Saturday, February 05, 2011

সমন্বয়হীন মহাজোট

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অব্যাহত বিদ্যুৎ সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ জনজীবনে সৃষ্ট অনেক সংকট জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। এ বক্তব্য খোদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শরিকদের।

আর জনমনের এই ক্ষোভ-হতাশা সৃষ্টির অন্যতম কারণ মহাজোটে ঐক্য না থাকা। সাম্প্রতিক পৌর ও উপনির্বাচনে মহাজোটের কার্যকর ঐক্যের অনুপস্থিতি জনমনে সৃষ্ট হতাশার প্রতিফলন বলেও মন্তব্য করেছেন শরিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তাঁরা এ-ও বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে এই নির্বাচনের ফলাফল সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যা উপেক্ষা করা হবে আত্মঘাতী।
এ ছাড়া শরিকদের পক্ষ থেকে মহাজোটের ভেতর কার্যকর ঐক্যের অনুপস্থিতি ও বিরাজমান সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ না থাকা এবং শরিকদের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা না করার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নামে মহাজোট সরকার হলেও শরিকদের মতামতের মূল্যায়ন না থাকায় সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার নিতেও রাজি নন তাঁরা। এমনকি শরিকদের পক্ষ থেকে এমন কথাও উঠেছে যে আসলে মহাজোট ছিল শুধু নির্বাচনী ঐক্য এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর সে ঐক্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্যে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। ১৪ দলের সমন্বয়ক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে ওয়ার্কার্স পার্টিপ্রধান রাশেদ খান মেনন এমপি অভিযোগ করেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অব্যাহত বিদ্যুৎ সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ জনজীবনে সৃষ্ট সংকট জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। এ সংকটগুলো মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনো ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উদ্যোগ দূরে থাক, ন্যূনতম আলোচনা পর্যন্ত নেই। এটাকে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে বলেও দলটির পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সতর্ক করা হয়েছে।
এই অবস্থায় আগামীকাল রবিবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৪-দলীয় জোটের বৈঠক। বৈঠকে চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক। আওয়ামী লীগের কাছে দেওয়া চিঠির সত্যতা স্বীকার করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা চিঠি দিয়েছি, আওয়ামী লীগের উচিত হবে বৈঠকে এটা উপস্থাপন করা। তারা সেটা না করলে আমাদের দলের পক্ষ থেকে এ চিঠি নিয়ে আলোচনা করা হবে।’
তবে গত নভেম্বরে এ ধরনের চিঠি গণতন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে দেওয়া হলেও তা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি।
সাজেদা চৌধুরীকে লিখিত চিঠিতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি অভিযোগ করেছেন, ১৪ দলের আগের বৈঠকগুলোয় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলের ঐক্যকে কার্যকর রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেওয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ’৭২-এর সংবিধানের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে ১৪ দলসহ সংগ্রামরত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় কনভেনশন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
পাশাপাশি চিঠিতে ওয়ার্কার্স পার্টি ১৪-দলীয় ঐক্যকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, পৌর নির্বাচনের মূল্যায়ন করাসহ ১৪ দলের ঐক্যকে বহাল ও সুদৃঢ় রাখা আরো জরুরি বলে চিঠিতে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ ও ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে হীন তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, তাকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সে কাজ না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও বিভক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ সংকটসহ জনজীবনে যেসব সংকট বিদ্যমান, তাকে পুঁজি করে জনগণের দৃষ্টি এসব ইস্যু থেকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে।
গত দুই বছরে বিশাল প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষি, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত নীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে দ্রব্যমূল্যসহ এসব সংকট অন্য অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে এবং এতে সরকার ও মহাজোট সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বিরোধী শক্তিকে সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয় চিঠিতে।
তবে জোটের ঐক্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময় মহাজোটকে বেগবান করতে চায় এবং এ জন্য উদ্যোগও নিচ্ছে।’ তবে মহাজোটকে কার্যকর করতে শরিকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। ১৪ দলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত হবে এবং এ জন্য সময়ের প্রয়োজন।’
মহাজোটের অন্যতম প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে তাদের মূল্যায়ন না করার জন্য। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘জাতীয় সমস্যগুলো মোকাবিলায় সবাইকে নিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কিন্তু সরকার শরিকদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে কোনো আলোচনা করছে না।’ যেহেতু সরকার নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাই সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার শরিক দলগুলো নিতে রাজি নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘মহাজোট এবং সরকারÑএই দুটোর কোনোটাতেই সমন্বয় নেই।’ তিনি বলেন, ‘মহাজোটে নির্বাচনী ঐক্য ছিল। নির্বাচনে জয়লাভের পরই ঐক্য ফুরিয়ে গেছে এবং এখন আর ঐক্যের দরকার নেই আওয়ামী লীগের।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, শেয়ারবাজারে ধস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মহাজোটের ঐক্যে ফাটলের ফল পড়েছে সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে।
১৪ দলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নিÑএই একই অভিযোগ জোটের অন্যতম শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপির। তিনি বলেন, ‘১৪ দলের রবিবারের বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হবে।’
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে খাদ্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।’ সরকারের ভেতরেই একটি চক্র সরকারকে ব্যর্থ করতে এসব করছে বলেও অভিযোগ করেন এই জোট-নেতা। তিনি বলেন, ‘১৪ দলের বৈঠক নিছক আই ওয়াশ। এর কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয় না।’
নুরুর রহমান সেলিম আরো বলেন, ‘সরকার যেভাবে চলছে, তা চলতে পারে না। এভাবে চললে সরকার ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
জোট প্রসঙ্গে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৪-দলীয় জোটের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবান হয় না, এমনকি কোনো বিষয় নিয়ে জোটভুক্ত শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয় না আওয়ামী লীগের।’ তিনি বলেন, ‘১৪ দলের বৈঠকগুলো গতানুগতিক এবং সব ব্যাপারে শরিকদের মধ্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন জোটের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট’Ñএ মন্তব্যও করেন এনামুল হক।
সরকার গঠনের পর দুই বছরে ১৪-দলীয় শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এ পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে পাঁচটি। গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বৈঠক। এরপর ৯ ফেব্র“য়ারি দ্বিতীয়, ২৮ নভেম্বর তৃতীয় এবং ২৪ ডিসেম্বর চতুর্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া ১ জুন গণভবনে মহাজোটের সব শরিকের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী ও জোটপ্রধান শেখ হাসিনা। এ অবস্থায় রবিবার বসতে যাচ্ছে ১৪ দলের ষষ্ঠ বৈঠক।

No comments:

Post a Comment