Saturday, June 18, 2011

নেই ঢাল তলোয়ার, আছে শুধু আবেগ by মাসুদুল আলম তুষার

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। আইনি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি লোকবল সংকটের কারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান কোনো কাজই করতে পারছে না। এই অচলাবস্থার জন্য সরকার দুষছে কমিশনকে। গত দুই বছরে কমিশন মানবাধিকার ইস্যুতে একটিমাত্র ঘটনার তদন্তে অংশ নিলেও সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাগজে-কলমে কমিশনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন পর্যন্ত বিবৃতি ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করতে পারেনি। তদন্তের বাইরে রয়ে গেছে বহু অভিযোগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শতাধিক ঘটনা। মানবাধিকার কমিশনে বর্তমানে আইন আছে, বিধি নেই।


অভিযোগ আছে, তদন্ত নেই। পদবি আছে, লোকবল নেই। কমিশনের নিজস্ব কোনো অফিসও নেই। ফলে মানবাধিকার ইস্যুতে কমিশনের দৃষ্টান্তমূলক কোনো কাজ নেই। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে সরকার আন্তরিক। আর এ কারণেই মহাজোট সরকার গঠনের শুরুতেই সংসদে আইন পাস করা হয়েছে। আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। লোকবল ও বিধি অনুমোদন করা হয়েছে। সহসাই গেজেট প্রকাশ করে বিধি কার্যকর করা হবে। আইনবিধিসহ কোনো কিছুতে পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কমিশন কোনো তদন্ত প্রতিবেদন অথবা সুপারিশ সরকারকে দেয়নি বলে আইনমন্ত্রী জানান। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কমিশন যতটুকু ভূমিকা রাখতে পারত, তা করেনি বলে অভিমত জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'সেখানে কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে।'
সম্প্রতি র‌্যাবের গুলিতে আহত ঝালকাঠির লিমনকে পঙ্গু হাসপাতালে দেখতে গিয়ে গণমাধ্যমের সামনেই কাঁদলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি। কিন্তু তিনি নিজে তদন্তের উদ্যোগ নিলেন না। এভাবেই হেফাজতে মৃত্যু, লাশ গুম, ক্রসফায়ারসহ নানা ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসব ইস্যুতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত নজির স্থাপনের মতো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান অবশ্য প্রতিদিনই নানা সভা-সেমিনারে মানবাধিকার বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ। জনবল না পেলে তিনি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী নিয়ে কাজ করবেন বলেও কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি।
মানবাধিকার কমিশনের কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়ে প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু কিছুই হয়নি। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের কান্না আর আবেগতাড়িত বক্তব্য আমাদের কাম্য নয়। কার্যকর ও গঠনমূলক কাজ প্রত্যাশিত। সরকার কমিশনকে অনেক কিছু না দিলেও যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, এর নূ্যনতম ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে না। সীমাবদ্ধতার মাঝেও কমিশন চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কারণ যেকোনো ঘটনা তদন্তে কমিশন চাইলেই লোকবলসহ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে পারে। অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোও কমিশনকে নানাভাবে সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু কাজের উদ্যোগ না থাকলে তো কেউ কিছু করতে পারবে না।'
কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটিকে রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ দিতে চেষ্টা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। এর পরও অনেক কাজ হচ্ছে না। বিশেষ করে জনবল দেওয়া হচ্ছে না। প্রকাশ্য বাধা না থাকলেও গোপনে অনেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছে। কমিশনের বিধিমালার অনুমোদন ও জনবল বরাদ্দ হয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে বুঝে পাইনি। মানবাধিকার কমিশনকে সহায়তা করা মানেই হচ্ছে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা জনগণের আস্থা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেখানে কমিশনের কাজ করার সুযোগ নেই, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি, সময় বেশি লাগলেও আমরা সফল হব।'
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা তদন্ত করে সে দেশের মানবাধিকার কমিশন নিজেই দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিশন মামলা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাতে পারবে কেবল। নিজের কিছু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি এ প্রতিষ্ঠানকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া, এমনকি মামলা করারও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কমিশনকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এর প্রতিকার করার কোনো ক্ষমতাও পায়নি কমিশন। শুধু সরকারের প্রতিবেদন চাইতে পারবে তারা এবং এর আলোকে সুপারিশ করতে পারবে। আবার কমিশনের সেই সুপারিশ মানতে সরকার বাধ্য নয়।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কমিশন আইন অনুযায়ী মানবাধিকার-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আদালতে মামলা হলে কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ কারণেই বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের অন্তর্ধান নিয়ে কমিশন উদ্যোগ নিতে পারেনি। আরো বেশ কিছু অভিযোগ একই কারণে নিষ্পত্তি করা যায়নি। পার্বত্যাঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে দুজন কমিশনারসহ তিন সদস্যের টিম কাজ করেছিল। সেটিই ছিল একমাত্র নিজস্ব তদন্ত। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সাংঘর্ষিক এ অবস্থানের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি সুপারিশ কমিশন সহসাই সরকারকে দিতে পারে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছরে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত হলেও তা নিজস্ব ছিল না। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজ করেছে কমিশন। বিধি চূড়ান্ত না হলে কোনো অভিযোগের তদন্ত সম্ভব নয়। বিধির পাশাপাশি লোকবল, যানবাহনসহ নিজস্ব অফিসও জরুরি।
জনবল সংকটের সঙ্গে আইনের নানা দুর্বলতার কারণে কমিশন শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেই বিষয়ে সন্দিহান মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন গঠনে সবাই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কমিশনের কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশের কোনো ঘটনায়ই এ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ভূমিকায় দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক।
মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুসারে বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে পারবে না কমিশন। আবার বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত শেষে শুধু সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কমিশন নিজে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইন অনুযায়ী কমিশন সরকার বা এর কর্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেদন চাইতে পারবে। তবে না পেলে করণীয় স্পষ্ট নয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ' জারি করা হয়। ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের কমিশন গঠিত হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ৯ জুলাই সংসদে 'মানবাধিকার কমিশন আইন' পাস করা হয়। বিধি প্রণয়ন বিষয়ে বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী কয়েক দফা সরকারের সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে নিজেই বিধির খসড়া করে ৪ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। কিন্তু সেই বিধি দুই বছরেও চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে চেয়ারম্যান পদে। প্রস্তাবিত বিধির ব্যাপারে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালের ২২ নভেম্বর বিভিন্ন পদে ৬২ জন লোকের নিয়োগ চাওয়া হয়েছিল। সরকার সম্প্রতি কমিশনের জন্য ২৮ জন লোক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু একজনকেও কমিশনে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কমিশনে আপাতত অন্য প্রকল্পের চারজন কর্মকর্তা ও ১০ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। কমিশনের কাজে সহায়তা দিতে শুরুতেই ইউএনডিপির 'প্রমোটিং একসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ' অস্থায়ীভাবে পাঁচজন কর্মী দেয়। তাঁরাই কমিশনের নানা দাপ্তরিক কাজে সহায়তা দিয়ে আসছেন।

1 comment:

Nejam Kutubi said...

নবাবজাদা নছরুল্লাহ

Post a Comment