Tuesday, January 25, 2011

ফেরি করে অবৈধ রক্ত বিক্রি by আবুল খায়ের

রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে অবৈধভাবে রক্ত বেচাকেনা । এমনকি ফেরি করে রক্ত বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব রক্তে থাকছে হেপাটাইটিস বি,সি ও ই এবং এইচআইভি এইডসের ভাইরাস। পেশাদার রক্তদাতারা মরণব্যাধি ভাইরাসযুক্ত রক্ত বিক্রি করছে অবাধে।

এছাড়া নেশার উপকরণ ক্রয় করার জন্য মাদকাসক্তরা নিয়মিত রক্ত বেচাকেনা করছে। তাদের দেহে এসব ভাইরাস থাকার আশংকা একশত ভাগ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে কমিশনের লোভে এক শ্রেণীর ডাক্তার বাইরের বস্নাড ব্যাংক থেকে রোগীর অভিভাবকদের রক্ত ক্রয় করে আনার পরামর্শ দেন। ডাক্তারের পছন্দের বস্নাড ব্যাংক থেকে রক্ত এনে রোগীর দেহে পুশ করা হয়। কিন্তু এসব প্রাইভেট বস্নাড ব্যাংকে পেশাদার রক্তদাতা ও মাদকাসক্তদের রক্ত ক্রয় করা হয়ে থাকে। সেই রক্তই রোগীর নিকট বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া ফেরি করে রক্ত বেচাকেনার প্রমাণ পেয়েছে ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্ট। এই রক্ত রোগীর জন্য অতি বিপজ্জনক বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিয়েছেন।

ভাইরোলজি, লিভারব্যাধি, চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে পেশাদার রক্তদাতার (ডোনার) ২৯ ভাগের দেহে হেপাটাইটিস বি, সি ও ই রয়েছে। এছাড়া সিফিলিস ও গনোরিয়ার জীবাণু ৫০ ভাগের এবং মরণব্যাধি এইডসের জীবাণু রয়েছে বেশিরভাগের দেহে। ডোনারের রক্ত ক্রয় না করে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করা উচিত। নিজেদের পরিবারের সুস্থ সদস্যের রক্ত নিলে কোন ধরনের ক্ষতি হয় না। এতে রোগী রোগমুক্ত নিরাপদ রক্ত পায় বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ অভিমত ব্যক্ত করেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশে বৈধ প্রাইভেট বস্নাড ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। এর বাইরে অলিগলিতে শতাধিক অবৈধ বস্নাড ব্যাংক রয়েছে।

সাধারণত বস্নাড ব্যাংকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী পাঁচটি ঘাতক ব্যাধি হেপাটাইটিস বি,সি, এইচআইভি/ এইডস, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিস পরীক্ষার বিধান রয়েছে। পাশাপাশি বস্নাড ব্যাংকে থাকতে হবে রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ, টেকনিক্যাল সুপারভাইজার, রেজিস্টার্ড নার্স ও ল্যাব সহকারী। ঘাতক রোগের পরীক্ষার ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতিও থাকতে হবে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইনে উলেস্নখ রয়েছে। এই সকল ব্যবস্থা থাকলেই কেবল প্রাইভেট বস্নাড ব্যাংক সরকারি অনুমোদন পেতে পারে। কিন্তু ৯৮ ভাগ বস্নাড ব্যাংকে এসব যন্ত্রপাতি ও জনবল নেই। শুধুমাত্র বস্নাড সংগ্রহ করা এবং কোন কোন বস্নাড ব্যাংকে সিফিলিস ও গনোরিয়া শনাক্তে রক্তের ভিডিআরএল পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

গত বছর র্যাবের তত্ত্বাবধানে ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ারের নেতৃত্বে রাজধানীর ২১টি বস্নাড ব্যাংকে অভিযান চালিয়ে ৪২ জনকে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এদের মধ্যে ২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এসব বস্নাড ব্যাংকে কোন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ডোনারের রক্ত সংগ্রহ করে দিনের পর দিন রোগীর নিকট বিক্রি করার প্রমাণ পায় মোবাইল কোর্ট। এদের নেই কোন যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ জনবল। তারা বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারও করেছে।

সম্প্রতি যাত্রাবাড়ী এলাকায় পরীক্ষা ছাড়াই ডোনারের রক্ত রোগীর নিকট বিক্রি করার সময় একজন ডাক্তারকে মোবাইল কোর্ট হাতে-নাতে ধরে ফেলে। ডাক্তারকে কারাদণ্ড দিয়ে মোবাইল কোর্ট কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। মোবাইল কোর্টকে তারা আরও জানায় যে, পেশাদার ডোনারকে এক ব্যাগ রক্তের জন্য ৯০ থেকে ১২০ টাকা দেয়া হয়। মাদকসেবীরাও প্রতি ব্যাগ অনুরূপ মূল্য পায়। দালালের মাধ্যমে আসলে দালালকে প্রতিব্যাগের জন্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা দেয়া হয়। প্রতিব্যাগ রক্ত নিম্নে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি করে থাকে। এদের ডোনাররা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত এবং তারা ফুটপাতে কিংবা অলিগলিতে ও পার্কে ময়লা-আবর্জনার মধ্যে দিন-রাত অবস্থান করে। মাদকাসক্তদেরও একই অবস্থা। দিনের পর দিন গোসল করে না এবং কাপড়-চোপড় ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক থেকে রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে ফোন করে। ঐ সময় একজন ডোনারকে ডেকে এনে গলির কোন একটি নির্ধারিত কক্ষে নিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে সঙ্গে সঙ্গে রোগীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে ফেরি করেও রক্ত বিক্রি করা হয়ে থাকে। প্রতি ব্যাগ থেকে ডাক্তারকে কমিশন দেয়া হয়। মোবাইল কোর্ট রাজধানীতে অবৈধ রক্ত বেচাকেনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেলে তারা ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করে ফেলে। বর্তমানে রক্তের প্রয়োজনে তারা ক্রেতা ও ডোনারকে রক্তের গ্রুপ বি হলে 'চশমার ফ্রেম', এ হলে 'এঙ্গেল', ও হলে 'আলু' এবং এবি হলে 'ডাবল' সঙ্গে পজেটিভ ও নেগেটিভ বলে দেয়। এইভাবেই চলছে অবৈধ রক্ত বেচাকেনার বাণিজ্য।

চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএন হুদা বলেছেন, এদেশে সরকারিভাবে এইচআইভি বাহক ও এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। কিন্তু বেসরকারিভাবে হাজার হাজার হবে। পেশাদার ডোনার ও মাদকাসক্তদের রক্তে ঘাতক ব্যাধি থাকার আশংকা একশত ভাগ। এই রক্ত দেয়া আর রোগীর দেহে বিষ ঢুকানো একই কথা বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মবিন খান বলেন, ২০ বছর আগে এক জরিপে দেখা যায়, পেশাদার রক্তদাতার ও মাদকাসক্তের মধ্যে ২৯ ভাগের দেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস রয়েছে। বর্তমানে এইডসসহ অন্যান্য ঘাতকব্যাধির জীবাণু পেশাদার রক্তদাতা ও মাদকাসক্তদের শরীরে রয়েছে বেশি। পেশাদার ডোনারদের রক্ত পরিহার করে পরিবারের সদস্যদের রক্ত দানে উৎসাহিত করা উত্তম কাজ। বিশ্বে কোথাও এদেশের মত রক্ত বেচাকেনা হয় না। মরণব্যাধির হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করত অবৈধ রক্ত বেচাকেনা বন্ধ করা জরুরি বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম একই মতামত দিয়েছেন।

এদিকে ঢাকার বাইরেও অবৈধভাবে রক্ত বেচাকেনা চলছে প্রকাশ্যে। গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে রাজী হয় না। তাদেরকে দালালরা রক্ত দিলে মারা যাওয়াসহ নানা ধরনের কথা বলে ভয়ভীতি দেখায়। এ কারণে তারা ডোনারের রক্ত ক্রয় করতে বেশি উৎসাহী বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার সিফায়েত উলস্নাহ বলেন, অবৈধভাবে রক্ত বেচাকেনা এবং পেশাদার ডোনার ও মাদকাসক্তের রক্ত সংগ্রহ বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এই বিপজ্জনক বাণিজ্য করতে দেয়া হবে না বলে মহাপরিচালক জানান।

No comments:

Post a Comment