Tuesday, January 25, 2011

২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নয়

নির্বাচন কমিশন অনেকটা নাটকীয়ভাবে জানিয়ে দিল, আগামী ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ১২টি পৌরসভা এবং জাতীয় সংসদের হবিগঞ্জ- ১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন হচ্ছে না।

গতকাল সোমবার এসব নির্বাচন নিয়ে ঢাকার আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া জানানো হয়েছে, ১৩টি পৌরসভায় নির্বাচনের কথা থাকলেও আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ঝালকাঠিতে নির্বাচন হচ্ছে না।
গতকালের ওই বৈঠকে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি লে. কর্নেল তৌফিককে নির্বাচন
কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন জিজ্ঞেস করেন, ‘২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কি সেনা, নৌবাহিনী মোতায়েন হচ্ছে?’ লে. কর্নেল তৌফিক বলেন, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ জবাব পাওয়ার পর ছহুল হোসাইন বৈঠকে উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, “তাহলে আমরা এর জবাব ‘না’ ধরে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারি। কারণ আমাদের হাতে আর সময় নেই।”
বৈঠক শেষে ছহুল হোসাইন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে কি লাভ? তারা তো কোনো উপকারে লাগছে না।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত ছিল-১৩টি পৌরসভার মধ্যে মাগুরা, ঝালকাঠি, মাধবদী, মাদারীপুর, কক্সবাজার, চকরিয়া ও টেকনাফে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে থেকে মোট পাঁচ দিনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। আর চরফ্যাশন ও মহেশখালীতে মোতায়েন থাকবে নৌবাহিনী। কিন্তু গত রবিবারই সে সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়।
নির্বাচন কমিশন ১৩টি পৌরসভার মধ্যে মাগুরা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, মাধবদী, কক্সবাজার ও চকরিয়া পৌরসভার জন্য দুই প্লাটুন করে এবং চরফ্যাশন, মহেশখালী, পার্বতীপুর, জাজিরা, মদন, দাগনভূঞা ও টেকনাফে এক প্লাটুন করে বিজিবি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি পৌরসভার জন্য এক থেকে দুই কম্পানি/প্লাটুন করে র‌্যাব মোতায়েনেরও সিদ্ধান্ত হয়। রবিবার নির্বাচন কমিশন আরো সিদ্ধান্ত নেয়-বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে (২৫ জানুয়ারি) থেকে নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্রে টহল দেবেন। আর ভোট গ্রহণের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে স্থায়ীভাবে মোতায়েন থাকবেন এবং ভোটগ্রহণ শেষে গণনার আগে থেকে গণনাকক্ষের চারপাশে নিরপত্তাবলয় সৃষ্টি করে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা কেন্দ্রভিত্তিক ফল ঘোষণার পর রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ফলাফল একীভূত করা এবং ফল ঘোষণার আগে থেকে ওই কার্যালয়ের চারপাশে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে প্রবেশপথেও দায়িত্ব পালন করবেন।
নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (পৌর-১) মো. আবদুল বাতেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি রবিবার স্বরাষ্ট্রসচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পাঠিয়ে এ বিষয়ে পরিপত্র জারির অনুরোধ করা হয়।
গতকালের বৈঠকে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান সিকদার যথসময়ে সে চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে রবিবারই সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। তবে সব পৌরসভায় বিজিবি মোতায়েনে সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, পার্বতীপুর, মাগুরা, মাধবদী, মদন, দাগনভূঞা, কক্সবাজার, চকরিয়া ও টেকনাফে বিজিবি মোতায়েন করা যেতে পারে। মাদারীপুর ও জাজিরায় বিজিবির বদলে অতিরিক্ত র‌্যাব সদস্য মোতায়েন সম্ভব হবে। বাকি দুটি পৌরসভা চরফ্যাশন ও মহেশখালীতে কোস্টগার্ড বা নৌবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করলে ভালো হয়।
এ প্রস্তাবে লে. কর্নেল তৌফিক বলেন, ‘মহেশখালীতে যাতায়াতের বিষয়ে আমরা যানবাহন দিয়ে সহায়তা করতে পারি, কিন্তু আমাদের জনবল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
এদিকে নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণের দিন প্রতি কেন্দ্রে বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যদের স্থায়ীভাবে মোতায়েন রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর বিপক্ষে মত দেন র‌্যাবের মহাপরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান ও নরসিংদীর জেলা প্রশাসক অমৃত বাড়ৈ। র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেন, কোনো স্থানে ৯ জনের কমে র‌্যাব সদস্য মোতায়েন সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রতি ভোটকেন্দ্রে তাঁদের স্থায়ীভাবে রাখতে হলে প্রচুরসংখ্যক র‌্যাব সদস্যের প্রয়োজন হবে, যা সম্ভব নয়।
বৈঠকে বিজিবি প্রতিনিধিও জানিয়ে দেন, কয়েকটি পৌরসভায় ২০ জন করে বিজিবি সদস্য দেওয়া সম্ভব হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে অর্থাৎ আজ মঙ্গলবার সকালেই সব নির্বাচনী এলাকায় বিজিবি ও র‌্যাব মোতায়েন হওয়ার কথা রয়েছে।
পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনকে ইসির ভর্ৎসনা : প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা দেশের বাইরে থাকায় নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইনের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতেই পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের ভর্ৎসনার শিকার হয়। কক্সবাজার-৪ আসনের (টেকনাফ) সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের আচরণের বিষয়েও কড়া মন্তব্য করা হয়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও এসপির উদ্দেশে বলেন, ‘ইউ ডোন্ট কেয়ার সংসদ সদস্য। টেকনাফে নির্বাচনের সময় প্রতিবার আমাদের লোককে মারধর করা হচ্ছে। জানি না আপনারা এটা কিভাবে সহ্য করেন। এ অবস্থা চলতে পারে না।’
জবাবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে সংসদ সদস্যের চাচাকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সংসদ সদস্যকে আমি পরামর্শ দিয়ে বলেছি, নির্বাচনের সময় আপনি সেন্ট মার্টিনে অথবা ঢাকায় নির্বাসনে থাকেন। তাহলে সবার জন্যই ভালো হবে। এ ছাড়া তাঁকে বলেছি, আবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’
এম সাখাওয়াত হোসেন গত ১৮ জানুয়ারি পৌরসভা নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটসহ বেশ কয়েকজন নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের গায়ে হাত দেওয়াটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। এটা ঠেকাতে হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, নোয়াখালী এলাকার পৌরসভাগুলোয় যেসব ঘটনা ঘটেছে, এর জন্য সংশ্লিষ্ট ওসিদের সাসপেন্ড করা হয়নি কেন? বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে?
নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন সেনবাগ, নোয়াখালী, সোনাগাজী, কবিরহাট, ফেনী, নাঙ্গলকোট, ঘাটাইল-এসব পৌরসভার নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারদের ওপর হামলা, ব্যালট পেপার ও বক্স ছিনতাই-এসব নির্বাচনী অপরাধের তথ্য উপস্থাপন করে বলেন, ‘যে সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতি আমরা শুরু করেছিলাম, যে ব্যক্তিকে জনগণ চাইবে তিনিই নির্বাচিত হবেন-এসব এলাকায় সে সংস্কৃতির কী হলো? পুলিশ, আনসার, আর্মি-এত সব বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে কিভাবে এসব ঘটতে পারে? কিভাবে তাদের চোখের সামনে ব্যালট বাক্স ভাঙার, পোড়ানোর মহোৎসব হয়?’
এর জবাবে স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘সরকার চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। পুলিশ আহত না হয়ে ব্যালট পেপার আহত হওয়া উচিত নয়। সরকারি নিয়মনীতির বাইরে যারা কাজ করেছে, তাদের এর জবাব দিতে হবে।’
স্বরাষ্ট্রসচিব আরো বলেন, ‘নির্বাচনী আইনকানুন এখন অনেক কড়া। এ ধরনের আইনকানুন যখন ছিল না তখনো নোয়াখালীর মতো ঘটনা ঘটেনি। কে সরকারের লোক, কে নয় সেটা তো কারো দেখার কথা নয়। যা ঘটেছে তা ক্ষমাযোগ্য অপরাধ নয়। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী অপরাধ ঘটানো হলে প্রিসাইডিং অফিসাররা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু নিজেরা সে ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত না থাকার কারণে তাঁরা হয়তো সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেননি।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, ‘বেশির ভাগ জায়গায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে গ্লাসের সামান্য অংশ খালি ছিল। এটা অনবধানতাবশত হয়েছে। আমাদের লোকজন হয়তো কিছু জায়গায় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। প্রিসাইডিং অফিসাররা তাদের কমান্ড করতে পারেননি। ঘাটাইলে যখন ঘটনা ঘটে তখন আমি সেখানে রাবার বুলেট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলাম। এ ছাড়া সামাজিক বাস্তবতার কারণে সব জায়গায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।’
র‌্যাবের মহাপরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘কোনো ঘটনায় হাজার হাজার লোক যখন জড়িত হয়ে পড়ে তখন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে গেলে হতাহতের ঝুঁকি থাকে। তা ছাড়া আমরা যে একেবারেই ভালো কিছু করতে পারিনি তা তো নয়।’
র‌্যাবের মহাপরিচালকের এ মন্তব্যে ছহুল হোসাইন বলেন, ‘৯৫ শতাংশ পৌরসভায় নির্বাচন ভালো হয়েছে-এই খুশিতে যদি থাকেন, তাহলে আরো বিপর্যয় হতে পারে। একটি জায়গার খারাপ ঘটনা অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে কতক্ষণ?’

No comments:

Post a Comment