Monday, January 24, 2011

অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা অসম্ভব নয় by উম্মে কুলসুম কলি

শিশুর গা গরম হলে আমরা বলি জ্বর হয়েছে, থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখে জ্বরের মাত্রা বুঝতে পারি। গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় টাইফয়েড, সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা নাকি অন্যকিছু। ঠিক তেমনি শিশুর বিভিন্ন রকম আচরণ দেখে তার মানসিক রোগ, রোগের মাত্রা শনাক্ত করা হয়।

আচরণই মানসিক রোগ নির্ণয়ের নির্দেশক। হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, অসংখ্য শিশুর মা-বাবা উদগ্রীব হয়ে আসেন শিশুদের মানসিক সমস্যা নিয়ে। শিশুর শারীরিক জটিল সমস্যা হলে কেউ লজ্জাবোধ করে না। কিন্তু মানসিক কোন সমস্যা হলেই লজ্জা-ভয়ে সব কিছু লুকানোর চেষ্টা শুরু করে দেয়। লোকে কি বলবে, নিজের দুর্ভাগ্য, পাপের ফল মনে করে গোপনে প্রার্থনা করে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা এবং এক সময় অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দিয়ে 'গিফটেড চাইল্ড' বা 'স্পেশাল বেবী' ইত্যাদি নামে অভিভাবকরা সান্তু্বনা পেয়ে আসছেন। শুধু আমাদের দেশেই নয় আমেরিকা-ইউরোপ-ইংল্যান্ডের মত উন্নত বিশ্বেও দেখা গেছে একই চিত্র। অথচ শিশুর মানসিক সব ধরনের সমস্যাই নতুন গবেষণাপ্রসূত মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব, এ তথ্যটি আমরা অনেকেই জানি না।

অটিস্টিক শিশুর লক্ষণ সমূহ :এই শিশুরা সাধারণত: দেখতে সুন্দর ও স্বাভাবিক হয়। এরা কারো চোখে চোখে তাকাতে পারে না (আই কন্টাক্ট করে না)। এদের নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। সার্বক্ষণিক অন্যমনস্ক থাকে। একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে । নিজের হাত, হাতের আঙ্গুল নিয়ে নিবিষ্ট মনে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাড়াচাড়া করে। সমবয়সী বা ছোট-বড় কারো সাথে এরা মিশতে পারে না। কোন মানুষের প্রতি এরা আকর্ষণ বোধ করে না। অর্থহীন বস্তুর প্রতি এরা বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অনেকে মা-বাবাকে চিনতে পারে না।

এদের অনেকেই কথা বলতে পারে আবার কেউ কথা বলতে পারে না। প্রশিক্ষণ দিলে তারা যান্ত্রিকভাবে রোবটের মত করে কিছু কথা বলে। এরা একই কথা বা অর্থহীন শব্দ বারবার বলে, বলতেই থাকে। আবেগশূন্য এই শিশু সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। এদের মনোযোগ ও ধৈর্য মোটেই থাকে না বা খুব কম থাকে। এদের খেলা অথবা খেলনার প্রতি কোনই আগ্রহ থাকে না। অনেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু একটা সার্বক্ষণিক হাতে ধরে রাখে এবং তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এরা টিভি বিজ্ঞাপন, কার্টুন ও সিডির প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকে। অনেকে কোন কথা বলতে না পারলেও টিভি দেখে বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন পণ্য, পণ্যের ব্রান্ড সব মুখস্থ করে ফেলে, গান বলে।

শিশুটি অটিস্টিক নাও হতে পারে? বহুবিধ প্রতিবন্ধিতা হতে পারে:শিশুর কোন ধরনের মানসিক সমস্যা হলেই তাকে অটিস্টিক বলে শনাক্ত করা ঠিক নয়। অটিস্টিক হওয়ার জন্য রোগীর মধ্যে অটিজমের অন্তত ৩/৪টি জোরালো ও যথাযথ লক্ষণ থাকা অত্যন্ত জরুরি। অটিজম না হলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, এডিএইচডি, নিওরোটিক, সাইকোটিক ও স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি অন্য কোন মানসিক রোগ হতে পারে। এই রোগীদের রোগ নির্ণয় খুবই কঠিন ও জটিল বিষয়। মনে রাখত হবে, ডায়াগনোসিসে ভুল হলে সমগ্র ম্যানেজমেন্ট বা চিকিৎসায় ভুল হতে পারে। যা রোগীর জন্য আজীবন ক্ষতির কারণ হতে পারে।

শিক্ষণে অপারগতা :অটিজম আক্রান্ত শিশু স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে অথবা স্বল্পবুদ্ধিও হতে পারে। তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা থাকলে তাকে কোন কিছু শেখানো খুবই কঠিন। অনেক সময় দিয়ে, কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে শেখালেও তারা বারবার দেখে ও শুনে তেমন কিছু শিখতে বা মনে রাখতে পারে না। ফলে মা-বাবা হতাশ হয়ে পড়েন। অনেক যত্ন নিয়ে প্রশিক্ষণ দিলে এরা খুব সামান্য বিষয়ই শিখতে পারে। নিজস্ব ব্যক্তিগত কাজ শেখাতেই এদের পিছনে বেশ কয়েক বছর বা আরো বেশি সময় ব্যয় করতে হয়, এদের সব কাজ অন্যদের করে দিতে হয়। চিকিৎসাহীন এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রোগীরা সাধারণত পরনির্ভরশীল জীবনযাপন করে থাকে।

বুঝবো কি করে আমার শিশু মানসিকভাবে সুস্থ কিনা:একটি শিশুর মধ্যে একাধিক মানসিক সমস্যা বা রোগ থাকতে পারে। নিম্নোক্ত প্রতিটি অসংলগ্ন আচরণই ভিন্ন ভিন্ন মানসিক রোগকে শনাক্ত করে। নিজেই নিজের শিশুর মানসিক রোগ সঠিকভাবে শনাক্ত করে নিন।

আচরণ সমস্যার লক্ষণসমূহ :আচরণ ও আবেগের দিক দিয়ে অপরিপক্ক, বয়সানুপাতে বুদ্ধি ও মানসিক বিকাশ যথাযথ নয়। পড়ালেখা ও স্কুল সংক্রান্ত কোন সমস্যা, পড়ালেখা করতে চায় না, পড়া মনে রাখতে পারে না। খেতে চায় না, জোর করে খাওয়াতে হয়। খাদ্য নয় এমন সব জিনিস, নোঙরা-ময়লা প্রভৃতি সবসময় মুখে দেয়। অস্থিরতা, বদমেজাজী, অতিরিক্ত জেদ, ভাংচুর করে, নিজেকে বা অন্যকে আঘাত করে, মারধর করে, কোন কিছুকে ভয় পায়, আরো অনেক রকম অস্বাভাবিক আচরণ করে। বিছানা ভিজায়, যেখানে-সেখানে প্রশ্রাব-পায়খানা করে। ঘুমের সমস্যা, নার্ভাসনেস, কোন বিষয়ে ভয় পায়, আত্মবিশ্বাসের অভাব। প্রচুর মিথ্যা বলে, যে কোন বদ-অভ্যাস, অপরাধ প্রবণতা প্রভৃতি। অকারণ হাসি-কান্না, নিজ মনে একা একা কথা বলে ইত্যাদি।

অটিজম কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য:আমার দীর্ঘ ১৬ বছরের গবেষণায় দেখা গেছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, অটিস্টিক, মানসিক রোগগ্রস্ত শিশুকে চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। আউট পেশেন্ট হিসাবে অথবা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটটে (আইসিইউ) শিশুর মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়_এ ধরনের সুবিধা সম্বলিত প্রতিষ্ঠান ঢাকায় রয়েছে, যেখানে রোগীকে কোনরূপ বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ থেকে বিরত রাখা হয়। ফলে নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি একটি করে রোগ সেরে যেতে থাকে, রোগী তার 'যোগ্যতা' অনুযায়ী নিজে নিজেই সব কাজ শিখে নিতে পারে। হাতে ধরে তাকে কোন কিছু শেখানোর প্রয়োজনই হয় না।

সমস্যা লুকিয়ে না রেখে যত কম বয়সে চিকিৎসা শুরু করা যাবে, রোগী তত দ্রুত সুস্থ হবে। তাই সময় নষ্ট না করে, 'বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে' এর জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ওষুধবিহীন ফলপ্রসূ চিকিৎসা :এই চিকিৎসা-পদ্ধতি সম্পূর্ণ পাশর্্বপ্রতিক্রিয়াহীন। কোন রকম ওষুধ ব্যবহার ছাড়াই নতুন গবেষণাপ্রসূত সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগীকে নিয়মিত বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত একাধারে চিকিৎসা দিতে হয়।

পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা শেষে রোগী সামাজিক সব ধরনের আদান-প্রদান ও যোগাযোগ করতে পারে। সব কথা বলতে পারে। বুদ্ধি মোটামুটি ভাল থাকলে নিয়মিত নরমাল স্কুলের সাধারণ নিয়মেই লেখাপড়া করতে পারবে। বুদ্ধিগত প্রকট সমস্যা থাকলে হয়তো এরা খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারবে না। তবে পরবর্তী জীবনে স্বাভাবিক মানুষের মতই বিয়ে, ঘর-সংসার করতে পারবে। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি অথবা ব্যবসা করে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

No comments:

Post a Comment