Monday, January 24, 2011

অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা অসম্ভব নয় by উম্মে কুলসুম কলি

শিশুর গা গরম হলে আমরা বলি জ্বর হয়েছে, থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখে জ্বরের মাত্রা বুঝতে পারি। গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় টাইফয়েড, সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা নাকি অন্যকিছু। ঠিক তেমনি শিশুর বিভিন্ন রকম আচরণ দেখে তার মানসিক রোগ, রোগের মাত্রা শনাক্ত করা হয়।

আচরণই মানসিক রোগ নির্ণয়ের নির্দেশক। হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, অসংখ্য শিশুর মা-বাবা উদগ্রীব হয়ে আসেন শিশুদের মানসিক সমস্যা নিয়ে। শিশুর শারীরিক জটিল সমস্যা হলে কেউ লজ্জাবোধ করে না। কিন্তু মানসিক কোন সমস্যা হলেই লজ্জা-ভয়ে সব কিছু লুকানোর চেষ্টা শুরু করে দেয়। লোকে কি বলবে, নিজের দুর্ভাগ্য, পাপের ফল মনে করে গোপনে প্রার্থনা করে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা এবং এক সময় অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দিয়ে 'গিফটেড চাইল্ড' বা 'স্পেশাল বেবী' ইত্যাদি নামে অভিভাবকরা সান্তু্বনা পেয়ে আসছেন। শুধু আমাদের দেশেই নয় আমেরিকা-ইউরোপ-ইংল্যান্ডের মত উন্নত বিশ্বেও দেখা গেছে একই চিত্র। অথচ শিশুর মানসিক সব ধরনের সমস্যাই নতুন গবেষণাপ্রসূত মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব, এ তথ্যটি আমরা অনেকেই জানি না।

অটিস্টিক শিশুর লক্ষণ সমূহ :এই শিশুরা সাধারণত: দেখতে সুন্দর ও স্বাভাবিক হয়। এরা কারো চোখে চোখে তাকাতে পারে না (আই কন্টাক্ট করে না)। এদের নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। সার্বক্ষণিক অন্যমনস্ক থাকে। একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে । নিজের হাত, হাতের আঙ্গুল নিয়ে নিবিষ্ট মনে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাড়াচাড়া করে। সমবয়সী বা ছোট-বড় কারো সাথে এরা মিশতে পারে না। কোন মানুষের প্রতি এরা আকর্ষণ বোধ করে না। অর্থহীন বস্তুর প্রতি এরা বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অনেকে মা-বাবাকে চিনতে পারে না।

এদের অনেকেই কথা বলতে পারে আবার কেউ কথা বলতে পারে না। প্রশিক্ষণ দিলে তারা যান্ত্রিকভাবে রোবটের মত করে কিছু কথা বলে। এরা একই কথা বা অর্থহীন শব্দ বারবার বলে, বলতেই থাকে। আবেগশূন্য এই শিশু সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। এদের মনোযোগ ও ধৈর্য মোটেই থাকে না বা খুব কম থাকে। এদের খেলা অথবা খেলনার প্রতি কোনই আগ্রহ থাকে না। অনেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু একটা সার্বক্ষণিক হাতে ধরে রাখে এবং তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এরা টিভি বিজ্ঞাপন, কার্টুন ও সিডির প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকে। অনেকে কোন কথা বলতে না পারলেও টিভি দেখে বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন পণ্য, পণ্যের ব্রান্ড সব মুখস্থ করে ফেলে, গান বলে।

শিশুটি অটিস্টিক নাও হতে পারে? বহুবিধ প্রতিবন্ধিতা হতে পারে:শিশুর কোন ধরনের মানসিক সমস্যা হলেই তাকে অটিস্টিক বলে শনাক্ত করা ঠিক নয়। অটিস্টিক হওয়ার জন্য রোগীর মধ্যে অটিজমের অন্তত ৩/৪টি জোরালো ও যথাযথ লক্ষণ থাকা অত্যন্ত জরুরি। অটিজম না হলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, এডিএইচডি, নিওরোটিক, সাইকোটিক ও স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি অন্য কোন মানসিক রোগ হতে পারে। এই রোগীদের রোগ নির্ণয় খুবই কঠিন ও জটিল বিষয়। মনে রাখত হবে, ডায়াগনোসিসে ভুল হলে সমগ্র ম্যানেজমেন্ট বা চিকিৎসায় ভুল হতে পারে। যা রোগীর জন্য আজীবন ক্ষতির কারণ হতে পারে।

শিক্ষণে অপারগতা :অটিজম আক্রান্ত শিশু স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে অথবা স্বল্পবুদ্ধিও হতে পারে। তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা থাকলে তাকে কোন কিছু শেখানো খুবই কঠিন। অনেক সময় দিয়ে, কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে শেখালেও তারা বারবার দেখে ও শুনে তেমন কিছু শিখতে বা মনে রাখতে পারে না। ফলে মা-বাবা হতাশ হয়ে পড়েন। অনেক যত্ন নিয়ে প্রশিক্ষণ দিলে এরা খুব সামান্য বিষয়ই শিখতে পারে। নিজস্ব ব্যক্তিগত কাজ শেখাতেই এদের পিছনে বেশ কয়েক বছর বা আরো বেশি সময় ব্যয় করতে হয়, এদের সব কাজ অন্যদের করে দিতে হয়। চিকিৎসাহীন এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রোগীরা সাধারণত পরনির্ভরশীল জীবনযাপন করে থাকে।

বুঝবো কি করে আমার শিশু মানসিকভাবে সুস্থ কিনা:একটি শিশুর মধ্যে একাধিক মানসিক সমস্যা বা রোগ থাকতে পারে। নিম্নোক্ত প্রতিটি অসংলগ্ন আচরণই ভিন্ন ভিন্ন মানসিক রোগকে শনাক্ত করে। নিজেই নিজের শিশুর মানসিক রোগ সঠিকভাবে শনাক্ত করে নিন।

আচরণ সমস্যার লক্ষণসমূহ :আচরণ ও আবেগের দিক দিয়ে অপরিপক্ক, বয়সানুপাতে বুদ্ধি ও মানসিক বিকাশ যথাযথ নয়। পড়ালেখা ও স্কুল সংক্রান্ত কোন সমস্যা, পড়ালেখা করতে চায় না, পড়া মনে রাখতে পারে না। খেতে চায় না, জোর করে খাওয়াতে হয়। খাদ্য নয় এমন সব জিনিস, নোঙরা-ময়লা প্রভৃতি সবসময় মুখে দেয়। অস্থিরতা, বদমেজাজী, অতিরিক্ত জেদ, ভাংচুর করে, নিজেকে বা অন্যকে আঘাত করে, মারধর করে, কোন কিছুকে ভয় পায়, আরো অনেক রকম অস্বাভাবিক আচরণ করে। বিছানা ভিজায়, যেখানে-সেখানে প্রশ্রাব-পায়খানা করে। ঘুমের সমস্যা, নার্ভাসনেস, কোন বিষয়ে ভয় পায়, আত্মবিশ্বাসের অভাব। প্রচুর মিথ্যা বলে, যে কোন বদ-অভ্যাস, অপরাধ প্রবণতা প্রভৃতি। অকারণ হাসি-কান্না, নিজ মনে একা একা কথা বলে ইত্যাদি।

অটিজম কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য:আমার দীর্ঘ ১৬ বছরের গবেষণায় দেখা গেছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, অটিস্টিক, মানসিক রোগগ্রস্ত শিশুকে চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। আউট পেশেন্ট হিসাবে অথবা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটটে (আইসিইউ) শিশুর মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়_এ ধরনের সুবিধা সম্বলিত প্রতিষ্ঠান ঢাকায় রয়েছে, যেখানে রোগীকে কোনরূপ বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ থেকে বিরত রাখা হয়। ফলে নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি একটি করে রোগ সেরে যেতে থাকে, রোগী তার 'যোগ্যতা' অনুযায়ী নিজে নিজেই সব কাজ শিখে নিতে পারে। হাতে ধরে তাকে কোন কিছু শেখানোর প্রয়োজনই হয় না।

সমস্যা লুকিয়ে না রেখে যত কম বয়সে চিকিৎসা শুরু করা যাবে, রোগী তত দ্রুত সুস্থ হবে। তাই সময় নষ্ট না করে, 'বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে' এর জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ওষুধবিহীন ফলপ্রসূ চিকিৎসা :এই চিকিৎসা-পদ্ধতি সম্পূর্ণ পাশর্্বপ্রতিক্রিয়াহীন। কোন রকম ওষুধ ব্যবহার ছাড়াই নতুন গবেষণাপ্রসূত সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগীকে নিয়মিত বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত একাধারে চিকিৎসা দিতে হয়।

পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা শেষে রোগী সামাজিক সব ধরনের আদান-প্রদান ও যোগাযোগ করতে পারে। সব কথা বলতে পারে। বুদ্ধি মোটামুটি ভাল থাকলে নিয়মিত নরমাল স্কুলের সাধারণ নিয়মেই লেখাপড়া করতে পারবে। বুদ্ধিগত প্রকট সমস্যা থাকলে হয়তো এরা খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারবে না। তবে পরবর্তী জীবনে স্বাভাবিক মানুষের মতই বিয়ে, ঘর-সংসার করতে পারবে। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি অথবা ব্যবসা করে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

রৌদ্রছায়া:'সময়ের বয়ান' by মাকিদ হায়দার

মাদের স্কুলে নিচের ক্লাসের ক্ষিতিশ পণ্ডিত জোড়া বেত হাতে বিশুদ্ধ বাংলা, শুদ্ধ উচ্চারণ, কথন, পঠন শেখাতেন। লেখাতেনও। সেই সাথে শেখাতেন নীতিকথা। প্রাথমিক পর্যায়েই দিতেন নৈতিক শিক্ষা। নীতি কথাগুলো মনে আছে। মনে আছে মাঝে-মধ্যে ভুল উচ্চারণ এবং ভুল বাংলা লেখার দায়ে জোড়া বেতের ব্যবহারের কথা।

১. সদা সত্য কথা বলিবে, ২. চুরি করা মহাপাপ, ৩. অহংকার পতনের মূল ইত্যাকার নীতিকথা। আমাদের বাংলা অভিধানে 'সাবেক' শব্দটির অর্থ করা হয়েছে প্রাচীন পূর্বেকার, পুরাতন শব্দটির ব্যবহার বোধকরি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে। নাট্যকার, গীতিকার, সেক্সপিয়র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আমার অভিধায় ওঁরা কেউ-ই সাবেক হননি। সম্রাট অশোকের আমল থেকে পঞ্চদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম এখন অবধি সাবেক হননি। এমনকি বিষাদ সিন্ধুর নিষ্ঠুর এজিদ। তিনি সেই সময়ের একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন [আরবী কবিতা, আবদুস সাত্তার অনূদিত] বাংলা অভিধানে নীতিকথা বলতে বলা হয়েছে ১. হিতোপদেশ, ২. ভালো-মন্দ বা কর্তব্য অকর্তব্য বিষয়ে বোধসম্পন্ন। নৈতিক সম্বন্ধে লেখা আছে ১. নৈতিক শক্তি, ২. নৈতিক অবনতি।

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষক ভুল বাংলা লিখে তিরস্কৃত হলেও সম্প্রতি তিনি 'ডঃ' শব্দটি নামের আগে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। উক্ত ডক্টরেট শিক্ষককে বলতে শুনলাম 'সাবেক' শব্দটি শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রসঙ্গ পাল্টে জানালেন, শিক্ষার মান, শুদ্ধ বানান, লেখন, পঠন এবং কিছু নীতিকথা। কিছু নৈতিকতার কথা। অনেকেই জানি ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, বিভিন্ন এনজিওতে কনসালটেন্সি থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেসরকারি) খণ্ডকালীন ক্লাস নিয়ে থাকেন। তাঁর শব্দ উচ্চারণেই স্পষ্ট হয়ে গেলো তিনি শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা বলতে পারেন না, আঞ্চলিকতার লক্ষণ স্পষ্ট।

আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে গ্রীসের দুইজন দার্শনিক পেস্নটো এবং এরিস্টটল তাদের দর্শন চিন্তায় বার বার জানিয়েছেন, সত্যিকারের সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক হতে হলে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। অন্যতিবে পেস্নটোর 'রিপাবলিক' গ্রন্থে নৈতিকতার উপর যেমন জোর দেয়া হয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই বলা হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শুধু জ্ঞানের জন্যই নয়, পড়ালেখা শিখে তারা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে। ভালো মানুষই ভালো নাগরিক হতে পারেন। নৈতিকতার বিরুদ্ধে আমরা সকলেই, তবে এর মধ্যে দু'একজন আছেন তাদের নৈতিকতাকে এখনো বিসর্জন দেননি।

বৃটিশ শাসনামলে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে দুটি স্কুলের অনুমোদন দিয়েছিলেন বৃটিশরা। তৎকালীন বাংলা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নৈতিকতার উপর সর্বপ্রথম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গুরুত্ব দিয়েছিলেন; এমনকি নৈতিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তভর্ুক্ত করেছিলেন ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যাসাগর। তিনি বিদেশী বইয়ের অনুবাদের মাধ্যমে শিশুদের জন্য রচনা করেছিলেন 'বোধোদয়' ও 'বর্ণপরিচয়' ১ম ও ২য় ভাগ। তিনি শিশু-কিশোরদের বইগুলোতে নৈতিক শিক্ষার দিকে দৃষ্টিও দিয়েছিলেন এবং একইসঙ্গে শিশু-কিশোররা যেন মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে শেখে সেদিকও ছিলো তাঁর প্রখর দৃষ্টি। নৈতিকতা নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। নৈতিকতার বালাই নেই অনেক শিক্ষকের কর্মকাণ্ডেও।

নৈতিকতার অধঃপতন চারদিকে। আজকাল সদা-সর্বদা সত্যকথা না বলে, আমরা মিথ্যে বলাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তবু এই সমাজে দুই-একজন এখনো আছেন যারা সত্য বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সম্প্রতি সাবেক সচিব মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের 'সময়ের বয়ান' নামে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটিতে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন 'তাঁর পিতা মহিউদ্দিন ভুঁইয়া পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনায় বাটা সু কোম্পানিতে শ্রমিকের চাকরি করতেন। ১৯৪৪ সালের দিকে তাঁকে বাটানগর থেকে খিদিরপুরের ওয়াটগঞ্জ স্ট্রীটে অবস্থিত বাটা সু কোম্পানির জুতার দোকানে সেলসম্যান এবং নিকটস্থ মসজিদের ইমাম হিসেবে কলকাতায় তাকে বদলি করা হয়।' আমার মনে হয় নৈতিকতার জয় এখানেই। শুদ্ধ ভাষায় যিনি সত্য বলতে অভ্যস্ত তাঁর মুখে মিথ্যে আটকে যায়।

দিনে এক কাপ কফি এনে দিতে পারে দীর্ঘায়ু

দিনে মাত্র এক কাপ গরম কফিতে চুমুক দিয়েই সহজে অনেক বেশিদিন সুস্থ দেহে বেঁচে থাকা যায়। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে, কফি পানে হূদরোগের সম্ভাবনা অনেকটাই এড়ানো যায়। সমীক্ষাটি চালিয়েছে এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।

তারা দেখেছেন যে, দিনে এক কাপ গরম কফি পান করলে মানুষের হূদপিণ্ডের ধমনীর প্রসারণ ক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যায়। ফলে হূদরোগের প্রকোপ এড়ানো সম্ভবপর। ব্রিটিশ সংবাদপত্র 'ডেইলি মেইল ঐ সমীক্ষা রিপোর্ট উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, গবেষকরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগা ৪৮৫ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন গ্রিসের ইকেরিয়া দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা, বয়স ৬৫ থেকে ১০০-র মধ্যে। ইকোরিয়া 'দীর্ঘজীবীর দেশ' বলে পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের এক-তৃতীয়াংশের বয়সই নব্বইয়ের কোঠায়।

গবেষকদলের প্রধান ড. ক্রিস্টিনা ক্রাইসোহু জানিয়েছেন, কফি পানের উপযোগিতা সম্পর্কে অনেকেরই দ্বিমত ছিল। বিশেষত হূদরোগের ক্ষেত্রে কফি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কফি পান করলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। কিন্তু গ্রিক সমাজে, সংস্কৃতিতে কফি পানের প্রচলন খুবই বেশি। তাই ্এই অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, দিনে এক বা দু'বার যারা কফি পান করেন (২৫-৫০ মিলিলিটার) তাদের প্রায় ৫৬ শতাংশের ধমনীর প্রসারণক্ষমতা অল্পবয়সীদের মতোই। একেবারেই যারা কফি পান করেন না তাদের ধমনী অনেক কমজোর। দিনে তিন অথবা তার চেয়ে বেশি বার কফি পান করেন তাদের প্রতি দশজনের একজনের ধমনীর প্রসারণক্ষমতা দুর্বল বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে। কফির উপাদান-ক্যাফিন ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস-নাইট্রিক অক্সাইড গ্রহণের মাত্রা বাড়িয়ে ধমনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে বলে তিনি মনে করেন। এই রিপোর্টটি স্টকহোমের ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজিতে প্রকাশিত হয়েছে।

বিদেশে আশ্রয় চাইতে পারেন লিনা সেন

মাওবাদীদের সহযোগিতা করার অভিযোগে কারারুদ্ধ ভারতের মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেনের স্ত্রী লিনা সেন বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। স্বামীর সাজা হওয়ার পর তিনি ও পরিবারের সদস্যরা ভারতে নিরাপদ বোধ করছেন না বলে সোমবার তিনি জানান।

তিনি বলেন, এখন আমার একটাই পথ খোলা আছে। সেটা হলো উদার, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দূতাবাসে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া। পুলিশ আমাদের ওপর সারাক্ষণ নজরদারি করছে। অনেক অজ্ঞাতনামা মেইল আসছে আমাদের কাছে এবং টেলিফোনে আমাদের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে।

২৪ ডিসেম্বর মাওবাদীদের সঙ্গে সংশিস্নষ্টতার দায়ে বিনায়ক সেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ভারতের ছত্তিশগড়ের একটি আদালত। তাকে আটক করা হয় ২০০৭ সালের মে মাসে। বানোয়াট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেনকে সাজা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে মানবাধিকার কর্মীরা। বিনায়ক সেনের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদন্ড লংঘিত হয়েছে বলে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

মার্কিন লেখক নোয়াম চমস্কি, ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপক রোমিলা থাপারসহ অনেক বিখ্যাত ভারতীয় শিক্ষাবিদ একটি বিবৃতিতে বিনায়ক সেনের সাজা হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ বিনায়ক সেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সাপ্তাহিক ক্লিনিক ও কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।

অবৈধভাবে ইয়েমেনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে নিখোঁজ ৮০ জন

সুখের খোঁজে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইয়েমেনে যাওয়ার পথে অন্তত ৮০ জন আফ্রিকান নাগরিক নিখোঁজ হয়েছেন।

দুটি নৌকার একটি সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে তলিয়ে যায়। অপরটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ নৌকাটিতে ৪০ জন ইথিওপিয়ান নাগরিক ছিলেন যারা উন্নত জীবনের খোঁজে অবৈধভাবে ইয়েমেনে যাচ্ছিলেন। ইয়েমেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সোমবার জানানো হয়েছে, ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে সাগরে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে সোমালিয়ার তিন নাগরিককে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ৪০ জনকে নিয়ে অন্য একটি নৌকা সাগরে নিখোঁজ হয়েছে। ডুবে যাওয়া নৌকার বেশিরভাগ যাত্রীই ইথিওপিয়ার নাগরিক।

নারী ও শিশুসহ ৩৫ থেকে ৪০ জন যাত্রী নিয়ে নিখোঁজ হওয়া নৌকাটি সম্পর্কে ইয়েমেনের উপকূলরক্ষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়েবসাইটটি জানিয়েছে, "বাতাসে নৌকাটি কোন্ দিকে যাবে এবং যাত্রীদের ভাগ্যে কি আছে তা আমাদের জানা নেই।" জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া নৌকাটির যাত্রীদের মধ্যে সোমালিয়ার ৫ জন নাগরিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের কাছে জানা যায়, জিবুতি থেকে ছেড়ে আসার তিন ঘণ্টা পর নৌকাটির ইঞ্জিন জেলেদের একটি জালের সঙ্গে আটকে গেলে যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ইয়েমেন হয়ে পশ্চিমের ও মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ দেশগুলোতে উন্নত জীবন-জীবিকার খোঁজে প্রায়ই সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা চালায় আফ্রিকার দরিদ্র মানুষ। কিন্তু অনুপোযোগী নৌকায় যাত্রা করায় প্রায়ই অনেক আফ্রিকান সাগরে ডুবে প্রাণ হারায়।

মহাজোট সরকারের দুই বছর এখন প্রয়োজন কম কথা বেশি কাজ

০০৮-এর ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করেছে। পাঁচ থেকে দুই গেলে থাকে তিন। যে সম্ভাবনার এবং স্বপ্নের জাল বুনেছিল প্রায় পনের কোটি মানুষের মনে, সেই স্বপ্নের জাল বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।

সুতরাং দুই বছরের সাফল্য নিয়ে নানাজনের নানা মত। আলোচনা হচ্ছিল নানা টেবিলে। একজন শহীদের স্ত্রী বলেন, "সফলতার বীজ বুনতে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে খালেদা জিয়ার হাত থেকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি উদ্ধার, কেননা '৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাংলার মাটিতে শুরু হয়েছিল সেই ষড়যন্ত্রের একটি খুঁটি উপড়ে ফেলা হয়েছে।" সুতরাং নানাভাবেই নানাজন সফলতা দেখতে চাইবে। সেই সঙ্গে আমাদের বিফলতা বা না পারার অংকের হিসাবও পাশাপাশি মিলিয়ে নিতে হবে। তা না হলে ২০১৪ সালের অগি্নপরীক্ষায় এই সফলতা দিন বদলের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। মনে রাখা দরকার কোন্ পরিস্থিতি মহাজোট সরকার গঠিত হয়েছিল। সমগ্র দেশ জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও গভীর ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল বাংলার মাটিতে।

দলতন্ত্র-পরিবারতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে বিরোধীদলকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেবার নীল-নকশা তৈরি করা হয়েছিলো রাষ্ট্রের সবের্াচ্চ পর্যায়ে । প্রগতিশীল শক্তিকে নস্যাৎ করে দেবার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং লুটপাট, দুর্নীতি সমগ্র প্রশাসনকে স্থবির করে ফেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনাকে নির্বাসিত করার বিভিন্ন কায়দা-কানুন ইতিহাস বিকৃতি খেলা চলছিল । নারীকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলার লক্ষ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে নারীর সকল অর্জনকে বন্দী করার পাঁয়তারা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার । সেই রকম একটি অবস্থা থেকেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এক আন্দোলন শুরু হল । সেই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি দেশের গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করল এবং দুই বছর সামরিক শাসকদের ছায়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত হয়। পরবতর্ীতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই মহাজোট সরকার নির্বাচিত হল । জনগণের সামনে প্রত্যাশা ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যুুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকর করে এই দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে এক অন্ধকার অতল গহ্বরে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে উঠে দাঁড়াবার জন্যই জনগণ ভোট দিয়েছিল। ভোট দিয়েছিল এবারে যারা প্রথম ভোটার হয়েছে এবং নারীরা। একটি গুমোট আবহাওয়া থেকে খোলা বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল মহাজোট সরকারের ক্ষমতা আরোহণের মধ্যদিয়ে। দু'বছরের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখতে গেলে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া জাতির জন্য সামনের এগিয়ে যাবার দিক বদলের কিছু নির্দেশনা দু'বছরে লক্ষ্য করা গেছে।

এক নজরে আমরা যদি দেখি

জনগণের কাছে সকল তথ্য পেঁঁৗছে দেয়ার লক্ষ্যে এবং তথ্য পাওয়া একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে বিবেচনায় এনে অবাধ তথ্যপ্রবাহের লক্ষ্যে তথ্য কমিশন গঠিত হয় এবং তথ্য অনুমোদন আইন হয়েছে ২০০৯-এর শুরুতে। যে দেশে জমি কম মানুষ বেশি সে দেশের জন্য কৃষিখাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কৃষিনীতি ঘোষণা করে সেখানে অনেকগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সারের মূল্য হ্রাস, ডিজেলের মূল্য হ্রাস, কৃষি ও তথ্য প্রযুক্তি জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেয়া, তার জন্য কমিউনিটি রেডিও চালু করা, বেতার ও টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচারের বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ, কৃষি তথ্য সার্ভিসের ই- কৃষি কার্যক্রমের আওতায় কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত ও পরামর্শ পাবার সুযোগ এবং অনলাইনে কৃষিতথ্য সেবা পেঁৗচ্ছে দেবার কার্যক্রম হাতে নিয়ে এক বিশাল দিক উন্মোচন করা হয়েছে। বিএডিসি বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম বৃদ্ধি করে স্থানীয় জনপ্রিয় উন্নতমানের ধানের বীজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কৃষি কার্ড প্রবর্তন করে তার মাধ্যমে সেচ ও ডিজেলের সহায়তা দেবার জন্য ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়ে এক যুগান্তকারী সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কৃষক তার একটি সামাজিক মর্যাদা পেয়েছে। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনের দ্বার উম্মোচিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাকে মোকাবিলা করার জন্য যে সকল কর্মসূচি এ সকল কিছুই এগিয়ে যাবার এক দিক-নির্দেশনা। একটি গণমুখী সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্যোগ একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ছিল। ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির সামনে বারবারই হোঁচট খেতে হয়েছে এই গণমুখী শিক্ষানীতিকে। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রায় সকলের মতামত নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ অনুমোদন করেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করে শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে এক আধুনিক জাতিতে পরিণত করার উদ্যোগ তৈরি হয়েছে। '৭১-এর ১০ এপ্রিল জারিকৃত ঘোষণাপত্র এবং ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শিক্ষানীতিতে যুক্ত করেই ইতিহাস বিকৃতির পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তি, ফলাফল ঘোষণায় প্রযুক্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবার পথ তৈরি করেছে। দু'বছরের বাজেট শ্রমিক-কৃষক-নারী-অতিদরিদ্র মানুষের কথা ভেবে রাষ্ট্রের দায়িত্বের অনেক দিক উন্মোচিত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তৃত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এই সরকার। দীর্ঘ বছর ধরে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর প্রচারণায় মুক্তবাজার অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণের যে নীতিমালা ছিল সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও রাষ্ট্র বাজারশক্তিকে নিয়মে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। হতদরিদ্র, বৃদ্ধ, অসহায়, বিধবা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যদিয়েও একটি দিন বদলের নির্দেশনা বুঝতে পারা যায়। শ্রম আইন-২০০৬-কে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মতামত নিয়ে খসড়া তৈরি হয়েছে। পোশাক শিল্পের সুবিধার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ, গৃহ-শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে খসড়া নীতিমালা, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যুব সমাজের বেকারত্ব ঘুচাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল স্কিল ডেভলপমেন্ট কাউন্সিল (এনএসডিসি ) , নূ্যনতম মজুরি বোর্ড বিভিন্ন সেক্টরে মজুরি ঘোষণা করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি পোশাক শিল্প। পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় বাংলাদের গর্ব। ৩৫ লক্ষ শ্রমিক এখানে কাজ করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম মজুরি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে। ১৬৬২.৫০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। শ্রমিক-মালিক সরকারের সমন্বয়েই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন হ্রাস শ্রমিকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বিক্ষোভ দমনে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিমই যথেষ্ট নয়, স্ব স্ব কারখানার নির্বাচিত প্রতিনিধি সফলতার চাবিকাঠি। নতুন বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ব্যবসায়ী মহলের উদ্দেশ্যে বলেছেন, শ্রমিকদের সুখী রাখলেই উৎপাদন বাড়বে, সরকারের এই দিক-নির্দেশনাই শ্রমজীবী মানুষের জন্য জরুরি। একদিকে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক একই সাথে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা জরুরি। একদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন অন্যদিকে সেই বাহিনীর হাতে পুলিশ হেফাজতে বিচার বহিভর্ূত হত্যাকাণ্ডে মানুষের মৃতু্যবরণ দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও যেমন বন্ধ করতে হবে। কারা এর হোতা সেটা বের করতে যেয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘাড়েই দোষ চাপায়। এ সকল বিষয়ে 'সতর্ক পা' ফেলা সরকারের জন্য জরুরি। অভিবাসী শ্রমিকেরা অর্থনীতিতে আজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এই দু'বছরে যেমন বৃদ্ধি হয়েছে তেমনি কিছু কিছু চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয়েছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা এবং দূতাবাসসমূহের দক্ষতাই এক্ষেত্রে আরো সফলতা বয়ে আনতে পারে। বিশ্ব শ্রমবাজারে নারীদের কাজের সুযোগ হয়েছে অনেক । ফলে নারীদের নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে পারলে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষিশ্রমিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকেরা এখনও শ্রম আইনের বাইরে রয়েছে। এদের জন্য আইন তৈরির উদ্যোগ সফলতার দ্বার উন্মুক্ত করতে সাহায্য করবে। বাংলার মাটিতে আদিবাসীরা বৃহৎ গোষ্ঠী । যারা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর বৃহৎ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম পার্বত্য শান্তিচুক্তির মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। বিগত সরকারের সময়ে এ চুক্তি প্রায় অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে আবার আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আবার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।'কারো সাথে শত্রুতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব'_এই নীতিতে চলিস্নশ বছর ধরে দেশ পরিচালিত হবার পরও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিগত দিনগুলোতে বন্ধুত্বের কথা মুখে বলে শত্রু শত্রু খেলায় ব্যস্ত ছিল বিভিন্ন সরকার। গত দু'বছরে পররাষ্ট্র নীতিতে সে দিকটি পরিবর্তিত হয়েছে। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করার এক মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে । ভারত থেকে চীন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মায়ানমার এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা । সফলতার দিক উন্মোচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বন্দী হয়ে থাকা অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইন তৈরি হয়েছে। সমগ্র নারী সমাজ সম-অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি যে নারী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল '৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি। আমরা লক্ষ্য করছি ২০০৪ সালে এ নীতি অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। অধিকার, মর্যাদা ও কর্তৃত্ববিহীন এক নারী নীতি ঘোষণার যড়ষন্ত্র চলছিল যা সকল নারীই প্রত্যাখ্যান করেছে। এ সরকার আবারও উদ্যোগ নিয়েছে ১৯৯৭ সালের নারী নীতিকে যুগোপযোগী ঘোষণার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করতে। সারা বছরই আমরা দেখেছি নারী হত্যা, খুন, অপহরণ এবং নতুন কায়দায় ইভটিজিংয়ের নামে নারীর উপর নির্যাতনের নামে নতুন যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের উপরও নেমে এসেছে নির্যাতন এবং অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যদিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিলেও এখনো সংকট কাটানো যায়নি। নারীদের উপর এই সহিংসতা পরিবারেও ঘটে চলছে। ইতিমধ্যে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে একটি আইন পাস হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে ঘোষিত কর্ম - শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা প্রণয়ন সে কাজও এগিয়ে চলছে।

সরকারের দু'বছরে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হয়েছে। মঙ্গাপীড়িত জেলাসমূহের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করায় ২০১০ সালে তেমন সংকট এ জায়গাগুলোতে দেখা যায়নি। বিবিধ পর্যায়ে নানা ধরনের সাফল্যের কথা আরো বিস্তারিত বলা যেতে পারে কিন্তু যে বিষয়গুলো সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার। দ্রব্যমূল্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১০ টাকা বা ২০ টাকা চালের বিতর্ক নয়, বিষয়টি অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ মানুষের সাধ্যের আওতায় রাখাটাই সরকারের কাজ। অবাধ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট বছরের পর বছর সরকার এবং জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েই চলছে। এক্ষেত্রে সরকারের খবরদারি আরো কঠোর হওয়া জরুরী। ওএমএস ও পূর্ণাঙ্গ রেশন ব্যবস্থা (চাল, ডাল, আটা, চিনি, কেরোসিন, লবণ, তেল) চালু এ সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক । এছাড়া টিসিবিকে কার্যকর করার পথে সকল বাধা দূর করা জরুরী। এ সরকার বিদু্যতের ক্ষেত্রে এসেই ঘোষণা দিয়েছিল কিন্তু সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধীরগতি বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় আঘাত করেছে। চাঁদাবাজি, দলবাজি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষাসহ অনেকক্ষেত্রে প্রশাসন নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। অতিদ্রুত বিদু্যৎ, দ্রব্যমূল্য এবং যানজট নিরসনে আরো দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাজে নেমে যাবার মধ্যেই সফলতা নিহিত। এসকল কাজের মধ্যেও সরকারকে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হয়েছে তাহলো বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করা এবং সংবিধানে গুরুতপূর্ণ সংশোধন আনা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকর করে এ সরকার জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। আগামী প্রজন্মের কাছে এক পাপমুক্তির বার্তা ঘোষণা করেছে। দীর্ঘদিনের আত্মস্বীকৃত খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশে-বিদেশে আস্ফালন করেছে। বুক ফুলিয়ে বলেছে 'ন্যায্য কাজটি তারা করেছে'। এই ঔদ্ধত্য জাতি বরদাশত করেনি। দীর্ঘদিন পরে হলেও সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যায়কারীরা কখনও পার পাবে না, ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। সেই পথ ধরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবতর্ী সময়ে যে সকল যুদ্ধাপরাধী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অপরাধ করেছিল, হত্যা,ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি সংঘটিত করেছিল তারা ভেবেছিল পার পেয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তারই পথ ধরে বাংলাদেশের বুকে আজ এ সকল ঘাতক-দালালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ট্রাইবুনাল গঠন হয়েছে। বিচারক এবং আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্তের ভিত্তিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে গ্রেফতার হয়েছে নিজামী, সা্ঈদী, মুজাহিদসহ আরো অনেকে। এই বিচার কার্য অতি দ্রুত শুরু হোক জাতি তা দেখতে চায়।'৭৫-পরবতর্ী যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল তা ছিল ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। নীতিহীন, মূল্যবোধহীন, ভিন জাতির সংস্কৃতি এবং হত্যা ও কু্য-এর রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হল কর্ণেল তাহেরকে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের পুনর্বাসিত করা হল। রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল। এই ছিনিমিনি খেলা খেলতে হাজার হাজার সৈনিককে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টায় পাঠ্যপুস্তকসহ অনেক কিছু বদলে ফেলা হল। অবৈধ ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনতাই হল। সামরিক শাসন জারি এবং সামপ্রদায়িক রাজনীতি বেগবান হল। এ সবকিছুকে বাতিল করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র ও দেশকে পুনর্গঠনের জন্য সংবিধান সংশোধন কমিটি গঠিত হল সংসদে। তাই সংবিধান সংশোধনের মধ্যদিয়ে জাতি আবার ফিরে পাবে অতীত, গৌরব ও সম্মান। যুগোপযোগী আরো সংশোধনের মধ্যদিয়ে জনগণের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বাস্তবায়িত হবার পথ উন্মুক্ত হবে। এ কাজটি করতে হাইকোর্টের দুই রায় পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের ঘোষণা সহজ করে দিয়েছে যাত্রাপথ। কিন্তু এই সফলতার পথ বেয়ে এগোতে হলে প্রয়োজন মহাজোটের ঐক্যকে 'চোখের মণি'র মত লালন করা। দু'বছরে এই ঐক্য বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি জেলা পর্যায় পর্যন্ত । অনেক ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আরো উপযুক্ত কৌশল নিতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। 'একলা চলো নীতি'- ধাঁচ যদি না কমানো হয়, ঐক্যকে জোরালো না করা যায় তবে এই সফলতার অংশীদারিত্ব জাতির কাছে বড় করে তোলা দুরূহ হবে। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, প্রয়োজন কম কথা, বেশি কাজ। প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ পরিকল্পিত নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ।

উজবেকিস্তান কাজাখস্তান

তাসখন্দ এক সময় ছিল রাশিয়ায়। এখন উজবেকিস্তানের রাজধানী এই তাসখন্দ। আকাশ পথে লাদাখ উপত্যকা, হিন্দুকুশ পর্বত, কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে এখানে যাওয়া যায়। পথে পড়ে বিরাট পর্বতমালা আর বরফাবৃত চূড়া। বিপুল সাহস আর ইচ্ছা নিয়ে সেই কতকাল আগে শাসক, পরিব্রাজকরা যুগে যুগে এই পথ পেরিয়েছে।

তাসখন্দ থেকে যাওয়া যায় ঐতিহাসিক শহর সমরখন্দ এবং বুখারার দিকে। সমরখন্দ ছিল তৈমুরলঙের রাজধানী। তারও আগে চেঙ্গিস খাঁ এখানে লুটপাট করেন। সমরখন্দ একটা পুরনো মরুদ্যান। এখানে অসংখ্য স্থাপত্য যা দেখতে দু'-তিনদিন লেগে যায়। সমরখন্দের একটা অংশ প্রাচীন রয়ে গেছে।

সমরখন্দ থেকে বুখারায় যাওয়া যায়। বুখারায় রয়ে গেছে অসংখ্য মসজিদ আর মাদ্রাসা। এরমধ্যে বিবিখানা মাদ্রাসা খুব বিখ্যাত। এখানকার স্থাপত্য দেখার জন্য একদিনের প্যাকেজ টু্যরের ব্যবস্থা আছে। বুখারাতে নানা জাতের, নানা ধর্মের লোকের বসবাস। বুখারার বাজার আর চায়খানা অপূর্ব। মোলস্না নাসিরুদ্দীনের জন্মস্থান এই বুখারা। এখানে তার একটা চমৎকার মূর্তি আছে, খচ্চরের পিঠে বসে আছেন তিনি। এই মূর্তির চারপাশে ছোট ছোট চায়খানা। দেখে মনে হবে, এরা সবাই যেন মোলস্না নাসিরুদ্দীনের গল্প বলছে। বুখারা-সমরখন্দের রাস্তায় রাস্তায় ধ্রুপদী সংগীত শোনা যায়। এই সব শিল্পী সারেঙ্গি-দোতারা ব্যবহার করেন। বুখারা হতে তাসখন্দের পথ প্রায় চারশো কি. মি.। এই রাস্তায় একদিকে রুক্ষ-মরু অঞ্চল, তাকে ঘিরে আছে তিয়েনশানের বরফ ঢাকা চূড়া, পামীর মালভূমি। অন্যদিকে মাইলের পর মাইল টিউলিপ ফুটে রয়েছে।

কাজাখস্তানে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে চিমিকেন্ট বলে একটা ছোট শহর। সেখান থেকে ফরঘনায় যাওয়া যায়। তাসখন্দ থেকে ফরঘনা যেতে প্রায় ১২ ঘন্টা সময় লাগে। আকাশ পথে আধঘন্টা। ফরঘনা সুলেমান পর্বত শ্রেণী, পামীর, তিয়েনশান পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা। জানা যায়, ফরঘনা ছিল ফুলে ফুলে ভরা আশ্চর্য সুন্দর এক রাজ্য। এখানে বৃষ্টি হয় না। চারদিকের পর্বতের বরফগলা পানি মাটির তলা দিয়ে যাবার ব্যবস্থা ছিল বলে ফরঘনা এত সবুজ। ফরঘনায় আন্দিজান আর ওশ- এই দুটোই বড় শহর। আন্দিজান মোঘল সম্রাট বাবরের জন্মস্থান। এ শহরে সারা বছর ফুলে ভর্তি থাকে। রাস্তায় রাস্তায় গোলাপ ফুলের গাছ। সর্বত্র পানির ব্যবস্থা উন্নত। এই কৃত্রিম পানির ব্যবস্থা না থাকলে ফরঘনা মরুভূমি হয়ে যেতো।

কিরঘিজস্তান পুরোটাই পার্বত্য অঞ্চল। তিয়েনশান পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা। এর একদিকে চীন, একদিকে উজবেকিস্তান, একদিকে কাজাখস্তান। কিরঘিজরা যাযাবর উপজাতি। এদের মধ্যে অনেকেই গরমকালে তাঁবুতে থাকে। এগুলোকে ইয়ুর্দ বলে। এখানের মানুষের মধ্যে অদ্ভুত সরলতা। বিসকেক এখানের উলেস্নখযোগ্য শহর। এখানের ওশ বাজার বিখ্যাত। বিসকেক থেকে ইসুকুল লেক ঘন্টা চারেকের পথ। সাড়ে সাত-আট হাজার ফিট ওপরে চলিস্নশ বর্গ কি. মি. জায়গা নিয়ে বিশাল এই ইসুকুল লেক। এর চারদিকে তিয়েনাশান পর্বতমালা। জেনেভা, কানাডার হ্রদ অঞ্চলের চেয়েও নাকি এটি সুন্দর। নোনা পানির হ্রদ। তাই শীতকালে চারদিকে বরফ থাকলেও এই হ্রদের পানি জমে না, আর পানির রঙও তেমনি একেবারে টলটলে নীল। হ্রদের চারপাশে ছোট ছোট কিরঘিজ গ্রাম। ইসুকুল হ্রদে সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের দৃশ্যও অকল্পনীয়।

মহাদেশে মহাপস্নাবন

কল বিচারেই ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছে অস্ট্রেলিয়ার বন্যা পরিস্থিতি। চরমে পেঁৗছিয়াছে বন্যাকবলিত হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ। সংকটাপন্ন হইয়া পড়িয়াছে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ।

সেইসাথে ইহাও স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ বলিয়া বিবেচিত এই বন্যার অভিঘাত শুধু অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না; বিশ্ব অর্থনীতিতেও ইহার নেতিবাচক প্রভাব অনিবার্যই বলা চলে। খাদ্যশস্য, বিশেষ করিয়া গমের বাজারে ইতিমধ্যে সেই আলামতও স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। কারণ বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ গম রফতানিকারী এই দেশটি আদৌ তাহাদের গম রফতানির প্রতিশ্রুতি পূরণ করিতে পারিবে কিনা তাহা লইয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় রহিয়াছে। অস্ট্রেলিয়ার কয়লার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল অর্থনৈতিক পরাশক্তি_জাপান, ভারত, ইউরোপ ও চীনসহ সংশিস্নষ্ট দেশগুলির উদ্বেগ আরও বেশি। কয়লা সরবরাহে বর্তমান অচলাবস্থা অব্যাহত থাকিলে ইহার প্রভাব সর্বব্যাপী হইতে বাধ্য। অতএব, এই উদ্বেগকে হালকা করিয়া দেখার কোনো অবকাশ নাই।

উলেস্নখ্য, ক্রিসমাসের ঠিক পূর্বক্ষণে শুরু হওয়া নজিরবিহীন এই বন্যায় ইতিমধ্যে ফ্রান্স ও জার্মানির আয়তনের সমপরিমাণ এলাকা তলাইয়া গিয়াছে। কৃষি খামার ও কয়লা খনিসমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য কুইন্সল্যান্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন পানির নীচে। সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের বিষয় হইল, বন্যার তাণ্ডবে দেশটির সুবৃহৎ কয়লাশিল্পে উৎপাদন প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হইয়া পড়ার কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হইতেছে কয়লা ও খাদ্যশস্যসহ সামগ্রিক রফতানি বাণিজ্য। এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও খাদ্যশস্য পরিবহন করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হইতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগিয়া যাইতে পারে বলিয়া সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন। শুধু কৃষি খাতেই ক্ষতির পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার ছাড়াইয়া যাইতে পারে বলিয়া প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হইতেছে। অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও কল্পনাকে হার মানাইতে পারে বলিয়া তাহাদের আশঙ্কা।

প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, দীর্ঘদিন যাবৎ কারণে-অকারণে বাংলাদেশকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার দেশ বলিয়া পরিহাস করা হইত। অবস্থানগত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে আমাদের নিত্যসঙ্গী তাহাতে দ্বিমত করিবার কিছু নাই। তবে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলিও যে অনুরূপ বা আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হইতে পারে_ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে ইতিমধ্যে তাহা বিশ্ববাসীর ভালোভাবেই জানা হইয়া গিয়াছে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে এই মহাপস্নাবনের প্রধান শিক্ষাটি হইল, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত হইতে কাহারও নিস্তার নাই। ধনী-গরিব এবং উন্নত-অনুন্নত কোনো দেশই দুর্যোগের ঝুঁকি হইতে মুক্ত নহে। আমেরিকায় উপর্যুপরি ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল এবং সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ার বন্যার ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে তাহা আবারও মনে করাইয়া দিয়াছে মাত্র। দুর্যোগের চিত্র সর্বত্রই অভিন্ন। তফাত শুধু এইটুকু যে, দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য উন্নত দেশগুলিকে কাহারও দ্বারস্থ হইতে হয় না। কারণ নিজেদের সমস্যা বা সংকট মোকাবিলার মতো সম্পদ ও প্রযুক্তি তাহাদের আছে। অস্ট্রেলিয়াও ব্যতিক্রম নহে। প্রধানত নিজেদের সম্পদ দিয়াই তাহারা বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে। আমরা সেই উদ্যোগের সর্বাত্মক সফলতা কামনা করি। অস্ট্রেলিয়ার সরকার ও বন্যাদুর্গত জনগণের প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা ও সহমর্মিতা।

পুলিশ সপ্তাহ ও পুলিশের সক্ষমতা

ত ৪ জানুয়ারী হইতে সারা দেশে পালিত হইতেছে পুলিশ সপ্তাহ ২০১১। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধিই ইহার মূল উদ্দেশ্য। এ উপলক্ষে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠে উদ্বোধনী বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের ভয়-ভীতি ও অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হইয়া আন্তরিকভাবে কাজ করিয়া যাওয়ার আহ্বান জানাইয়াছেন।

আইনভঙ্গকারী সামাজিকভাবে যতই শক্তিশালী হউক, তাহাদের শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলিয়াছেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বিধানে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা সব সময়ই জরুরি ও অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি জনবহুল দেশ। বেসরকারি হিসাবে এখানকার জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়াইয়া গিয়াছে। একেতো জনবহুল দেশ, তাহার উপর দারিদ্র্যপীড়িত। স্বাভাবিক কারণেই এখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। অন্যদিকে, আধুনিক সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়া যতই অগ্রসর হইতেছে, ততই অপরাধের গতি-প্রকৃতি বদলাইয়া যাইতেছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি না পাইলে তাহাদের নিকট হইতে কার্যকর ভূমিকা আশা করা যায় না। জানা মতে, পুলিশ বাহিনীর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজারের অধিক। আর থানার সংখ্যা ছয় শতাধিক। সাম্প্রতিককালে পুলিশের কনস্টেবল হইতে শুরু করিয়া ইন্সপেক্টর পর্যন্ত ১৩ হাজার পদ সৃষ্টি করা হইয়াছে। তাহার পরও জনসংখ্যা অনুপাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা অনেক কম। প্রায় তেরশত মানুষের বিপরীতে রহিয়াছে একজন পুলিশ। এই অবস্থায় থানা ও পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়ানো আবশ্যক। বিশেষত রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার অনুপাতে এরূপ সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করিয়া দেখা প্রয়োজন। কেহ কেহ মনে করেন, এখন ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডেই থানা স্থাপন করিতে হইবে।

পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর কথা আমরা প্রায়শ বলিয়া থাকি। আসলে দক্ষতার বিষয়টি কেবল প্রশিক্ষণ, দৈহিক সামর্থ্য এবং বুদ্ধিমত্তার উপরই নির্ভর করে না। এজন্য আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদিও প্রয়োজন। আধুনিক বিশ্বে সমাজ ব্যবস্থা যেমন অনেক জটিল হইয়াছে, তেমনি যুদ্ধ-বিগ্রহ ও উত্তাপ-উত্তেজনায় অস্ত্র ব্যবসাও সম্প্রসারিত হইয়াছে। এখন একজন সাধারণ সন্ত্রাসীর কাছে যেই অস্ত্র আছে, তাহা অনেক সময় পুলিশের কাছেও থাকে না। আজকাল পৃথিবীর হতদরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশেও পুলিশকে রাস্তায় দাঁড়াইয়া বা আইন অমান্যকারী গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়াইয়া দায়িত্ব পালন করিতে দেখা যায় না। অথচ ইহাই আমাদের এখানকার প্রাত্যহিক চিত্র। ইহা পুলিশের জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। গত এক দশকে দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া সাড়ে তিনশতেরও বেশি পুলিশ নিহত হইয়াছেন যাহার ক্ষতি অপূরণীয়।

পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তাহার পরও বাস্তবতা হইল, নানা আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তার জন্য আমাদের পুলিশের কাছেই যাইতে হয়। আমাদের পুলিশ বাহিনী ১৮৬১ সালের পুরাতন আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কারণে নানা সমস্যাই হইতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বিভিন্ন আইনের সংস্কার করিলেও এ ব্যাপারে আমরা এখনও দ্বিধান্বিত। প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় রদবদল শেষে নূতন আইন কার্যকর করা জরুরি। পুলিশের যানবাহন, আবাসন ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত সমস্যা দূর করিয়া সর্বপ্রকার লজেস্টিক সাপোর্ট বাড়াইতে হইবে। বাড়াইতে হইবে বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। সেইসঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে দায়িত্বশীল, অধিক সক্রিয় ও জনগণের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হইতে হইবে।

সিদ্ধিরগঞ্জে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে নিহত ১

চাকরি স্থায়ীকরণ ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের গুলিতে এনামুল হক (২৫) নামের এক শ্রমিক নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছেন। তবে পুলিশের দাবি, শ্রমিকদের ইটপাটকেলের আঘাতে এনামুলের মৃত্যু হয়েছে।

দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা হামলা চালিয়ে কারখানার প্রতিটি বিভাগ তছনছ করেন। ভাঙচুর করেন ১২টি গাড়ি। পুরো কারখানা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। শ্রমিকদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন ১০ পুলিশ সদস্য, পথচারী, শ্রমিকসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি।
সংঘর্ষের সময় শ্রমিকেরা প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইশতিয়াক আহম্মেদকে মারধর ও অবরুদ্ধ করে রাখেন। এক ঘণ্টা পর তাঁকে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারখানার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
নিহত এনামুলের বাড়ি রংপুর জেলায়। তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। এসিআই ওষুধ কারখানায় অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গতকাল রাত সোয়া আটটায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে নিহত এনামুলের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর মুখ ও বুকে অনেকগুলো রাবার বুলেটের চিহ্ন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল পানিরকল এলাকায় অবস্থিত এসিআইয়ের ওষুধ কারখানায় ১৬৭ জন স্থায়ী শ্রমিক ও ৬০০ অস্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার স্থায়ী এক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে দাবি করে অস্থায়ী শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা মজুরি বাড়ানোর দাবি জানান। অস্থায়ী শ্রমিকদের দৈনিক ১২০ থেকে ১৪০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। শ্রমিকেরা এই মজুরি ২৫০ টাকা করার দাবি জানান।
দাবি আদায়ে অস্থায়ী শ্রমিকেরা গতকাল সকালে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা কারখানার ভেতরে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি আদায়ে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইশতিয়াক আহম্মেদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাঁরা কারখানার দুটি ইউনিটে (এনিমেল ড্রাগস ও হিউম্যান ড্রাগস) ভাঙচুর চালান। এতে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে যায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ। এ সময় আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে। শ্রমিকেরা পাল্টা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ওষুধের কাচের বোতল নিক্ষেপ করেন। শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। শ্রমিকেরা কারখানার ভেতরে সাতটি মাইক্রোবাস, তিনটি কাভার্ড ভ্যান, একটি পিকআপ ভ্যান ও একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করেন। দফায় দফায় চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া আর সংঘর্ষ।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের শহরের খানপুরে অবস্থিত ২০০ শয্যাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় কারখানার অস্থায়ী শ্রমিক এনামুলের মৃত্যু হয়।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আর্মড পুলিশের নায়েক মনির হোসেন, কনস্টেবল হেলাল এবং ২৬ শ্রমিককে শহরের ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত অন্যদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বেলা তিনটায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কারখানার জানালার কাচ, চেয়ার, টেবিলসহ আসবাব, কম্পিউটার, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষই ছিল তছনছ। কারখানা পাহারা দিচ্ছিল পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা। কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিক সোহেল, ময়না, সজীব ও মামুন জানান, ‘আমরা মূল মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা করার দাবি করছিলাম। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি মেনে নেয়নি। দাবি আদায়ে আন্দোলন করলেই শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। ১৫ বছর ধরে চাকরি করছেন এমন অনেক শ্রমিক আছেন, যাঁদের চাকরি এখনো স্থায়ী করা হয়নি। এসব দাবিতে কয়েক দিন ধরে আমরা কারখানায় শান্তিপূর্ণভাবে কর্মবিরতি পালন করছিলাম। কিন্তু গতকাল সকালে পুলিশ আমাদের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে আমাদের সহকর্মী এনামুল হক নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আরও ১৫ শ্রমিক। আহত হন শতাধিক।’
এসিআই কারখানার সিবিএ সভাপতি নুরুল হক দাবি করেন, পুলিশ নিরীহ শ্রমিকদের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণ করেছে। তিনি হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
এ বিষয়ে এসিআই কারখানার আহত কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহম্মেদ জানান, শ্রমিকেরা অযৌক্তিক দাবিতে কয়েক দিন ধরে কারখানায় কর্মবিরতি পালন করছেন। গতকাল সকালে শ্রমিকেরা কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর করলে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ বাধে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদরুল আলম জানান, শ্রমিকেরা কারখানায় ভাঙচুর চালালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৩০-৪০টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করে। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। তবে পুলিশের গুলিতে এনামুলের মৃত্যু হয়নি। শ্রমিকদের ইটপাটকেলের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
ওসি বদরুল জানান, সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এনামুলের লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। সংঘর্ষ, কারখানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ সুপার বিশ্বাস আফজাল হোসেন জানান, ‘ঘটনাটি শুধুই শ্রমিক অসন্তোষ, নাকি পেছনে কারও ইন্ধন রয়েছে, আমরা তা খতিয়ে দেখছি।’

ব্যাংকের মুনাফার হিসাব প্রকাশ ও তা বাজারে আনার সুপারিশ

পুঁজিবাজার থেকে গত কয়েক বছরে ব্যাংক, বিমা ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ মুনাফা করেছে, তার হিসাব প্রকাশের দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ওই মুনাফার টাকা পুনরায় শেয়ারবাজারে ফিরিয়ে আনারও সুপারিশ করা হয়েছে।

গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এসব দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেয়ারবাজারের ধসের জন্য কারা দায়ী, তা নিয়েও অনেক কথাবার্তা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা উপায়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে অর্থ তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে এক দফা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় বলেও জানা গেছে।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হওয়া এ বৈঠক চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ চৌধুরী, সাবেক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান, বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সহসভাপতি আল মারুফ খান, বাংলাদেশ পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএলসিএ) সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার, এবি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কাইজার এ চৌধুরী, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি শেখ মর্তুজা আহমেদসহ শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা বলেন, গত কয়েক বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব টাকা বাজারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ব্যাংক কত টাকা মুনাফা করেছে তাও জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, ব্যাংকের আমানতের কোনো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। কেউ তা চায়ও না।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান সভায় বলেন, যেসব কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দেশক দামের নিচে নেমে এসেছে, ওই সব কোম্পানির বেলায় আইন করে নিজ কোম্পানির শেয়ার পুনঃক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে তুলে নেওয়া টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম তালিকাভুক্তির ছয় মাসের মধ্যে নির্দেশক দামের নিচে নেমে আসে তাহলে কোম্পানিটির শেয়ারের যে পরিমাণ দাম কমবে সমপরিমাণ অর্থ কোম্পানিটিকে বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে বা ওই সমপরিমাণ টাকায় তাকে নিজ কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে।
রকিবুর রহমানের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সালমান এফ রহমান। তিনিও শেয়ার পুনঃক্রয় (বাই-ব্যাক) ব্যবস্থা চালুর কথা বলেন।
সালমান এফ রহমান বৈঠকের একটি আলোচনাকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত একজন তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি উড়োজাহাজ কোম্পানির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই বক্তা বলেন, কোম্পানিটি বছরের পর বছর লোকসান দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে আইপিওতে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার আগের বছর কোম্পানিটি মুনাফা দেখিয়েছে। যখন কোম্পানিটি লোকসান করেছে, তখন খরচ বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু যে বছর মুনাফা করেছে, সে বছর খরচ দেখানো হলো কম। এটা কীভাবে সম্ভব, তা বোধগম্য নয়। কোম্পানিটি যে টেলিফোন খরচ দেখিয়েছে, তা তাঁর ব্রোকারেজ হাউসের টেলিফোন খরচের চেয়েও কম।
এ বক্তব্যের পরপরই সালমান এফ রহমান বলেন, তিনি বহু ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়নি। এসব আলোচনা এ ফোরামের বিষয় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর উড়োজাহাজ বহরে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রুট চালু করা হয়েছে। এসব কারণে মুনাফা হয়েছে। টেলিফোন খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ‘সিটা’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ কারণে টেলিফোন খরচ কম হয়েছে। এসব বিষয়ে না জেনে ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।
সিএসইর সহসভাপতি আল মারুফ খান প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে একসঙ্গে পুরো টাকা বাজার থেকে তোলার সুযোগ না দিয়ে ধাপে ধাপে টাকা তোলার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইপিও-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, এতে পুরো প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমবে। দীর্ঘদিন টাকা আটকে থাকবে না। পাশাপাশি কোম্পানির দামভেদে আরোপিত সার্কিট ব্রেকার (দাম বাড়া-কমার নির্ধারিত সীমা) সীমা কমিয়ে আনার কথা বলেন, যাতে খুব বেশি লাভ-লোকসানের সুযোগ না থাকে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্লেসমেন্টকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান সিএসইর প্রতিনিধিরা।
দুই এক্সচেঞ্জের নেতারা বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কোম্পানিগুলোর হিসাব বিবরণী নিরীক্ষার দাবি জানান।
সভায় উপস্থিত ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে যে মুনাফা করেছে তার একটি অংশ ওই ব্যাংকেরই সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে রাখতে হবে। তার পরই ওই ব্যাংক মুনাফার ভিত্তিতে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে।
জানা গেছে, সভায় তিনটি কোম্পানি বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, ওই সব কোম্পানি তালিকাভুক্তির শুরুতে বিনিয়োগকারীদের কাছে যে দামে শেয়ার বিক্রি করেছে, ধীরে ধীরে তার দাম কমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কীভাবে কোম্পানিগুলোকে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দেওয়া হলো, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি একপর্যায়ে বক্তব্য দিতে চাইলে অর্থমন্ত্রী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আলাদা বৈঠকে তোমাদের কথা শোনা হবে। এখানে আমি অন্যদের কথা শুনতে চাই।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম শেয়ারবাজারের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে গেলে সেখানে দলের লোকজন বাজার সম্পর্কে জানতে চান। শেয়ারবাজারের অস্থিরতার কারণে দলের অনেক কর্মীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে তাঁদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ বাজারের সঙ্গে এখন সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোক জড়িত। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে কোনোভাবেই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই।
সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশানুরূপ ফল অর্জন না করার পেছনে শেয়ারবাজারের অস্থিরতার একটা প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সভায় সব শেয়ারের অভিন্ন অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) নির্ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, অভিহিত মূল্য পরিবর্তনে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও এটিকে কেন্দ্র করে বাজারে কারসাজি হয়েছে। এটিও বাজারে অস্থিরতা তৈরিতে সহায়তা করেছে। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এভাবে আর দামে কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য সব কোম্পানির অভিন্ন অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।
পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতার স্বার্থে এসইসির জনবল বাড়ানো এবং একে আরও বেশি শক্তিশালী করার পরামর্শ তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বাজার নিয়ে যেকোনো মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন উপস্থিত অনেকে। তাঁরা বলেন, সরকারের লোকজনই বাজার নিয়ে যেসব মন্তব্য করছেন, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আরও বাড়াচ্ছে।
সভায় উপস্থিত অনেকে সরাসরি নাম উল্লেখ না করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, এ মুহূর্তে কারোরই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে কেউ যাতে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে না পারেন, সে জন্য আর্থিক বিশ্লেষক লাইসেন্স পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাজারের গভীরতা বাড়াতে তহবিল ও পত্রকোষ (পোর্টফোলিও) ছাড়পত্র চালুরও কথা বলেন কেউ কেউ।
সকালের এই সভাতেই মূল্যসূচকের ওপর আরোপিত সার্কিট ব্রেকার তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গতকালের সভায় শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করা হয়। বাজারের এই অস্থিরতার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন অনেকে।

বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও বিশ্বের কল্যাণ কামনা

র্মপরায়ণ মুসলি্লদের আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার দুপুরে শেষ হয়েছে তাবলিগ জামাতের প্রথম পর্বের তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমা। বৃহত্তর ঢাকাসহ ৩৩ জেলার মুসলি্লরা এ পর্বে অংশ নেন।

চার দিনের বিরতির পর ৩১ জেলার মুসলি্লদের নিয়ে ২৮, ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি এ ময়দানেই অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমার শেষ পর্ব। গতকাল আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ভোর থেকে টঙ্গীর চারপাশ থেকে সমবেত হন মুসলি্লরা। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে শুরু হয় আখেরি মোনাজাত। মুহূর্তেই টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান ও তুরাগতীরবর্তী কয়েক কিলোমিটার এলাকা পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। মাঠ থেকে ইথারে ভেসে আসে আল্লাহর দরবারে শত মিনতি আর অশ্রুপূর্ণ ফরিয়াদ।
এবারও আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতিনির্ধারক দিলি্লর নিজামুদ্দীনের মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। ২০ মিনিট স্থায়ী মোনাজাতে তিনি ব্যক্তিজীবনের পরিশুদ্ধি, মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্বমানবের কল্যাণ কামনা করেন। তাঁর অনুসরণে করজোড়ে লাখো মুসলি্ল রাস্তায়, নৌকায়, ঘরের চালে, বাসার ছাদে বসে কেবল আমিন আমিন বলেন।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ধর্মীয় সমাবেশ ও আখেরি মোনাজাত ঘিরে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলি্লরা সমবেত হন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয়
নেতা খালেদা জিয়াসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাত শুরুর আগ পর্যন্ত বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, কিশোর, যুবক_নানা বয়সের মানুষ ছুটে আসে ময়দানের দিকে। দক্ষিণে র‌্যাবের প্রধান কার্যালয় ও উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ছিল মুসলি্লদের স্রোত। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, অফিস-আদালত প্রায় বন্ধ ছিল। সরকারি ঘোষণা না থাকলেও রাজধানীর অফিস-আদালত ছিল অনেকটা ফাঁকা। বাংলাদেশ বেতার ও কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করে।

আখেরি মোনাজাতের সংক্ষেপ
মাওলানা যোবায়েরুল হাসান আখেরি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে ইজতেমায় উপস্থিত সব হাতের হেদায়েত কামনা করেন। মিনতি কণ্ঠে তিনি বলেন, 'যাঁরা হাত ওঠালেন, তাঁদের কবুল করুন, সবার হেদায়েতের ফয়সালা করুন।'
আবেগতাড়িত কণ্ঠে মাওলানা যোবায়েরুল বলেন, 'হে আল্লাহ, আমাদের, আমাদের মা-বাবার, সারা বিশ্ববাসীর হেদায়েত দিন। যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের মাফ করে দিন। যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের ক্ষমা করে দিন। আপনার মকবুল (উত্তম) বান্দা হিসেবে আমাদের কবুল করে নিন। দুনিয়ার যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে আমাদের বাঁচান। চরিত্র ভালো করে দিন। আপনার আদর্শমতো চলার তৌফিক দিন।' দীর্ঘ মোনাজাতে তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের রক্ষা করার আবেদন জানান। হিংসুকের হিংসা, শত্রুর শত্রুতা দূর করে মুসলমানদের কদম ইসলামের ওপর দৃঢ় করতে আল্লাহর দরবারে সামর্থ্য কামনা করেন।

মুসলি্লর চাপ কমেছে সামান্য
মুসলি্লদের জায়গার সংকুলান না হওয়া এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মুসলি্লদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তাবলিগ জামাত কর্তৃপক্ষ এ বছর থেকে দুই পর্বে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এ সিদ্ধান্তে মুসলি্লদের চাপ সামান্য কমলেও ইজতেমায় জনদুর্ভোগের ক্ষেত্রে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। বিশেষ করে অজু ও গোসলের পানির সংকটে মুসলি্লরা কষ্ট পেয়েছেন।
মিরপুর ৭ নম্বর থেকে ইজতেমায় আসা কাঁচামালের ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন বলেন, 'এবারের ইজতেমায় কমপক্ষে গতবারের চার ভাগের এক ভাগ মানুষ কম হয়েছে।' আবদুল্লাহপুর সড়কে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'গত বছর এ জায়গায় গলায় গলায় জড়িয়েও হাঁটতে পারিনি। এবার হাঁটতে পারছি।' আরিফ জানান, ২০ বছর ধরে তিনি ইজতেমায় আসছেন।
গতকাল ফজর নামাজের পর বয়ান করেন তাবলিগের মুরবি্ব মাওলানা জমির উদ্দিন। সকাল ৯টা থেকে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত তাবলিগ জামাতের ছয় মৌলিক নীতিমালার (কালেমা, নামাজ, ইল্ম, জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিহে নিয়ত) মর্মার্থ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন শীর্ষ মুরবি্ব মাওলানা সাদ। বাংলায় তা ভাষান্তর করে শোনান হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের।

সকালে যানবাহনশূন্য, বিকেলে যানজটের দুর্ভোগ
সকালে ইজতেমায় যেতে যানবাহনশূন্যতায় দুর্ভোগ পোহান মুসলি্লরা। বিকেলে ওই রাস্তায় যানজটে পড়ে আবার দুর্ভোগ নিয়েই বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা। ইজতেমা উপলক্ষে গতকাল ভোর থেকেই একদিকে মহাখালী, অন্যদিকে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সব ধরনের যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় শেষ সময়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ মুসলি্ল দলে দলে হেঁটে মোনাজাতে শরিক হন। কিছুসংখ্যক মুসলি্ল ভ্যানে ও মোটরসাইকেলে চড়ে ইজতেমায় অংশ নেন। পুলিশ বারিধারার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রাইভেট কার চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করে। মোটরসাইকেল ছাড়া ওই রাস্তায় অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। রাস্তায় যাত্রীবাহী কোনো যানবাহন না থাকায় মুসলি্লরা দুর্ভোগে পড়েন। অনেকে চড়া ভাড়ায় রিকশাভ্যানে চড়ে গন্তব্যে ফেরেন। সন্ধ্যার পর 'গেটলক' বলে চড়া ভাড়ায় এ রুটের যানবাহনগুলো যাত্রী পরিবহন করে।
যানজট ঠেকাতে উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী, স্টেশন রোড, মিলগেট, চেরাগ আলী মার্কেট, বোর্ডবাজার, জয়দেবপুর চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে শনিবার রাতেই র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার মোতায়েন করা হয়। কিন্তু ইজতেমা শেষ হওয়ার কিছু পর ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেট স্ট্যান্ডে থাকা বেশ কিছু খালি ট্রাক যাত্রী বহনের জন্য এলোমেলো করে রাস্তায় দাঁড়ালে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী রেলস্টেশনেও মুসলি্লরা ভিড় করেন। বগিতে উঠতে না পেরে অনেকে ছাদে ওঠেন। স্থানীয় বাসিন্দারা মুসলি্লদের ট্রেনের ছাদে উঠতে 'মই' ভাড়া দেন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার অংশগ্রহণ
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান মূল বয়ানমঞ্চে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবদুল্লাহপুর পলওয়েল কনভেনশন সেন্টারের ছাদে এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া টঙ্গীর এটলাস মোটরসাইকেল ফ্যাক্টরির ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে শরিক হন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক, সংসদ সদস্য কে এম মোজাম্মেল, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও জাহিদ আহসান রাসেল, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম এ করিম, প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এম এ মান্নান ও রুহুল আলম চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মাসুদ আহমেদ তালুকদার, মহিলা দলের সভাপতি নূরে আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদক শিরীন সুলতানা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

মাইক নিয়ে অসন্তোষ
মাঠের বাইরে পর্যাপ্ত মাইক না থাকায় এবার আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়া মুসলি্লরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। আবদুল্লাহপুর, উত্তরা ও আজমপুরে অনেক মুসলি্ল পরস্পর দেখাদেখি মোনাজাত ধরেছেন, আবার মোনাজাত ছেড়েও দিয়েছেন। ইজতেমায় বয়ান শোনার জন্য এবার মাঠের বিভিন্ন স্থানে দেড় শ ছাতা মাইক ও পাঁচ শতাধিক লম্বা মাইক টাঙানো হয়। কিন্তু আবদুল্লাহপুর, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মাইক দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় মুসলি্লরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
উত্তরার কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা শফিউল্লাহ নাতিকে নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আসেন। টঙ্গী সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'অন্তত আজমপুর পর্যন্ত মাইক দেওয়া উচিত ছিল। মাইক না থাকায় অনেকে মোনাজাতে শরিক হতে পারবে না। ফলে লাখ লাখ মানুষের কষ্টটাই বৃথা যাবে।'

নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে
বিশ্ব ইজতেমায় নারীদের অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়। এর পরও কয়েক বছর ধরে ইজতেমায় নারী মুসলি্লদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। গতকাল ময়দানের দক্ষিণে আবদুল্লাহপুর সড়ক ও উত্তরা এলাকায় পুরুষদের পাশাপাশি চাটাই ও পলিথিন বিছিয়ে বিপুলসংখ্যক নারী মুসলি্লকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়।
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে হেঁটে ইজতেমায় আসেন সুফিয়া খাতুন। চার বছর ধরে তিনি আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সকাল ৬টায় তিনি বাসা থেকে বের হন। সাড়ে ১০টায় আবদুল্লাপুর পেঁৗছেন। লাখো মুমিনের সঙ্গে মোনাজাতে অংশ নিতে পারা বড় পুণ্যের কাজ বলে তিনি মনে করেন। অবশ্য তাবলিগ জামাতের একজন মুরবি্ব আখেরি মোনাজাতে নারী-পুরুষের অবাধ অংশগ্রহণ থাকলে ইজতেমায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন।

চার মুসলি্লর মৃত্যু
শনিবার রাতে ইজতেমার প্যান্ডেলে মালয়েশিয়ার এক নাগরিকসহ চারজন মুসলি্ল মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন মালয়েশিয়ার নাগরিক আবু বকর বিন মনছুর (৬৩), চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার ফরিদ উদ্দিন (৬০), সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকার মো. মুসা মিয়া (৭০) ও ভোলার লালমোহনের ওয়াজিউল্লাহ (৫৮)। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনা ও হৃদরোগে এক পুলিশ কনস্টেবলসহ আরো চারজন মারা যান।
মালয়েশিয়ার নাগরিক আবু বকর বিন মনছুরের লাশ জানাজা শেষে ইজতেমা মাঠেই দাফন করা হয়। বাকিদের লাশ নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাঠের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শুরু আজ
প্রথম পর্বের মোনাজাত শেষ হওয়ার পর আজ সোমবার থেকে আবার স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু হবে। মাঠ প্রস্তুতবিষয়ক জিম্মাদার আবদুল কুদ্দুছ জানান, এ কয়েক দিনে মাঠে প্রচুর আবর্জনা জমা হয়েছে। এগুলো পরিষ্কার করে দ্বিতীয় পর্বের মুসলি্লদের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে হবে। অজুখানা, পায়খানা, প্রস্রাবখানা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে।
ইজতেমায় আসা বিদেশি মুসলি্লদের বেশির ভাগই দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষে নতুন জামাতবন্দি হয়ে বিভিন্ন দেশে তাবলিগে যাবেন। আন্তর্জাতিক নিবাসের নিরাপত্তা পাসের দায়িত্বে থাকা জিন্মাদার প্রকৌশলী মুহিব উল্লাহ জানান, বিদেশি মেহমানরা আপাতত কাকরাইল ও রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে দাওয়াতি কাজ করবেন। তাঁরা দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায়ও অংশ নেবেন।

সংসদের ২ বছরঃ ১৩০ বিলের ৯১টি পাস বিরোধী দল ছাড়া

গামীকাল ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার তৃতীয় বর্ষে পড়ছে নবম জাতীয় সংসদ। গত দুই বছরে নবম সংসদে সাতটি অধিবেশনে পাস হয়েছে ১৩০টি বিল। এগুলোর ৯১টিই পাস হয়েছে সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে।

সংসদের কার্যপ্রবাহ থেকে জানা যায়, যেসব (৩৯টি) বিল পাসের সময় বিরোধীদলীয় সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন, সে সময় তুমুল বিতর্কে সংসদ ছিল প্রাণবন্ত। এ কারণে প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার বেশি। বিলের ওপর বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও রাশেদা বেগমের আনা সংশোধনী প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। তবে বেশি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিমের।
জানা যায়, প্রথম অধিবেশনে ৩২টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১১টি, চতুর্থ অধিবেশনে ২৩টি, পঞ্চম অধিবেশনে ২৪টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ১৩টি এবং সর্বশেষ সপ্তম অধিবেশনে চারটি বিল পাস হয়েছে। এসব বিলের ওপর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সদস্যরা এক হাজারের বেশি নোটিশ দিয়েছেন। ফজলুল আজিম দিয়েছেন দুই শতাধিক নোটিশ। সরকারি দলের সদস্যদের দেওয়া নোটিশের সংখ্যা ১০০-এর বেশি নয়।
জানা গেছে, যে ৯১টি বিল পাসের সময় বিএনপি ও তাদের জোটের সদস্যরা অনুপস্থিত ছিলেন, সেসব বিলসংক্রান্ত বিরোধীদলীয় সদস্যদের নোটিশের ৯০ শতাংশ উত্থাপিত হয়নি। এমনও হয়েছে, বিরোধী দল সংসদে থাকলেও নোটিশদাতা সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে এসব বিলের ওপর সংসদে তেমন আলোচনা হয়নি। এসব বিলের দফা উচ্চারণ করতে স্পিকারের যতটুকু সময় লেগেছে, সেই সময়ের মধ্যে বিলগুলো পাস হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এ রকম প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে গড়ে পাঁচ থেকে সাত মিনিট।
এ অবস্থায় আগামীকাল বিকেল তিনটায় বর্তমান সংসদের অষ্টম অধিবেশন শুরু হচ্ছে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন। সংসদ বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর অতীতের মতো বর্তমান সরকারের মেয়াদের প্রথম দুই বছরেও সংসদ সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে পারেনি। সংসদ বর্জনের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিরোধী দল। বেশির ভাগ সময় তাদের অনুপস্থিতির কারণে সংসদ ছিল একপেশে।নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা মহাজোটও ছোট আকারের বিরোধী দলকে সংসদে ধরে রাখতে পারেনি।
স্পিকার আবদুল হামিদ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধী দল সংসদে থাকলে সংসদ আরও প্রাণবন্ত ও কার্যকর হতো, এটা ঠিক। তবে বিরোধী দল সংসদে না এলেও সংসদীয় কমিটির সভায় তাদের সদস্যরা নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিলগুলো প্রস্তুত করছেন। অধিবেশন কক্ষে তাঁরা সশরীরে না এলেও প্রশ্ন জমা দিচ্ছেন এবং মন্ত্রীরা সেসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তাই এ সংসদকে অকার্যকর বলার সুযোগ নেই। তিনি মনে করেন, আইন প্রণয়নে বিরোধী দল আরও সক্রিয় হলে নিশ্চয়ই আইনগুলো আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। তবে বিলের ওপর সাংসদদের কম অংশগ্রহণের বিষয়টি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ এম কে আনোয়ার বলেন, বিলের ওপর বিরোধী দল আলোচনা করলে সংসদও প্রাণবন্ত হতো, আইনগুলোও নির্ভুল হতে পারত।
বিরোধী দলের সদস্যদের গড় উপস্থিতি ৪৪ দিন: গত সাত অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ১৭৪টি। এর মধ্যে বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের সাংসদেরা গড়ে উপস্থিত ছিলেন ৪৪ দিন। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম অধিবেশনের পুরোটাই অনুপস্থিত ছিলেন তাঁরা। পঞ্চম অধিবেশনে তাঁরা যোগ দেন এক দিন। প্রথম অধিবেশনে যোগ দিলেও টানা ৬৩ কার্যদিবস অনুপস্থিতির পর গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল সংসদে ফিরে কয়েক দিন অধিবেশনে যোগ দেয়। গত বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় কার্যদিবস থেকে তারা টানা ৪৮ দিন অনুপস্থিত রয়েছে।
দু্ই বছরেও বিরোধী দল তাদের উপনেতা নির্বাচন করেনি। ফলে বিরোধীদলীয় নেতার অনুপস্থিতিতে তাদের বিকল্প নেতা থাকেন না। তবে বিরোধী দলের সাংসদেরা অধিবেশনে প্রশ্ন, নোটিশ, বিলের ওপর সংশোধনীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব জমা দিচ্ছেন। তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেন সরকারি দলের সদস্যরা। তবে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সংসদীয় কমিটির সভায় নিয়মিত অংশ নেন। সংসদের যেকোনো আইন প্রণয়নকাজের সঙ্গে তাঁরা কমিটির মাধ্যমে তাঁদের মতামত দিচ্ছেন। সংসদকেন্দ্রিক বিদেশ সফরেও যাচ্ছেন তাঁরা।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) অলি আহমদ, স্বতন্ত্র ফজলুল আজিম এবং মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদেরা সংসদে নিয়মিত যোগ দেন।
নবম সংসদে এ পর্যন্ত সব কার্যদিবসে উপস্থিত ছিলেন নীলফামারী-৫ আসনের এ এ মারুফ সাকলান। উপস্থিতির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে স্পিকার আবদুল হামিদ (১৬৭ দিন)।
শেখ হাসিনা ১২৬ দিন, খালেদা জিয়া পাঁচ দিন: সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপ্তম অধিবেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন ১২৬ দিন। আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন পাঁচ দিন, যা বর্তমান সংসদে সর্বনিম্ন উপস্থিতি। তবে অষ্টম সংসদের সংসদ নেতা থাকাকালে তিনি ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে ১৯৫ দিন উপস্থিত ছিলেন। আর ওই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৪৫ দিন।
নবম সংসদে অনুপস্থিতির দিক থেকে খালেদা জিয়ার পরে রয়েছেন কুমিল্লা-৩ আসনের কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ (১০ দিন)।
প্রসঙ্গত, বর্তমান আইন অনুযায়ী টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে যে কারও সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ রয়েছে, ‘৩০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলেই সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে, আমরা সরকার গঠন করতে পারলে এই আইন করব।’
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অঙ্গীকার আমরা এখনো অস্বীকার করি না। আমরা তো সংসদে যাওয়ার ও সংসদ কার্যকর করার পক্ষে। কিন্তু সরকারি দলের ব্যর্থতার কারণে সেটি না হলে এর দায়ভার সরকার পক্ষেরই।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংসদের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, বিরোধী দল ছোট হলেও তাদের ছাড়া সংসদ কার্যকর বলা কঠিন। তাই অনেক কাজ করলেও গত দুই বছরে সংসদ কার্যকর হয়েছে, এটা খুব করে বলা যাবে না। তিনি বিএনপির সংসদে না যাওয়ার সমালোচনা করে বলেন, বিরোধী দলের সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন জনগণের স্বার্থেই।
ওয়াকআউট: বিএনপি গত সাতটি অধিবেশন পর্যন্ত ওয়াকআউট করেছে ৫২ বার। সর্বশেষ গত বাজেট অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসে ওয়াকআউটের পর তারা আর অধিবেশনে যোগ দেয়নি। অষ্টম সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল ৯৫ বার ওয়াকআউট করে।

পুঁজিবাজারে অস্থিরতার দায় এসইসির

'পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) শেয়ারবাজার নিয়ে অনভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো আচরণ করেছে। অনভিজ্ঞ ডাক্তার যেমন রোগীকে সকালে হাড় ভাঙার ওষুধ দেওয়ার পর বিকেলে তা বাতিল করে ঠাণ্ডা লাগার ওষুধ দেয়_পুঁজিবাজার নিয়ে তেমনটিই করেছে এসইসি।

তারা সকালে এক সিদ্ধান্ত, বিকেলে অন্য সিদ্ধান্ত দিয়েছে!' গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন। 'মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ ব্যাংক' শিরোনামে সেমিনারটি আয়োজন করা হলেও তা মূলত শেয়ারবাজারের আলোচনায় রূপ নেয়। সেমিনারে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ, কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইব্রাহীম খালেদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
পুঁজিবাজারের অস্থিরতার পেছনে অর্থমন্ত্রীর তেমন ভূমিকা নেই উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর বলেন, 'সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অর্থমন্ত্রী সংস্থাটিকে হয়তো পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারেন। বাজার অস্থিরতার পেছনে এসইসির দোষ রয়েছে।' কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হলেও ডিসেম্বরে সিআরআর, এসএলআরের হার বাড়ানো ঠিক হয়নি উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'কিছু দিন আগে অথবা আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে এসব পদক্ষেপ নিতে পারত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আগে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। অনলাইন পদ্ধতি দোষীদের খুঁজে বের করা খুবই সহজ। ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারীদের তখনই শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। বিদেশে এ ধরনের অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'পুঁজিবাজারের এ অস্থিরতার কারণে আর্থিক খাতও ঝুঁকিতে রয়েছে। আর আর্থিক খাতে মড়ক দেখা দিলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ অবস্থা হলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার তেমন কোনো উপায় থাকবে না।' সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, 'ব্যাংকগুলো আমানতকারীর টাকা নিয়ে শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। আমানতকারীর টাকা নিয়ে এ ধরনের ঝুঁঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যাওয়া ব্যাংকগুলোর উচিত হয়নি। আর মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর, এসএলআর বাড়িয়ে মুদ্রাবাজার সংকোচন করবে_এটা ঠিক নয়। এতে উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এসব খাত এমনতিইে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসি নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।' সাবেক এই গভর্নর আরো বলেন, 'পৃথিবীর কোনো দেশে ১০০ টাকা ফেসভ্যালুর শেয়ার ১১০ বা ১১৫ টাকার বেশি বিক্রি হতে দেখা যায় না। আর বাংলাদেশে ১০ টাকার ফেসভ্যালুর শেয়ার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়ও বিক্রি হয়!' কেবল আইপিও-নির্ভর না হয়ে বাজারে করপোরেট বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসইসির নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও সার্কুলার পরস্পরকে প্রভাবিত করে উল্লেখ করে সংস্থা দুটির মধ্যে গভীর সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, 'প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও মুদ্রানীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি দমানো সম্ভব নয়। এজন্য মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এখনো ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণের সুদের হারের পার্থক্য ৫ শতাংশেরও বেশি উল্লেখ করে তিনি তা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন।'
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, 'শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার পেছনে কারা দায়ী, তা সকলেরই জানা। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতেও পুঁজিবাজার নিয়ে_এমন খেলা খেলবে তারা।'
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অর্থনীতির বড় অংশ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে আয় ও কাজ বাড়াতে না পারলে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যোগসাজশের অর্থনীতি চলছে। এখানে যিনি সংসদ সদস্য, তিনিই রাজনীতিবিদ, তিনিই ব্যবসায়ী, তিনিই ব্যাংকার। তিনিই নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ধরনের অবস্থা থেকে অর্থনীতিতে মুক্তি দিতে হবে।' মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতি ও বহির্বিশ্বে পণ্যমূল্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ এসব দেশ থেকেই বাংলাদেশকে পণ্য আমদানি করতে হয়। ভারতে মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়ে।' তিনি বলেন, 'চলমান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি থাকবেই। তবে তা ৪-৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ হলে তা চিন্তার বিষয়। আর তারও বেশি হলে ব্যবস্থা নিতেই হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের বেশি, আর খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় ব্যবস্থা না নিয়ে উপায় নেই।'
সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কে কার্যকর করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কোনো পণ্য আমদানি করতে হলে ৪০ থেকে ৫০ জনের স্বাক্ষর নিতে হবে। তত দিনে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে।' তাই টিসিবিকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে রূপান্তরের পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইব্রাহীম খালেদ বলেন, 'শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করা যৌক্তিক নয়। কারণ বাজারে শেয়ারের দাম যে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল, তা আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছিল। আর পাঁচটি ব্যাংক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল। এর মধ্যে দুই-তিনটি ব্যাংক শেয়ারবাজার নিয়ে অতি বাজে খেলায় মেতেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো উদ্যোগ না নিলে শেয়ারবাজারের সঙ্গে এখন ব্যাংকগুলোও বিপর্যস্ত হতো। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল, আরো আগে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।'
বাংলাদেশের মুদ্রায়ন খুবই নিম্নমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মুদ্রানীতি মুদ্রাবাজারকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে না।' মোটামুটিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলসহ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হলে সবাই সন্তুষ্ট হবেন বলে মত দেন তিনি। সেমিনারে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রশীদ লালী বলেন, 'বাজারে তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংকে গিয়ে ১০ লাখ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কয়েক মাস আগেও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি অলস টাকা পড়ে ছিল। এই টাকা গেল কোথায়?' সেমিনারে ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবু কায়সার প্রমুখ বক্তব্য দেন।

২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সেনা মোতায়েন অনিশ্চিত

গামী ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ১৩টি পৌরসভা এবং জাতীয় সংসদের হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে উপনির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত ছিল, ১৩ পৌরসভার মধ্যে মাগুরা, ঝালকাঠি, মাধবদী, মাদারীপুর, কঙ্বাজার, চকরিয়া ও টেকনাফে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে থেকে পাঁচ দিনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। আর চরফ্যাশন ও মহেশখালীতে মোতায়েন থাকবে নৌবাহিনী। কিন্তু গতকাল রবিবার সে সিদ্ধান্ত পাল্টে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন গতকাল মাগুরা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, মাধবদী, কঙ্বাজার
ও চকরিয়া পৌরসভার জন্য দুই প্লাটুন করে এবং চরফ্যাশন, মহেশখালী, পার্বতীপুর, জাজিরা, মদন, দাগনভূঞা ও টেকনাফে এক প্লাটুন করে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি পৌরসভার জন্য এক থেকে দুই কম্পানি/প্লাটুন করে র‌্যাব মোতায়েনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের আরো সিদ্ধান্ত, বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা ভোট গ্রহণের দুদিন আগে (২৫ জানুয়ারি) থেকে নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্র টহল দেবে। আর ভোট গ্রহণের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে মোতায়েন থাকবে। ভোট গ্রহণ শেষে ভোট গণনা কক্ষের চারপাশে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে দায়িত্ব পালন করবে তারা। এ ছাড়া বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল ঘোষণার পর রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ফলাফল একীভূত করা এবং ফলাফল পরিবেশনের আগে থেকে ওই কার্যালয়ের চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে প্রবেশ পথেও দায়িত্ব পালন করবে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (পৌর-১) মো. আবদুল বাতেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এক সপ্তাহ আগে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত পৌরসভাগুলোয় সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করার জন্য সশস্ত্রবাহিনী বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সে সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, আমার জানা নেই।'
তবে কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকর্তা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনা মোতায়েন না করার পক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করায় সেসব যুক্তি গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনীর ফায়ারিং মহড়া থাকার কারণে নির্বাচনে তাদের দায়িত্ব পালন অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া নির্বাচন হয়ে যাওয়া পৌরসভার বেশ কয়েকটিতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করে তেমন কোনো সুফল মিলেছে বলে মনে হয়নি। সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকার পরও কয়েকটি পৌরসভায় ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আবার সেনাবাহিনী মোতায়েন না থাকা সত্ত্বেও বিএনপির আশঙ্কার বিপরীতে সেখানে তাদের সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে।'
এদিকে এর আগে এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, জাতীয় সংসদের দুই আসনের উপনির্বাচন ও পৌরসভা নির্বাচনেও সেনা মোতায়েন থাকছে। এ ছাড়া তিনি বলেন, সেনাবাহিনীকে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি বলে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইয়ের ঘটনায় তাদের কিছু করার ছিল না। এবারে তারা ভোটকেন্দ্রেও দায়িত্ব পালন করবে এবং এতে আইনগত কোনো বাধা নেই। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই অংশ।
উপনির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত বহাল থাকছে কি না_এ প্রশ্নে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে আইন নেই। সোমবার (আজ) এ নির্বাচন সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বৈঠক রয়েছে। সেখানে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
গত ১১ জানুয়ারি হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে কমিশন এ নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দুই কম্পানি করে সশস্ত্রবাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (সংসদ নির্বাচনের আইন) সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত না রাখা সত্ত্বেও কেন এ দুই উপনির্বাচনে তাদের মোতায়েন করা হচ্ছে_এ প্রশ্নে এম সাখাওয়াত হোসেন এর আগে বলেন, বিশ্ব ইজতেমা দুই দফায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ দিতে পারছে না বলেই সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভিডিও ক্যামেরা : হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচনী এলাকায় তিনটি করে ভিডিও ক্যামেরা চালু থাকবে। ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে থেকে নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম এবং ভোট গ্রহণের দিনের কার্যক্রম ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে তা সিডির মাধ্যমে কমিশনের কাছে পাঠনোর জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল কমিশন সচিবালয় থেকে পাঠানো এ নির্দেশনায় আরো বলা হয়, ভিডিও ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান জেলার বাইরে থেকে নিয়োজিত করতে হবে।

এখনো আশাঃ মাশরাফির বিশ্বকাপ-স্বপ্নে নতুন রং

ডেভিড ইয়াং কী বলতে পারেন, সে সম্পর্কে আগাম ধারণা নিয়েই কলম্বো গিয়েছিলেন তিনি। গতকাল সাক্ষাতের পর অস্ট্রেলীয় এ শৈল্যবিদের মূল্যায়নের সঙ্গে পূর্বধারণা মিলে যাওয়ায় কি মাশরাফি বিন মুর্তজার বিশ্বকাপ-স্বপ্ন আরো ডালপালা মেলল?

দল ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় এ স্বপ্ন নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে রাজি নন মাশরাফি। তবে আগামী দিন দশেক পর 'নড়াইল এঙ্প্রেস'কে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ খেলতে দেখলে অবাক হবেন না। কারণ মাশরাফির মাঠে ফেরার জন্যই যে অপারেশনের সময় পিছিয়ে দিয়েছেন ইয়াং!
কাল দুপুরে ডেভিড ইয়াংয়ের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও না পেয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন মাশরাফি। তবে একটু পর হোটেল লবিতে মুত্তিয়া মুরালিধরন ও ফারভিজ মাহরুফের সার্জনের ঠিকানা খুঁজে পান। একই হোটেলে আছেন ডেভিড ইয়াং। তাঁকে দেখাতেই সাতসকালে তাজ সমুদ্রে উপস্থিত লঙ্কান ওই দুই তারকা। মুরালিধরনদের পালা শেষে ডেভিড ইয়াংয়ের রুমে ঢোকেন মাশরাফি। জেনেছেন, যেসব কথা মনে এঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেসব ভুল নয়, 'লিগামেন্ট যে ছিঁড়েছে, সেটা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে পড়ে যাওয়ার সময় হাঁটুর শব্দ শুনেই বুঝেছিলাম। পুরোটা ছিঁড়েনি। অবশ্য পুরোটা ছিঁড়লেও একই ব্যবস্থাপত্র দিতেন ডাক্তার। আজ হোক কাল হোক, দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলতে হলে আমাকে অপারেশন করাতেই হবে।'
দুই হাঁটুতে এরই মধ্যে ছয়বার অস্ত্রোপচার করানো মাশরাফির এ লিগামেন্ট-সংক্রান্ত ধারণাকে অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কারণ নভেম্বরে চোট পাওয়ার পর থেকে মাশরাফির পূর্বধারণার সঙ্গে মিলেছে ডাক্তারি পরীক্ষার ফলও! তাই বলে এখনই সপ্তমবারের মতো অস্ত্রোপচারের টেবিলে শুচ্ছেন না তিনি, 'অপারেশন করালে অন্তত ছয় মাস বসে থাকতে হবে। তবে লিগামেন্ট একটু আর পুরো ছিঁড়ে যাওয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সেই অপারেশনই করাতে হবে। ডেভিড বলেছেন, হাতে যেহেতু সময় আছে, সেহেতু আরেকটু অপেক্ষা করাই ভালো।'
বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাশরাফিকে অপেক্ষায় রাখছে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন। যদি পুরোপুরি সেরে ওঠেন। ফিট মাশরাফি যে বাংলাদেশ দলের সম্পদ, এটা তো প্রধান নির্বাচক-কোচ সবাই স্বীকার করছেন। দল ঘোষণার সময় ম্যাচ ফিটনেসের কথাই বলছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কে জানে, তাঁদের একটা বড় চমকই দেন কি না মাশরাফি। কারণ কলম্বোর উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই প্রিমিয়ারে নিজের ক্লাব আবাহনীর তাঁবুতে গিয়ে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন সুপার লিগের শেষ দুটি ম্যাচ খেলার ইচ্ছার কথা, 'সুপার লিগের শেষ দুটি ম্যাচ খেলার ইচ্ছা আছে। দিন দশেক পর হবে ম্যাচগুলো।'
১০ দিন পর মাশরাফিকে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ খেলতে দেখলে আর যে-ই অবাক হন না কেন, ডেভিড ইয়াং হবেন না। তবে হয়েছিলেন। ২০০৩ সালের মাশরাফি নাকি এখনো ডেভিড ইয়াংয়ের কাছে বিস্ময়। কালও মাশরাফিকে তা মনে করিয়ে দিয়েছেন এ শৈল্যবিদ, 'ঠিক এ রকম চোট নিয়েই পুরো একটা বছর ক্রিকেট খেলেছিলে তুমি।' যা শুনে আশার ভেলায় আরো স্বস্তিতে ভাসছেন মাশরাফি, 'ডেভিড সবসময় মনে করে ফিটনেসটা ভালো বোঝে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটার। তাই সব কিছু আমার ইচ্ছার ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।'
মনের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্যই চোট পাওয়ার পর মাশরাফিকে চার সপ্তাহ সময় দিয়েছিলেন ডেভিড ইয়াং, 'এ ধরনের চোট পেলে বিশ্রাম জরুরি। তাই চার সপ্তাহ সময় দিয়েছিলেন যেন আমি আমার অবস্থা ঠিকমতো বুঝতে পারি। সত্যি বলতে কি, এ সময়ে আমার মনের জোর আরো বেড়েছে।' শুধু মনের জোরই নয়, মাশরাফির চোট পাওয়া হাঁটুর পেশি গঠনকে দারুণ ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন ইয়াং, 'লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলে পেশি তৈরিতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু আমার সে সমস্যা হয়নি। যেটাকে সবচেয়ে পজিটিভ দিক বলে মনে করছেন ডেভিড।'
অপারেশন থিয়েটার আর চেম্বারে দেখা করতে করতে ডেভিড ইয়াং যেন মাশরাফির ব্যক্তিগত চিকিৎসক! তাই মাশরাফির কাছে সবচেয়ে ভরসার জায়গাও এ অস্ট্রেলীয়। সেই ডেভিডের সঙ্গে দেখা করার পর দ্রুত মাঠে ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী মাশরাফি, 'রিস্ক হয়তো আছে। আছে জেনেই আমি দ্রুত মাঠে ফিরতে চাচ্ছি। সামনে কী আছে, জানি না। শুধু জানি আমি খেলতে চাই!'
তবে মাশরাফি জানেন তাঁর মাঠে ফেরার বিষয়টি নির্ভর করছে অন্য আরেকজনের ওপর, 'দেশে ফিজিও (মাইকেল হেনরি) দেখছেন। দেখি উনি কী বলেন।' জাতীয় দলের এ ফিজিও অপেক্ষা করছেন ডেভিড ইয়াংয়ের লিখিত প্রতিবেদনের, 'এখনো সেটি হাতে পাইনি। সম্ভবত কাল (আজ) জানাতে পারব।' সোয়া ৩টায় মাশরাফি ঢাকায় নেমেই হয়তো ফিজিওর মূল্যায়ন জানতে পারবেন। নির্বাচকদের দাবি অনুযায়ী যাঁর রিপোর্টের কারণে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা হয়নি মাশরাফিকে।

ডিসেম্বর '৭১-এর কিছু স্মৃতি by জাফর আলম

মি ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে। সঙ্গে আমার স্ত্রী রহিমা, দুই কন্যা পারভীন ও জাবীন। উঠেছি ছোট ভাই বদিওলের আন্দরকিল্লার ঘাট ফরহাদবেগের বাসায়। আমার ভাই বদিওল তখন কঙ্বাজারে। ছোট বোন প্রয়াত জহুরা ছিল। আমাদের জন্য রাতে জহুরা খিচুড়ি রেঁধেছিল।

ওদিকে সেদিন বিকেলে চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে মুসলিম লীগ আয়োজিত জনসভায় মুক্তিযোদ্ধারা বোমা ফাটিয়েছে। জনসভা পণ্ড। অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার জন্য এ জনসভার আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে কারফিউ জারি করা হয়েছে। আমার শ্বশুর মরহুম মকবুল আহামদ নাজির এসডিও কোর্টের পিয়ন রশীদকে কঙ্বাজার থেকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছে আমাদের নেওয়ার জন্য। কারফিউর কারণে বেচারি আমাদের বাসায় আসতে পারেনি, টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল। তার সঙ্গে সাব্যস্ত হলো, ৪ ডিসেম্বর সকালে কারফিউ প্রত্যাহৃত হলে আমাদের বাসায় এসে নিয়ে যাবে। হোটেল সফিনার সামনে চট্টগ্রাম থেকে কঙ্বাজারগামী বাস ছাড়বে।
৩ ডিসেম্বর রাত ৩টায় দেখলাম, কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে শেলিং হচ্ছে। জাহাজের গোলা এসে পড়ছে কোর্ট বিল্ডিংয়ে। আর আগুনের ফুলকি বাসার ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে। আর আকাশে ভারতীয় বিমানের সঙ্গে পাকিস্তানি মিগ বিমানের কক ফাইট হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠে আমরা সবাই ছাদের ওপর গিয়ে এ দৃশ্য উপভোগ করেছি।
সকালে রশীদ বাসায় এসে আমাদের চট্টগ্রামের সফিনা হোটেলের সামনে নিয়ে গেল। কঙ্বাজারে যাওয়ার কোনো গাড়ি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে তখন যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর আমরা কাশিমবাজার হোটেলে গিয়ে দুপুরের আহার সেরে নিই। ১১টায় কো-অপারেট ও বুক সোসাইটির সামনে একটি কঙ্বাজারগামী কোস্টার পাওয়া গেল। আমরা এ কোস্টারে উঠেছি। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যাকে গাড়িতে বসিয়ে আমি নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা সবাই গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষায়। একজন স্বাস্থ্যবান তরুণ পরনে প্যান্ট, গায়ে হাফ শার্ট আর পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল পরা দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল। বয়স হবে ১৮ থেকে ১৯। হঠাৎ পাকিস্তান আর্মির একটি পিকআপ ভ্যান এসে হাজির। পেছনে ত্রিপলে ঢাকা। সামনে সিট থেকে একজন সাদা পোশাকধারী পাকিস্তানি সামরিক অফিসার আমেরিকান পিস্তল হাতে নিয়ে নেমেই হাঁক দিল। 'কুই নেহি হিনেগা' অর্থাৎ কেউ নড়বে না। তারপর পিকআপ গাড়ির পেছনের ত্রিপল তুলল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলাম।সামরিক অফিসারটি যখন পিকআপ ভ্যানের পেছনের ত্রিপল তুলল, দেখলাম, বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লুঙ্গি ও প্যান্ট পরা, পেছনে দড়ি দিয়ে মোড়ানো হাত দুটি বাঁধা। ওরা সবাই কাঁদছে। অফিসারটি বলল, 'কউন হ্যায় দেখা দো' অর্থাৎ কে সে দেখিয়ে দাও। পিকআপের ভেতর থেকে একজন ইশারায় আমাদের পাশে দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধা তরুণকে দেখিয়ে দেয়। চিলে যেমন ছোঁ মেরে মুরগি নিয়ে যায়, তেমনি পাকিস্তানি সামরিক অফিসারটি তরুণটিকে ধরে নিয়ে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিল আর ত্রিপল ঢেকে দ্রুত চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে যায়। এসব তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আর ফিরে আসেননি, আর বর্বর হানাদার বাহিনী তাঁদের হত্যা করেছিল নিশ্চয়। তাঁদের কান্না দেখে আমার চোখেও অশ্রু দেখা দিয়েছিল।
৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় রওনা দিয়ে আমরা সন্ধ্যায় কঙ্বাজার পেঁৗছি। দোহাজারী-চিরিঙ্গা আর রামু বাসস্টেশনে আমাদের গাড়ি চেক হয়। তবে রক্ষা পেয়েছি, গাড়িতে দুজন ইপিআর বাহিনীর সদস্য যাত্রী ছিল। গাড়ি চেক করতে এলেই ওরা বলত, 'এ্যাঁহা কুই মুক্তি নেহি হ্যায়' অর্থাৎ এখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। দ্রুত গাড়ি স্টেশন ত্যাগ করে।
সন্ধ্যায় বাহারছড়ায় আমাদের বাড়িতে পেঁৗছে দেখি, সারা শহর অন্ধকার, নিষ্প্র্রদীপ মহড়া চলছে। কঙ্বাজার বিমানবন্দরে ভারতীয় জঙ্গি বিমান রকেট হামলা করেছে। টার্গেট ছিল বিমানবন্দরের অফিস ও বিমানবন্দর। আমরা জেনেছি, এই বিমান হামলায় কঙ্বাজার বিমানবন্দরে অ্যাডভোকেট মঈদুর রহমান চৌধুরী নিহত এবং বাহারছড়ার বিমানবন্দরের কর্মচারী মঞ্জুর গুরুতর আহত। পরে সে মারা যায়। আমার ফুফাতো ভাই কাদের বিমানবন্দরের কর্মচারী। সে কোনোমতে পরিখায় লুকিয়ে জীবনে রক্ষা পায়। ৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় জঙ্গি বিমান কঙ্বাজার বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণ করে। আমি তখন সপরিবারে আমার শ্বশুর মকবুল আহামদ নাজিরের বাসায় অবস্থান করছি। এ বোমাবর্ষণে বাহারছড়াসহ আশপাশের বাড়িঘর কেঁপে ওঠে। আমরা ৬ ডিসেম্বর বাহারছড়ার বাড়ি ছেড়ে সদলবলে কলাতলীতে নিরাপদ স্থানে চলে যাই আমার শাশুড়ির পৈতৃক বাড়িতে। সে আরেক কাহিনী। স্বাধীনতার ৩৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর যখন বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসে তখন আমার চোখে একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বাসস্ট্যান্ড থেকে একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। আমি আবেগাপ্লুত হই, উদ্বেলিত হই আর আমার দুচোখে দেখা যায় বেদনার অশ্রু। শুধু মনে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার ৩৯ বছর কেটে গেছে, কিন্তু আমরা কী এখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের রাহু থেকে মুক্ত হতে পেরেছি? নাকি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ওরা এখনো সক্রিয়?