Tuesday, January 25, 2011

১৬ ডিসেম্বরের শিক্ষা by আই এ রেহমান

পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা ১৬ ডিসেম্বর এলেই উপলক্ষকেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনায় মেতে ওঠেন। অবশ্য এর সারবত্তা সম্পর্কে কেউই সন্তুষ্ট হন না। পাকিস্তানের স্থপতিরা সমগ্র উপমহাদেশে ১৯৪৫-৪৬ সালে মুসলিম লীগের বিরাট নির্বাচনী বিজয় ও এক বছর বাদের দেশভাগে বড় বেশি আপ্লুত ছিলেন।
তাঁদের কাছে স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রাদেশিক ইউনিটগুলোর আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা উপেক্ষিত হলো। ১৯১৯ সালের দ্বৈতশাসন-ব্যবস্থায় প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষকে কৃষি, শিক্ষা, গণপূর্ত ও স্থানীয় সরকার নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। এর কারণ ছিল জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের সঙ্গে এসব বিভাগের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা। সে কারণেই ফজল-ই-হুসেইন কায়েদে আযমকে পাঞ্জাব ও সিকান্দার হায়াত থেকে শতভাগ দূরে থাকতে বলেছিলেন। আর সেটা ছিল লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যান্য প্রদেশে ছিল একই অনুভূতি। লাহোর প্রস্তাবের রূপকারেরা কিন্তু ভাষা-বিষয়ে প্রকৃত সত্য স্বীকার করেছিলেন। আর পরিহাস হলো, সেই একই সত্য পাকিস্তানি শাসকদের পুরো ৬৩ বছর ধরে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
প্রাদেশিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভে পূর্ব বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল শুধুই একটি বাড়তি মাত্রাগত ভিন্নতা। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭—এই এক দশক বাংলার জনগণ ক্ষমতার অংশীদারি পেয়েছিল। বাংলার সরকারগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম প্রধানমন্ত্রীরা। কিন্তু তাঁরা এ কথা ভুলে যাননি, ১৯০৫ সালে প্রথম বাংলা ভাগের সময় তাঁরা কী করে অধিকতর ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তাঁদের এমন একটি প্রদেশ দিয়েছিল, যেমনটা তাঁদের ১৯০৫ সালেই ছিল। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে, কলকাতার ওপর তাঁদের যে কর্তৃত্ব ছিল, সেটা হারানোর একটা বেদনা ছিল তাঁদের। শুধু পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিলে তাঁদের সেই বেদনা প্রশমিত হতে পারত।
পাকিস্তান একটি সাফল্যের গল্প হোক—সেটা বাঙালিরা দেখতে চেয়েছিল। সে কারণে তারা ক্ষমতার প্রশ্নে তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সংযমের পরিচয় দিয়েছিল। গণপরিষদে তারা সংখ্যালঘু প্রদেশ থেকে মুসলিম লীগের নেতাদের নির্বাচিত করতে রাজি হয়েছিল। আমলাদের পদোন্নতি প্রদানের ফর্মুলা তারা গ্রহণ করেছিল, যদিও একজন বাদে সেই পদোন্নতির সুবিধা যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন অবাঙালি। নতুন দেশের রাজধানী হিসেবে তারা করাচিকে মেনে নেয়; এমনকি গভর্নর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী, গণপরিষদের সভাপতি এবং পূর্ব বাংলার গভর্নর পদে অবাঙালিদেরও তারা মেনে নেয়। অথচ বাঙালিদের এই মহানুভবতার প্রশংসা পশ্চিম পাকিস্তানিরা করতে পারেনি। এর পরিবর্তে পূর্ব বাংলার জনগণকে তাদের জাতিসত্তার শেকড়-সন্ধানের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা দেখানো হলো।
দেশভাগের আগেই কায়েদে আযম পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা সংক্ষেপে স্বীকার করেছিলেন। বাংলাকে অবিভক্ত রাখতে সোহরাওয়ার্দীর নেওয়া উদ্যোগের প্রতি সমর্থনের মধ্য দিয়ে আমরা তার বহিঃপ্রকাশ দেখি। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানের নেতারা বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি তাঁদের কর্ণকুহর রুদ্ধ করে রেখেছিলেন। এর শুরুটা ঘটেছিল অপরিপক্ব ভাষানীতির মধ্য দিয়ে। মুজিবের কথায় হয়তো অতিরঞ্জন ছিল। তিনি বলেছিলেন, গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে একজন বাঙালি সদস্যকে তাঁর মাতৃভাষায় শপথ গ্রহণের অধিকার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, সেটাই ছিল পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের দূরে সরে যাওয়ার সূচনা। কিন্তু সত্য হলো, দেশের শাসকগোষ্ঠী এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে তাঁদের ভাষার অধিকার ক্ষুণ্ন করার মধ্য দিয়ে তাঁদের পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব হুমকি-কবলিত হওয়া ছিল প্রথম সতর্কবার্তা।
কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুলোর কারণে পূর্ব বাংলার জনগণের বুঝতে অল্প সময় লেগেছিল যে তাদের মর্যাদা হলো একটি উপনিবেশের। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে নির্বাচন সম্পন্ন হলো ১৯৫১-৫২ সালে। আর বাঙালিদের অপেক্ষায় রাখা হলো ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এবং তারপর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শান্তিতে শাসন করতে দেওয়া হলো না। ইস্কান্দার মির্জাকে পাঠানো হয়েছিল তাদের দমিয়ে রাখার কাজে। এভাবে পূর্ব বাংলার মানুষ ধীরে ধীরে তাদের বঞ্চনার স্বরূপ বুঝতে পারল। আইয়ুব খান বাঙালিদের অধিকার এবং বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটা সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তিনি তাদের পেছনে লাগিয়ে দিলেন মোনেম খানকে। একই সঙ্গে লাহোরে প্রতিরক্ষা বহুগুণে শক্তিশালী করে পূর্ব বাংলাকে অরক্ষিত রাখার মনোভাব প্রকাশ পেল। এটা ছিল একটা মধ্যযুগীয় কৌশল, যখন সামরিক বিষয় ছিল একান্তভাবে রাষ্ট্রীয় বিষয়; প্রতিরক্ষার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্কই বিবেচনায় নেওয়া হতো না।
ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান অবলোপনের সভাপতিত্ব করতে দৃশ্যত সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি তাঁর সাধারণ নির্বাচনের ‘উপঢৌকন’ ব্যবহার করতে চেষ্টা করলেন। সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় তিনি ও তাঁর শ্রেণীস্বার্থ সুরক্ষার কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বাগে আনতে চেষ্টা করলেন। তাঁর এই কৌশল ব্যর্থ হলো। চাপালেন যুদ্ধ, যে যুদ্ধে জয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনায় বাঙালিদের সাহস ও সহিষ্ণুতা ধারণার চেয়ে দ্রুততম সময়ে সাফল্য এনে দিল।
কোনো রাজনৈতিক বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ চার দশক পরে সহজ ও একপেশে মনে হতে পারে, যতটা উল্লিখিত বিবরণ দিকনির্দেশক ছিল। সত্য বটে, একটি অনভিজ্ঞ, সম্পদের সংকটে ভুগতে থাকা এবং কেন্দ্রের অপ্রতুল নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম ছিল না। নিরাপত্তা-সমস্যার পূর্বজটিলতা এবং বৈদেশিক ফ্যাক্টরগুলো পরিস্থিতিকে জটিল করেছিল।
ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষকেরা পূর্ব বাংলার উপাখ্যানে কে নায়ক এবং কে খলনায়ক, তা চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা এবং ঠিক কোন ঘটনায় পাকিস্তান ভাঙতে শুরু করেছিল, তা নিরূপণে নিজেদের বিরত রাখতে অনিচ্ছুক হতেই পারেন। সম্ভবত এটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে প্রথম দিন থেকে পূর্ব বাংলার প্রতি ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করার পরিণতিতে পাকিস্তানকে তীব্র বেদনা সইতে হয়েছে।
কারণ যা-ই হোক না কেন, আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতিরা প্রাদেশিক রাজনীতির চড়াই-উতরাই সম্পর্কে দূরদর্শী হতে পারেননি। গোলাম মোহাম্মদ যখন নাজিমউদ্দিনকে অপসারিত করলেন, গণপরিষদ বিলুপ্ত করলেন, তখন তিনি আসলে সাংবিধানিকতার প্রতি শাসকদের অঙ্গীকারের বিষয়ে পূর্ব বাংলার আস্থার জায়গাটিকে ধ্বংস করেছিলেন। উন্নয়ন ঘুষ এবং দালাল সৃষ্টি করে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগণের হূদয় জয়ের কোনো চেষ্টা সফল হয়নি। জনগণ কখনোই রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি তাঁদের অধিকার সমর্পণ করেনি, করবে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষায় দুই দশক ধরে ধর্ম ব্যবহারের প্রয়াসকে বাঙালিরা লক্ষ করেছে। বাঙালিরা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের তুলনায় অনেক বেশি ধর্মপরায়ণ। কিন্তু জবরদখল ও নিপীড়নের কাজে তারা ধর্মকে কখনো ব্যবহার করেনি। পাকিস্তান মানবজাতির (আরবসহ) ইতিহাসের পাঠ থেকে শিক্ষা না নেওয়ার মূল্য দিয়েছিল। ধর্ম ইতিহাসের কোনো পর্বেই ধেয়ে আসা জাতীয়তাবাদের স্রোতকে পরাস্ত করতে পারেনি।
১৬ ডিসেম্বর হলো এমন একটি জুতসই উপলক্ষ, যখন এটা উপলব্ধি করার সময়, ইতিহাসের বিধান মোটেই বদলে যায়নি।
আই এ রেহমান: পাকিস্তানি সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

No comments:

Post a Comment