Saturday, June 18, 2011

নেই ঢাল তলোয়ার, আছে শুধু আবেগ by মাসুদুল আলম তুষার

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। আইনি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি লোকবল সংকটের কারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান কোনো কাজই করতে পারছে না। এই অচলাবস্থার জন্য সরকার দুষছে কমিশনকে। গত দুই বছরে কমিশন মানবাধিকার ইস্যুতে একটিমাত্র ঘটনার তদন্তে অংশ নিলেও সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাগজে-কলমে কমিশনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন পর্যন্ত বিবৃতি ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করতে পারেনি। তদন্তের বাইরে রয়ে গেছে বহু অভিযোগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শতাধিক ঘটনা। মানবাধিকার কমিশনে বর্তমানে আইন আছে, বিধি নেই।


অভিযোগ আছে, তদন্ত নেই। পদবি আছে, লোকবল নেই। কমিশনের নিজস্ব কোনো অফিসও নেই। ফলে মানবাধিকার ইস্যুতে কমিশনের দৃষ্টান্তমূলক কোনো কাজ নেই। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে সরকার আন্তরিক। আর এ কারণেই মহাজোট সরকার গঠনের শুরুতেই সংসদে আইন পাস করা হয়েছে। আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। লোকবল ও বিধি অনুমোদন করা হয়েছে। সহসাই গেজেট প্রকাশ করে বিধি কার্যকর করা হবে। আইনবিধিসহ কোনো কিছুতে পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কমিশন কোনো তদন্ত প্রতিবেদন অথবা সুপারিশ সরকারকে দেয়নি বলে আইনমন্ত্রী জানান। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কমিশন যতটুকু ভূমিকা রাখতে পারত, তা করেনি বলে অভিমত জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'সেখানে কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে।'
সম্প্রতি র‌্যাবের গুলিতে আহত ঝালকাঠির লিমনকে পঙ্গু হাসপাতালে দেখতে গিয়ে গণমাধ্যমের সামনেই কাঁদলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি। কিন্তু তিনি নিজে তদন্তের উদ্যোগ নিলেন না। এভাবেই হেফাজতে মৃত্যু, লাশ গুম, ক্রসফায়ারসহ নানা ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসব ইস্যুতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত নজির স্থাপনের মতো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান অবশ্য প্রতিদিনই নানা সভা-সেমিনারে মানবাধিকার বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ। জনবল না পেলে তিনি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী নিয়ে কাজ করবেন বলেও কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি।
মানবাধিকার কমিশনের কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়ে প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু কিছুই হয়নি। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের কান্না আর আবেগতাড়িত বক্তব্য আমাদের কাম্য নয়। কার্যকর ও গঠনমূলক কাজ প্রত্যাশিত। সরকার কমিশনকে অনেক কিছু না দিলেও যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, এর নূ্যনতম ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে না। সীমাবদ্ধতার মাঝেও কমিশন চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কারণ যেকোনো ঘটনা তদন্তে কমিশন চাইলেই লোকবলসহ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে পারে। অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোও কমিশনকে নানাভাবে সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু কাজের উদ্যোগ না থাকলে তো কেউ কিছু করতে পারবে না।'
কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটিকে রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ দিতে চেষ্টা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। এর পরও অনেক কাজ হচ্ছে না। বিশেষ করে জনবল দেওয়া হচ্ছে না। প্রকাশ্য বাধা না থাকলেও গোপনে অনেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছে। কমিশনের বিধিমালার অনুমোদন ও জনবল বরাদ্দ হয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে বুঝে পাইনি। মানবাধিকার কমিশনকে সহায়তা করা মানেই হচ্ছে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা জনগণের আস্থা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেখানে কমিশনের কাজ করার সুযোগ নেই, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি, সময় বেশি লাগলেও আমরা সফল হব।'
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা তদন্ত করে সে দেশের মানবাধিকার কমিশন নিজেই দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিশন মামলা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাতে পারবে কেবল। নিজের কিছু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি এ প্রতিষ্ঠানকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া, এমনকি মামলা করারও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কমিশনকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এর প্রতিকার করার কোনো ক্ষমতাও পায়নি কমিশন। শুধু সরকারের প্রতিবেদন চাইতে পারবে তারা এবং এর আলোকে সুপারিশ করতে পারবে। আবার কমিশনের সেই সুপারিশ মানতে সরকার বাধ্য নয়।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কমিশন আইন অনুযায়ী মানবাধিকার-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আদালতে মামলা হলে কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ কারণেই বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের অন্তর্ধান নিয়ে কমিশন উদ্যোগ নিতে পারেনি। আরো বেশ কিছু অভিযোগ একই কারণে নিষ্পত্তি করা যায়নি। পার্বত্যাঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে দুজন কমিশনারসহ তিন সদস্যের টিম কাজ করেছিল। সেটিই ছিল একমাত্র নিজস্ব তদন্ত। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সাংঘর্ষিক এ অবস্থানের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি সুপারিশ কমিশন সহসাই সরকারকে দিতে পারে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছরে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত হলেও তা নিজস্ব ছিল না। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজ করেছে কমিশন। বিধি চূড়ান্ত না হলে কোনো অভিযোগের তদন্ত সম্ভব নয়। বিধির পাশাপাশি লোকবল, যানবাহনসহ নিজস্ব অফিসও জরুরি।
জনবল সংকটের সঙ্গে আইনের নানা দুর্বলতার কারণে কমিশন শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেই বিষয়ে সন্দিহান মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন গঠনে সবাই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কমিশনের কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশের কোনো ঘটনায়ই এ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ভূমিকায় দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক।
মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুসারে বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে পারবে না কমিশন। আবার বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত শেষে শুধু সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কমিশন নিজে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইন অনুযায়ী কমিশন সরকার বা এর কর্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেদন চাইতে পারবে। তবে না পেলে করণীয় স্পষ্ট নয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ' জারি করা হয়। ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের কমিশন গঠিত হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ৯ জুলাই সংসদে 'মানবাধিকার কমিশন আইন' পাস করা হয়। বিধি প্রণয়ন বিষয়ে বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী কয়েক দফা সরকারের সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে নিজেই বিধির খসড়া করে ৪ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। কিন্তু সেই বিধি দুই বছরেও চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে চেয়ারম্যান পদে। প্রস্তাবিত বিধির ব্যাপারে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালের ২২ নভেম্বর বিভিন্ন পদে ৬২ জন লোকের নিয়োগ চাওয়া হয়েছিল। সরকার সম্প্রতি কমিশনের জন্য ২৮ জন লোক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু একজনকেও কমিশনে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কমিশনে আপাতত অন্য প্রকল্পের চারজন কর্মকর্তা ও ১০ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। কমিশনের কাজে সহায়তা দিতে শুরুতেই ইউএনডিপির 'প্রমোটিং একসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ' অস্থায়ীভাবে পাঁচজন কর্মী দেয়। তাঁরাই কমিশনের নানা দাপ্তরিক কাজে সহায়তা দিয়ে আসছেন।

আবাসন শিল্প: ক্রেতা-বিক্রেতাকে কাঁদাবে সরকার!

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে তৃতীয়টি হলো বাসস্থান। আধুনিক ও সভ্য মানুষের জন্য উন্নত আবাসন ব্যবস্থা জরুরি। এ জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও মানুষের উন্নয়ন আর পরিকল্পিত আবাসন একসূত্রে গাঁথা। এই জরুরি কাজটি করার মূল দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের কোনো সরকারই সে দায়িত্ব পালন করেনি। বরং এই গুরুদায়িত্ব যখন কাঁধে তুলে নিয়েছেন বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা, তখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার। নিরুপায় মানুষ মাথা গোঁজার একটু আশ্রয়ের জন্য শরণাপন্ন হয়েছে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে। সব সঞ্চয় দিয়ে তারা ক্রয় করছে এক টুকরো স্বপ্নের জমি; কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনের প্যাঁচে পড়ে তারা আজ অসহায়। অসহায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও। উভয় পক্ষের আজ চোখের পানিতে ভাসার দশা।

গতবারের আবাসন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয় এমন কিছু করবেন না। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? আবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয়, এমন কিছুই হচ্ছে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি আবাসন খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ খাত এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সিদ্ধান্তের অভাবেই মূলত আবাসিক খাতের বিভিন্ন প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার রাজউক সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলায় এগুলো বাতিলও করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা আরো ভেঙে পড়েছেন। আবাসন শিল্পের এ সংকট কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ শ্রমিকসহ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৬৯টি উপখাতে বিনিয়োগ করা অর্থ জলে যাবে এবং এর সঙ্গে জড়িত সারা দেশের অন্তত তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আবাসন খাতের এ সংকটের জন্য রাজউক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছেন এ খাতের ক্রেতা-বিক্রেতারা। ক্রেতাদের ভাষ্য, 'সরকারি লোকজনের চোখের সামনে আবাসন ব্যবসায়ীরা
প্লট ও ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে সেই বিজ্ঞাপন প্রচারিতও হয়েছে। আমরা বিজ্ঞাপন দেখে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা জনগণকে যদি সাবধান করত তবে আমরা অননুমোদিত প্রকল্প থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতাম না। এখন মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো জমি কেনার পর বলা হচ্ছে এটা অননুমোদিত প্রকল্প। আমরা এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব? অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি করার পর তা রেজিস্ট্রি করে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন, তাঁদের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?'
আর বিক্রেতাদের বক্তব্য, 'আমরা ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি। এর মধ্যে তারা কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে, আবার বেশির ভাগ প্রকল্পই অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ঝুলিয়ে রাখা প্রকল্পের বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তও দিচ্ছে না। আমরা ধরেই নিয়েছি, যেহেতু কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হবে।'
এ অবস্থায় বিক্রেতা হিসেবে আবাসন ব্যবসায়ীরা ও ক্রেতারা সম্মিলিতভাবে বিপর্যয়ের জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, বিধিমালা চূড়ান্ত করাসহ এ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে রাজউকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতির জন্যই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ একটি বেসরকারি সংগঠনের জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের আদেশ যেন বিনিয়োগকারীদের মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। তাঁরা বলেন, শেয়ার কেলেঙ্কারির ফলে বিনিয়োগকারীদের যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আবাসন খাতের বিপর্যয় তার চেয়ে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে দেখা দেবে।
প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়া : রাজউকের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক বছরে আবাসিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজউক মাত্র ২৬টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে না, আবার অনুমোদন দেওয়া হবে না_এটাও স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। এ কারণে এসব প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি ও বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ বিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা আবাসন খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা বারবার সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রীকে বলেছি, যেসব প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, সেগুলোর অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হোক। আমারও একটি প্রকল্প আছে, যেটা বন্যাপ্রবণ এলাকা নয়, তার পরও অনুমতি পাচ্ছি না। এখন সরকার বলছে, তারা এগুলো রিভিউ করবে। কিন্তু রিভিউ করতে করতে তো এ ব্যবসার বারোটা বেজে গেছে। এ খাতে মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটি প্লট কিনেছে। কিন্তু সেখানে তারা কোনো বাড়ি বানাতে পারছে না। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।'
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিধিবিধান মেনে যেগুলোর আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর কাগজপত্র ঠিক থাকলে সেটা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। অনুমোদনের জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি আছে। কমিটি সেটা দিয়ে থাকে। আবেদনকারীরা ৯০ শতাংশ শর্ত পূরণ করলেও আমরা সেগুলোকে পাসের ব্যাপারে সুপারিশ করি। আর যারা শর্ত অনুসরণ না করে অনুমোদনহীন প্রকল্পের প্লট বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি আমরা। সাধারণ লোকজন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আমরা ওয়েবসাইটে অনুমোদিত প্রকল্পের নামগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। এমনকি রাজউকে এসেও তারা জেনে যেতে পারে, কোনটা অনুমোদিত আর কোনটা অননুমোদিত। কিন্তু লোকজন সেটা না দেখে কিনে ফেলছে। কেউ জেনেশুনে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিলে সেই দায় তো সরকার বা রাজউক নেবে না।'
বিধিমালা নেই : বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রণয়ন করে বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ওই বিধিমালা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ব্যবসায়ীসহ সব মহলে এ বিধিমালা সমালোচিত হয়। স্ববিরোধী বিধি থাকায় এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সরকারও বিপাকে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিধিমালা যুগোপযোগী করার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিধিমালাটি সময়োপযোগী করার জন্য একাধিক বৈঠক করে নতুন নতুন প্রস্তাবও দেয়। কিন্ত অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাব সংযোজন করে এখন পর্যন্ত বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে না। এর পেছনেও আবাসন খাতকে ধ্বংস করতে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ওই বিধিমালা চূড়ান্ত না করে আবাসন প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিতে গড়িমসি করছে রাজউক। অন্যদিকে সরকার নিজেই একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। ওই সব প্লটে লটারির মাধ্যমে খুব সামান্য সংখ্যক লোকই প্লট পেয়ে থাকে। বঞ্চিতের সংখ্যা হাজার হাজার। প্লট না পেয়ে টাকা ফেরত নিতেও তাদের ভুগতে হয়। যারা বরাদ্দ পায়, তাদেরও সময়মতো প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। প্লট বরাদ্দ যারা পেয়েছে, তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছরের আগে রাজউক কোনো প্লট হস্তান্তর করতে পারে না।
এক দেশে দুই নীতি : সরকার ঘোষণা দিয়েছে, জলাশয় ভরাট করা যাবে না, কৃষিজমি অপরিবর্তিত রাখতে হবে ইত্যাদি। অথচ বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ সরকারের নির্দেশ মেনে চলেছেন। কিন্ত সরকারি সংস্থা রাজউক এ নির্দেশ মানছে না। তারা জলাশয় ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে চলেছে একের পর এক। জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই সরকারের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সেই যন্ত্রকে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে সরকার। সরকার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বেসরকারি আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের প্রতি নানাভাবে অবিচার করে চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্লট ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা করলেও তা দক্ষতার অভাবে খুব বেশি লোককে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না।
সরকারি প্লট জনগণের চাহিদা মেটাতে না পারায়, প্লট বরাদ্দ পেয়ে বা না পেয়ে বিভিন্ন হয়রানির কথা শুনে আবাসনের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ ঝুঁকছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কিন্তু এ খাতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকায় প্লট কেনায় আগ্রহীরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। আবার ঢাকা ও এর আশপাশের আবাসন প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করেছে, তারাও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হাতাশ হয়ে পড়েছে। অথচ প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সবার আশঙ্কা দূর হতো বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত।
হাইকোর্টের রায় : রাজউকের অননুমোদিত আবাসিক প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ড ৩০ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত ৭ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট এ নির্দেশ দেন।
আদালতের আদেশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে রাজউককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। রাজউকের অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার ও মাটি ভরাটসহ তাদের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিট আবেদনটি করেছিল। জানা গেছে, ৭০টি প্রকল্পের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিটটি দায়ের করে বেলা।
হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে আবাসন প্রকল্পগুলোতে আরো স্থবিরতা চলে আসছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজউকে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের নিষ্পত্তি হয় না। তা ছাড়া রাজউক থেকে জানানোও হয়নি যে, এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হবে না। বিভিন্ন আবাসন মেলা হচ্ছে। সরকারের অনুমোদন নিয়েই ওই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্লট বিক্রি হচ্ছে। লোকজন কিনছে। কোনো বাধা আসেনি।
রাজউক একের পর এক জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প করে তা বিক্রি করছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হয় না। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাটি ভরাট করলেই পরিবেশ নষ্ট হয়। এটা আবাসন খাতকে ধ্বংস করারই চক্রান্ত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ড্যাপ বাস্তবায়ন : গত বছর এ খাতের স্থবিরতার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ড্যাপ। অপরিকল্পিতভাবে তড়িঘড়ি করে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করায় আবাসন খাতের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আবাসন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে জনগণ ও আবাসন ব্যবসায়ীরা কিছুই অনুমান করতে পারছে না। ড্যাপে ঢাকা ও আশপাশের বিশাল এলাকাকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ড্যাপ নিয়ে একাধিক নকশা প্রকাশ করেছে রাজউক। নকশায় অন্তর্ভুক্ত জমিতে বহুতল ভবন বা আবাসিক এলাকা করার বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এক টুকরো জমি কিনেছে। আবার এমনও আছে, এসব জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে অনেকে। পারিবারিক কারণেই তাদের বসতবাড়ি বড় করতে হয়। সরকার কোনো দিক বিবেচনা না করে হঠাৎ ওই সব এলাকাকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব কারণে আগ্রহী সাধারণ মানুষ জমি কেনার বিষয়ে এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। একইভাবে ব্যবসায়ীরা এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জমি কিনে প্রকল্প করে রাস্তা, খেলার মাঠ, মসজিদ বানিয়ে খোলা জায়গা রেখে অবশিষ্ট জমি আবাসিক এলাকা হিসেবে উন্নয়ন করেছেন, রাজউক সেই জমিকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে। ফলে শহরমুখী মানুষ ওই এলাকার জমি আর কিনতে চাইছে না। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকে গেছে। বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে আনার বিষয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। যারা প্লট কিনেছে, তাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ১৩ শতাংশ এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে।
যদিও এসব বিবেচনা করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ড্যাপ পর্যালোচনার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জনকল্যাণের বিপক্ষে এমন একটি পরিকল্পনাও বেসরকারি আবাসন খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে।