২০১০ সালের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) সময়জুড়ে দেশে মোট প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে এক হাজার ১০০ কোটি ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে গেল বছরটি সরকার স্বস্তিতে কাটিয়ে দিলেও চলতি বছর বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারণ বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি দু-তিন বছর ধরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নেমে এসেছে। এসব দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ফেরতও এসেছে।
অবকাঠামোর বাধা ভূমি : অবকাঠামোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে সরকার। জমি হারিয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে। আর সরকারের জন্য তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে।
মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের জন্য ২৫ হাজার একর জমি প্রয়োজন সরকারের। কিন্তু ওই এলাকার জনগণ এরই মধ্যে বিক্ষোভ শুরু করেছে। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের জমি নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। বিনিয়োগ বোর্ড ও বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন্স অথরিটির (বেপজা) কর্মকর্তারা জানান, শিল্প স্থাপনের জায়গা দিতে পারলে গত বছর ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে কমপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ আসত। জমি না পেয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে গেছেন।
ভূমি অধিগ্রহণ সরকারের জন্য বড় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. বিনায়ক সেন। টাটার গাড়ি তৈরির কারখানার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এমন অবস্থা তৈরি হতে পারে। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তার পরামর্শ দেন।

মূল্যস্ফীতির চাপে শেয়ারবাজারে টানাপোড়েন

দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের নাম আরেকবার ছড়িয়ে পড়ল। তা সম্ভব হলো দেশের পুঁজিবাজারে বিরাট বিপর্যয়ের কারণে। এতে হয়তো খুশি হওয়ার কিছু নেই। তবে যেটা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে পারে সেটি হলো, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই উত্থান-পতন কিছু কিছু দেশে গভীর মনোযোগ কেড়েছে।

মনোযোগ কেড়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের। তারা বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এবার একটু ভিন্নভাবে পর্যালোচনা শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও প্রবণতার সঙ্গে নিজেদের শেয়ারবাজারকে মিলিয়ে দেখতে চাইছে। ফিলিপাইনের কথাই ধরা যাক। সেখানকার কোনো কোনো বিশ্লেষক বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ধস নামা থেকে সে দেশের কারবারি ও বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা নিতে বলছে, সতর্ক হতে বলছে। দেশটির প্রধান শেয়ারবাজার ফিলিপাইন স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচক হলো পিএসই সূচক। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই সূচক চার হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গেছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলায় তা ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারের ওপর চাপ তৈরি করেছে।
অবশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে তারা একটা দিক থেকে স্বস্তিতে রয়েছে। গত পাঁচ বছরের (২০০৬-১০) দুই বাজারের গতি-প্রবণতা পর্যালোচনা করে তারা দেখতে পায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক যত দ্রুত হারে ও যতটা বেড়েছে, পিএসই সূচক সেই হারে ও সেভাবে বাড়েনি।
ফিলিপাইনের বাজারের বিষয়টি যখন চলে এল, তখন আসলে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোর সর্বশেষ প্রবণতাটার দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এখানে চলে আসছে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত এই বছরের প্রথম তিন সপ্তাহে এশিয়ার প্রধান শেয়ারবাজারগুলোয় দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও চীনের শেয়ারবাজার যথাক্রমে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে পড়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পতনের মূলে রয়েছে মূল্যস্ফীতিজনিত আতঙ্ক।
এখানকার বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে দিয়ে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার দিকেই মনোযোগী। তাঁরা এও মনে করছেন, এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাসময়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেনি বা করলেও তা খানিকটা ধীরে ধীরে।
যেমন—ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গত মঙ্গলবার রেপো (কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেয়) ও রিভার্স রেপোর (কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে যে সুদ দেওয়া হয়) হার বাড়িয়েছে। তবে সেখানকার অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, এই হার যতটা বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ানো উচিত ছিল।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার ইকোনমিক টাইমসকে বলেছেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূলে রয়েছে দুই অঙ্কের খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার ও তেল-পণ্যের উচ্চমূল্য। একদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, অন্যদিকে মুদ্রার সরবরাহ কমানো—এ দুইয়ের মাধ্যমে এই মূল্যস্ফীতিকে প্রশমিত করতে হবে। রেপো ও রিভার্স রেপোর হার বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’
আরেক ধাপ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক বিপুল মালাকার। তাঁর মতে, এই নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানোর কোনো প্রভাব বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের ওপর পড়বে না। কেননা, মুদ্রাবাজারে উচ্চমাত্রায় ফাটকা চাহিদাই মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। তাই এই ফাটকা চাহিদার প্রশমন ঘটিয়ে এবং উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে হবে।
অথচ আরবিআইকে বলা হচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে আগ্রাসী কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যে কিনা গত বছরে ছয়বার বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়েছে। আর জানুয়ারি মাসে রেপো ও রিভার্স হার যথাক্রমে সোয়া ছয় ও সোয়া পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ছয় ও সাড়ে পাঁচ শতাংশে উন্নীত করেছে।
বিপরীতে মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা দ্রুত মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করেছে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে। এটি আবার সে দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। তাই এ দুটি দেশের প্রধান শেয়ারবাজার আলোচ্য সময়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সিউল স্টক এক্সচেঞ্জে তো একপর্যায়ে রেকর্ড উল্লম্ফন ঘটেছে। রয়টার্সের বিশ্লেষণে এমনটিই বলা হয়েছে।
সুতরাং, মূল্যস্ফীতির চাপে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোয় এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। শুধু শেয়ারবাজারই নয়, মুদ্রাবাজারে বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির চাপ আরেকটি অস্থিরতা তৈরি করেছে।
থাইল্যান্ডের বিহিত মুদ্রা বাথ ও ভারতের রুপির দরের বড় ধরনের পতন ঘটেছে। আর এটা ঘটছে যেহেতু এসব দেশের বিদেশি বিনিয়োগকারী ও কারবারিরা শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছে এবং মার্কিন ডলার কিনছে। এমনকি থাইল্যান্ডে কিছু স্থানীয় স্বর্ণ আমদানিকারকও ডলার কিনতে শুরু করেছে। এই চাহিদা বৃদ্ধি ডলারের দর বাড়িয়ে স্থানীয় মুদ্রাকে স্বাভাবিকভাবেই চাপের মুখে ফেলছে। সিঙ্গাপুরের স্ট্রেট টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে (২৩ জানুয়ারি) এসব তথ্য দিয়ে আরও বলা হয়েছে, সম্ভবত এশিয়ার মধ্যে এখন একমাত্র তাইওয়ানেই বিদেশিরা শেয়ার ও বন্ড কিনছে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ: বাংলাদেশে শেয়ারবাজারের বিরাট দরপতন বা ধস যা-ই বলা হোক না কেন, এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতির একটা যোগসূত্র দাঁড় করানো যেতে পারে। যদিও বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে যে অবস্থায় গিয়েছিল, তা থেকে বিরাট পতনটা ছিল অনিবার্য। আর মূল্যস্ফীতি প্রশমনের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি এই পতনে দৃশ্যতই একটা ভূমিকা রেখেছে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মূল কথাই হলো মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে আনা। আর এটা কমিয়ে আনতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত সুদের হার বাড়ানোর দিকে যায়। এতে একদিকে ঋণ প্রবাহ কমে, অন্যদিকে মানুষজন আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা করে একটু বাড়তি সুদ পাওয়ার জন্য। এতে শেয়ার ও বন্ড বাজার থেকে অর্থ প্রত্যাহার করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে (অক্টোবর, ২০১০ হিসাবে) বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর সরকারি লক্ষ্যমাত্রা হলো চলতি ২০১০-১১ অর্থবছর শেষে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা। কাজেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে করণীয় হলো সুদের হার বাড়ানো। সেই পদক্ষেপ হিসেবেই ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতের বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) ও নগদ জমার হার (সিআরআর) বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ ছিল। কেননা, সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে।
এ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে বাড়তি তারল্য তুলে নেওয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসের তুলনায় ২০১০ সালের নভেম্বরে দেশে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এতে বোঝা যায়, বাজারে যথেষ্ট অর্থ প্রবাহ ঘটেছে।
তবে আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। মুদ্রা সরবরাহ এতটা বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর যতখানি প্রভাব পড়ার কথা, ততখানি পড়েনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী তসলিম এ বিষয়টি উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন, তাহলে এত টাকা গেল কোথায়? উত্তরটা অবশ্য তিনিই দিয়েছেন, যা এখানে তুলে ধরা হলো।
হতে পারে, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির প্রভাবটি মূল্যস্ফীতিতে প্রতিফলিত হয় দীর্ঘ সময় পরে। সে ক্ষেত্রে আরও কিছুদিন পর গিয়ে হয়তো মূল্যস্ফীতির হার আরও উচ্চ হবে। তবে এর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে।
সরবরাহকৃত মুদ্রার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খাটানো হয়েছে শেয়ারবাজারে। ফলে অর্থগুলো ধাবিত হয়েছে শেয়ারের পেছনে, যা ক্রমান্বয়ে শেয়ারের দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। আর যেহেতু এই অর্থ বাজারে নিত্যপণ্যের পেছনে ধাবিত হয়নি, তাই তা মূল্যস্তরেও সেভাবে প্রভাব ফেলেনি। তাছাড়া বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির নির্ণায়ক যে ভোক্তা মূল্যসূচক, তাতে শেয়ারের দাম অন্তর্ভুক্ত হয় না। ফলে, শেয়ারের দাম অনেক বাড়লেও তা এই সূচকে প্রতিফলিত হয়নি। তাই তা মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে সেভাবে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
বলা যেতে পারে, শেয়ারবাজার বিপুল পরিমাণ অর্থ টেনে নিয়ে মূল্যস্ফীতিকে প্রশমিত রাখার ক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই কাজ করেছে। তবে এই কাজটি যে টেকসই নয় বা হতে পারে না, তাও ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, শেয়ারবাজার থেকে যখন অর্থ তুলে নেওয়া শুরু হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা বাজারকে নিম্নমুখী করেছে। এটা আবার বাজারকে বড় ধরনের সংশোধনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।
শেয়ারবাজারের এই বিপর্যস্ত অবস্থার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশের আর্থিক খাতে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। কেউ কেউ ভবিষ্যতে গোটা আর্থিক খাতেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। সেটা হয়তো ঘটবে না। অন্তত শেয়ারবাজারের এই অবস্থার পর নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট সতর্ক ও দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা তা কতটা হয়েছেন, তা বোঝা যাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি হওয়া বা না হওয়ার ওপর।