Monday, January 24, 2011

সংসদের ২ বছরঃ ১৩০ বিলের ৯১টি পাস বিরোধী দল ছাড়া

গামীকাল ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার তৃতীয় বর্ষে পড়ছে নবম জাতীয় সংসদ। গত দুই বছরে নবম সংসদে সাতটি অধিবেশনে পাস হয়েছে ১৩০টি বিল। এগুলোর ৯১টিই পাস হয়েছে সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে।

সংসদের কার্যপ্রবাহ থেকে জানা যায়, যেসব (৩৯টি) বিল পাসের সময় বিরোধীদলীয় সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন, সে সময় তুমুল বিতর্কে সংসদ ছিল প্রাণবন্ত। এ কারণে প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার বেশি। বিলের ওপর বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও রাশেদা বেগমের আনা সংশোধনী প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। তবে বেশি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিমের।
জানা যায়, প্রথম অধিবেশনে ৩২টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১১টি, চতুর্থ অধিবেশনে ২৩টি, পঞ্চম অধিবেশনে ২৪টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ১৩টি এবং সর্বশেষ সপ্তম অধিবেশনে চারটি বিল পাস হয়েছে। এসব বিলের ওপর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সদস্যরা এক হাজারের বেশি নোটিশ দিয়েছেন। ফজলুল আজিম দিয়েছেন দুই শতাধিক নোটিশ। সরকারি দলের সদস্যদের দেওয়া নোটিশের সংখ্যা ১০০-এর বেশি নয়।
জানা গেছে, যে ৯১টি বিল পাসের সময় বিএনপি ও তাদের জোটের সদস্যরা অনুপস্থিত ছিলেন, সেসব বিলসংক্রান্ত বিরোধীদলীয় সদস্যদের নোটিশের ৯০ শতাংশ উত্থাপিত হয়নি। এমনও হয়েছে, বিরোধী দল সংসদে থাকলেও নোটিশদাতা সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে এসব বিলের ওপর সংসদে তেমন আলোচনা হয়নি। এসব বিলের দফা উচ্চারণ করতে স্পিকারের যতটুকু সময় লেগেছে, সেই সময়ের মধ্যে বিলগুলো পাস হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এ রকম প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে গড়ে পাঁচ থেকে সাত মিনিট।
এ অবস্থায় আগামীকাল বিকেল তিনটায় বর্তমান সংসদের অষ্টম অধিবেশন শুরু হচ্ছে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন। সংসদ বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর অতীতের মতো বর্তমান সরকারের মেয়াদের প্রথম দুই বছরেও সংসদ সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে পারেনি। সংসদ বর্জনের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিরোধী দল। বেশির ভাগ সময় তাদের অনুপস্থিতির কারণে সংসদ ছিল একপেশে।নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা মহাজোটও ছোট আকারের বিরোধী দলকে সংসদে ধরে রাখতে পারেনি।
স্পিকার আবদুল হামিদ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধী দল সংসদে থাকলে সংসদ আরও প্রাণবন্ত ও কার্যকর হতো, এটা ঠিক। তবে বিরোধী দল সংসদে না এলেও সংসদীয় কমিটির সভায় তাদের সদস্যরা নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিলগুলো প্রস্তুত করছেন। অধিবেশন কক্ষে তাঁরা সশরীরে না এলেও প্রশ্ন জমা দিচ্ছেন এবং মন্ত্রীরা সেসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তাই এ সংসদকে অকার্যকর বলার সুযোগ নেই। তিনি মনে করেন, আইন প্রণয়নে বিরোধী দল আরও সক্রিয় হলে নিশ্চয়ই আইনগুলো আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। তবে বিলের ওপর সাংসদদের কম অংশগ্রহণের বিষয়টি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ এম কে আনোয়ার বলেন, বিলের ওপর বিরোধী দল আলোচনা করলে সংসদও প্রাণবন্ত হতো, আইনগুলোও নির্ভুল হতে পারত।
বিরোধী দলের সদস্যদের গড় উপস্থিতি ৪৪ দিন: গত সাত অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ১৭৪টি। এর মধ্যে বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের সাংসদেরা গড়ে উপস্থিত ছিলেন ৪৪ দিন। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম অধিবেশনের পুরোটাই অনুপস্থিত ছিলেন তাঁরা। পঞ্চম অধিবেশনে তাঁরা যোগ দেন এক দিন। প্রথম অধিবেশনে যোগ দিলেও টানা ৬৩ কার্যদিবস অনুপস্থিতির পর গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল সংসদে ফিরে কয়েক দিন অধিবেশনে যোগ দেয়। গত বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় কার্যদিবস থেকে তারা টানা ৪৮ দিন অনুপস্থিত রয়েছে।
দু্ই বছরেও বিরোধী দল তাদের উপনেতা নির্বাচন করেনি। ফলে বিরোধীদলীয় নেতার অনুপস্থিতিতে তাদের বিকল্প নেতা থাকেন না। তবে বিরোধী দলের সাংসদেরা অধিবেশনে প্রশ্ন, নোটিশ, বিলের ওপর সংশোধনীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব জমা দিচ্ছেন। তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেন সরকারি দলের সদস্যরা। তবে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সংসদীয় কমিটির সভায় নিয়মিত অংশ নেন। সংসদের যেকোনো আইন প্রণয়নকাজের সঙ্গে তাঁরা কমিটির মাধ্যমে তাঁদের মতামত দিচ্ছেন। সংসদকেন্দ্রিক বিদেশ সফরেও যাচ্ছেন তাঁরা।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) অলি আহমদ, স্বতন্ত্র ফজলুল আজিম এবং মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদেরা সংসদে নিয়মিত যোগ দেন।
নবম সংসদে এ পর্যন্ত সব কার্যদিবসে উপস্থিত ছিলেন নীলফামারী-৫ আসনের এ এ মারুফ সাকলান। উপস্থিতির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে স্পিকার আবদুল হামিদ (১৬৭ দিন)।
শেখ হাসিনা ১২৬ দিন, খালেদা জিয়া পাঁচ দিন: সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপ্তম অধিবেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন ১২৬ দিন। আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন পাঁচ দিন, যা বর্তমান সংসদে সর্বনিম্ন উপস্থিতি। তবে অষ্টম সংসদের সংসদ নেতা থাকাকালে তিনি ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে ১৯৫ দিন উপস্থিত ছিলেন। আর ওই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৪৫ দিন।
নবম সংসদে অনুপস্থিতির দিক থেকে খালেদা জিয়ার পরে রয়েছেন কুমিল্লা-৩ আসনের কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ (১০ দিন)।
প্রসঙ্গত, বর্তমান আইন অনুযায়ী টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে যে কারও সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ রয়েছে, ‘৩০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলেই সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে, আমরা সরকার গঠন করতে পারলে এই আইন করব।’
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অঙ্গীকার আমরা এখনো অস্বীকার করি না। আমরা তো সংসদে যাওয়ার ও সংসদ কার্যকর করার পক্ষে। কিন্তু সরকারি দলের ব্যর্থতার কারণে সেটি না হলে এর দায়ভার সরকার পক্ষেরই।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংসদের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, বিরোধী দল ছোট হলেও তাদের ছাড়া সংসদ কার্যকর বলা কঠিন। তাই অনেক কাজ করলেও গত দুই বছরে সংসদ কার্যকর হয়েছে, এটা খুব করে বলা যাবে না। তিনি বিএনপির সংসদে না যাওয়ার সমালোচনা করে বলেন, বিরোধী দলের সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন জনগণের স্বার্থেই।
ওয়াকআউট: বিএনপি গত সাতটি অধিবেশন পর্যন্ত ওয়াকআউট করেছে ৫২ বার। সর্বশেষ গত বাজেট অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসে ওয়াকআউটের পর তারা আর অধিবেশনে যোগ দেয়নি। অষ্টম সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল ৯৫ বার ওয়াকআউট করে।

No comments:

Post a Comment