Tuesday, January 25, 2011

পুঁজিবাজারের মুনাফা থেকে লভ্যাংশ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো

পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসাবে দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো। বিদায়ী বছরে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত এ মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ না করে রিজার্ভে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলো এ অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। সম্প্রতি ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে এ নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা লভ্যাংশ হিসাবে বিতরণ না করে রিজার্ভে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তাহলে ঘুরেফিরে এ মুনাফার একটি নির্দিষ্ট অংশ পুঁজিবাজারে আবার বিনিয়োগে আসবে।'
তিনি বলেন, 'পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক ধসের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাংক খাতের সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ ও উচ্চ মুনাফা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাজারে এ খাতের বিনিয়োগ ও মুনাফা বাজার ধসের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাবই ফেলেনি। সার্বিকভাবে পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা এসেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে সূচক বৃদ্ধি বা হ্রাসে এ টাকার ভূমিকা খুবই নগণ্য।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ মুনাফাকারী ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো হচ্ছে_ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এদের দুটি সর্বোচ্চ আড়াই শ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা করেছে। বাকি ব্যাংকগুলোর একটির এক শ কোটি টাকার কিছু বেশি এবং বাকিগুলোর মুনাফা ৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা এসেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। বৈঠকে তাদের পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ না করে তা রিজার্ভে রেখে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্য থেকে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর সর্বমোট বিনিয়োগ ১২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, যা পুঁজিবাজারে মোট শেয়ারমূল্য তিন লাখ ৫০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মাত্র ৩.৫৮ শতাংশ। অপরদিকে পুঁজিবাজারের মোট শেয়ারের পরিমাণ তিন লাখ তিন হাজার ৪৩২টির মধ্যে ব্যাংকগুলো মাত্র ৭.৪১ শতাংশ ধারণ করে আছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর হাতে বর্তমানে শেয়ার রয়েছে ২২ হাজার ৪৭৯টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা রিজার্ভে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে থাকলে এটা ভালো সিদ্ধান্ত বলেই আমি মনে করি। রিজার্ভে এ লভ্যাংশ নিয়ে গেলে ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়বে এবং ভিত্তি শক্ত হবে।' এ ছাড়া এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতাও বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলো মোট দায়ের ৫-২৮ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। এ বিনিয়োগ পুঁজিবাজারের মোট বিনিয়োগের মাত্র ৩.৫৮ শতাংশ। যদি ব্যাংকগুলো আইনি সীমার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করে, তাহলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ দাঁড়াবে পুঁজিবাজারের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭ শতাংশ। এই অবস্থায় সূচকের পতন ঠেকাতে ব্যাংকিং খাত নির্ভরতা কতটুকু যৌক্তিক_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোয় সূচকের তেমন পরিবর্তন আসবে না। তাই আমি বরাবরই শুধু ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। তবে সরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করছে। তাই হয়তো বারবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে ফেরানোর কথা বলে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে ফেরানোর কথা বলছে।
সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন ব্যাংকগুলোর জন্য উপকারী, অন্যদিকে তা পরিচালকদের জন্য শাস্তিস্বরূপ। ব্যাংকগুলোর এ মুনাফা রিজার্ভে রেখে দেওয়াই যুক্তিসংগত।'
ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সরকারের যে সিদ্ধান্ত, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, সরকার এসইসিকে পুনর্গঠন ছাড়া যত সিদ্ধান্তই নিক না কেন, তাতে জনগণের আস্থা ফিরবে না। কারণ সূচকের ধস ঠেকাতে এই এসইসি বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখন সূচক অতি দ্রুত বাড়ছিল তখন তারা উদ্যোগ নেয়নি কেন। তাই আমি বলব, সরকার কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে এসইসির পুনর্গঠন জরুরি।'
তিনি বলেন, '৩০ লাখ লোক পুঁজিবাজারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এদের অনেকেই শিক্ষিত বেকার। সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফার একটি অংশ আবার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ে আসার অনুরোধ করে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তার মনিটরিং পলিসি ও ব্যাংকিং আইন ঠিক রেখে এ ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ আমি আগেই বলেছি, এখানে অনেক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান রয়েছে।'
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা যদি আমি দুই হাজার কোটি টাকাও ধরি, তাহলে এ মুনাফার জন্য এদের যেভাবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সেভাবে কিন্তু ব্যক্তি বা সিন্ডিকেটকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে না। সরকারের উচিত ১৫ দিনের আগেই কমিটি গঠন করা, কমিটির রিপোর্টের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া। এর ফলে ব্যক্তি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরকার দ্রুত চিহ্নিত ও ব্যবস্থা নিতে পারবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো বাড়বে।'

No comments:

Post a Comment