Thursday, December 02, 2010

স্মরণ: শিক্ষাবিদ সেলিনা বাহার জামান

জ ১ ডিসেম্বর ২০১০। ২০০৪ সালের এইদিনে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসেবী সেলিনা বাহার জামান চৌষট্টি বছর বয়সে হূদরোগের চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। সেলিনা বাহার জামান ১৯৪০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাবীবুলস্নাহ বাহার, মা আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ও ফুফু বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন সে যুগের আলোকিত মানুষের প্রতিনিধি। বাবা-মার জ্যেষ্ঠ সন্তান সেলিনা বাহারের এক ভাই ইকবাল বাহার চৌধুরী ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসের প্রধান ও আরো তিন বোন শাহীন চৌধুরী-দেশের প্রথম মহিলা স্থপতিদের অন্যতম, অন্য দুই বোন নাসরীন শামস্ ও তাজিন চৌধুরী যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপিকা।
কলকাতায় প্র্যাট মেমোরিয়াল স্কুলে সেলিনা বাহারের স্কুলজীবন শুরু হয়, ৪৭-এর দেশ বিভাগের পরে ঢাকায় এসে কামরুন্নেসা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৬ সালে ইডেন কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন, ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশুদ্ধ গণিতে এমএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অত্যন্ত মেধাবী সেলিনা বাহার ১৯৬১ সালে ইডেন কলেজের গণিতের প্রভাষক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে বদরুন্নেসা কলেজে গণিতের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ঐ বছরই প্রকৌশলী বদিউজ্জামানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৭৭ সালে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজে গণিতের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ঐ কলেজেই গণিতের অধ্যাপক এবং পরবতর্ীতে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

ঐতিহ্যবাহী পরিবারের উত্তরাধিকার-পারিবারিক আভিজাত্য ও খ্যাতিমান বাবা-মা'র সানি্নধ্যে ও অনুপ্রেরণায় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় এবং লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হন সেলিনা অল্প বয়স থেকে। তাঁর বাবা ও ফুফু চলিস্নশের দশকের মাঝামাঝি সময় কলকাতার 'বুলবুল' পত্রিকা প্রকাশনা ও 'বুলবুল' পাবলিশিং হাউজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই সময়ে আধুনিক সাহিত্য ধারা সৃষ্টি এবং প্রধানত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক মুসলিম সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চা ও প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা ও গান 'বুলবুল' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নন্দিত সাহিত্যিক শওকত ওসমানের জীবনের প্রথম লেখাও 'বুলবুল' পত্রিকায় ছাপা হয়। পরিবারের এই অনন্য ঐতিহ্য এবং সাহিত্যানুরাগ সেলিনা বাহারকে সংস্কৃতিসেবী, লেখিকা এবং কবি জনরুলের একনিষ্ঠ ভক্ত ও বিশেষ অনুরাগী করে তোলে। সেলিনা বাহার তাঁর নিজের লেখনির মাধ্যমে যেমন আমাদের সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি তাঁর দক্ষ সম্পাদনায় কাজী নজরুল ইসলামের দুটি বই আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারে অমূল্য সংযোজন নিঃসন্দেহে। একজন যোগ্য সম্পাদক হিসাবে ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমী হতে তাঁর সম্পাদনায় 'নজরুল পাণ্ডুলিপি' এবং ২০০১ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত অর্ধ সাপ্তাহিক 'নজরুলের ধূমকেতু' বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং নজরুল গবেষকদের কাছে একটি গাইড বিশেষ। সেলিনা বাহার পরবতর্ীতে হাবীবুলস্নাহ বাহার (১৯৯৫), জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৬), আনোয়ারা বাহার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৭), শামসুদ্দিন আবুল কালাম স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৮), আব্দুল ওয়াহাব মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৯), শামসুন্নাহার মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ (২০০০), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন স্মারকগ্রন্থ (২০০২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তাঁর সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থ 'আমায় তুমি অশেষ করেছ' (২০০৪) ইত্যাদি।

সেলিনা বাহার জামানের স্বামী এম বদিউজ্জামান বিসিআইসির অবসর প্রাপ্ত ডাইরেক্টর, পেশায় প্রকৌশলী। দুই ছেলে বড়জন পারভেজ জামান, পেশায় ডাক্তার যিনি ২০০১ সালের মার্চ মাসে লন্ডনে এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোট ছেলে রিয়াজ জামান, কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তার স্ত্রী ও একটি কন্যা আছে।

তাঁর ষষ্ঠ মৃতু্যবার্ষিকীতে সকলের সাথে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তারিক রহমান সৌরভ

কোপেনহেগেন হইতে কানকুন

লবায়ু পরিবর্তনের কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের অন্যতম বাংলাদেশ। সোমবার মেক্সিকোর কানকুন জলবায়ু সম্মেলন শুরু হইয়াছে। আমরা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলি আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি। উহার প্রভাবে তাপমাত্রার ঊধর্্বগতি, হিমবাহ গলনাঙ্কের নিচে নামিয়া আসা হইতে শুরু করিয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও দীর্ঘায়িত খরা মৌসুম উলেস্নখযোগ্য। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহা হইলে, আমাদের গ্রহে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হইয়া দেখা দিবে।
মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন একটি সুন্দর ও ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি করিতেছে বলিয়া আশাবাদ ব্যক্ত করিয়া চলিয়াছেন অনেকে। অভিজ্ঞ মহলের অনেকে আবার হতাশ। তাহারা কোপেনহেগেনের সম্মত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিতেছেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, গত বৎসর কোপেনহেগেনে যে অগ্রগতি অর্জিত হইয়াছিল উহাকে অবশ্যই অধিকতর আগাইয়া লইয়া যাইতে হইবে কানকুনে। সেই সময়ের মূল বিষয়গুলির অসমাপ্ত আলোচনা। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, গৃহীত কর্মসূচীর স্বচ্ছতা বজায়, অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রযুক্তি ও আমাদের বন সংরক্ষণ সমস্যা বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। এইসব বিষয়ে একটি 'ভারসাম্যপূর্ণ' ফলাফল খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। আমরা অবশ্যই প্রত্যাশা করিব, কোপেনহেগেনের অর্জনটুকুরও গুরুত্ব অনুবাধন করিবেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।

'কোপেনহেগেন চুক্তি'র সংকল্পটিকে সম্মুখে রাখিয়াই নূতন করিয়া যাত্রা করিতে হইবে সকলের। ঐ চুক্তি হইতে দূরে সরিয়া গিয়া কোনো প্রকার 'বারগেইন' কিংবা দর কষাকষি করিয়া কালক্ষেপণ করা কাহারও জন্য কোনো সুফল বহিয়া আনিতে পারিবে না।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৪০টি দেশ কোপেনহেগেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়াছে। বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলি আন্তর্জাতিক মান ও মাত্রা বজায় রাখিয়া কার্বন নিঃসরণ কমাইয়া আনিবার কর্মকাণ্ডে অঙ্গীকারও করিয়াছে। কোপেনহেগেন চুক্তির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্যাভিজ্ঞমহল বলেন, অর্থনৈতিক সাহায্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নে, অভিযোজনে ও বন সংরক্ষণে ব্যয় করা হইবে। জলবায়ুর কার্বন দূষণ বন্ধ করিতে না পারিলে সম্ভবত আগামী শতকে শিল্পোন্নত দেশগুলিও বিপন্ন হইবে। তখন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বও ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হইবে। আমাদের সবুজ গ্রহটিকে সকলের জন্য বাসযোগ্য করিয়া রাখিতে কোপেনহেগেন চুক্তি ও কানকুনে জলবায়ু পরিবর্তন বৈঠক বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত প্রয়াস ও প্রচেষ্টাকে সংহত করিবে, এমনটিই প্রত্যাশিত।

লাইসেন্সবিহীন চালক ও আমাদের বাস্তবতা

রকারি হিসাবেই সারা দেশে লাইসেন্সবিহীন চালক রহিয়াছে সাড়ে চার লক্ষ। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা তিনগুণ। সরকারি সংস্থা বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, আমাদের দেশে রেজিস্ট্রেশনকৃত পরিবহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ। ইহার বিপরীতে বৈধ চালকের সংখ্যা নয় লক্ষ। তবে অরেজিস্ট্রেশনকৃত পরিবহনের সংখ্যা কত তাহা জানা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। ইহা লইয়া কোন বাস্তবভিত্তিক গবেষণা হইয়াছে বলিয়া আমাদের জানা নাই। সুতরাং ভুয়া ড্রাইভারের প্রকৃত সংখ্যাটিও অজ্ঞাত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের ৬১ ভাগ চালক বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাইতেছেন। এই গবেষণাটিও সীমিত পর্যায়ের যাহার ফোকাস বা মূল কেন্দ্রবিন্দু হইল সড়ক দুর্ঘটনা। অবৈধ ও অদক্ষ গাড়ি চালক নিঃসন্দেহে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু সরকারি হিসাবেই যেখানে কয়েক লক্ষ অবৈধ চালকের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে, সেখানে এই পরিস্থিতির উন্নতি হইতেছে না কেন তাহা একটি বড় প্রশ্নই বটে।

বিআরটিএ'র পক্ষ হইতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারের বিরুদ্ধে বহুবার অভিযান চালাইয়াছে। চলতি বৎসরেও এই ব্যাপারে দুইবার অভিযান পরিচালিত হইয়াছে। কিন্তু তাহাতেও আশানুরূপ সাফল্য আসে নাই। বাড়ে নাই বৈধ চালকের সংখ্যাও। কারণ, গোড়ায় গলদ। মূল সমস্যায় হাত না দেওয়ায় সকল অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগসহ সংশিস্নষ্ট সকলে বৈধ চালকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক তাহা আন্তরিকভাবে কামনা করে কিনা তাহাও বিবেচ্য। কেননা এক অনিয়মই অন্য অনিয়মের জন্ম দেয় বা তাহার সুযোগ তৈরি হয়। প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব সততার সহিত পালন করিলে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে গিয়া ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার শিকার হইতে হইত না কাহাকেও। ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্তি যেমন সহজ করিতে হইবে, তেমনি জাল লাইসেন্স তৈরির কারখানায় পুলিশি অভিযানও অব্যাহত রাখিতে হইবে। তবে সবার আগে দক্ষ চালক তৈরিতে দেশে পর্যাপ্ত, মানসম্মত ও স্বীকৃত ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থাকা চাই।

রোগ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনাপত্র প্রদান ও নিরাময়ের উদ্যোগ গ্রহণ করিতে না পারিলে কোন লাভ নাই। স্বাধীনতার পর অনেক রাস্তা-ঘাট হইয়াছে। তাহার সহিত পালস্না দিয়া বাড়িয়াছে যানবাহনের সংখ্যা। কিন্তু এজন্য যুগোপযোগী ব্যবস্থাপনা দরকার, সেদিকে তেমন কেহই নজর দেন নাই। আজ বিআরটিএ-কে একটি আধুনিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া ইহার জনবল অবশ্যই যৌক্তিক করিতে হইবে। যে কোন গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার বৈধ ড্রাইভার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সর্বোপরি, সর্বত্র নিয়ম মানিয়া চলার অভ্যাস গড়িয়া উঠিলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের বক্তব্য হইল, নিয়ম মানাইতে হইবে এবং সেই সঙ্গে তাহা নিজেও মানিয়া চলিতে হইবে।

জীব বৈচিত্র্য : হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক লাঙ্গল

সৌরজগতে পৃথিবী নামক গ্রহেই শুধু প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। জীবনের কোলাহল শুধু এ গ্রহেই শ্রুত হয়। পৃথিবী নামক গ্রহেই জীবনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যার জীবন আছে সেই তো জীব। জীব দুই ধরনের। যেমন- উদ্ভিদ ও প্রাণী। পৃথিবীর গহীন বন, মরুভূমি, ছোট-বড় বন-বাদাড়ে, মাটিতে জীব বসবাস করে। স্থানভেদে পরিবেশের বিভিন্নতায় ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী বাস করে। কেউ স্থলে, কেউ জলে, কেউবা সমুদ্রে। আবার কেউ মন সুখে আকাশ পানে উড়াল দেয়। জলবায়ু ও পারিপাশ্বর্িক অবস্থায় বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন পরিবেশে ওপর নির্ভরশীল। এরকম বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় প্রাণী নিয়েই প্রাণিজগৎ।
কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ থেকে শুরু করে আমাদের পরিবেশে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী। কোনগুলো মানবহিতকারী পরিবেশ বান্ধব আবার কোনটি মানুষও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। যেমন- মৌমাছির মৌচাক থেকে মধু ও মোম পাওয়া যায়। রেশম পোকার গুটি থেকে রেশম পাওয়া যায় পাশাপাশি মশা, মাছি, উইপোকা আমাদের ক্ষতি করে থাকে। ফসলের জন্য ক্ষতিকর হলো পামরী পোকা, লেদা পোকা বিছা পোকা, ক্ষুদে মাকড় যেগুলো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। এসবের ভিড়ে আমাদের জন্য একটি উপকারী ও পরিবেশ বান্ধব সরীসৃপ জাতীয় অ্যামিবা দলভুক্ত প্রাণী হলো কেঁচো। কেঁচো মাটির নিচে বাস করে। কেঁচো মাটির উর্বরা শক্তির জন্য এক বিরাট শক্তি। কেঁচো ফসলের জমিতে ওলট-পালট করে। যেমন উপরের মাটি নিচে ও নিচের মাটি ওপরে তুলে আনে। তাইতো কেঁচোকে "প্রকৃতির লাঙল" বলা হয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে কেঁচোর ভূমিকা অনন্য। তাছাড়া কেঁচোর তৈল থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়। কেঁচোর বিষ্ঠা ফসলি জমির জন্য মহাউপকারী। গ্রামাঞ্চলে কেঁচোর তোলা মাটি ফোঁড়া উপশমে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দিনকে দিন কেঁচো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু অনেক প্রজাতির অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়া ফসলি জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে কেঁচো। তাছাড়া এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারী কেঁচোকে মাছের ' টোপ" হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা "বিষলং" গোটা, "রিডা বীজ"সহ অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে মাটির নিচে থাকা কেঁচো নিধন করছে। বর্ষা মৌসুমে গ্রামাঞ্চলে প্রায়শই দেখা যায় কেঁচো নিধন দৃশ্য। তাই দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির লাঙল কেঁচো। বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে, সেদিন দূরে নয় ১১ হাজারেরও বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির প্রহর গুণছে। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মৎস্য এবং এক-চতুর্থাংশ স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ। বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে কার্বনসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ নির্গমন। মানব সৃষ্ট ঘনীভূত অমস্নজান মানুষ ও প্রাণীর জন্য মারাত্মক বিপদের কারণ। পরিবর্তীত জলবায়ু ও মানব সৃষ্ট কারণে প্রতিদিনই আমরা হারাচ্ছি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। ফলে জীববৈচিত্র্যে চির ধরছে। প্রকৃতি হারাচ্ছে ভারসাম্য। আমাদের অস্তিত্বের জন্য, পরিবেশের অস্তিতের জন্যই আমাদের উচিত বিভিন্ন প্রাণিকূলকে বাঁচিয়ে রাখা। কেঁচো এমন একটি প্রাণী। যা আমাদের জমির উর্বরতা ধরে রাখতে উত্তম সহায়ক। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত উপকারী। অথচ আমরা সেদিকে খেয়াল না করে নির্বিচারে কেঁচোর অস্তিত্ব ধ্বংস করছি। আমরা বুঝতে পারছি না যে, নিজেই নিজের ক্ষতি করছি। এমনিতেই জমির উর্বর শক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। এরপরেও যদি জমির উর্বরতা ধরে রাখার সহায়ক শক্তি প্রকৃতির লাঙল কেঁচো ধ্বংস করা থেকে আমরা বিরত না হই তবে সেদিন খুব দূরে নয়, যখন মাটি থেকে একেবারে হারিয়ে যাবে মানবহিতকারী জীব কেঁচো। তাই প্রকৃতির লাঙল কেঁচো বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ প্রয়োজন।

বিদেশের কলাম : পাক-ভারত সম্পর্ক : একটি পর্যালোচনা নাথানিয়েন গ্রোনেউড

ক সময় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম দখল করেছিল ইরাকের রামাদি, নাজাফ, সামারা ও বাগদাদ। বর্তমানে সে স্থানে উঠে এসেছে পাকিস্তানের লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, পেশোয়ার ও ইসলামাবাদ। কারণ প্রতিদিনই এসব শহর ছাড়াও দেশটির বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্প্রতি সীমান্তবতর্ী উপজাতি অধু্যষিত এলাকায় অভিযান শুরু করেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে তালেবান ও পাঞ্জাবী জঙ্গিদের রয়েছে যোগসূত্র।
তাদের ধারণা আফগান সীমান্তে এক সময় যে জঙ্গিবাদের সূচনা তা এখন আর সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। জড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। বস্তুত সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, চিরশত্রু ভারত নয়, পাকিস্তানের জন্য হুমকি সেদেশের সন্ত্রাসী চক্র। তাই পাকিস্তানিদের সর্বাগ্রে সন্ত্রাস তথা জঙ্গিদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ভারত সীমান্তের দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছে। অবশ্য তার কারণও যে নেই তা নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ও পাকিস্তান তিন তিনটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। তার মধ্যে দুইবারের যুদ্ধ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে, যা পাকিস্তানিদের মনে আজো দাগ কেটে আছে। বিশেষ করে সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় বেশিরভাগ পাকিস্তানি সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। তাদের ভাষায়, ঐসব যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানকে কেবলই দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র যে মুহূর্তে পাকিস্তানের সন্ত্রাস নিমর্ূলের জন্য মরিয়া ঠিক সে মুহূর্তে পাকিস্তানিদের অনেকেই আফগান যুদ্ধ ও নিজ দেশের সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইকে দেখছে সে ফ মার্কিন সংগ্রাম হিসাবে সেটা যে তাদেরও লড়াই-সংগ্রাম তা মানতে রাজি নয় তারা। বরং আফগানিস্তানে ভারতের কনসু্যলেট অফিস খোলার বিষয়কে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা দেখছে অবিশ্বাসের চোখে, তাদের ধারণা, আফগানিস্তানে প্রভাব খাটানোর লক্ষ্যেই ভারত কাজটি করেছে। তাদের বোঝা উচিত সময় পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় ভারত যদিও পাকিস্তানকে বিভক্ত করার কাজে সহযোগিতা করেছে, এখন আর তেমনটি চায় না। বরং পাকিস্তানে নৈরাজ্য সৃষ্টির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চিন্তিত ভারতও। বিশেষ করে মুম্বাইয়ের হোটেলে ও কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে বোমা হামলার ঘটনায় ভারত সন্ত্রাস নিমর্ূলে আরো বেশি জোরালো ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। তাই পুরনো দিনের অনাস্থা-অবিশ্বাস ভুলে পাকিস্তান ও ভারতের উচিত সন্ত্রাস নির্মূলে একাট্টা হয়ে কাজ করা। এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় মনে রাখা দরকার-আফগানিস্তানের চেয়ে পাকিস্তানের গুরুত্ব বেশী। যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারত ও পাকিস্তানকে তার আস্থাভাজন মিত্র বহাল রাখতে চায় তাহলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে পারে, একথাও মনে রাখতে হবে, কাজটি মোটেই সহজ নয়। কারণ কথিত ইসলামী জঙ্গীরাই এক্ষেত্রে প্রথম প্রতিবন্ধক, যা ভারত ও পাকিস্তানি নাগরিক কারোরই হালকা হিসাবে নেয়ার অবকাশ নেই।

আনন্দ স্কুলের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম

বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কবলে নিপতিত হইয়াছে আনন্দ স্কুলের কার্যক্রম। ইহাতে এই স্কুলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হইতেছে। সদ্য সমাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ছিল সর্বাধিক। বিষয়টি অনুসন্ধান করিতে গিয়া উদঘাটিত হইয়া পড়ে নানা অনিয়মের চিত্র। ইহার আগে এই ধরনের কোন কোন স্কুলে একজন মাত্র শিক্ষার্থী রহিয়াছে এমন সংবাদও প্রকাশিত হইয়াছে পত্র-পত্রিকায়। অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রী না থাকিলেও ভুয়া শিক্ষার্থীর নামে প্রকল্পের অর্থ উত্তোলন করা হইয়াছে ঠিকই।
এইসব স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে এবার ছিল ১ লক্ষ ৯০ হাজার শিশু। তন্মধ্যে পাবলিক পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার। রেজিস্ট্রেশনের সময় বাদ পড়ে ৫৫ হাজার শিক্ষার্থী। তাহার উপর সমাপনী পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল অনুপস্থিত। বিষয়টি নিঃসন্দেহে হতাশা ও উদ্বেগজনক।

সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পথে প্রধানতম বাঁধা ঝরিয়া পড়া শিশু। ইহার মূল কারণ দারিদ্র্য ও অসচেতনতা। কাহারও মতে, সরকারি স্কুলের নিরানন্দময়তা। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় হইতে ঝরিয়া পড়া ৭ হইতে ১৪ বৎসর বয়সী ৫ লক্ষ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনিতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন বা রস্ক প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় গড়িয়া ওঠে ১৫ হাজার আনন্দ স্কুল। বর্তমানে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হইয়াছে এবং ২০১০-২০১১ সালের জন্য ব্যয় ধরা হইয়াছে ৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া যাইতেছে যে, এই প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থ জাতীয় ও স্থানীয় এনজিও, পরামর্শদাতা ও মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত এলজিইডির পিছনেই ব্যয় হইতেছে। স্কুল পরিচালনায় ব্যয় বাড়িলেও শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র একজন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিদেশী দাতা সংস্থার ঋণে গড়িয়া উঠা অধিকাংশ প্রকল্পের অর্থব্যয়ে যথেচ্চ্ছাচারের কাহিনী সুবিদিত। বাংলাদেশে চলমান এই ধরনের বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাধারণত আমরা বলিয়া থাকি ঋণ করিয়া ঘি খাইতে নাই। কিন্তু আমাদের কার্যকলাপে ইহার কোন প্রয়োগ নাই বলিলেই চলে। ফলে সেসব প্রকল্পে খাজনার চাইতে বাজনা বেশি হইবে ইহাই স্বাভাবিক। অনেক এনজিও প্রকল্পের অর্থের যোগানদার মূলত সরকার এবং তাহা পাবলিক মানি হিসাবে পরিগণিত। এনজিওগুলি শুধু সেই প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী। যেহেতু শেষপর্যন্ত ঋনের বোঝা জনগণকেই বহিতে হয় এবং ইহার সহিত দেশের উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত, তাই এইরূপ অর্থও নয়-ছয়ের বদলে তাহার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করিতে হইবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তদারককারী সংস্থাকে হইতে হইবে আরও সক্রিয়।

ভোজ্যতেলের দাম লইয়া বাণিজ্যমন্ত্রীর হতাশা অযৌক্তিক নহে

রকারের নানামুখী চেষ্টা সত্ত্বেও একদিনের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ১৩ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যমন্ত্রীর একটি মন্তব্য যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি খোলাখুলি বলিয়াছেন_ দেশটা মগের মুলস্নুক নয় যে ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো যাইবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর মতে, যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই আকস্মিকভাবে ভোজ্যতেলের দাম যেইভাবে বৃদ্ধি করা হইয়াছে তাহা কোনো ব্যবসা নয়, স্রেফ মুনাফাখোরি। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য যে, ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত ২৯ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশিস্নষ্ট ব্যবসায়ীদের সহিত এক জরুরি সভায় মিলিত হইয়াছিল।
সেই সভায় ক্ষুব্ধ মন্ত্রী উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেন। সন্দেহ নাই যে, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের চাপে দিশেহারা জনগণ মন্ত্রীর এই মন্তব্যে কিছুটা হইলেও স্বস্তিবোধ করিবেন। তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্যে হতাশার সুরও অস্পষ্ট নহে। এই হতাশা যে কিছুটা অসহায়তাজনিত তাহাও অনুধাবন করা কঠিন নয়। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রীর হয়তো সদিচ্ছা বা আন্তরিকতার অভাব নাই। কিন্তু বাস্তবতা হইল, কিছুতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাইতেছে না। রাখা কঠিনও বটে। কারণ বিষয়টি শুধু মন্ত্রীর একার ইচ্ছাধীন নহে।

অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ার কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির যুক্তি দেখাইয়াছেন। তবে তাহাদের এই যুক্তি যে যথার্থ নহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উত্থাপিত তথ্য-উপাত্তে তাহা স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম-প্রধান জানাইয়াছেন যে, গত তিন মাসের আমদানি-মূল্য বিশেস্নষণ করিয়া দেখা গিয়াছে বর্তমানে বাজারে যে-সয়াবিন তেল পাওয়া যাইতেছে তাহা কেনা হইয়াছে কেজি ৭০ টাকারও কমে। পরিশোধনসহ সব খরচ হিসাবে নিলে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৮৩ টাকার কিছু বেশি। অথচ ক্রেতাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো দাম আদায় করা হইতেছে। মন্ত্রীর সদুপদেশ কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কতর্ৃক দাম নির্ধারণ করিয়া দেওয়ার পরও পরিস্থিতি পাল্টায় নাই। বরং ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়াই চলিয়াছে। আর ইহার জন্য যথারীতি একে অপরকে দায়ী করার চিরাচরিত প্রবণতাও অব্যাহত আছে।

বাজার বাজারের নিয়মেই চলিবে_ইহাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক বাজারে দরের উঠানামা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে দামের কিছুটা হেরফের হইতেই পারে। এই ব্যাপারে কাহারও আপত্তি থাকিবার কথা নহে। কিন্তু ভোজ্যতেল লইয়া নিকট অতীতেও নানা কারসাজির অভিযোগ উঠিয়াছে। সেইসব অভিযোগ যে একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না তাহাও সর্বজনবিদিত। গণতন্ত্রই বলি আর মুক্তবাজার অর্থনীতিই বলি_সবকিছুরই মূল ভিত্তি হইল আইনের শাসন। আর ইহার অবিচ্ছেদ্য অংশ হইল দায়িত্বশীলতা। আইনের শাসনের স্বার্থে সকলকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি মানিয়া চলিতে হয়। ব্যবসায়ীরাও ইহার ব্যতিক্রম নহেন। কিছুটা রূঢ় শোনাইলেও বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদেরকে গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য সেই দায়িত্বশীলতার কথাই স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন মাত্র। কারণ ইহার ব্যত্যয় ঘটিলে আইনের শাসন বাধাগ্রস্ত হয়, স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্য মাথাচাড়া দিয়া ওঠে_যাহা দীর্ঘকাল যাবৎ 'মগের মুলস্নুক' হিসাবে তুলনীয় হইয়া আসিতেছে। সেই অবস্থা নিশ্চয় কাহারও কাম্য নহে।

হত্যা মামলার পুনরুজ্জীবনঃ এক নম্বর আসামির নাম বাদ দিলে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হবে

রাজনৈতিক রং চড়িয়ে মিরপুরের আফতাব হত্যা মামলাটি প্রত্যাহার যে সঠিক ছিল না, আদালতের নির্দেশে মামলাটির পুনরুজ্জীবনই তার প্রমাণ। তবে সেটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি মামলার ১৯ আসামির মধ্যে এক নম্বর আসামির নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায়। গত সোমবার প্রথম আলোয় আফতাব হত্যা মামলা প্রত্যাহারের খবর প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট মহলে চাঞ্চল্য দেখা যায়। ওই দিনই আইন ও বিচারসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা করা এবং আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যাও চেয়ে পাঠানো হয়।
হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামও স্বীকার করেছেন, আদালতের ত্রুটিযুক্ত আদেশের কারণে শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম প্রত্যাহার করা হয়েছিল। শুধু কি ত্রুটিযুক্ত আদেশ? মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল কি না, তা তদন্ত করে দেখা জরুরি। ২০০৫ সালে সংঘটিত এই হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এক নম্বরে ছিলেন ওসমান গনি। তিন নম্বর আসামি ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত। ওসমান গনিকে আওয়ামী লীগের কর্মী দাবি করে মামলাটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছিলেন স্থানীয় সাংসদ কামাল মজুমদার। তাঁর সুপারিশের ভিত্তিতেই মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ওসমান গনি আওয়ামী লীগের কর্মী নন।
আইন প্রতিমন্ত্রী আদালতের ত্রুটি সংশোধন করে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এক নম্বর আসামির নাম বাদ দেওয়ায় ন্যায়বিচার পাবেন না বলে আশঙ্কা করছেন নিহত ব্যক্তির ভাই ও মামলার বাদী। কেউ আওয়ামী লীগের কর্মী হলেই মামলা থেকে রেহাই পেতে পারেন না; দেখতে হবে হত্যার সঙ্গে আসামি জড়িত ছিলেন কি না। মামলার তালিকাভুক্ত ১৯ আসামির বিরুদ্ধেই আইনি প্রক্রিয়া চলতে হবে। আদালতই নির্ধারণ করবেন, কে অপরাধী আর কে নির্দোষ। তার আগেই কোনো আসামির নাম বাদ দিলে সেটি হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত বিদেশে পলাতক থাকার পরও বাদীকে কে বা কারা ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, সেটিও আমলে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে কোনো আসামির নাম বাদ দেওয়া হলে বিচারের পথই রুদ্ধ হয়ে যাবে।

পাথরখেকো!

দেশজুড়ে খাওয়া-খাওয়ির অন্ত নেই। যার যেমন ইচ্ছে, তেমনটিই যেন খাওয়ার মহোৎসব চলছে। ইচ্ছে করলেই যেন খেয়ে ফেলা যায়। সব কিছুই যেন ভক্ষণযোগ্য। কোনো কিছুই তো আর বাদ যাচ্ছে না। এখানে বন খাওয়া হয়েছে। বনের গাছ বাদ যায়নি। বাদ যায়নি খাসজমি থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষের জমিও। যার যেমনটি ক্ষমতা সে অনুযায়ী খাওয়া হয়েছে। একেকজনের খাওয়ার ধরন একেক রকম। কেউ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে খেতে অভ্যস্ত। কেউ কোনো কিছু বুঝতে না দিয়েই গ্রাস করতে দড়।
এ খাদকদের হজমশক্তিও অস্বাভাবিক। হজম করতে না পেরে কাউকে কিছু উগরে দিতে বাধ্য হতে হয়েছে_এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া বোধ হয় দুষ্কর। খাওয়া-খাওয়ির বিরুদ্ধে নানা কথা বলা হচ্ছে। হর্তাকর্তা যাঁরা, তাঁরাও এ খাওয়া-খাওয়ির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। উচ্চারিত হচ্ছে সাবধানবাণী। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার সময় নেই খাদকদের। কেবল ভক্ষণেই সুখ এই ভক্ষক বা খাদকদের।
এবার খোঁজ পাওয়া গেল পাথরখেকোদের। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনসে বিনা বাধায় চলছে পাথর উত্তোলন! পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাটির নিচ থেকে নির্বিচারে তোলা হচ্ছে পাথর। বাদ যাচ্ছে না ফসলি জমিও। সেই পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে রাস্তা ও বাড়ি নির্মাণের কাজে। কেউ কেউ আবার সীমানা প্রাচীর তৈরি করছে এ পাথর দিয়ে। শুধু পাথর নয়, মাটির নিচ থেকে বালুও তোলা হচ্ছে। এতে দ্বীপের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু পাথরে 'ভাগ্য ফেরাতে' ব্যস্ত যাঁরা, তাঁদের সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নেই। অথচ এই দ্বীপটিকে ১৯৯৫ সালে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে কোনো নির্মাণকাজ করতে হলে অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করা হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না নিয়ম। এর নেপথ্যের কারণ হচ্ছে প্রভাব। যে মহলটি এ পাথর ও বালু উত্তোলনের পৃষ্ঠপোষক, তাদের প্রভাব আছে। এই প্রভাবশালীদের যে বাগে আনা যাচ্ছে না_সেটা বলাই বাহুল্য। পরিবেশ ছাড়পত্রের তোয়াক্কা না করেই তাই সেন্টমার্টিনসে গড়ে উঠছে ভবন। তৈরি করা হচ্ছে বাণিজ্যিক পর্যটন কটেজ। পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তারা বিষয়টি তাঁদের ঊর্ধ্বতন মহলে জানানোর পরও প্রভাবশালী এই পাথরখেকোদের পাথর ভক্ষণ থেমে নেই। থেমে নেই দ্বীপের বালু ও মাটি কাটার কাজ!
এভাবে পাথর তোলা, বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার ফলে সেন্টমার্টিনস দ্বীপের পরিবেশ ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সেখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের এই একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি সংরক্ষণের দায়িত্ব সবার। কেবল কিছু অর্থলোভী মানুষের লোভের কাছে পরাজিত হবে একটি দ্বীপের পরিবেশ? নষ্ট হবে জীববৈচিত্র্য? নষ্ট হবে দেশের পর্যটনের এমন অনিন্দ্য আকর্ষণ? প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাবে একটি প্রাকৃতিক দ্বীপ? এটা কি মেনে নেওয়া যায়?

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হোক

জুম্ম জনগণ পাহাড়কে নিজের ঠিকানা ভাবতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এখনো। স্বস্তি নেই অনেকের। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে সরকার যাত্রা করেছিল, সেই যাত্রা বিঘি্নত হয়েছে মাঝখানে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, চুক্তিসম্পাদনকারী রাজনৈতিক দলের সরকারে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে হয়তো শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হতে এবার আর দেরি হবে না। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাফল্য আশানুরূপ হয়নি এখনো।
শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ের মানুষ আবারও সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছে, আদৌ চুক্তি বাস্তবায়ন হবে কি না। তাদের অভিযোগ অনুযায়ী, প্রশাসনই তাদের সেই অনিশ্চিত অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আজ ত্রয়োদশ বর্ষপূর্তি হচ্ছে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের। সরকারের ব্যর্থতা কিংবা চুক্তি সম্পাদনে অমনোযোগী হওয়ায় সেখানে যে অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং শান্তিচুক্তি বিরোধীচক্র। তাদের কাজে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে সমতলেরও একটি গোষ্ঠী।
অথচ সরকার গঠনের আগে আওয়ামী লীগ ও মহজোটের শরিক দলগুলো পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পর্কে প্রায় একই বক্তব্য উপস্থাপন করেছিল। মহাজোটের অঙ্গীকার ছিল, সরকার গঠন করার পর তারা পর্যায়ক্রমে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েও খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি তারা। ভূমি জরিপ করতে গিয়ে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ভূমি কমিশন আইন ২০০১ নিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে মতভেদ, তা কাটিয়ে আস্থাশীল পরিস্থিতি তৈরি করা সরকারের দায়িত্ব। পার্বত্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মও পাহাড়িদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী নিরাপত্তার নামে হয়রানিও বন্ধ হয়নি সেখানে। পাহাড়ি-বাঙালি কোন্দল কোথাও কোথাও মৃত্যুর কারণ হতেও দেখা যায়, যাকে কোনোতেই মেনে নেওয়া যায় না। সম-অধিকার আন্দোলন নামের একটি সংগঠন সম্পর্কে পাহাড়িরা যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, সে সম্পর্কে সরকারকে তদন্তসাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান সরকারি দল কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তির কারণে পাহাড়ে যে শান্তির সূচনা হয়েছে এবং তাদের এ কাজে যেভাবে পাহাড়ের মানুষ সমর্থন দিয়েছে, সেদিকটি খেয়াল রেখে এ সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। একসময় পাহাড়িরা সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিরোধপূর্ণ দেশগুলোর কাতারে ঠেলে দিয়েছিল। পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিপথগামী পাহাড়িদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে আনার যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা অবশ্যই ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো। এ জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, তাকে ধরে রাখার দায়িত্ব সরকারেরই। আর চুক্তির উদ্যোগ ও সাফল্যের জন্য যেমন এ সরকার সাধুবাদ পেতে পারে বেশি, এর বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেও তেমনি তাদের সে-রকম সাফল্য পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রত্যাশা করে। শান্তি যেন পাহাড়ের পরিচয় হয়, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে সরকারকে আর পাহাড়ি এবং সেখানে বসবাসকারী বাঙালিদেরও মনে রাখতে হবে, মতানৈক্য তাদের শান্তি কেড়ে নেবে। স্থায়ী শান্তি ফিরে আসুক পাহাড়ে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

চালের দামঃ সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে

লন পর্যাপ্ত হয়েছে, কিন্তু চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। দেশে চালের বাজারের এই অস্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ করে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ যথার্থ। তবে আমাদের মনে হয়, এই শঙ্কা-উদ্বেগ সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সর্বদা সজাগ থাকলে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো অসম্ভব হবে না।
ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার, পর্যাপ্ত ফলন হওয়া সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ার প্রবণতার কারণগুলো কী। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মঙ্গলবারের সভার পর বলেছেন, এবার ধানের ফলন ভালো হওয়ায় একশ্রেণীর চালকলমালিক অস্বাভাবিক পরিমাণ চাল মজুদ রাখছেন—মূলত এ কারণেই চালের দাম বাড়ছে। আমাদের মনে হয়, এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও চালের দাম কম নয়; এবং খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন দেশ বেশ সজাগ রয়েছে, তারা চাল রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছে নিজ জনগোষ্ঠীর চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। এসব কারণে চালের বাজার নিয়ে দেশে-বিদেশে সতর্কতা রয়েছে। তবু আমাদের চাল আমদানি করার সুযোগ আছে; আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে আট লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি হওয়ার কথা। আর দেশের বিভিন্ন গুদামে সাড়ে সাত লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে বলে সরকারি সূত্রে জানা যাচ্ছে।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করবে না। এই সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই মত দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ, সরকার কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে। এবার এমনিতেই বাজারে দাম বেশি, কৃষকেরা ধান-চালের ন্যায্যমূল্যই পাচ্ছেন। অবশ্য, যদি দেখা যায়, কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, তখন সরকার হস্তক্ষেপ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চালের দাম নির্ধারিত হবে বাজারের নিজস্ব পদ্ধতিতেই এবং দৈনন্দিন পরিস্থিতির ওপর দাম কিছুটা ওঠানামা করবে। সরকারের কর্তব্য হবে এই দৈনন্দিন গতিবিধির ওপর গভীরভাবে লক্ষ রাখা, যাতে কোনো ধরনের কারসাজি বা অসদুপায়ের সুযোগ কেউ নিতে না পারে। সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছে ‘অসাধু’ চাতালমালিকদের মজুদদারি ঠেকাতে তাঁদের ঋণের সীমা মিলের মোট উৎপাদনক্ষমতার সমমূল্যের অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু এর ফল উল্টো হতে পারে বলে মন্তব্য করলেন একজন বিশেষজ্ঞ। বরং ঋণগ্রহীতা চাতালমালিকদের ঋণ সমন্বয় করার সময়সীমা কমিয়ে দেওয়ার যে নির্দেশনা গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছিল, তাতে সুফল পাওয়ার কথা। কারণ, দ্রুত ঋণ সমন্বয় করতে হলে দীর্ঘ সময় চাল মজুদ করে রাখার সুযোগ থাকে না। এই ব্যবস্থা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছিল তার মূল্যায়ন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণই অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে।
এ ছাড়া অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি কার্যক্রমের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও নাজুক জনগোষ্ঠীর মৌলিক খাদ্যচাহিদা মেটানোর ব্যবস্থাগুলোর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর বৈঠক

ভোজ্যতেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গত সোমবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘ইচ্ছামতো তেলের দর বাড়ানো যাবে না। বাড়ানোর যুক্তি থাকতে হবে।’ তাঁর এই বক্তব্য ন্যায্য। কিন্তু প্রশাসন যেখানে উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণে পদক্ষেপ নিতে নিষ্ক্রিয় থাকে, সেখানে শুধু অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে আর হুকুম করে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী সভায় উপস্থিত ব্যবসায়ীদের তেলের নতুন দর নির্ধারণ না করে, কক্ষ ত্যাগ না করার কথা বলেন। বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন মরিয়া আচরণ থেকে বোঝা যায়, মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে সরকার আসলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
গত ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বোতলজাত সয়াবিনের দাম এক দিনেই লিটারপ্রতি বেড়ে যায় ছয় থেকে ১৩ টাকা। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম তখন কমতির দিকে। এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কথাই বলা হচ্ছে। বাজারের স্বাভাবিক নিয়মও এ দেশে কার্যকর নয়। এ অবস্থায় সরকার কয়েক দিন পর পর হুংকার দিলে তো বাজারের নৈরাজ্য দূর করা যাবে না।
দ্রব্যমূল্য হঠাৎ বেড়ে গেলে বিপাকে পড়ে ভোক্তারা। উদারনৈতিক ব্যবস্থায় বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ন্যূনতম থাকলেও কেউ বাজার কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে, তা ঠেকানোর ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশে বারবার এমন সংকট সৃষ্টি হওয়া থেকে বোঝা যায়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যবস্থাগত আয়োজন মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। নিয়মিত বাজার তদারকি না থাকা, বাজারের চাহিদা ও জোগানের হালনাগাদ অবস্থা না জানা ইত্যাদি কারণে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি সহজ হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে বর্তমান নৈরাজ্য নিরসনে সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ করার সম্ভাবনা বা সামর্থ্য আছে—এমন কোনো আশা ভোক্তাদের মনে জাগাতে পারেনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর এই বৈঠক। নিত্যপণ্যের মূল্য তদারকির ভূমিকা পালনে সরকারের ব্যর্থতা ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রয়োজনে বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা কার্যত সরকারের হাতে নেই। তাই এখন ইচ্ছামতো দর না বাড়ানোর কথা বলে খুব বেশি সুফল পাওয়ার আশা করা যায় না। ব্যবসায়ী ও ভোক্তার স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজন মূল্য নির্ধারণে সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ, শুধু হম্বিতম্বি হিতে বিপরীত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতিতে স্বীকৃত উপায়গুলো ব্যবহারে সরকারকে দক্ষ হতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করাই হলো আসল কাজ।

আর হরতাল নয়ঃ সংসদে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করুন

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ডাকে এক মাসে দুটি হরতাল হয়ে গেল। গতকালের হরতালকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ গরম হয়ে উঠেছিল। এ সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরপাকড় হয়েছে, বিএনপির মিছিলে পুলিশের লাঠিপেটা হয়েছে, হরতালের আগের রাতে রাজধানীতে গাড়িতে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল হরতালের দিনও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও লাঠিপেটা হয়েছে। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল যেমন হয়, তা-ই হয়েছে। জনগণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে, তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি, স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য চলেনি, ব্যাহত হয়েছে শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন। হরতালের মতো কর্মসূচি না দেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতি বিভিন্ন মহলের জোরালো আবেদন ও আহ্বান সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে দলটি তাতে সাড়া দিল না।
আমাদের দেশে বিরোধী দল সব সময়ই ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ হিসেবে হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করে থাকে। জনগণ যদি বিরোধী দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হরতাল পালন করত, তাতে হয়তো কোনো আপত্তি থাকার কারণ ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জনগণ হরতাল পালন করতে বাধ্য হয়। বিরোধী দল তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে রাস্তায় গাড়িতে আগুন দেয়, গাড়ি ভাঙচুর করে। গতকালের হরতালের আগের রাতেও এ ঘটনা ঘটেছে। জনগণকে হরতাল পালনে বাধ্য করতে ভয় দেখানোর জন্য এসব করা হয়। আমরা দেখেছি, হরতালের আগে বিএনপির নেতারা গণসংযোগ করেছেন, লিফলেট দিয়ে জনগণকে হরতাল পালনে আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার কী দরকার ছিল? বিরোধী দল নিশ্চিতভাবেই দাবি করবে যে এটা তারা করেনি। তবে করেছে কারা? হরতাল ডাকা হলেই যেহেতু এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাই এ ধরনের কর্মসূচি পরিহার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
নব্বই-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারকে হরতাল করে ক্ষমতাচ্যুত করা বা সরকারের ক্ষতি করা যায়নি। ক্ষতি যা হয়েছে, তা দেশের ও দেশের অর্থনীতির। আর দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে দেশের জনগণকে। আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে হরতাল তাই পুরোনো, সেকেলে ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, দেশের জনমত যেহেতু হরতালের পক্ষে নয়, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া। হরতালের ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা আমাদের বছরের পর বছর ধরে হয়েছে, গতকাল আবার হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে হরতাল ডাকার বিরোধিতায় আমরা অক্লান্ত। গতকালের হরতালের পর আমরা আবারও আহ্বান জানাই, আর হরতাল নয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের কাজের সমালোচনা, বিরোধিতা ও তর্ক-বিতর্কের জায়গা সংসদ। সরকার ও সরকারি দলের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিরোধী দল বিএনপির অভিযোগের শেষ নেই। আমরা চাই, হরতাল না করে সংসদে ফিরে গিয়ে বিএনপি সেই সব কথা বলুক। জনমত সৃষ্টির এটাই সবচেয়ে কার্যকর পথ।

দখল-সংস্কৃতি বন্ধ হোক

রাজনীতির পালাবদল কিংবা ক্ষমতার হাতবদল হয়, হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু ক্ষমতার পথে পা রাখতেই জনসাধারণের সঙ্গে শুরু হয় প্রতারণার প্রতিশ্রুতি। যে দলই ক্ষমতায় আসে_শোনায় রাশি রাশি স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই নির্মম বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে একরাশ হতাশা নিয়ে জনগণ নিশ্চুপ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের দুর্দিনের পরিবর্তন ঘটে না_সহজে ঘটবেও না তা জেনেশুনেই হয়তো ব্যালটে সিল মারেন সবাই। এ দেশের বাস্তুভিটায় টিকে থেকে বাঁচতে হলে কাউকে না কাউকে ভোট দিতে হবে, তাই দেওয়া। জনগণ চুপচাপ চেয়ে দেখে ক্ষমতার সঙ্গে বদলায় অনেক কিছুই অনেকের। যাঁরা ক্ষমতার পাশাপাশি অবস্থান করেন, ক্ষমতার স্পর্শে থাকার জন্য ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি করেন নিজেদের বদলানোর জন্য, তাঁদের দিন বদলায়।
নিদেনপক্ষে অন্য কোনো সুযোগ না ঘটলেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন দখল-বাণিজ্যে। যেমন_রাজধানীর মিরপুরের 'জিয়া স্মৃতি ক্লাব' রাতারাতি 'রাসেল স্মৃতি সংঘ' হয়ে গেল। পত্রিকার এ খবরটি পড়ে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, এরূপ সাইনবোর্ড বদলে যাওয়া শুধু মিরপুরে নয়, দেশজুড়েই চলছে। আর এ-ও নিশ্চিত যে আগের সাইনবোর্ডটিও ছিল দখলসূত্রে, বৈধতা ছিল না। তাই দেশের মানুষ এ সম্পর্কে কোনো কথা বলে না, কৌতূহল পর্যন্ত প্রকাশ করে না। সবাই মনে করে, যে দল ক্ষমতায় যায় তার লোকজন খায়_এ যেন অলিখিত এক চুক্তি মোতাবেক চলছে। কখনো কখনো সংঘর্ষ বাধে বটে; কিন্তু বড় কোনো বিপত্তি ঘটে না হাতবদলের রীতিতে। কিছুদিন আগে তেজগাঁওয়ে রেলওয়ের ৩০ কাঠা জমি শ্রমিক লীগ নেতা দখল করে নিলেন। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এরূপ দুই হাজার একর জমি বেদখল রয়েছে। তা নিশ্চয়ই কোনো জনস্বার্থমূলক খাতে ব্যবহৃত নয়, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মহলের মুষ্টিতে। পত্রিকান্তরে পাওয়া খবর অনুযায়ী সূত্রাপুরে ভবনসহ জমি ও মন্দির দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী ভূমি দুর্বৃত্তচক্র। 'নারায়ণগঞ্জের সরকারি জমি দখল করে অফিস বানাচ্ছে আ. লীগের ক্যাডাররা'_পত্রিকার প্রতিবেদনটি জানান দেয়, দেশের সর্বত্র এ দুর্নীতির রীতি প্রতিষ্ঠিত।
আমরা মনে করি না ক্ষমতার শীর্ষে যেসব নেতা আছেন, তাঁরা সবাই এ সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। যাঁরা এমন অপরাধে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না, তাঁদের সোচ্চার হতে হবে সাধারণ মানুষের স্বার্থে।
৩১ অক্টোবর পত্রিকান্তরে শেখ রেহানার একটি লেখা অনেকে পড়েছেন, 'সম্প্রতি আমি লক্ষ করছি আমার বাবা, মা ও ভাইদের নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা...কিছু লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে খালি জায়গা দখল...। বুঝতে পারি এসব অপকর্মের খবর সবারই জানা। তবে এর প্রতিকার কেন হবে না? সরকার ইচ্ছে করলে এ দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে পারে। দেশের স্বার্থে, সরকার ও সরকারি দলের স্বার্থে এসব বন্ধ করা উচিত।'

প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান সব সময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরকালে নতুন সহযোগিতার আশ্বাস মিলেছে। বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক বড় পাওয়া। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণে অতিরিক্ত ১০ কোটি ডলার সাহায্যের আশ্বাস মিলেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে এই অতিরিক্ত ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ের এ বিশাল প্রকল্পে জাপান আগেই ৩০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।জাপান অনেক দিন আগে থেকেই বাংলাদেশে নানা প্রকল্পে সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগও কম নয়। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের ভেতর দিয়ে দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করা গেলে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ আরো বাড়বে। বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের পরিবেশ রয়েছে। অর্থনীতিতে মন্দাভাব কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস প্রণীত পরবর্তী ১১টি উদীয়মান দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে আরো একটি মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে বলে স্বীকার করেছে। তবে এটাও ঠিক, জাপানের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতিও রয়েছে। এসব বাণিজ্য ঘাটতি দূর করাও জরুরি। প্রধানমন্ত্রী সেদিকেও আলোকপাত করেছেন। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে জাপানের সঙ্গে একটি সমন্বিত চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জিএসপি বা জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস সুবিধা লাভের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে 'রুলস অব অরিজিন' শিথিল করার জন্য জাপান সরকারকে অনুরোধ
করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, আইটি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরিবহন, টেঙ্টাইলসহ অন্যান্য খাতে জাপানের বিনিয়োগ আহ্বান করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আশা করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের ভেতর দিয়ে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর, নতুন বিমানবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় জাপান সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যেকোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নের প্রথম শর্ত পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর জন্য এখন কাজ করতে হবে। দুই দেশের মধ্যে সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন একটি লাভজনক অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জাপানের মতো বিনিয়োগকারী দেশের কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরতে পারলে সেটা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে উভয় দেশের জন্য সম্ভাবনার সেই নতুন দিগন্তই উন্মোচিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করা যেতে পারে।