Tuesday, January 25, 2011

ইউনিপের থাবা এখন ঢাকায়

ন্দেহভাজন মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কম্পানি 'ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশ লিমিটেড' চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর এখন ঢাকায়ও ব্যবসা ফেঁদে বসেছে।

'ইউনিপে-তে টাকা রাখুন, ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভ করুন/স্বাবলম্বী হোন/দারিদ্র্য বিমোচন করুন'-এমনই চটকদার স্লোগানে গ্রাহক আকৃষ্ট করে তারা ধানমণ্ডিতে নতুন শাখা অফিস খুলেছে। অথচ এ ধরনের কম্পানির গ্রাহক প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সরকারি তথ্য বিবরণীতেও এমএলএমের গ্রাহক প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইউনিপে টু ইউ কর্তৃপক্ষের দাবি, এ ব্যবসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির কোনো বৈধ অনুমোদনই নেই। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে প্রতিষ্ঠানটির সন্দেহজনক কার্যক্রম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খতিয়ে দেখছে। ইউনিপেও এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার হাইকোর্টে ইউনিপের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন দায়ের হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরই মধ্যে ইউনিপে টু ইউ সারা দেশ থেকে অন্তত ছয় লাখ গ্রাহক সংগ্রহ করেছে। কম্পানিটির ব্যবসায় খাটছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। ঢাকার ধানমণ্ডির পুরনো ২৭ নম্বর সড়কে তারা একটি চকচকে ছয় তলা অফিস ভবনও ভাড়া করেছে। সেখানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা তরুণ গ্রাহকদের ভিড় লেগেই আছে। ইউনিপের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিজন গ্রাহককে তাঁরা অনলাইনে একটি আইডেন্টিফিকেশন নম্বর ও পাসওয়ার্ড দেন। এরপর তাঁদের নগদ লেনদেনের পুরোটিই হয় অনলাইনে। তাঁদের দাবি, এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত। একজন গ্রাহক মাত্র চার হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে আট হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। এর ওপরে তাঁরা নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ দিয়ে থাকেন। দুই লাখ ১২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে গ্রাহকরা ১২ শতাংশ লভ্যাংশ পাবেন। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এ লভ্যাংশের হার ২০ শতাংশ হতে যাচ্ছে। এভাবে ১০ মাসে তাঁরা দ্বিগুণ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিয়ে থাকেন। তবে লভ্যাংশের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসছে, কর্মকর্তারা তা বলতে নারাজ।
ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা আনিসুজ্জামান নামের একজন গ্রাহক অভিযোগ করে কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি নিজে বিনিয়োগের পাশাপাশি পরিচিত অনেককে দিয়ে ইউনিপে-তে বিনিয়োগ করিয়েছেন। এখন ইউনিপে সম্পর্কে নানা খবর প্রকাশ হওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের অনেকেই তাঁদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১০ মাস শেষ হওয়ার আগে কোনোভাবেই বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। অথচ এ নিয়ম কোথাও লিখিত আকারে নেই।
ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান শাহীন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির মামুনও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁরা কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন।
তবে নিজেকে ইউনিপের মুখপাত্র দাবি করে এ প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদ সারোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত এমএলএম ব্যবসা। সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে ইউনিপে টু ইউ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছে। ই-কমার্স মেথডে ইউনিপে টাকা ১০ মাসে দ্বিগুণ করে যে লাভ দিচ্ছে, তা মোটেই আজগুবি নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থ খাটিয়ে কম্পানিটি এ মুনাফা দিতে পারছে। এ নিয়ে গ্রাহকদের কোনো অভিযোগ নেই।’
চট্টগ্রাম ও সিলেটে গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে মোহাম্মদ সারোয়ার বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রতারণার অভিযোগ নেই। আমাদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমরা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমাদের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করার আহ্বান জানিয়েছি। প্রয়োজনে সরকার আমাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করুক।’
অ্যাডভোকেট সারোয়ার আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের লেনদেন আছে। আমরা সরকার অনুমোদিত বলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে পারছি। আমাদের বিরুদ্ধে সরকারেরও কোনো অভিযোগ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রাহকদের বিনিয়োগের অর্থ কোনোভাবেই বিদেশে যাচ্ছে না, বরং মালয়েশিয়ার সঙ্গে নেট সার্ভার ব্যবহার করার কারণে বিদেশ থেকে এ দেশে টাকা আসছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ইউনিপের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেনের প্রশ্নই আসে না। বরং মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কম্পানিগুলোর এ ধরনের গ্রাহক প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সরকারি তথ্যবিবরণীও এমএলএমের গ্রাহক প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এ ছাড়া রাতারাতি অর্থশালী করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেটে ইউনিপে টু ইউয়ের বিরুদ্ধে গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখছে।
দেবপ্রসাদ জানান, এমএলএম কম্পানিগুলো বিশ্বের নানা দেশে আইনের ফাঁক গলে চটকদার বিজ্ঞাপনের আড়ালে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কানাডায়ও এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতারণার ব্যবসা খুলে বসলে সে দেশের সরকার তাদের আইন আরো কঠোর করেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক কর্নেল হানিফ ইকবাল কালের কণ্ঠকে জানান, কমিশন যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে জন্য আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট আইনি দিকগুলো খতিয়ে দেখছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান এর আগে সাংবাদিকদের জানান, ইউনিপে টু ইউ নামের প্রতিষ্ঠানটি রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচারণা চালিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে প্রতারণা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে একাধিক ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, টাকা নিয়ে বিদেশে গ্রাহকদের নামে স্বর্ণ কিনে ভল্টে রাখা হচ্ছে। যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে, তাদের ২০ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হবে বলেও জানানো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটি টাকা নিয়ে লুটে খাচ্ছে, কোথাও কোনো স্বর্ণ ক্রয় করছে না, যা বাংলাদেশ ব্যাংক চিহ্নিত করেছে। তিনি আরো বলেন, জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ওঠানো হয়েছে। কিন্তু ওই টাকা কোথায় রাখা হয়েছে, কী করা হয়েছে, ইউনিপে টু ইউয়ের কাছ থেকে এর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শেয়ারবাজারের ভয়াবহ পতনের জন্য অন্যান্য কারণের পাশাপাশি ইউনিপে টু ইউয়ের গ্রাহক প্রতারণাকেও দায়ী করেছেন। গত ৯ জানুয়ারি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে দায়ী কাউকে ছেড়ে দেব না। ইউনিপে টু ইউ এক সপ্তাহে দ্বিগুণ লাভ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদেরও ধরব।’
ইউনিপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রুল
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম জানায়, ‘স্বর্ণ কেনার নামে বিনিয়োগ পুঁজি সংগ্রহ কেন বন্ধ করা হবে না’ মর্মে ইউনিপে টুইউ এবং সরকারের চার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। অন্যরা হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ।
চট্টগ্রাম উত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মোহাম্মদ আইয়ুব ও মুক্তিযোদ্ধা গোরী শংকরের জনস্বার্থে দায়ের করা রিট পিটিশনের (পিটিশন নম্বর ৭৮৩ তারিখ ২৩-০১-১১) পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
গত রবিবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রিটের শুনানি শেষে এই আদেশ দেন।
এ ছাড়া আদালত আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন স্বর্ণ কেনার নামে অর্থ আদায় কার্যক্রম বন্ধ করা হবে না মর্মেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। বেঞ্চ একই সঙ্গে ইউনিপের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে আবেদন জানানোর জন্যও পরামর্শ দেন।
রিটকারীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন জয়, অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন ও অ্যাডভোকেট কে এম জাবির।

No comments:

Post a Comment