Tuesday, January 25, 2011

মিসবাহউদ্দিন: অনেক কিছুর একজন by নীলুফার বেগম

মিসবাহউদ্দিন খান একাধারে ছিলেন অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ, কবি, লেখক, গবেষক, অনুবাদক, তীক্ষ বিশ্লেষক, ব্যবস্থাপনা বিশারদ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, দক্ষ প্রশাসক, সফল সংগঠক, প্রশিক্ষক, সাংসদসহ আরও অনেক কিছু—সর্বোপরি দেশপ্রেমিক।

এত গুণের আধার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অনেকটা প্রচারবিমুখ, আর জীবনাচরণে ছিলেন ধার্মিক, শৌখিন ও রুচিমান। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মিসবাহউদ্দিন খানের জন্ম ১৯২৯ সালে চাঁদপুরের পুরানবাজারসংলগ্ন নানাবাড়ি শ্রীরামদির জমিদার গৃহে। বাবা শিক্ষাবিদ আশেক আলী খান ছিলেন চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট (চরিতাবিধান, বাংলা একাডেমী) মা সুলতানা আশেক ছিলেন খ্রিষ্টান নারী মিশনারিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হূদয়বান মহিলা। মিসবাহউদ্দিন খানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার গুলবাহারে। মিসবাহউদ্দিন খানেরা আট ভাই-বোন। সবাই জীবনে প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্যিক, গবেষক ও অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর ছোট ভাইদের একজন। মিসবাহউদ্দিন খানের তিন ছেলে। বড় ছেলে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন একজন সুপরিচিত ইতিহাসবিদ।
ছাত্রজীবনে তিনি লেখাপড়ায়, খেলাধুলায় ও বক্তৃতায় ছিলেন তুখোড় আর চালচলনে ছিলেন চোখে পড়ার মতো রুচিমান মানুষ। তিনি ১৯৪৯ সালে ইতিহাসে স্নাতক সম্মান ও ১৯৫০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ঢাকার তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে যোগদান করেন। এখানে একটানা ৩০ বছর চাকরি করে ১৯৮৬ সালে ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মরত অবস্থায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। কর্মসূত্রে বহু দেশ ভ্রমণ করেন।
প্রথম জীবনে তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতার বইয়ের নাম লুসাইবালা। ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁর বই তত্ত্বাবধায়ন ও তত্ত্বাবধায়ক, ব্যবস্থাপনায় করণিক কাজ, অফিস ব্যবস্থাপনা: দক্ষতা ও উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনায় পত্রালাপ ও ডাক চালনা সংশ্লিষ্ট মহল কর্তৃক প্রশংসিত। ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত উল্লিখিত শেষের বই দুটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত। মিসবাহউদ্দিন খান ১২ খণ্ডে চট্টগ্রাম বন্দরের দলিলপত্র গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন, যা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছে। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বৃহদায়তন গ্রন্থ হিস্ট্রি অব দ্য পোর্ট অব চিটাগং। তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন পর প্রকাশিত বইয়ের নাম নবীজীর সাহাবারা (অনুবাদ)। কমপেনিয়াস অব দ্য প্রফেট বইটি চার খণ্ডে লন্ডনের মুসলিম এডুকেশন অ্যান্ড লিটারেরি সার্ভিস কর্তৃক প্রকাশিত। মূল বইয়ের লেখক ছিলেন আবদুল ওয়াহিদ হামিদ খান। মিসবাহউদ্দিন খান অতি যত্নের সঙ্গে বইটি অনুবাদ করেছিলেন। বইটির প্রচ্ছদও জীবদ্দশায় দেখে গিয়েছিলেন। তিনি আত্মজীবনীও লিখেছেন। এতে রয়েছে তৎকালীন সমাজকাঠামোর অবয়ব। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় ছিলেন তিনি সিদ্ধহস্ত।
১৯৯১ সালে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে চাঁদপুরের কচুয়া থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। সংসদে থাকাকালীন বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক, বন্দর বিশেষজ্ঞ, সমাজসচেতন সাংসদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি একজন সফল সংগঠকও ছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তাঁরই উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে। প্রশিক্ষকের ভূমিকাও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন তিনি। ১৯৮২ সালে তৎকালীন প্রশাসনিক স্টাফ কলেজ আয়োজিত প্রশিক্ষকদের সম্মেলনে তাঁর চেষ্টায় গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে যে নিবন্ধ পাঠ করেছিলেন ও বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা সে সময়ে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মিসবাহউদ্দিন খান একজন অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক ছিলেন। ৩০ বছর চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে শুধু বইপত্র লিখেই ক্ষান্ত হননি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কীভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে, কীভাবে আয়ত্তে আনতে হবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য সরবরাহ ছাড়াও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। নৌ-কমান্ড মো. খলিলুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান শীর্ষক বই থেকে জানা যায় (পৃ. সংখ্যা ৭৩-৭৫) মিসবাহউদ্দিন খান বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দরের টাইডাল চার্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেন। তাঁর ৫ নম্বর পোর্টের আবাসিক বাংলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের রাখা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে (গাড়ি নং ৮৬৮৬) তাঁদের সমগ্র নদীবন্দর এলাকা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন নিজের দেশের বাড়ির আত্মীয়দের পোর্ট দেখাতে এনেছেন এই কথা বলে। এসব কাজে মিসবাহউদ্দিন খানের স্ত্রীরও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। মিসহাবউদ্দিন খানের ভাইয়েরাও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মিসবাহউদ্দিন খানের কাজগুলো এ কালে লেখা যত সহজ, তৎকালীন সময়ে কত বিপজ্জনক ও ভয়াবহ তা অনুমান করা কঠিন। তাঁকে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌ-ঘাঁটিতে মাঝেমধ্যে ডেকে পাঠালে পরিবার-পরিজনের মুখ ভয়ে পাংশু হয়ে যেত। তখন একবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি আর্মির নায়কেরা তাঁকে ডেকে পাঠালে তিনি জানতেন নিশ্চিন্ত মৃত্যু—কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন (অবাঙালি) বসের কাছ থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে কাজেকর্মে অতি দক্ষ অফিসার—এ প্রশংসা শুনে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ায় তিনি বেঁচে যান।

No comments:

Post a Comment