Friday, February 11, 2011

দ্রোহ ও সৃজনের জেলজীবন by মুর্তজা বশীর

নানা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেছেন বাংলাদেশে ও বিশ্বের নানা প্রান্তের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক। জেল-জুলুমেও তাঁদের চিরতরে স্তব্ধ করা যায়নি। তাঁদের সেই সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করেই আয়োজন জেলখানার লেখালেখি। লিখেছেনঃ মুর্তজা বশীর

১৯৫০ সালের ৭ জুন আমি জেলে যাই। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি ‘মুক্ত এলাকা দিবস’ ঘোষণা করেছিল। স্থানগুলো হলো বাংলাদেশের ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের হাজং, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ আর মাদ্রাজের তেলাঙ্গানা। জনযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। আমি একটা পোস্টার এঁকেছিলাম। যার বিষয় ছিল ময়মনসিংহের মানচিত্র হাতুড়ি-কাস্তে দিয়ে ঘেরা। পোস্টারের ওপরে লেখা ছিল মুক্ত এলাকা দিবস, যা দেয়ালে লাগাতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হই।
জেলে আমাকে রাখা হয় ১৪ সেলে। ‘শকুন্তলা ফাটক’ বলে যার একটা সুন্দর নাম ছিল। আমার রাজনৈতিক সতীর্থ আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, আলী আকছাদ, শ্রমিকনেতা আবদুল বারি এবং ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়াও এখানে ছিল। জেলের ১৪টি কক্ষই দুদিকে লম্বা শিক দিয়ে ঘেরা ছিল। দুজন করে থাকার নিয়ম, তবে একজনও থাকত।
সকালে যখন লকআপ খুলে দেওয়া হতো, তখন আবদুল্লাহ আলমুতী, আলী আকছাদসহ অন্যরা শুনতে চাইত, রাতে আমি কী লিখেছি। রাতে লেখা গল্প-কবিতা তখন আমি পড়ে পড়ে তাদের শোনাতাম।
প্রথম দিকে যখন খাতা ছিল না, মুতী ভাই কিছু লেখার জন্য মাঝেমধ্যেই তাগাদা দিতেন। তখন খবরের কাগজের সাদা মার্জিনের মধ্যে পেনসিল দিয়ে লিখতাম। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে আমি কমলা রঙের মলাট দেওয়া একটা খাতা আনিয়েছিলাম এবং ওই লেখাগুলো উঠিয়ে রেখেছিলাম।
সেখানে আমি সতীর্থ সঙ্গীদের প্রতিকৃতি এঁকেছিলাম। কয়েকজন কয়েদিও ছিল। জেলখানায় একটা রজনীগন্ধার ঝাড় এত ভালো লেগেছিল যে মনে হয়েছিল মুক্ত জীবন। তার ড্রয়িংও আমি করেছি। ওই খাতায় আমি বেশ কিছু গল্প-কবিতাও লিখেছিলাম।
কবিতাগুলো ছিল মূলত সুকান্ত ভট্টাচার্যের অনুকরণে, গণচীনের অভ্যুদয় ও নতুন জীবনের জয়গান নিয়ে। দুঃখটা হলো, এসবের সবই আমার হারিয়ে গেছে।
আমাদের বেগমবাজারের বাসায় মূল ফটক দিয়ে ছোট একটা করিডোর ছিল, যেখানে ঢুকলেই ছিল ইলেকট্রিকের মিটার, তার পাশে তালা মারা দরজা। ওটিই ছিল আমার স্টুডিও। সেখানে আমি ছবি আঁকতাম। ওই ঘরে একটা কালো টিনের বাক্সে আমার জেলজীবনের খাতাটা রাখা ছিল। সঙ্গে ছিল ইতালি থেকে আমিনুল ইসলামের লেখা চিঠি ও ছবি এবং শিল্পী পরিতোষ সেন ও দিলীপ দাশগুপ্তের লেখা চিঠি ও ছবি।
এ ছাড়া খুবই মূল্যবান একটি জিনিস যত্ন করে খামের ভেতর রাখা ছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ আবুল বরকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় ধরেছিলাম। আমার হাতে ছিল কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য পানিভেজা রুমাল। ওই রুমালের এক কোণে একটা লাল ফুল এমব্রয়ডারি করা ছিল। যার লাল উজ্জ্বল রং রক্তের উজ্জ্বলতায় হারিয়ে গিয়েছিল। বায়ান্নর সেদিনের ঘটনা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন দুপুর গড়িয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সারি সারি ব্যারাকের সম্মুখের ঘাসে আমি এবং হাসান হাফিজুর রহমান বসেছিলাম চার-পাঁচটা ব্যারাক পেরিয়ে, লাল খোয়া রাস্তার একধারে।
হাসান বলছিল নতুন কবিতার কথা, আর আমি ভাবছিলাম আজকে জাদুঘরে ঢাকা আর্ট গ্রুপের ২য় চিত্র প্রদর্শনীর কথা। যেখানে আমার তেলচিত্রগুলো রাখা ছিল। হঠাৎ দেখলাম, ব্যারাকগুলোর দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা চলন্ত জটলা। দৌড়ে গেলাম। বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণ, মুখমণ্ডল পরিষ্কারভাবে কামানো, সারা চেহারায় বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভরে যাওয়া ঘাম আর পরনের প্যান্টের পেটের নিচ থেকে কল খুলে দেওয়ার মতো অঝোরে রক্তের ঢল। সবার সঙ্গে আমিও তাকে ধরেছি, আমার সাদা পাজামায় কে যেন আবীরের রং পিচকারি দিয়ে ছড়িয়ে রাঙিয়ে দিল। আমি তাকে ধরেছি বুকের কাছে, আমার মাথা তার মুখের কাছে। একসময় সে চোখ তুলে তাকাল। একটা ছোট শিশুর ন্যায় গড়গড় করে নামতা পড়ার মতো করে বলল, আমার বাড়িতে খবর দেবেন...আমার নাম আবুল বরকত...বিষ্ণুপ্রিয় ভবন, পল্টন লাইন...।
পরমুহূর্তে জবাই করা মুরগির মতো হাঁ করে জিব কাঁপিয়ে ফিসফিস করে বলল, পানি। পানি।
বাঁ হাত দিয়ে মৃদুভাবে ধরেছি তার পিঠ, ডান হাতখানা তার বুকের ওপর। সে হাতে রুমালখানা রেখেছি ধরে, যা মুখের ঘাম মোছার কারণে ভেজা আর নোংরা। ভাবলাম কী করব। জিব কাঁপছে অনবরত খোলা মুখের ভেতর। একটু ইতস্তত করলাম। মনে দ্বিধা, এক ধরনের অপরাধ বোধ। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। জিবটা বারবার নড়ছে। পরমুহূর্তেই নিংড়িয়ে দিলাম হাতের রুমাল।
শহীদ বরকতের অমর স্মৃতিমাখা সেই রুমালসহ আমার জেলজীবনের সবকিছুই বাক্সবন্দী অবস্থায় ওই রুম থেকে চুরি হয়, যা আমার জীবনে অনেক বড় ক্ষতি করেছে। চোরেরা পরে হয়তো সবই ফেলে দিয়েছে। কারণ, এসবে তার কোনো কাজেই আসবে না। নেওয়ার সময় হয়তো ভেবেছিল, অনেক দামি কিছু আছে।
প্রসঙ্গত, একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনা নিয়ে আমি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’ বলে একটি গল্প লিখি। এবং সেই সংকলনে ‘রক্তাক্ত একুশে’ নামে একটি লিনোকাটও করেছিলাম। একটি কবিতাও লিখেছিলাম ‘পারবো না’ এই শিরোনামে, যা ছাপা হয়েছিল সেই বছরই কলকাতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায়।

মুর্তজা বশীর: শিল্পী, সাহিত্যিক, গবেষক। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সৃজনে নবযাত্রার প্রয়াস by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

ফ্রেমের সামনে দাঁড়াতেই দর্পণে নিজের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। কাচের গায়ে কাচ জোড়া দিয়ে কাজী রকিব তৈরি করেন স্থাপনাশিল্পের আদলে শিল্পকর্ম। বর্গাকৃতির কাচের গায়ে আঁচড় কেটে তৈরি করেছেন বৃষ্টির অবয়ব। প্রথাগত রং লেপনের প্রক্রিয়ার বাইরে নতুন শিল্পভাষা নির্মাণ আমাদের শিল্পে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।

শিল্পচর্চায় নিবিড় মনোযোগী হয়ে কাজ করছেন এবং সৃষ্টিকর্মে বৈচিত্র্যপূর্ণ নিরীক্ষায় সফল যাঁরা, তাঁদের কাজের অষ্টম আয়োজন সৃজনে ও শেকড়ে শুরু হয়েছে গত ৪ জানুয়ারি বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে। ১০ জন শিল্পীর ৪০টি শিল্পকর্ম নিয়ে স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
সত্তর এবং আশির দশকের শিল্পীদের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে নব্বই ও শূন্য দশকের শিল্পীদের এ প্রদর্শনীতে। আমাদের সমৃদ্ধ লোকঐতিহ্য, প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষী জীবনযাত্রার নানা ঘটনাপ্রবাহকে বিষয় করে শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। প্রদর্শনীর জ্যেষ্ঠ শিল্পী মোহাম্মদ মোহসীন চারটি অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা বিমূর্ত ছবিতে প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মনোমুগ্ধকর রঙের উপস্থাপন করেছেন। শীতের ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালকে নীল ও সবুজাভ নীলের ব্যবহারে প্রকৃতির বিমূর্ততা প্রকাশ করেছেন ‘ইমেজ অব উইন্টার মরনিং’ ছবিতে। মোমিনুল ইসলাম রেজা ক্যানভাসে স্পর্শকাতর তিনটি রঙের ব্যবহার করেছেন। সবুজ, লাল ও নীল এই তিনের ব্যবহার রঙের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এনেছে। লাল জমিনে কালো চতুর্ভুজের উপস্থাপন সবুজের মাঝে অপেক্ষাকৃত কম লালের ব্যবহার দৃষ্টিকে বন্দী করে এক কেন্দ্রে। প্রথাবিরুদ্ধ সৌন্দর্য নির্মাণ মোমিনুলের কাজের বৈশিষ্ট্য। কাগজের গায়ে খোদাই চিত্রের আদল তৈরি, বিন্দুর পাশে বিন্দুর গড়ন মোহাম্মদ ফকরুল ইসলামের শিল্পভাষা। নতুন ভাবনা ও কৌশলকে প্রয়োগ করে নিবিড়ভাবে সৃষ্টি করেন শিল্পকর্ম। সেপিয়া ও ধূসর কালো রঙের কাগজের গায়ে তেল প্রয়োগের পর সুচালো উপকরণের সাহায্যে বিন্দু সৃষ্টি করে কখনো বৃত্তাকার, চৌকোনা, বর্গাকৃতির ক্যানভাস সৃষ্টি করেন শিল্পী। প্রদর্শনীর সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী মাকসুদা ইকবাল। মৌলিক রঙের ওপর স্তরে স্তরে রঙ চড়িয়ে বুনট সৃষ্টি করেছেন ‘সারফেস’ শিরোনামের ক্যানভাসগুলোতে। যা প্রকৃতিতে ছড়ানো রঙের বিন্যাসকে ব্যক্ত করে। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া ১০ জন শিল্পী মোহাম্মদ মোহসীন, ইফফাত আরা দেওয়ান, মোমিনুল ইসলাম রেজা, কাজী রকিব, ফারেছা জেবা, মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম, লায়লা শারমিন, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, আনিসুজ্জামান, মাকসুদা ইকবাল নীপা। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি।

কারাগারের কবিতা

বিদের যদি স্তব্ধ করে দেওয়া যায় লাখ লাখ মানুষ স্তব্ধ হয়ে যাবে, লাখ লাখ মানুষ হারাবে কণ্ঠস্বর। জেল-জুলুমেও স্তব্ধ করা যায়নি এমন চারজন কবির কারাগারে রচিত কবিতা অনুবাদ করেছেন আন্দালিব রাশদী

নাজিম হিকমেত
আমন্ত্রণ


দূর এশিয়া থেকে লাফিয়ে এসে
ঘোটকীর মাথার মতো বেরিয়ে এসেছে
ভূমধ্যসাগরের দিকে—সে আমাদের দেশ।

কবজি রক্তস্নাত, দাঁত কপাটিলাগা, খালি পা
এ মাটি রেশমের কার্পেটের মতো ছড়িয়ে আছে
এই নরকই স্বর্গ আমাদের।

ধনিকতন্ত্রের দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, আর খুলতে দিয়ো না
মানুষের কাছে, মানুষের দাসত্ব নিশ্চিহ্ন করে দাও
এই আমন্ত্রণটি আমাদের।

বৃক্ষের মতো এককভাবে বাঁচতে, স্বাধীনভাবে
জঙ্গলের গাছের মতো ভ্রাতৃভাব নিয়ে
এই প্রত্যাশাটি আমাদের।

[নাজিম হিকমেত তুরস্কের কবি, অত্যাচার ও দারিদ্র্যের কবি, গ্রেপ্তার ও নির্বাসনের কবি। বছরের পর বছর অন্তরীণ ছিলেন। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৬৩ সালে মস্কোতে মৃতুবরণ করেন।]

সামিহ আল-কাসিম
কারা-কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা শেষ


আমার ছোট্ট কারা-প্রকোষ্ঠের সরু জানালা দিয়ে
আমি গাছ দেখি—আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে
আর ছাদের ওপর আমার পরিবারের লোকজনের ভিড়
জানালাগুলো আমার জন্য কাঁদছে, প্রার্থনা করছে
আমার ছোট্ট কারা-প্রকোষ্ঠের সরু জানালা দিয়ে
আমি তোমার বড় কারা-প্রকোষ্ঠ দেখতে পাচ্ছি।

[সামিহ আল-কাসিম ১৯৫০ দশকের ফিলিস্তিনি ‘প্রতিরোধের কবি’। বহুবার জেল খেটেছেন।]

হাবিব জালিব
প্রতিরোধের অধিকার


যে বাতি কেবল প্রাসাদেই জ্বলে
হাতেগোনা পছন্দের কজনের সেবায়
যে আলো কেবল তাদের লাভটুকু রক্ষা করে
এমন একটা নিয়ম, আলোহীন ভোর
আমি কবুল করতে অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না।
সিংহাসনে যারা আছে, আমি তাদের দেখে সন্ত্রস্ত নই
আমিও বিজয়ী, শহীদ, শত্রুদের বলে এসো
কারাদেয়ালের ভেতর আমাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছ কেন?

এমন নিপীড়ন, হূদয়ের অন্ধকারের মতো
আমি অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না
শাখায় শাখায় ফুল ফুটছে, তুমি তাই বলছ
সুরাপায়ীর পাত্র উপচে পড়ছে, তুমি তাই বলছ
বুকের ক্ষতগুলো নিজেরাই সারা যাচ্ছে, তুমি তা-ই বলছ
এসব খোলা মুখ মিথ্যে, আত্মার এই অপমান
আমি কবুল করতে অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না।

শতকের পর শতক আমাদের শান্তি হরণ করছ
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আমাদের আর বোকা বানাবে না
যেন তুমি ওসব ক্ষতের আরোগ্যকারীর ভান করছ?
তুমি আরোগ্যকারী নও, যদি কেউ তোমাকে মানে মানুক
আমি কবুল করতে অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না।

[পাকিস্তানি বিপ্লবী কবি হাবিব জালিবের জীবন কেটেছে কারাগারে আশ্রয়হীন অবস্থায় খোলা রাস্তায়। ১৯৮৮ সালে তিনি কারামুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন, সরকার শেষকৃত্যে সহায়তা করতে এগিয়ে আসলেও কিন্তু তার পরিবার থেকে সরকারি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা হয়।]

ফাজিল আল-আজ্জাবি
আমার অবসর সময়ে


আমার দীর্ঘ বিরক্তিকর অবসর সময়
আমি পৃথিবী বৃত্ত নিয়ে খেলতে বসে যাই
পুলিশ কিংবা দলবল ছাড়া আমি রাষ্ট্র গড়ি
যা কিছু মানুষের ভালো লাগে না, আমি ভেঙে ফেলি
শূন্য মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমি গর্জে ওঠা নদী বইয়ে দিই
আমি মহাদেশ ও মহাসাগর সৃষ্টি করি
যদি দরকার হয়, ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখি
আমি জাতিসমূহের নতুন মানচিত্র তৈরি করি।

হাঙরভরা প্রশান্ত মহাসাগরে জার্মানিকে গড়িয়ে দিই
দরিদ্র শরণার্থীরা জলদস্যুর জাহাজ পৌঁছে যাক উপকূলে, কুয়াশায়
বাভারিয়ার প্রতিশ্রুত বাগানের স্বপ্ন দেখতে দেখতে
আমি আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ডকে জায়গা অদল-বদল করে দিই
যাতে মহামাননীয়া রানির সৌজন্যে তরুণেরা হাসিস ফুঁকতে পারে
কুয়েতকে বেড়া ও মাইনপোঁতা সীমান্ত থেকে উঠিয়ে
চন্দ্রগ্রহণের দ্বীপ কমোরোতে পাচার করি
অবশ্যই তেলক্ষেত্রগুলো অক্ষত রাখি
একই সময় প্রচণ্ড ড্রামবাদ্য বাদনের মাঝখানে তেহরানকে
পাঠিয়ে দিই তাহিতি দ্বীপপুঞ্জে।
সৌদি আরবকে তার মরুভূমিতে গুটিসুটি মেরে থাকতে দিই
সেখানে অসংকর উটের বিশুদ্ধতা রক্ষা করুক
আর আমি আমেরিকাকে সমর্পণ করি ইন্ডিয়ানদের কাছে
ইতিহাসকে কেবল দিতে
এত দিনের না পাওয়া ন্যায়বিচার
আমি জানি, পৃথিবীটা বদলানো সহজ কাজ নয়
তবুও কাজটা করা যে খুব জরুরি।

[ফাজিল আল-আজ্জাবি তুর্কি কবি, জন্ম ১৯৪০ সালে, জীবন কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে। তাঁর কবিতায় একটি কাল্পনিক ভূগোলক স্পষ্ট। ইউরোপ তাঁর কাছে সাম্রাজ্যবাদী অমানবিক মহাদেশ।]

বিচিত্রতার আনন্দ by শাশ্বতী মজুমদার

বাংলাদেশের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন দেশের শিল্প সম্পর্কে জানার সুযোগ কম। এ কারণে গত বছর মার্চ ২০১০ থেকে স্লেড স্কুল অব ফাইন আর্ট, ইউসিএল লন্ডন ও চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার মধ্যে তিন বছরমেয়াদি একটি শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচির সূচনা হয়।

এ কর্মসূচির প্রধান বিষয় শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসূচি সংক্রান্ত আদান-প্রদান ও ভৌগোলিকভাবে দুই অবস্থান থেকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন। এই শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজি পার্টনারশিপস ইন রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন (আইএনএসপিআইআরই) প্রকল্পের সাহচর্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ থেকে স্লেড প্রফেসর ও বিশ্বখ্যাত ভাস্কর জন এইকেনের পরিচালনায় ‘সেপিং দ্য স্পেস বিটুইন’ শিরোনামে পাঁচ দিনের একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় চারুকলা অনুষদের সাতটি বিভাগের ১২ জন ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে এবং ১৪ জন শিক্ষক পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত থাকেন, কর্মশালার সৃষ্ট শিল্পকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি।
চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের তৃতীয় তলায় এই প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। অনুষ্ঠানে সচিত্র উপস্থাপনার মাধ্যমে শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থীকে সনদপত্র বিতরণ করা হয়।
কর্মশালায় জন এইকেন মূলত শিক্ষার্থীদের ড্রইং কম্পোজিশন, বস্তুর আকার ও পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ধারণা দেন। ভাস্কর্য যে স্থানে বসবে, সেই স্পেসের ব্যবহার ও সে অনুযায়ী ফর্ম তৈরির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেন। প্রদর্শনীতে শিক্ষার্থীরা মূলত একটি গোলাকার স্পেসকে ব্যবহার করে চার কোণের বেশি ফর্ম তৈরি করেন। ফর্ম তৈরিতে তারা কাঠ, কার্ডবোর্ড ও কাগজ ব্যবহার করেন। রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ছিলেন স্বাধীন।
এ শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচির লিড পার্টনার হিসেবে ভাস্কর্য বিভাগের লালা রুখ সেলিম দায়িত্ব পালন করছেন।

দুই ময়নাতদন্তের অমিল খতিয়ে দেখার নির্দেশ

রীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের কিশোরী হেনার মৃতদেহের দুটি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অমিল খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত কমিটিকে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে ভবিষ্যতে ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে ভুল এড়াতে সুপারিশসহ ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আর যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নজরদারি রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হেনার পরিবারের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার ও নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালতের নির্দেশে গতকাল হাইকোর্টে হাজির হন হেনার বাবা দরবেশ খাঁ ও খালাতো বোন মিনু বেগম। হাজির হন শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন গোলাম সারোয়ার, সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা নির্মল চন্দ্র দাস, চিকিৎসা কর্মকর্তা রাজেশ মজুমদার, গাইনি বিশেষজ্ঞ হোসনে আরা, চিকিৎসক সুলতান আহমেদ, নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের, উপপরিদর্শক মো. আসলাম উদ্দিন ও সালিস বৈঠকে নেতৃত্ব দেওয়া ইদ্রিস ফকির। আদালত তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণের পর নির্দেশসহ আদেশ দেন।
শুনানিকালে আদালত বলেন, ফতোয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ। দেশে ফতোয়া চলবে না। চিকিৎসকদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনারা একটা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন।’ এ ধরনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে—এমন মন্তব্য করে আদালত বলেন, গ্রামে-গঞ্জে এ ধরনের মিথ্যা, ভুয়া পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপর একটি মামলার বিচার নির্ভর করে। এ ধরনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হলে প্রকৃত আসামিরা পার পেয়ে যাবে, সাজা হবে না। আদালত বলেন, ‘আপনারা যে রিপোর্ট দাখিল করেছেন, তা পুরোপুরি মিথ্যা। পুনরায় ময়নাতদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে শরীয়তপুরের চিকিৎসকদের রিপোর্টের ব্যবধান আকাশ আর জমিনের।’
আদালতের আদেশ: হেনার ঘটনায় যাঁরা ফতোয়া দিয়েছেন ও দোররা মেরেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের এবং মামলার অন্য আসামিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হেনার সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী নড়িয়ার উপপরিদর্শক আসলাম উদ্দিন ও এজাহার নথিভুক্তকারী পরিদর্শক (তদন্ত) মির্জা এ কে আজাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়।
এ ছাড়া উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের পরিচালক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্রতিনিধিসহ আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি রাখার কথা বলা হয়েছে। আর ফতোয়ার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে ফতোয়া দেওয়া যে অপরাধ, তা তুলে ধরে প্রচার চালাতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মসজিদ, মাদ্রাসাসহ স্থানীয় পর্যায়ে ফতোয়াবিরোধী প্রচার চালানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে ধর্ম ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।
আদালত ইদ্রিস ফকিরকে গ্রেপ্তারের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বক্তব্য উপস্থাপন: সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আদালতে হাজির হন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শুনানি হয়। শুনানিতে নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তাঁরা।
শুরুতে আদালত সিভিল সার্জনকে দ্বিতীয় দফায় করা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পড়তে বলেন। গোলাম সারোয়ার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে উল্লেখ করলে আদালত বলেন, ‘আপনারা হেনার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাননি। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করা পুনঃ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে একাধিক আঘাতের চিহ্ন উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কীভাবে হলো? হেনার শরীরের আঘাতগুলো (ইনজুরি) কেন আপনারা শনাক্ত করতে পারলেন না?’
সিভিল সার্জন বলেন, দুটি টিমের ডাক্তারদের মধ্যে অভিজ্ঞতার তফাত রয়েছে।
এটা কি আপনার ব্যাখ্যা? হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কত সময় পর হেনার মৃত্যু হয়েছে?
—২৫ জানুয়ারি হেনা হাসপাতালে ভর্তি হয়। ৩০ জানুয়ারি সকাল ১০টায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। যখন ছাড়া পায়, তখন হেনা পুরোপুরি সুস্থ ছিল। কিন্তু হেনা মৃত্যুবরণ করে ৩১ তারিখ রাত নয়টায়। ফলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার এবং মৃত্যুর মাঝে ব্যবধান ছিল ৪৮ ঘণ্টা। সিভিল সার্জন সময় ভুল বলায় তা শুধরে দিয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ৩৪ ঘণ্টা ব্যবধান ছিল।
আদালত সিভিল সার্জনের উদ্দেশে বলেন, তাহলে ভূত এসে মেয়েটিকে (হেনা) মেরে দিল? আদালত সিভিল সার্জনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আদালতের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করলে আপনাকে জেলে পাঠানো হবে। সত্য বললে অনুকম্পা পেতে পারেন।’ আদালত জানতে চান, কে কে ময়নাতদন্ত করেছেন?
সিভিল সার্জন অন্য তিন চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করেন।
—আবাসিক চিকিৎসক (মেডিসিন) ও শিশু বিশেষজ্ঞ কি যোগ্য?
—জেলা পর্যায়ে তাঁরাই ময়নাতদন্ত করে থাকেন।
এ পর্যায়ে প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনটি পড়তে বলেন আদালত।
—একটি আঘাতের চিহ্ন ছিল।
ঢাকায় করা দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে এর ভিন্নতা সম্পর্কে মতামত দেন।
—দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
দুটি সত্য হতে পারে না। একটি সত্য হলে অন্যটি মিথ্যা হবে। শরীয়তপুরের প্রতিবেদনে ইনজুরি নেই, ঢাকার প্রতিবেদনে ইনজুরি আছে। কত দিন পেশায় আছেন?
—৩১ বছর।
আকাশ-জমিন পার্থক্য হলো কেন? মতামত দেন। সম্পূর্ণ অমিলের কারণ কী? সত্য বলেন। সত্য না বললে কাউকে ছাড়া হবে না।
সিভিল সার্জন চুপ করে থাকেন।
আদালত অপর চিকিৎসকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের একটা বিষয় আছে।
মারা গেল কীভাবে?
—সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে তাকে (হেনা) ৩০ জানুয়ারি ছাড়া হয়।
হাসপাতাল ত্যাগের সঙ্গে মারা যাওয়ার সময়ের ব্যবধান কত সময়?
—৪৮ ঘণ্টার মতো।
পৌনে একটার দিকে হেনার ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম। তিনি বলেন, ‘বলা হয়েছে, দাগ না থাকলে আমরা কী করব—বলে সিভিল সার্জন মন্তব্য করেন কীভাবে!’ এ বিষয়ে আদালত সিভিল সার্জনকে বক্তব্য রাখতে বলেন। সিভিল সার্জন বলেন, ‘এটা আমি বলিনি।’ আদালত মন্তব্য করেন, সাংবাদিকেরা মিথ্যা, ভুল তথ্য দেন না। সাংবাদিকেরা যা বলেছেন, তা সত্য হয়েছে। আপনারা যা বলেছেন তা মিথ্যা, ভুল। আদালত জানতে চান, ৩৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু কীভাবে হলো, এটা কি স্বাভাবিক? সিভিল সার্জন বলেন, এটা আনন্যাচারাল (অস্বাভাবিক)।
অপর চিকিৎসক হোসনে আরার কাছে প্রতিবেদনের অমিল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুটিতে কোনো মিল নেই। আদালত জানতে চান, কার চাপে ছিলেন? হোসনে আরা বলেন, ‘আমি চিকিৎসায় ছিলাম না।’
সোয়া একটার দিকে আদালত হেনার বোন মিনু বেগমের বক্তব্য শুনতে চান।
আপনি কি হেনার সঙ্গে হাসপাতালে ছিলেন?
মিনু বলেন, ছয় দিন ছিলাম।
হাসপাতাল ছাড়ার সময় হেনা সুস্থ ছিল কি?
অল্প সুস্থ ছিল। ধরে ধরে নিয়ে যেতে হয়, হাঁটতে পারছিল না। বাড়িতে নেওয়ার পর বিছানায় পড়ে ছিল। রুহুল খান (আসামি মাহাবুবের বাবা) নাম কেটে (হাসপাতাল থেকে) দেওয়ার জন্য বলেছে। ডাক্তাররা ভালো করে চিকিৎসা করেনি।
ডাক্তারদের বলেছিলেন?
—সে পুরো সুস্থ হয়নি।
এরপর আদালত উপপরিদর্শক আসলামকে সুরতহাল প্রতিবেদন পাঠ করতে বলেন। আসলাম সুরতহাল প্রতিবেদন পাঠ করেন। আদালত বলেন, সিআরপিসির ১৭৪ ধারায় সুরতহাল প্রতিবেদনের কথা বলা রয়েছে। কিন্তু আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় কি বলা রয়েছে কার সঙ্গে প্রেম ছিল এটা সুরতহাল প্রতিবেদনে আসবে? মাহাবুবের সঙ্গে হেনার প্রেম ছিল, এটা সুরতহাল প্রতিবেদনে কেন লিখেছেন? লাশের শরীরে কোনো ইনজুরি আছে কি না, সেটা বের করার দায়িত্ব আপনার। আপনি তদন্ত না সুরতহাল প্রতিবেদন করতে গেছেন, সত্য কথা বলেন। আসলাম বলেন, মিথ্যা বলিনি। আদালত প্রশ্ন করেন, কাকে বাঁচানোর জন্য এটা করেছেন? তিনি নিশ্চুপ থাকেন।
এরপর আদালত স্থানীয় ইউপি মেম্বার ইদ্রিস ফকিরকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ডাকেন। আদালত বলেন, সংবাদপত্রে প্রতিবেদন বেরিয়েছে, আপনি এ মৃত্যুর ঘটনাটি টাকার মাধ্যমে আপসরফা করতে চেয়েছিলেন।
ইদ্রিস বলেন, ‘আমি হেনার চিকিৎসার জন্য তার পিতা দরবেশ খাঁকে ২০-৫০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য মাহাবুবের পিতাকে বলেছিলাম। কোনো আপসের প্রস্তাব দেইনি।’
এই পর্যায়ে আদালত হেনার পরিবারের সদস্যদের ডাকেন। হেনার পিতা দরবেশ খাঁ ইদ্রিস ফকিরকে দেখিয়ে বলেন, ‘তিনি হেনার মৃত্যুর ঘটনাটি সাড়ে তিন লাখ টাকায় আপসরফার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমি থানায় গিয়ে এজাহার দায়ের করেছি।’
আদালত বলেন, ‘আপনি কি নিজ হাতে এজাহার লিখেছেন?’
—আমি মুখে ঘটনা বলেছি, থানার লোক সেটা লিখেছে।
এজাহার আপনাকে পড়ে শোনানো হয়েছে?
—না। আমি লেখাপড়া না জানায় শুধু টিপসই দিয়েছি।
আদালত নড়িয়া থানার ওসির কাছে জানতে চান, দরবেশ খাঁকে কেন এজাহার পড়ে শোনানো হয়নি? এজাহারে ধর্ষণ-সম্পর্কিত কোনো তথ্যও নেই। ওসি বলেন, ‘আমি ওই দিন থানায় দায়িত্বে ছিলাম না। দায়িত্বে ছিলেন পরিদর্শক এ কে আজাদ। তবে ইদ্রিস ফকির সালিসে জড়িত ছিলেন।’
এ পর্যায়ে দরবেশ খাঁ বলেন, ‘আমি থানায় বলেছি আমার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ওই মেম্বার (ইদ্রিস ফকির) বলে, মেয়েকে ১০১টা ও ছেলেকে ২০১টা মার। মারা যাওয়ার আগে মিটমাট করার কথা বলে মেম্বার টাকা দিতে চায় সাড়ে তিন লাখ।’
আদালত বলেন, ‘সাত লাখ টাকা মেম্বার আপনাকে দিতে চেয়েছেন না?’ দরবেশ বলেন, না, সাড়ে তিন লাখ।
এ পর্যায়ে আদালত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, সুরতহাল রিপোর্টে প্রেমের কাহিনি আইন অনুসারে আসে কি না?
—না।
কেন ইদ্রিসকে গ্রেপ্তার করা হয়নি?
—খুঁজে পাইনি। ঢাকায়ও চেষ্টা করা হয়েছে। এফআইআরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন-সংক্রান্ত আইনের ৯ ধারা কেন উল্লেখ করা হয়নি?
—উনি (দরবেশ খাঁ) যা বলেছেন, তা লেখা হয়েছে।
উনি (দরবেশ) বলেছেন, তাঁকে পড়ে শোনানো হয়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কে?
—প্রথমে আসলাম দেখেছেন। এখন এ কে আজাদকে তদন্ত কর্মকর্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা অনেকটা শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার মতো। এরপর আদালত আদেশ দেন।
প্রসঙ্গত, ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে ‘মেয়েটির জন্য কারও মায়া হলো না!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দিন প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি সীমা জহুর। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেন। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি আদালত দোররা মারার পর নিহত শরীয়তপুরের হেনা আক্তারের লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করতে নির্দেশ দেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে তা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের মাধ্যমে আদালতে জমা দেওয়া হয়।
আমাদের শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, মামলার প্রধান আসামি মাহাবুবকে গতকাল শরীয়তপুর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এরই মধ্যে মামলাটি সিআইডিতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান মাহাবুবের সাত দিনের রিমান্ড চান। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম অশোক কুমার দত্ত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
হেনা হত্যা মামলাটি পরিচালনার জন্য স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছে। সংস্থাটি মামলার যাবতীয় ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির শরীয়তপুর জেলা সমন্বয়কারী আবদুল আউয়াল বলেন, ‘মামলাটি সরকারপক্ষ পরিচালনা করবে। কোনো গাফিলতি যাতে না থাকে, সে জন্য এ হত্যা মামলাটি পরিচালনা করার জন্য আমরা একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছি।’
সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান জানান, মাহাবুবকে সিআইডির হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে।

বেনজিরকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন মোশাররফ

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বেনজির ভুট্টোকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন। তালেবানের এ ষড়যন্ত্রের কথা আগেভাগে জেনেও বিষয়টি তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানাননি। বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে গঠিত একটি দল এ তথ্য জানিয়েছে।

জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম (জেআইটি) নামের এ দলটি তদন্তে দেখতে পেয়েছে, বেনজিরকে হত্যার মূল পরিকল্পনা করেন পাকিস্তানভিত্তিক তেহরিক-ই-তালেবানের প্রধান বায়তুল্লাহ মেহসুদ। এ পরিকল্পনার কথা কানে আসে পারভেজ মোশাররফের। কিন্তু তিনি বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে গোপন রেখেছিলেন।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন ও ডন নিউজ টেলিভিশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফআইএ) চলতি সপ্তাহে রাওয়ালপিন্ডির সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে (এটিসি) এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। জেআইটির প্রধান খালিদ কুরেশি এ প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। এ প্রতিবেদনে মোশাররফের বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে এক নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ শেষে মোটর শোভাযাত্রা করে সমাবেশস্থল ত্যাগের প্রাক্কালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর কিছু আগে একজন বন্দুকধারী বেনজির ভুট্টোর দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল, তালেবান এ হামলা চালিয়ে বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করেছে। তবে চিকিৎসকেরা বলেছেন, ঘটনার সময় গাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেনজির। হামলার সময় গাড়ির ছাদের সঙ্গে মাথায় প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
জেআইটি তদন্তের সময় অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জাভেদ ইকবাল চিমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ঘটনার সময় তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সেলের দায়িত্বে ছিলেন।
জাভেদ ইকবাল চিমা বলেছেন, বেনজির হত্যাকাণ্ডের একদিন পর অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট মোশাররফের নির্দেশে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। পাঞ্জাব প্রদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এ সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছিল।
এফআইএ কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই সংবাদ সম্মেলনে চিমার দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে গোয়েন্দা ব্যুরোর প্রধান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আইজাজ শাহর বিবৃতির মিল রয়েছে। জেআইটি মনে করে, পুলিশের তদন্তকাজে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে মোশাররফ তড়িঘড়ি করে ওই সংবাদ সম্মেলনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এফআইএ বলেছে, বেনজির ভুট্টোর নিরাপত্তায় যেসব পুলিশ কর্মকর্তা নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো পদক্ষেপ নেননি মোশাররফ।
বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় মোশাররফের নাম রয়েছে। রাওয়ালপিন্ডির সাবেক প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা সাউদ আজিজের এক বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মোশাররফের নাম অভিযুক্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সাউদ আজিজ দাবি করেন, বেনজির ভুট্টোর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছিলেন মোশাররফ। এমনকি হামলার ঘটনাস্থল তাৎক্ষণিকভাবে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করারও নির্দেশ দেন তিনি।
১৯৯৯ সালে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন মোশাররফ। টানা নয় বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৮ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর থেকেই তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। ডন।

সরকারের কর্মকাণ্ডে দল ও মহাজোটে অস্বস্তি

রকারের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দল ও জোটে ক্ষোভ বাড়ছে। মহাজোটের শরিক দলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-সাংসদেরাও এখন সরকারের ব্যর্থতার কথা বলছেন। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, শেয়ারবাজারে ধস ও রাস্তাঘাটের দুরবস্থা নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন মহাজোটের সাংসদেরা। এলাকায় গেলে তাঁরা জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়ছেন বলে জানিয়েছেন।

মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যেই হতাশা প্রকাশ করছেন। অপর দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাজে সমন্বয় না থাকায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হচ্ছে। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ী-মন্ত্রীরা থাকায় সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
যোগাযোগ করা হলে সরকারি দলের সাংসদ ফজলে রাব্বী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চাল-ডাল-তেলের দাম এক বছরে কয়েক দফা বেড়েছে। এগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় গেলে কথা শুনতে হয়।
সরকারি দলের আরেকজন সাংসদ ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। চাল-ডালের দাম ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারকে এখনই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একই দলের ইসরাফিল আলম বলেন, চালের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। এলাকায় গেলে মানুষ এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন করে।
এ ছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক সাংসদ বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অসহনীয় বিদ্যুৎ-সংকট, শেয়ারবাজারে দরপতন সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়েছে। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হবিগঞ্জের উপনির্বাচনে পরাজয় এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পৌরসভা নির্বাচনের ফলও সরকারি দল খুব একটা ভালো করেনি। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
একজন সাংসদ বলেন, সাংসদদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মাসে অন্তত একবার বৈঠক করা উচিত। তাহলে মাঠের পুরো খবরটা তিনি জানতে পারবেন। বিভিন্ন সংস্থা থেকে আসা তথ্যের সঙ্গে তা মেলাতে পারবেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ বন্ধ থাকায় সারা দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
স্পিকার আবদুল হামিদ শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার আগে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ আছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ল না কমল, তা গ্রামের সাধারণ মানুষের বিবেচনায় থাকার কথা নয়। তিনি বলেন, রাস্তাঘাট ভাঙাচোরার বিষয়ে তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে টেবিল চাপড়ে সমর্থন করেছেন সাংসদেরা। জনগণের যেকোনো ভোগান্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত থাকার পরও দ্রব্যমূল্য সহনশীল রাখার কার্যকর পন্থা উদ্ভাবন করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ-সংকট নিরসনে দেরিতে পদক্ষেপ নেওয়ায় ভবিষ্যতে এ সমস্যার সমাধান হবে—এমনটা বিশ্বাস করতে পারছে না জনগণ। একইভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাও রোধ করা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতারা মনে করেন, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতানুগতিক। গত দুই বছরে চোখে পড়ার মতো কোনো উন্নয়ন সরকার দেখাতে পারেনি। অনেক পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কম। তাঁদের মতে, সরকারের ভুল সংশোধন করে ব্যর্থতা কাটিয়ে আগামী দিনে পথ চলা উচিত। এটাই গণতান্ত্রিক সরকারের ধর্ম।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, মহাজোটের শরিকদের রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ঐক্যবিরোধী একলা চলার নীতি প্রাধান্য পেয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা ও সাংসদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজনৈতিক সরকার দরকার। আমলাতান্ত্রিক সরকার দিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তা ছাড়া সরকারের সঙ্গে দল ও জোটের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
তবে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মনে করেন, জোট ও দলের মধ্যে ক্ষুব্ধ অংশটি সরকারের ব্যর্থতার কথা প্রচার করছে। সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।
স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দলের সদস্যদের মনেও অনেক ক্ষোভের কথা রয়েছে। কিন্তু তাঁরা তা বলতে পারছেন না। এলাকায় গেলে সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই চাল-ডালের দাম বাড়ার কারণে কষ্টের কথা তাঁদের বলেন। তিনি বলেন, সরকার বিরোধী দলকে আশ্বাস দিচ্ছে যে, সংসদে এলে সব কথা বলার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু এখন সরকারি দলই সে সুযোগ পাচ্ছে না।