Saturday, February 05, 2011

মোহনা by হরিশংকর জলদাস

কালিন্দীর যে-তীরে ডমরনগর, সে-তীরে বারাঙ্গনাপল্লী। এই পল্লী নগরীর বাইরে, বাজারের পাশে। ও-পাড়ের মাঝিরা যে-ঘাটে নৌকা ভিড়ায়, তার থেকে সামান্য পশ্চিমে বারাঙ্গনাপল্লীটি। জোয়ার ভাটার নদী কালিন্দী। ভাটায় জল নেমে গেলে চর ভেসে ওঠে। বারাঙ্গনাপল্লী থেকে দু’কদম হাঁটলেই নদীপাড়।

ওখান থেকে ঢালু হয়েছে ভূমি। বারাঙ্গনারা সকালে একবার, সন্ধেয় আরবার গা-গতর ধুতে যায় নদীজলে। পুরুষ-বর্জ্য শরীর থেকে সাফ করতে হয় যে তাদের। রাতে দিনে অতিথি আসে বারাঙ্গনাগৃহে। শরীর-ক্ষুধার তো কোনো রাত দিন নেই। মাহুত, মশালচি, সৈন্য, চারণকবি, টিকিনাড়া ব্রাহ্মণ, বাজারিয়া, হাটুরিয়া সবাই আসে ক্ষুধা মিটাতে। আর আসে ভীমের একজন সেনানায়ক, চণ্ডক তার নাম। মোহনার কাছে আসে সে। নদী-সমুদ্রের মিলনস্থল মোহনা। মিষ্টি আর নোনা জলে মাখামাখি, লুটোপুটি। নদী সমুদ্রকে আর সমুদ্র নদীকে পেয়ে তৃপ্ত। মোহনার কাছে এলেই চণ্ডকের তৃপ্তি। মোহনা তার নদী।
বারাঙ্গনাপল্লীটি তত বড় নয়, তবে এর মাঝখানে বিশাল চত্বর। চত্বরের চতুর্দিকে সারি সারি ঘর, মাটির দেয়াল। ঘরগুলো উঁচু উঁচু, প্রশস্ত আঙিনা। সেই আঙিনায় অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। মিলনের স্থান ভিতরে। ভিতরটা নয়নাভিরাম। একদিকে বিশাল খাট, চারদিকে অগুরু চন্দনের সুবাস। একটু দূরে তাকিয়ার ওপর গুবাক-তাম্বুলের বাটা। অতিথিকে গুবাক-তাম্বুলে আপ্যায়নের রেওয়াজ আছে।
এই বারাঙ্গনাপল্লীর প্রধানা জানকি। জানকি একদা এই পল্লীরই বারাঙ্গনা ছিল। এখন প্রৌঢ়া জানকি ত্রিশ-চল্লিশ জন যৌবনবতী বারাঙ্গনার দেখাশোনা করে। তাদের নিরাপত্তার দিকেও নজর তার। পল্লীর চারদিকে সুউচ্চ মাটির পাঁচিল। দক্ষিণ দিকে প্রবেশদ্বার। ওই দ্বার দিয়েই আসা যাওয়া। পাঁচিল ডিঙানোর উপায় নেই।
শুধু ডমরনগরে নয়, আরও বিশাল বিশাল নগরীতে বাররামাদের আবাসস্থল। গৌড়, চম্পকনগর, মগধ, বৈশালী—এসব নগরে চিরায়ুষ্মতীরা বাস করে। তারা নগরীর শোভা। গঙ্গা-করতোয়া-কালিন্দী-সংলগ্ন ভূমিতে বারাঙ্গনারা বহু বহু প্রাচীনকাল থেকে কামলোভীদের তৃপ্তি দিয়ে আসছে। সমাজে তারা আদরণীয়। বাররামারাও তা জানে। ডমরনগরের বারাঙ্গনাপল্লীর মেয়েরা জানে যে, তারা ভোগের, ভোগের পর ছুড়ে ফেলারও। মোহনা, কুন্তি, সুবর্ণা, দময়ন্তী, অঙ্গনা, মেনকারা এও জানে যে, সমাজে তাদের কদর ওইটুকু সময় পর্যন্ত, যতদিন তাদের গতরে যৌবন আছে। তাই তারা স্তনের পরিচর্যা করে, অধরের পরিচর্যা করে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মহুল মদ গরম করে ডলে। উষ্ণ মদে গতরের ব্যথা সারে। দীর্ঘ সময় মদের গন্ধ লেগে থাকে শরীরে। ওই গন্ধে গ্রাহকের দেহমন আনচান করে।
বারাঙ্গনাপল্লীর দুয়ারে দুয়ারে দীপাধার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে চিরায়ুষ্মতীরা। তাম্বুল চর্চিত অধর তাদের। বারাঙ্গনাদের সন্তান হতে নেই। তবু হয়। কন্যাসন্তানেই সুখ তাদের। বিগতযৌবনে এই কন্যাই মূলধন। ডমরনগরের বারাঙ্গনাপল্লীতে এই পেশায় প্রথম যেদিন হাতেখড়ি হয়, সেদিন সকালে নাপিতানী এসে নখ খুঁটে দিয়ে যায়। মেয়েটির মাথায় ঘষে ঘষে সুবাসিত তেল মাখানো হয়। নদীতে স্নান করানো হয়। নতুন কাপড় আলতা কাজল পরিয়ে ধানদূর্বা দেয়া হয় তার মাথায়। ওর হাত ধরে লক্ষ্মী ঢুকবে যে এই বারাঙ্গনাপল্লীতে।
মোহনার স্পষ্ট মনে আছে—এই বৃত্তিতে ব্রতী হবার প্রথম দিনের কথা। সদ্য রজস্বলা হয়েছে সে। বামুনঠাকুর এসে গোধূলি লগ্নে একটি বঁটির সঙ্গে বিয়ে দিল তার। সিঁথিতে চিকন করে সিঁদুর দিল, গলায় ঝুলাল গাঁদাফুলের মালা। রাতের অতিথি ফুলমালা ছিঁড়তে বড় ভালোবাসে। অতিথি জানে—এ মালা শুধু মালা নয়, মেয়েটির অক্ষতযোনীর প্রমাণও। অক্ষতযোনীতে যুবা প্রৌঢ় বৃদ্ধ কার না আগ্রহ!
জানকির কাছ থেকে মোহনার কুমারিত্ব কিনে নিয়েছিল চণ্ডক। উচ্চ মূল্যে। সেরাতে আধা পন কড়ি দিয়ে মোহনার ঘরে ঢুকেছিল চণ্ডক।
বঁটির সঙ্গে বিয়ের পর থেকে ভাবনায় পড়েছিল মোহনা। বিয়েই যদি, বঁটির সঙ্গে কেন? জিজ্ঞেস করেছিল জানকিকে, ‘লোহার সাথে বিয়া কেনে, মানুষের সাথে নয় কেনে?’
জানকি বলেছিল, ‘এই পাড়ার অক্ষতযোনীদের গাছ বা লোহার সাথে বিয়া দেওয়ার নিয়ম। গাছ ত অমর, লোহার ক্ষয় নাই। এক গাছ মরল ত, তার বীজ থেকে আরেক গাছ জন্মাল, গাছ চিরায়ু, লোহা অক্ষয়। বারবধূরাও চিরায়ুষ্মতী। এক মোহনা গেলে, আরেক কাঞ্চনা আসে। জায়গা খালি থাকে না। তাই অমর জিনিসের সাথে মোদের বিয়া হয়। তোহারও হয়েছে।’
সেই থেকে বঁটিটিকে কাছে কাছে রাখে মোহনা। ভাবে—ওই-ই ত মোর স্বামী।
মোহনা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। জালিকদের ঘরে ফর্সা রঙের নারী নেই। মোহনার চুল কোঁকড়ানো। কোঁকড়া চুল খুব বেশি লম্বা হয় না। কিন্তু বিপুল হয়। মাথাভর্তি চুল মোহনার। চিপচিপে শরীর। চোখেমুখে এখনো গ্রামজীবনের শৈশব লেপ্টে আছে। কালিন্দী এগিয়ে যেতে যেতে যেতে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেই বাঁকে জেলেপল্লী। সেই পল্লীর নাম গাঙ্গী। সেই গাঙ্গী থেকে তিন বছরের মোহনাকে চুরি করে এনেছিল সনকা। কিনে নিয়েছিল জানকি। তারপর লালন-পালন। তারপর চ্লকের ডুবসাঁতার, মোহনায়। মদিরারক্তিম চোখে চণ্ডক মোহনার ঘরে ঢুকেছিল সেরাতে। মোহনার গলার মালায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘এই মালা আমার, এই মোহনা আমার। এর ঘরে আর কাউরে ঢুকতে দিও না।’ [অংশ]

সিদ্দিকবাজার থেকে নবাবপুর by মীজানুর রহমান

ফুলবাড়িয়া স্টেশনের পোর্টিকোয় পা দিলে প্রথমেই চোখে পড়ত রাস্তার ওপারে সারিবদ্ধ বাঁশের তৈরি আসবাবের দোকান। যে কারণে এলাকাটির নাম বাঁশপট্টি। উচ্ছিষ্ট কিছু বাঁশ ও বেতের আসবাবের দোকান কিছুকাল আগেও চোখে পড়ত। ইদানীং ওপাড়ায় যাওয়া হয়ে ওঠে না, তাই বলা যাবে না ওগুলো আছে কি নেই।
অথচ একসময় এটাই ছিল কুটিরশিল্পের আস্তানা। এখন তো শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে, গ্রিন রোড ও পান্থপথে বেতের কাজের রমরমা ব্যবসা। হূতগৌরব বাঁশপট্টির পেছনেই সিদ্দিকবাজার এলাকা। এই নামকরণের পেছনে আছে দেওয়ান পরিবারের পীর, মিঞা মহম্মদ সিদ্দিক। এখানেই তাঁর মাজার, আজও ভক্তকুলকে কম আকর্ষণ করে না। এখানেই থাকতেন ঢাকা শহরের গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর। তাঁর সম্বন্ধে আগেই বলা হয়ে গেছে।
সিদ্দিকবাজারের পাশেই আলুবাজার। মোগল আমল থেকেই আছে। এটার মালিক ছিলেন আল্লাইয়ার খান। তিনি আওরঙ্গজেবের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। বাস করতেন লালবাগ দুর্গে। সময়ের পথ বেয়ে আল্লাইয়ার বাজার নামটি জিভের ডগায় বিকৃত হতে হতে প্রথমে হয়েছে আল্লুর বাজার। তারপর আলুবাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ এ বাজারে আলু ছাড়া অন্য সওদাপাতিও লোকে করত বা করে থাকে।
এখন এই নবাবপুর রোড ধরে যদি এগোতে থাকি, তাহলে প্রথমেই ডান দিকে চোখে পড়ত রাস্তা থেকে উঁচুতে ওষুধের বিপণি—ডন ফার্মেসি, যার কথা এর আগে বলেছি। এই দোকানের কোল ঘেঁষে কিছু পত্রপত্রিকা নিয়ে বসে থাকতে দেখতাম কুচেল এক কলকাতিয়াকে, যাদের চেহারা আমায় চট করে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের পসারিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে জানা হয়ে গেল ওই পাড়ারই লোক সে। স্বাধীনতার একেবারে গোড়ায়, মেডিকেল কলেজের সামনে, মানসী সিনেমার অনতিদূরে, সদরঘাটের ব্যাপটিস্ট মিশনের দোরগোড়ায় আর চকবাজারের গোলচক্করে যে কটা বুকস্টল ছিল, সবটাতেই এই কলকাতিয়াদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। তো এই স্টলের পাশ কাটিয়ে যত এগোই পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি দোকানপাট। তখনো হিন্দু দোকানিরা আছে—পাট তুলে নেয়নি। ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়েছে কিছু অবাঙালি মুসলমান। বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের মোড়ে এলেই চমকে উঠতাম প্রতিবার—একটা সুন্দর ইউরোপীয় ছাদে তৈরি দোতলা বাড়ি—শহরে যেন বা হঠাৎ আলোর ঝলকানি! কেমন বেমানান মনে হতো, আজও মনে হয়। এটাই কি ছিল বুদ্ধদেব বাবুর যৌবনকালের বিলিতি মদের ঝকঝকে দোকান রায় কোম্পানি, যেখান থেকে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে তিনি তাঁর সুপ্রিয় চকলেট কিনতেন মাঝেমধ্যে? না, বুদ্ধদেব বাবুর প্রসাধনহীন অ্যালবার্ট লাইব্রেরি যেমন দেখা হয়নি, ওঁর অর্ধদগ্ধ চুরুট মুখে বসে ঢাকা শ্মশ্রুমান সমর্থ বৃদ্ধকেও না। তবে ওই যে যখন তিনি বলেন, ‘রায় কোম্পানির মুখোমুখি একটি মিষ্টান্ন ভান্ডার, যা খোলা থাকে নিশুতি রাত’—সেই ‘মতিলাল সুইটমিট’—এই সেদিনও আমার চোখে পড়ত—এত কাল ভেঙেও ‘পাছে ছদ্মবেশে পরিরা খেতে এসে ফিরে যায়’—তাই খোলা থাকত নিশুতি রাত পর্যন্তই।
তখনো স্টুডিও ওরিয়েন্ট হয়নি, কিন্তু আছে তো ৮১ নম্বর সদনে ১৯৩২ সনে স্থাপিত বনেদি দাস অ্যান্ড কোম্পানি (DOSS & Co.)—ফটো তোলা এবং ফটোর যাবতীয় সরঞ্জামের দোকান। সেকালে ফটো তোলার আরেকটি যে দোকান ছিল, সে তো ভিক্টোরিয়া পার্কে: ঢাকা মিউজিক্যাল মার্ট—A Silent Music—এই রোমান্টিক আত্মপরিচয় যার মদগর্বী ভূষণ। সে কথায় পরে আসছি। তো কথা আমাদের দাস কোম্পানি নিয়ে। এর সঙ্গে বোধকরি অগ্নিদেবের একটা যোগ আছে। চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আগুনে ঝলসে সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল দোকানটা। তার আগে লুটপাট তো হয়েছেই। আইয়ুবি আমলের কী সুমতি হলো, ক্ষতিপূরণ দিলে, বোধকরি, আন্তর্জাতিক চাপে মান বাঁচানোর তাগিদে। কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতে একাত্তরে আবার লুটের কবলে! মজা কী, এত যে ঝুটঝামেলা গেল, দাস কোম্পানি কিন্তু আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—মাথা নুইয়ে পালায়নি কোথাও।
আরেকটু এগোলেই একটা বইয়ের দোকান। নামহীন। হঠাৎ চোখে পড়ত না। নানা সাইনবোর্ডে আকীর্ণ সেকেলে ঝাঁজি-ধরা বাড়িটার কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, ধরার উপায় ছিল না। দুই-আড়াই হাত চওড়া সরু এক চিলতে গোলকধাঁধা—সুড়ঙ্গের মতো কোথায় যে শেষ, ধরার উপায় ছিল না। কলকাতিয়া কাঁচি উর্দুওয়ালার দোকান। কিছু হালকা বাংলা-ইংরেজি পত্রপত্রিকা ছাড়া সিংহ ভাগ জুড়েই ছিল উর্দু পত্রপত্রিকা ও গল্প-উপন্যাসে ঠাসা। পত্রিকার ভিড়ে শামা তো অবধারিত ছিল। দিল্লি ও করাচি থেকে বেরোত। বহু বছর ভারতবর্ষে আঞ্চলিক ভাষায় মুদ্রিত পত্রিকার মধ্যে কাটতির দিক থেকে ছিল প্রথম। এখনো বোধকরি জায়গাটা বেহাত হয়নি। এরপর গল্প-উপন্যাসের রাজ্যে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন আমাদের শরৎবাবুর মতো, তিনি সাদৎ হাসান মান্টো। কৃষণ চন্দর, ইসমত চুগতাই, খাজা আহমদ আব্বাস, গোলাম আব্বাস প্রমুখও কম জনপ্রিয় ছিলেন না। তবে যে বইয়ের বেশি কাটতি ছিল, যারা লঘু লেখা পছন্দ করেন, পৃথিবীর আর সব পাঠকের মতোই, সে তো জাসুসি দুনিয়া; অর্থাৎ গোয়েন্দাদের ভুবন। জাসুসি দুনিয়া নামেই একটা পত্রিকা ছিল, যার জনপ্রিয়তা ঈর্ষা করার মতো। এসব বই, পত্রপত্রিকা লাহোর, করাচি, দিল্লি থেকে আসা মাত্র বিক্রি হয়ে যেত, আমাদের বাংলা বইয়ের মতো বছর গুনতে হতো না। সবারই তো ক্রয়ক্ষমতা থাকত না বা সংগ্রহ করার বাতিকও ছিল না। তাদের বেলায় ছিল lending library-র সুব্যবস্থা। এখনো ‘মানসী’ সিনেমা হলের কাছে একটা বইয়ের দোকান আছে, যার মালিক বাঙালি, কিন্তু ব্যবসা অধিকাংশ উর্দু বই ও পত্রিকার, জামানত ও কিছু অর্থের বিনিময়ে বই-পত্রিকা ধার নিয়ে পড়া যায়। সন্ধে হলেই এই দোকানে ঘরমুখো উর্দু-পাঠকের ভিড় দেখে মনে শ্রদ্ধা জাগে। নিজের ভাষার প্রতি এদের কী সান্দ্র মায়া! কথায় কথায় জানতে পারি, এই ব্যবসা করে কুমিল্লার ভদ্রলোক জুরাইনে জায়গা কিনেছেন, বাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি সবকিছু সাঙ্গ করেছেন।
আর নূরু মিঞার দোকান সম্পর্কে না বললে অনেকটাই অবলা থেকে যাবে এ সম্পর্কে। গুলিস্তানের পেছনে ওই যেখানে ফুচকার দোকানগুলো ছিল, তার পাশেই ছিল নূরু মিঞার দোকান। কে বলবে এ বিহারি নয়, নোয়াখালীর লোক! যৌবনে পালিয়ে কলকাতায় গিয়েছিল ভাগ্যান্বেষণে ওই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে। প্রথমে সহকারী হিসেবে, পরে নিজেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফুটপাতে পত্রপত্রিকার দোকান খুলে বসে। কমিক স্ট্রিপ, হলদে ম্যাগাজিন ও প্যারিস কার্ডের রমরমা ব্যবসা গড়ে ওঠে ওর। জি আই ব্লু ও টমিদের ক্রেতা হিসেবে পেয়ে আহ্লাদ আর ধরে না! কিন্তু সুদিন ফুরিয়ে আসে যুদ্ধ শেষে, যখন একে একে সৈনিকেরা বাড়িমুখো হয়। এক জি আই যুবা বাড়ি যাওয়ার আগে ওর সঞ্চিত সব বইপত্র এবং এক ‘থলে’ টাকা দিয়ে যায় নূরু মিঞাকে। এক গাল হেসে কেলেকিষ্টি নূরু মিঞা ওর কলকাতাই বুলিতে বলে ওঠে, মেরা সর্ ঘুমা গায়া আওর সাদি কর লিয়া!
[একটি অধ্যায়]

বইয়ের পাতায় পাখি by খসরু চৌধুরী

ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ—লেখক আলোকচিত্রী: রোনাল্ড আর হালদার \ প্রকাশক: বৈকাল \ প্রচ্ছদ: রোনাল্ড আর হালদার \ ২৬০ পৃষ্ঠা \ ছবি: ৭৩৫টি \ ১৬০০ টাকা

বাংলার সাধারণ পাখির নিয়ে বই লিখেছিলেন অজয় হোম। ১৯৬৮ সালের দিকে হারুনুর রশীদ তখনার পূর্ব পাকিস্তানের পাখিদের একটি চেকলিস্ট তৈরি করেছিলেন। ওই লিস্টটি ছিল ধারণার ওপর, মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে নেওয়া। ফলে অনেক পাখির নাম ওখানে ছিল, যেটা এ দেশের পাখি নয়। অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন, ড. রেজা খান বাংলাদেশের পাখি নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ঢাকার পাখির ওপর বই লিখেছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মকর্তা হার্ভে। পাখির ওপর লেখালেখি-ছবি প্রদর্শনী করে ইনাম আল হক পাখিপ্রেমীদের সজাগ করেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের পাখির ওপর এশিয়াটিক সোসাইটির ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অব বাংলাদেশ-এর একটি খণ্ডে দেশের অধিকাংশ পাখি নিয়ে একটি সচিত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানও দেশের অধিকাংশ পাখিসহ বন্য প্রাণীর ওপর একটি বই প্রকাশ করেছেন। আগেই শরীফ খান বাংলায় পাখির ওপর একটি চমৎকার বই লেখেন।
এত দিন পাখি দেখিয়েরা সালীম আলী ও গ্রিমেটের আঁকা ছবিওয়ালা বই-ই ফিল্ড গাইড হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। তাতে বিশেষ করে ইন্সকিফ-গ্রিমেটের বইয়ের ইলাস্ট্রেসন বেশ বাস্তবানুগ হওয়ায়, পরিবর্তিত আধুনিক ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম যুক্ত হওয়ায় সব পক্ষীবিদই বইটি সঙ্গে রাখছেন।
পক্ষীবিদ সবাইকে আশান্বিত করে এ বছর ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ৭৩৫টি ফটোগ্রাফসহ মোট ৪৭২টি পাখির বাংলা, ইংরেজি, বৈজ্ঞানিক নামসহ রোনাল্ড হালদারের বই এ ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ। আকার-আকৃতিতে বইটি পুরোপুরি ফিল্ড গাইডের চাহিদা পূরণ করবে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও দেশের অবস্থান ইন্দো হিমালয়ান ও ইন্দো মালয়ান, দুটি উপজৈব ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ায় উভয় বিভাগেরই পাখি এখানে আসন গেড়েছে অথবা মৌসুমি বিরতি নেয়। দেশের অবস্থান কর্কট ক্রান্তিতে হওয়ায় উত্তর-দক্ষিণের অনেক পরিযায়ী পাখি ক্ষণিক আবাস গড়ে এ দেশে। দেশে তিন ধরনের বনভূমি ও গ্রামীণ জঙ্গল থাকায় এ দেশ পাখির জন্য আদর্শ আবাসস্থল। উত্তর আমেরিকা ও কানাডা মিলে লাখ লাখ বর্গমাইলব্যাপী যেখানে মাত্র সাড়ে আট শ পাখির বাস, সেখানে বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলেই সাড়ে ছয় শ পাখির স্থায়ী বাস ও আসা-যাওয়া করে। গাছবৈচিত্র্য, সহনীয় তাপমাত্রা, বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, খাদ্যবৈচিত্র্য এত পাখি সমাহারের কারণ।
পাখির মতো ক্ষুদ্র (বড় পাখিও অবশ্য আছে) সদাচঞ্চল, ঋতু আশ্রয়ী ডানায় ভর করা প্রাণীর ছবি তোলা অত্যন্ত দুরূহ। তার ওপর বাংলাদেশে পাখি নিদারুণ নিগ্রহের শিকার। অনেকের কাছে পাখি মানেই সুখাদ্য মাংস হাড়ের স্তূপ—সেখানে পাখির বাস করতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। এই আতঙ্কিত পাখির মানসম্মত ও পরিষ্কারভাবে প্রজাতি, লিঙ্গ চেনা যাবে, এ রকম ছবি তোলা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেটাও দু-চারটি পাখির নয়, ৪৭২ প্রজাতির। যাঁরা কাজটি করছেন অর্থাৎ পাখির ছবি তুলছেন, তাঁরা জানেন, দিনের পর দিন, জঙ্গল থেকে মাঠ-নদী-সমুদ্রের চর, পাহাড় ডিঙিয়ে, নানা ঋতুতে নানা পাখির ছবি তোলা, চেনা কী ধরনের অভিনিবেশের কাজ। পাখির ছবি তোলার লেন্স বেশ ভারী, তেমনি দামিও। নিয়মিত মাঠে যাওয়া সময় ও খরচসাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই রাত যাপন করতে হয় নৌকায় অথবা জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে। কষ্ট-ক্লেশের এই পথচলায় একটি পাখি যদি নিতান্ত সুযোগ দেয়, তবে তার কয়েকটি ছবি তুললে একটি হয়তো ব্যবহার উপযোগী হয়, কখনো হয় না—একই পাখি আবার খুঁজতে বের হতে হয়। আবার সেই পাখি পেতে বছর পার হয়ে যায়। কোনো কোনো পাখির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা মিলন ঋতুতে দেহের পালকের রঙে পরিবর্তন আসে। একই আকারের উদীয়মান যুবক পাখির সঙ্গে পরিণত বয়সী পাখির রঙের পার্থক্য দেখা যায় অনেক পাখির মধ্যে। এসব ধোঁয়াশার জাল ছিন্ন করে একটি দেশের অধিকাংশ পাখি চিহ্নিত করে সচিত্র বইয়ের পাতায় নিয়ে আসা—নিবেদিতপ্রাণ একজন সাধকই কাজটি করতে পারেন।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টির গুরুত্ব কিছুটা অনুধাবন করা যাবে। ভারতে পাখি আছে এক হাজার ২০০ প্রজাতির (সারা পৃথিবীতে ২৫ হাজার) মতো। বহুকাল ধরে সে দেশে পাখিচর্চা হয়। কিন্তু ভারতে প্রাপ্ত প্রায় সব পাখির সচিত্র কোনো বই সে দেশে নেই। আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান—ইনাম আল হক প্রায় সম্পূর্ণ, মনিরুল এইচ খান অনেকটা, রোনাল্ড হালদার আরও সুস্পষ্ট করে সচিত্র পাখির গাইড বই আমাদের দিয়েছেন।
বাংলাদেশের পাখিচর্চার ইতিহাসে দুজন বিদেশি—ডেভিড জনসন ও পল টমসনকে অনেক পক্ষীবিদ গুরু হিসেবে মানেন। রোনাল্ড হালদারের ২৫০ পৃষ্ঠার এ ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ডেভিড জনসনকে। বইটির চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন পল টমসন। প্রায় সব ছবিই গ্রন্থাকারের হলেও আরও ২৫ জন পাখি আলোকচিত্রীর ছবি বইটিকে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছে।
বইটি হাতে নিলে প্রত্যেক পক্ষীপ্রেমীর মনে হবে, বইটির অপেক্ষায়ই এত দিন ছিলাম।

আদালতের সব বিচারকাজ বাংলায় চালাতে হবে by আবদুল মতিন

ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালে আমি ছিলাম ২২ বছরের টগবগে যুবক। ১৯৪৮ সালে বিএ পাস করেছি। ওই বছরই আমি কনভেনশনে যাই। কনভেনশনে জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান, অ্যান্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ।’ আমরা বললাম, আমরা এটা মানি না।

আপনার মতো একজন চরম পরাক্রমশালী ব্যক্তি এ কথা অকপটে বলছেন! আপনি যখন অকপটেই বলছেন, তখন আমাদেরও অকপটেই বলতে হয়, আপনার এই কথা আমরা গ্রহণ করব না। ‘নো নো নো’ বলে উত্তর দিলাম। আবুল হাশিম ডায়াসের ওপর ছুটে গিয়ে জিন্নাহ সাহেবকে বললেন, ‘এই দরজাই আপনার দরজা। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করছি, ওই আপনার সাদা গাড়ি, আপনি সাদা গাড়িতে উঠুন। আর আমাদের গাড়ি রেডি আছে। আপনার পেছনে পেছনে গার্ড দিয়ে আপনাকে দিয়ে আসব।’
বিজয় তো আর অত সহজে আসে না। এভাবেই আমরা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এভাবে না বলে বরং বলা ভালো, আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। আমি বলি, ভাষা আন্দোলন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফল। পাকিস্তানি নেতারা কথা রাখার লোক ছিলেন না। একবার বললেন, ‘লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হব।’ এ কথা রাখলেন না। এমনকি তাঁরা বললেন, ‘ইট ওয়াজ অ্যা প্রিন্টিং মিসটেক।’ লাহোর প্রস্তাব নাকি একটা ভুল কথা! ছাপার ভুল। সুতরাং, আমাদের কিছু করণীয় নেই। আবুল হাশিম তখন মুসলিম লীগের সেক্রেটারি। তিনি বললেন, ‘আপনি জলজ্যান্ত একটা মিথ্যা কথা বললেন। আমরা সবাই বলেছি সেটা ছাপা হয়েছে এবং সেটা ভারতব্যাপী বিলি হয়েছে। আর আপনি এখন বলছেন সেটা ছাপার ভুল?’ তিনি আবারও বললেন, ‘ইট ওয়াজ অ্যা প্রিন্টিং মিসটেক।’ আবুল হাশিম বললেন, ‘তাহলে একটা কপি নিয়ে আসেন। আর্কাইভসে আছে।’ জিন্নাহ বললেন, ‘নিয়ে আসো আর্কাইভস থেকে।’ কিছুক্ষণের মধ্যে আর্কাইভস থেকে নিয়ে আসা হলো। জিন্নাহ বললেন, ‘তা তো লেখা নেই।’ আবুল হাশিম বললেন, ‘আপনি পড়েন। পড়েই বলেন আছে কি না। আপনারা বললেন, প্রিন্টিং মিসটেক। কিন্তু প্রিন্টিং মিসটেক তো না। পরিষ্কার লেখা আছে। পরিষ্কার লেখা আছে, দেয়ার শ্যাল বি টু স্টেটস।’ এইভাবে লাহোর প্রস্তাবটা আমরা অবশেষে পেয়ে গেলাম। পাকিস্তান হলো। পাকিস্তান হওয়া মানে বাংলাদেশ আবার ভাগ করবে। বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে পশ্চিম বাংলা-পূর্ব বাংলা হয়ে গেল। কিন্তু তারা জবাব দেবে না। তারা মনে করল, পাকিস্তান তো হয়ে গেছে। মেনে নাও তোমরা। আবুল হাশিম বললেন, ‘আমরা মানছি না। আপনাদের এটার সঙ্গে আমরা একমত না। আমাদের পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।’ তাঁরা দিলেন না। ১৯৭১ সালে আমরা তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করলাম।
আমি মনে করি, একুশকে ঘিরে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনাই উল্লেখযোগ্য। সে সময়ের একটা স্মৃতির কথা বলছি। মনে পড়ে, ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে যখন মিছিল বের হলো, সেদিন নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমি জিন্নাহ সাহেবের কথার পুনরুক্তি করছি, এটা কিন্তু আপনারা মনে রাখবেন। এটা আমার কথা না, জিন্নাহ সাহেবের কথা। পাকিস্তানের উন্নতি হবে না, যদি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা না করা হয়। সুতরাং আমি মনে করি, সেটা হওয়া উচিত।’ তখন তাঁর বিরুদ্ধে বিরাট মিছিল হয়ে গেল। যে মিছিলে ৫০-৬০ হাজার ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ হয়েছিল। আমাদের ওপর সেদিন পুষ্পবৃষ্টি হয়েছিল। উপস্থিত সবাই বলল, ‘তোমরাই হলে আমাদের আশা-ভরসা।’ এরপর ২০ তারিখ ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। কুর্মিটোলা, তেজগাঁওসহ চারদিক থেকে ধরপাকড় শুরু হলো। তিন হাজারের মতো লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমরা ২টার সময় মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছাই। সেখান থেকে বেরুনোর সময় গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। এতে বহু লোক আহত এবং নিহত হয়। আমরা তাদেরকে নিয়ে আসি। এরপর বাগানের মধ্যে বসে বসে ভাবছিলাম, এত প্রাণ শেষ হয়ে গেল! ওদের মৃত্যুর কথা ভেবে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। মাথা নিচু করে কেঁদেছিলাম! ছাত্তার বলল, ‘মতিন ভাই, আপনি এখানে! এদিকে আপনাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।’ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন নাকি?’ আমি বললাম, এত মানুষ মারা গেছে, তা সহ্য করা যায়! ছাত্তার বলল, ‘না না, আমাদের এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের দাঁড়াতেই হবে।’ আমি বললাম, ঠিক আছে, আমাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। বলো, এখন কী করব? আমরা কি কর্মসূচি দেব? ছাত্তার বলল, ‘সাধারণ ছাত্ররা চাইছে এই হত্যার প্রতিবাদে কালকে প্রতিবাদ দিবস পালন করব।’ আমি বললাম, এই সিদ্ধান্ত যথাযথ। ছাত্তার বলল, ‘এখন কী করব?’ আমি বললাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের কাছে যেতে। সঙ্গে আমিও গেলাম।
কাজী গোলাম মাহবুব ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁর বক্তব্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও পরবর্তী কর্মসূচি মিছিলকে ভুল এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা হঠকারীদের সাথে রাজনীতি করব না। আমরা আগেই বলেছিলাম, ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত না।’ আমি বললাম, এত ছেলে মিছিল করল এবং মারা গেল, অথচ আপনারা বলছেন, হরতাল দেবেন না! এটা কি হঠকারিতা নয়? পরোক্ষভাবে এটা কি সারেন্ডার নয়? যদি বলি, আপনারা পরোক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন! আর আপনি বলছেন, আমরা হঠকারী! এসব তর্কবিতর্ক চলল। আমাদের সিদ্ধান্তে তাঁরা সই দিলেন না। এরপর তাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখতে অস্বীকৃতি জানালেন। অবশ্য এতে আমরা থেমে থাকিনি। তখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগ এবং নেতৃত্বের ফলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হই। আমার স্বাক্ষরে লিফলেট ছাপা হয়। ওই লিফলেট ছাত্রজনতার মাঝে বিলি হয়। মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গুলিতে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের গায়েবি জানাজা হলো। জানাজায় সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা শামিল হয়েছিলেন। অথচ তাঁদের সেদিন নোটিশ ছিল, ‘যাঁরা সেক্রেটারিয়েটে অনুপস্থিত থাকবেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। সুতরাং, আপনারা বুঝে-শুনে কাজ করবেন।’ তখন তাঁরা এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ছেলেপেলেরা আন্দোলন করে মরবে, আর আমরা অফিস করব! এটা হতে পারে না। আমরা যাব।’ ২১ ফেব্র“য়ারির আন্দোলন সফল হয়েছিল মূলত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত এবং ছাত্রদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীদের অংশগ্রহণে গায়েবি জানাজায় শরিক হওয়ার কারণে। জানাজাস্থল থেকে আমরা মিছিল নিয়ে বের হয়েছিলাম। সেই মিছিলেও গুলি করা হয়েছিল। এতে অনেকে হতাহত হয়েছিল। কিন্তু এর ফল হয়েছিল বিপরীত। এতে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। এভাবেই সরকার পরাজিত হয়েছিল। আমাদের জয়ের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল।
কিন্তু ভাষা আন্দোলন হলেই কি সব অর্জিত হয়ে যায়? না, আমাদের মোটেই তা হয়নি। আমরা সবাই ইংরেজির দিকেই ছুটছি। অনুকরণের তো চূড়ান্ত করে ছাড়ছি আমরা। বীর শহীদরা এ জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল! এসব দেখার জন্যই কি বেঁচে আছি!
এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা করা দরকার। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সব বিচারকাজ বাংলায় চালাতে হবে। এ ব্যাপারে তরুণদেরই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্য এসব কথা বলতে বলতে আমি ৮৫ বছরের বৃদ্ধ হয়ে গেছি। তবুও আমি হতাশ নই। সচেতনতার কথা বলে যাবই।
অনুলিখন : শরীফা বুলবুল

সমন্বয়হীন মহাজোট

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অব্যাহত বিদ্যুৎ সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ জনজীবনে সৃষ্ট অনেক সংকট জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। এ বক্তব্য খোদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শরিকদের।

আর জনমনের এই ক্ষোভ-হতাশা সৃষ্টির অন্যতম কারণ মহাজোটে ঐক্য না থাকা। সাম্প্রতিক পৌর ও উপনির্বাচনে মহাজোটের কার্যকর ঐক্যের অনুপস্থিতি জনমনে সৃষ্ট হতাশার প্রতিফলন বলেও মন্তব্য করেছেন শরিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তাঁরা এ-ও বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে এই নির্বাচনের ফলাফল সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যা উপেক্ষা করা হবে আত্মঘাতী।
এ ছাড়া শরিকদের পক্ষ থেকে মহাজোটের ভেতর কার্যকর ঐক্যের অনুপস্থিতি ও বিরাজমান সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ না থাকা এবং শরিকদের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা না করার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নামে মহাজোট সরকার হলেও শরিকদের মতামতের মূল্যায়ন না থাকায় সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার নিতেও রাজি নন তাঁরা। এমনকি শরিকদের পক্ষ থেকে এমন কথাও উঠেছে যে আসলে মহাজোট ছিল শুধু নির্বাচনী ঐক্য এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর সে ঐক্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্যে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। ১৪ দলের সমন্বয়ক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে ওয়ার্কার্স পার্টিপ্রধান রাশেদ খান মেনন এমপি অভিযোগ করেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অব্যাহত বিদ্যুৎ সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ জনজীবনে সৃষ্ট সংকট জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। এ সংকটগুলো মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনো ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উদ্যোগ দূরে থাক, ন্যূনতম আলোচনা পর্যন্ত নেই। এটাকে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে বলেও দলটির পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সতর্ক করা হয়েছে।
এই অবস্থায় আগামীকাল রবিবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৪-দলীয় জোটের বৈঠক। বৈঠকে চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক। আওয়ামী লীগের কাছে দেওয়া চিঠির সত্যতা স্বীকার করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা চিঠি দিয়েছি, আওয়ামী লীগের উচিত হবে বৈঠকে এটা উপস্থাপন করা। তারা সেটা না করলে আমাদের দলের পক্ষ থেকে এ চিঠি নিয়ে আলোচনা করা হবে।’
তবে গত নভেম্বরে এ ধরনের চিঠি গণতন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে দেওয়া হলেও তা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি।
সাজেদা চৌধুরীকে লিখিত চিঠিতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি অভিযোগ করেছেন, ১৪ দলের আগের বৈঠকগুলোয় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলের ঐক্যকে কার্যকর রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেওয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ’৭২-এর সংবিধানের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে ১৪ দলসহ সংগ্রামরত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় কনভেনশন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
পাশাপাশি চিঠিতে ওয়ার্কার্স পার্টি ১৪-দলীয় ঐক্যকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, পৌর নির্বাচনের মূল্যায়ন করাসহ ১৪ দলের ঐক্যকে বহাল ও সুদৃঢ় রাখা আরো জরুরি বলে চিঠিতে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ ও ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে হীন তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, তাকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সে কাজ না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও বিভক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ সংকটসহ জনজীবনে যেসব সংকট বিদ্যমান, তাকে পুঁজি করে জনগণের দৃষ্টি এসব ইস্যু থেকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে।
গত দুই বছরে বিশাল প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষি, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত নীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে দ্রব্যমূল্যসহ এসব সংকট অন্য অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে এবং এতে সরকার ও মহাজোট সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বিরোধী শক্তিকে সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয় চিঠিতে।
তবে জোটের ঐক্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময় মহাজোটকে বেগবান করতে চায় এবং এ জন্য উদ্যোগও নিচ্ছে।’ তবে মহাজোটকে কার্যকর করতে শরিকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। ১৪ দলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত হবে এবং এ জন্য সময়ের প্রয়োজন।’
মহাজোটের অন্যতম প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে তাদের মূল্যায়ন না করার জন্য। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘জাতীয় সমস্যগুলো মোকাবিলায় সবাইকে নিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কিন্তু সরকার শরিকদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে কোনো আলোচনা করছে না।’ যেহেতু সরকার নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাই সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার শরিক দলগুলো নিতে রাজি নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘মহাজোট এবং সরকারÑএই দুটোর কোনোটাতেই সমন্বয় নেই।’ তিনি বলেন, ‘মহাজোটে নির্বাচনী ঐক্য ছিল। নির্বাচনে জয়লাভের পরই ঐক্য ফুরিয়ে গেছে এবং এখন আর ঐক্যের দরকার নেই আওয়ামী লীগের।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, শেয়ারবাজারে ধস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মহাজোটের ঐক্যে ফাটলের ফল পড়েছে সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে।
১৪ দলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নিÑএই একই অভিযোগ জোটের অন্যতম শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপির। তিনি বলেন, ‘১৪ দলের রবিবারের বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হবে।’
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে খাদ্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।’ সরকারের ভেতরেই একটি চক্র সরকারকে ব্যর্থ করতে এসব করছে বলেও অভিযোগ করেন এই জোট-নেতা। তিনি বলেন, ‘১৪ দলের বৈঠক নিছক আই ওয়াশ। এর কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয় না।’
নুরুর রহমান সেলিম আরো বলেন, ‘সরকার যেভাবে চলছে, তা চলতে পারে না। এভাবে চললে সরকার ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
জোট প্রসঙ্গে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৪-দলীয় জোটের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবান হয় না, এমনকি কোনো বিষয় নিয়ে জোটভুক্ত শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয় না আওয়ামী লীগের।’ তিনি বলেন, ‘১৪ দলের বৈঠকগুলো গতানুগতিক এবং সব ব্যাপারে শরিকদের মধ্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন জোটের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট’Ñএ মন্তব্যও করেন এনামুল হক।
সরকার গঠনের পর দুই বছরে ১৪-দলীয় শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এ পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে পাঁচটি। গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বৈঠক। এরপর ৯ ফেব্র“য়ারি দ্বিতীয়, ২৮ নভেম্বর তৃতীয় এবং ২৪ ডিসেম্বর চতুর্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া ১ জুন গণভবনে মহাজোটের সব শরিকের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী ও জোটপ্রধান শেখ হাসিনা। এ অবস্থায় রবিবার বসতে যাচ্ছে ১৪ দলের ষষ্ঠ বৈঠক।

জামায়াতের সামনে তিন সংকট

গামী দিনে দলের রাজনীতির জন্য গুরুতর সংকট সৃষ্টি করতে পারে-এমন তিনটি ইস্যুর সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইস্যু তিনটির একটি দলের অভ্যন্তরীণ, বাকি দুটি রাজনৈতিক। অভ্যন্তরীণ সংকটের সমাধানের ব্যাপারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মোটামুটি আস্থাশীল হলেও বাকি দুই সম্ভাব্য সংকট নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠায় আছেন তাঁরা।

সূত্রের দাবি, এ বিষয়ে দলের অবস্থান ঠিক করতে গতকাল শুক্রবার ডাকা কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বিশেষ অধিবেশনে আলোচনা হওয়ার কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন সংকটের অন্যতম হচ্ছে নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিট মামলা। আদালতের কার্যতালিকা অনুযায়ী আগামীকাল রবিবার এ মামলার শুনানি হওয়ার কথা। মামলার ফলাফল প্রতিকূলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করে জামায়াতের নীতি-নির্ধারণীপর্যায়ের নেতারা খুব চিন্তায় পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, বাকি দুই সংকটের একটি হচ্ছে দলের নতুন ‘আমির’ নির্বাচন। অন্যটি হচ্ছে সারা দেশে অনুষ্ঠিত
পৌরসভা নির্বাচনের আগে ও পরে স্থানীয়পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের ছন্দপতনে জামায়াতের ভবিষ্যৎ রাজনীতি।
বিষয় তিনটির উল্লেখ করে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম দাবি করেন, কোনোটিই জামায়াতের রাজনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করবে না।
নিবন্ধন বাতিলের আশঙ্কা : জামায়াতে ইসলামীর নাম ও এর গঠনতন্ত্রের অন্তত ছয়টি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে ২০০৮ সালে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। মামলাটি বিচারাধীন রেখেই জামায়াত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। নিবন্ধন বাতিলের আরজি করে দায়ের করা ওই মামলাটি আবার সক্রিয় হয়েছে।
জামায়াতের শীর্ষপর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা এ মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। তবে তাঁরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেই মনে করছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায়ে বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃস্থাপন ও সে আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এমনিতেই বিলুপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো এখনো প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের নাম ও এর গঠনতন্ত্রের ধারার সংশোধিত সংবিধানের সঙ্গে বিরোধ থাকলে আদালত দলটির নিবন্ধন বাতিলের রায় দিতে পারেন।
এ টি এম আজহারুল ইসলামও মনে করেন, বাহাত্তরের সংবিধানকে বেইজ ধরলে কোর্ট নিবন্ধন বাতিলের রায় দিতেও পারেন। তবে তিনি জানান, নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করলে তাঁরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাবেন। তিনি বলেন, নিবন্ধন বাতিল মানে তো দল বাতিল নয়। বিষয়টি এই নয় যে এর মাধ্যমে দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে।
মামলার বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে এ মামলার কুশলী ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক ও ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল। কৃত্রিমভাবে কোনো আইন তৈরি করে জামায়াতকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা কল্যাণকর হবে না।’
সময় চাইবে জামায়াত : নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করা মামলাটির শুনানি পেছাতে জামায়াতের পক্ষ থেকে আবেদন করা হবে। সহসা যাতে মামলার নিষ্পত্তি না হয়, সে জন্য তাঁরা আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করার কৌশল নিতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে দলের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘এটা এমন ইস্যু নয় যে এখনই শেষ করতে হবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হাজার হাজার মামলা আছে। আমরা সময় চাইব।’
জানা গেছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আগামী মার্চের শেষ নাগাদ মামলার রায় হয়ে যেতে পারে।
নতুন আমির নির্বাচন : ২০১২ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাসের বেশি হওয়ায় দলের একটি অংশে নানা রকম চিন্তাভাবনা চলছে। এ অংশটি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমিরের অন্তর্বর্তীকালীন শেষে নতুন আমির নির্বাচনের পক্ষে।
মতিউর রহমান নিজামী প্রথমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার একটি মামলায় ও পরে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন সাত মাস আগে। গ্রেপ্তারের আগে তিনি নায়েবে আমির মকবুল আহমদকে ভারপ্রাপ্ত আমির নিয়োগ দিয়ে যান।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আগামী মে মাসে ভারপ্রাপ্ত আমিরের অন্তর্বর্তী সময় শেষ হবে। এ মেয়াদের পর বিশেষ কারণ না থাকলে নতুন আমির নির্বাচনের কথা উল্লেখ আছে।
নিজামীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০১২ সালে অবশ্যই নতুন আমির নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু দলের ওই অংশটি গঠনতন্ত্রের ‘বিশেষ অবস্থার’ সুযোগ না নেওয়ার পক্ষে। তারা অতীতে গোলাম আযমের মতো মাওলানা নিজামীকে আমির পদে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন আমিরের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী করার পক্ষপাতী নয়।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির প্রথম ছয় মাস পার করার পর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অনুমোদন নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে আরো ছয় মাসের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই মেয়াদের পরই নির্বাচন হওয়ার কথা। নতুন আমির নির্বাচনের পক্ষে থাকা অংশটি মনে করে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো একটি জটিল মামলায় আটক নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। দলের গতিশীল নেতৃত্বের জন্য এত সময় অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
কিন্তু জামায়াতের মূলধারা এই চিন্তার সঙ্গে একমত নয়। তারা মনে করে, বিচারের আগেই শীর্ষ নেতাদের সরিয়ে দেওয়া অমানবিক এবং আদালতের আগেই বিচারের শামিল বলে বিবেচিত হবে।
সূত্রে জানা গেছে, গতকাল অনুষ্ঠিত দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকের আলোচনায় ভারপ্রাপ্ত আমিরের বর্ধিত ছয় মাসের মেয়াদ অনুমোদন ও এই মেয়াদ শেষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের প্রসঙ্গটি ছিল। এ বিষয়ে শুরার সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
বৈঠকের আগে বিষয়টির উল্লেখ করে বক্তব্য জানতে চাইলে এ টি এম আজহার বলেন, ‘২০১২ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব নিয়ে কোনো চিন্তার কারণ নেই। এ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না।’
তিনি বলেন, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমিরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা হয় নির্বাচন, না হয় স্বাভাবিক মেয়াদ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের সময় বাড়াতে পারবে।
বিএনপির সঙ্গে ছন্দপতন : এবারের পৌরসভা নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কে বড় ছন্দপতন হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় তিক্ততারও সৃষ্টি হয়। পৌর নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি আগামীতে চারদলীয় জোটে জামায়াতকে কোণঠাসা করারও ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু জোটে বিভক্তি হতে পারে আশঙ্কা করে জামায়াতের নেতারা তা হজম করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন নেতা বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনে আবারও প্রমাণ হলো জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই এক। আমরা দেখেছি, যেসব পৌরসভায় জামায়াত প্রার্থীদের সম্ভাবনা ছিল, সেসব জায়গায় কোথাও আওয়ামী লীগ পক্ষ নিয়েছে বিএনপির, কোথাও বিএনপির পক্ষ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।’
জামায়াত এবার ৪৩টি পৌরসভায় মেয়র ও সাড়ে তিন শ’ কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়ে ছয়টি মেয়র ও ১১০টি কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে ৪৩টি পৌরসভাতেই বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের গোপনে-প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব ছিল।
বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ‘এবারের পৌর নির্বাচন আমাদের জন্য উৎসাহের এবং সতর্কেরও।’
নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জামায়াতের বেশির ভাগ প্রার্থী হেরেছেন বিএনপি প্রার্থীর কাছে। বিশেষ করে জামায়াত প্রভাবিত এলাকা হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, সাতকানিয়া ও কক্সবাজারে এই ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, পৌর নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপির বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জামায়াতকে এড়িয়ে চলছেন। তাঁদের ভূমিকায় পৌর নির্বাচনে সমঝোতার লক্ষ্যে তিন দফা বৈঠক করেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। জামায়াতের প্রার্থিতা থাকার পরও পৌর নির্বাচনের এ ফলাফলে বিএনপিতে আÍবিশ্বাস জেগেছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে চারদলীয় জোটে জামায়াতের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা চিন্তিত। জানা গেছে, গতকালের মজলিসে শুরার বৈঠকে এ বিষয়টিও আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল। তথ্য মতে, শুরার সদস্যরা কারো দিকে চেয়ে না থেকে দলের অবস্থান মজবুত করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
পৌর নির্বাচনকে জামায়াত কিভাবে মূল্যায়ন করছে জানতে চাইলে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি বলেন, ‘পুরো একটি বছর আমরা সরকারের কোপানলে ছিলাম। সে হিসেবে উৎসাহব্যঞ্জক।’
দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ বলেন, ‘তারা (সরকার) আমাদের মুছে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমরা ছয় মেয়র ও ১১০ কাউন্সিলর পেয়েছি।’ পৌর নির্বাচনে বিএনপির আÍবিশ্বাস জামায়াতকে জোটে কোণঠাসা করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না সেটা ঘটবে।’

বিএনপির দুর্বলতায় ফসকে যায় ইস্যু

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সামনে ইস্যু আসছে আর যাচ্ছে। কিন্তু আন্দোলন আর দানা বাঁধছে না। দলে কোন্দল এবং তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্বহীনতার কারণেই কোনো ইস্যু কাজে লাগাতে পারছে না দলটি। এ ছাড়া ছোটখাটো ইস্যুতে রাস্তায় নামলেও পুলিশের সামনে দাঁড়াতেই পারছে না দলের নেতা-কর্মীরা।

সর্বশেষ আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের ইস্যুও হাতছাড়া হয়ে গেছে সরকার এ কর্মসূচি থেকে সরে আসায়। আগামী সোমবারের হরতাল কর্মসূচি কতটুকু সফল করা যাবে, তা নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যেই রয়েছে সংশয়। এ জন্য দলের নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। ইস্যু থাক আর না থাক, সেটা বড় কথা নয়, দলের ভেতরে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা আছে, তা খুঁজে বের করে অচিরেই সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, সোমবারের দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সফল করাই এখন দলের নেতা-কর্মীদের মূল দায়িত্ব। হরতাল সফল করতে দলীয় নেতাদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বৈঠক হচ্ছে। হরতালের পর দলের দুর্বলতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার পর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এ সরকারের আমলে গত দুই বছরে বিএনপি ইতিমধ্যে তিনটি হরতাল কর্মসূচি পালন করেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি বাতিলের দাবিতে গত বছরের ২৭ জুন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করে দলটি। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার অভিযোগে গত ১৪ নভেম্বর দেশব্যাপী আরেকটি হরতাল দেয় তারা। এ হরতালে বাধা দেওয়া ও হামলার অভিযোগ এনে তৃতীয় হরতালটি ডাকা হয় ৩০ নভেম্বর। তবে তিনটি হরতালের কোনোটিই সর্বাত্মক সফল হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, আগের হরতালগুলোতে বিএনপির অনেক নেতা বাসায় বসেই খোঁজ-খবর নিয়েছেন। রাস্তায় পিকেটিং ছিল না। হরতালের দিন মাঠে না থাকায় দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতার ওপর ক্ষুব্ধ হন দলীয় চেয়ারপারসন। এ পরিস্থিতিতেই আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি রয়েছে দলটির। এ হরতালের দিনও দলের সব নেতা-কর্মী মাঠে থাকবে কি না, তা নিয়েও দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে হরতাল সফল করতে শরিক দল জামায়াতে ইসলামী ও আটটি সমমনা রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হরতালের প্রতি সমমনা দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন থাকলেও তাদের অনেকেরই মাঠে না থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এর আগে বিএনপির হরতালের প্রতি সমমনা দলগুলোর সমর্থন ছিল, কিন্তু কাউকে মাঠে পাওয়া য়ায়নি।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ঘটা করে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও মাঠে সংগঠনের অবস্থা এখনো নাজুক। দলীয় কোন্দল আর চরম বিশৃঙ্খলায় ২৩ জেলায় এখনো কাউন্সিল হয়নি। অধিকাংশ জেলায় কাউন্সিল ছাড়া কমিটি গঠন করা হলেও কোন্দলের কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা সম্ভব হয়নি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তৃণমূল নেতাদের চাপা ক্ষোভ ক্রমেই প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে বছরজুড়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েও দল গোছাতে পারেনি বিএনপি। এবারের পৌর নির্বাচন ও উপনির্বাচনে বিএনপির অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে গেলেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল। তবে পৌর নির্বাচনের বিজয়ের রেশ আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ধরে রাখতে হলে বিএনপিকে সাংগঠনিক অবস্থা আরো জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন তৃণমূল নেতারা।
২০০৯ সালে বছরজুড়ে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও অধিকাংশ জেলায় জোড়াতালি দিয়ে কাউন্সিল করা হয়েছে। নামমাত্র কাউন্সিল দেখিয়ে কমিটি করা হয়েছে। কাউন্সিল দেখানো হলেও অনেক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। কোথাও কোথাও পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ কেন্দ্রে পৌঁছলে বেশ কিছু জেলার কমিটি স্থগিত রাখা হয়। এক বছর পার হলেও ওই কমিটির ব্যাপারে বিএনপি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এসব কারণে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলেও দলের মাঠ সংগঠন শক্তিশালী হচ্ছে না।
জাতীয় কাউন্সিলের আগে দেশের ৭৫টি সাংগঠনিক ইউনিটের কাউন্সিল সম্পন্ন করতে পারেনি বিএনপি। বিশেষ করে দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের নিজের এলাকা মানিকগঞ্জে কাউন্সিল হচ্ছে না ১০ বছর ধরে। খোন্দকার দেলোয়ার ও হারুনুর রশিদ খান মুন্নুর মধ্যে বিরোধ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এবার জেলার কাউন্সিল করার জন্য আহ্বায়ক করা হয়েছিল অ্যাডভোকেট মোকসেদুর রহমানকে। উভয় পক্ষের নেতাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলেও খোন্দকার দেলোয়ার তা গ্রহণ করেননি। ফলে কাউন্সিলের বিষয়টি ঝুলে আছে বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়।
এদিকে ঢাকা জেলার কমিটি গঠন করা হলেও তা নিয়ে দল বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ঢাকা জেলার সভাপতি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বহিষ্কৃত হন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ঢাকা জেলার সভাপতি নির্বাচিত হন এম এ মান্নান। ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়েও চলছে দেনদরবার। এখানে একদিকে আছেন সাদেক হোসেন খোকা, অন্যদিকে মির্জা আব্বাস। জানা যায়, নগরীর এই দুই প্রভাবশালী নেতার বিরোধের কারণেই নগর কমিটি ঘোষণা করতে পারছেন না বিএনপির চেয়ারপারসন।
সারা দেশে ৭৫ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে যেসব জেলায় কাউন্সিল হয়নি তার মধ্যে আছে ঝালকাঠি, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, গাজীপুর, নোয়াখালী, বরগুনা, জামালপুর, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, রংপুর, চাঁদপুর, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা জেলা, ঢাকা মহানগর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, পিরোজপুর, বরিশাল (দক্ষিণ), বরিশাল মহানগর, খুলনা জেলা ও নড়াইল জেলা। তবে বিএনপির অবস্থা যে করুণ, তা মানতে চান না দলের অধিকাংশ নেতা। তাঁরা মনে করেন, ভবিষ্যতে বিএনপির অবস্থা ভালো হবে। সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে যাবে এই দল।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কাউন্সিলের পর বিএনপি এক বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে সাংগঠনিক অবস্থা আরো শক্তিশালী হবে। তিনি বলেন, গত দুই বছরে সরকার যেভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীর ওপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি-নির্যাতন করেছে। এর মধ্যেও বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এটা অনেক বড় ব্যাপার। বিশেষ করে পৌরসভা ও উপনির্বাচনের পর বিএনপির মধ্যে প্রত্যয় বাড়ছে। ভবিষ্যতে সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে বিএনপি-কে চাঙ্গা করা হবে বলে মন্তব্য করেন দলের সিনিয়র এ নেতা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দলের সাংগঠনিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। ‘ইস্যু ধরে রাখতে পারছি না, তা ঠিক নয়’ দাবি করে তিনি বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক দলের একটা কৌশল থাকে, বিএনপিরও একটি কৌশল আছে। আর আন্দোলন করলেই যে দলের অবস্থা ভালো হবে, তা ঠিক নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর দলের অনেক কিছু নির্ভর করে। তার প্রমাণ হলো বিএনপি আন্দোলন না করেও আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি ক্ষমতায় ছিল।
খন্দকার মোশাররফ আরো বলেন, ‘দলের কৌশলের ওপর নির্ভর করছে ইস্যু ধরে রাখব কি রাখব না। তবে ভবিষ্যতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা আরো জোরদার হবে এবং বিএনপি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাবে।’