Saturday, February 05, 2011

সিদ্দিকবাজার থেকে নবাবপুর by মীজানুর রহমান

ফুলবাড়িয়া স্টেশনের পোর্টিকোয় পা দিলে প্রথমেই চোখে পড়ত রাস্তার ওপারে সারিবদ্ধ বাঁশের তৈরি আসবাবের দোকান। যে কারণে এলাকাটির নাম বাঁশপট্টি। উচ্ছিষ্ট কিছু বাঁশ ও বেতের আসবাবের দোকান কিছুকাল আগেও চোখে পড়ত। ইদানীং ওপাড়ায় যাওয়া হয়ে ওঠে না, তাই বলা যাবে না ওগুলো আছে কি নেই।
অথচ একসময় এটাই ছিল কুটিরশিল্পের আস্তানা। এখন তো শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে, গ্রিন রোড ও পান্থপথে বেতের কাজের রমরমা ব্যবসা। হূতগৌরব বাঁশপট্টির পেছনেই সিদ্দিকবাজার এলাকা। এই নামকরণের পেছনে আছে দেওয়ান পরিবারের পীর, মিঞা মহম্মদ সিদ্দিক। এখানেই তাঁর মাজার, আজও ভক্তকুলকে কম আকর্ষণ করে না। এখানেই থাকতেন ঢাকা শহরের গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর। তাঁর সম্বন্ধে আগেই বলা হয়ে গেছে।
সিদ্দিকবাজারের পাশেই আলুবাজার। মোগল আমল থেকেই আছে। এটার মালিক ছিলেন আল্লাইয়ার খান। তিনি আওরঙ্গজেবের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। বাস করতেন লালবাগ দুর্গে। সময়ের পথ বেয়ে আল্লাইয়ার বাজার নামটি জিভের ডগায় বিকৃত হতে হতে প্রথমে হয়েছে আল্লুর বাজার। তারপর আলুবাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ এ বাজারে আলু ছাড়া অন্য সওদাপাতিও লোকে করত বা করে থাকে।
এখন এই নবাবপুর রোড ধরে যদি এগোতে থাকি, তাহলে প্রথমেই ডান দিকে চোখে পড়ত রাস্তা থেকে উঁচুতে ওষুধের বিপণি—ডন ফার্মেসি, যার কথা এর আগে বলেছি। এই দোকানের কোল ঘেঁষে কিছু পত্রপত্রিকা নিয়ে বসে থাকতে দেখতাম কুচেল এক কলকাতিয়াকে, যাদের চেহারা আমায় চট করে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের পসারিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে জানা হয়ে গেল ওই পাড়ারই লোক সে। স্বাধীনতার একেবারে গোড়ায়, মেডিকেল কলেজের সামনে, মানসী সিনেমার অনতিদূরে, সদরঘাটের ব্যাপটিস্ট মিশনের দোরগোড়ায় আর চকবাজারের গোলচক্করে যে কটা বুকস্টল ছিল, সবটাতেই এই কলকাতিয়াদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। তো এই স্টলের পাশ কাটিয়ে যত এগোই পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি দোকানপাট। তখনো হিন্দু দোকানিরা আছে—পাট তুলে নেয়নি। ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়েছে কিছু অবাঙালি মুসলমান। বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের মোড়ে এলেই চমকে উঠতাম প্রতিবার—একটা সুন্দর ইউরোপীয় ছাদে তৈরি দোতলা বাড়ি—শহরে যেন বা হঠাৎ আলোর ঝলকানি! কেমন বেমানান মনে হতো, আজও মনে হয়। এটাই কি ছিল বুদ্ধদেব বাবুর যৌবনকালের বিলিতি মদের ঝকঝকে দোকান রায় কোম্পানি, যেখান থেকে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে তিনি তাঁর সুপ্রিয় চকলেট কিনতেন মাঝেমধ্যে? না, বুদ্ধদেব বাবুর প্রসাধনহীন অ্যালবার্ট লাইব্রেরি যেমন দেখা হয়নি, ওঁর অর্ধদগ্ধ চুরুট মুখে বসে ঢাকা শ্মশ্রুমান সমর্থ বৃদ্ধকেও না। তবে ওই যে যখন তিনি বলেন, ‘রায় কোম্পানির মুখোমুখি একটি মিষ্টান্ন ভান্ডার, যা খোলা থাকে নিশুতি রাত’—সেই ‘মতিলাল সুইটমিট’—এই সেদিনও আমার চোখে পড়ত—এত কাল ভেঙেও ‘পাছে ছদ্মবেশে পরিরা খেতে এসে ফিরে যায়’—তাই খোলা থাকত নিশুতি রাত পর্যন্তই।
তখনো স্টুডিও ওরিয়েন্ট হয়নি, কিন্তু আছে তো ৮১ নম্বর সদনে ১৯৩২ সনে স্থাপিত বনেদি দাস অ্যান্ড কোম্পানি (DOSS & Co.)—ফটো তোলা এবং ফটোর যাবতীয় সরঞ্জামের দোকান। সেকালে ফটো তোলার আরেকটি যে দোকান ছিল, সে তো ভিক্টোরিয়া পার্কে: ঢাকা মিউজিক্যাল মার্ট—A Silent Music—এই রোমান্টিক আত্মপরিচয় যার মদগর্বী ভূষণ। সে কথায় পরে আসছি। তো কথা আমাদের দাস কোম্পানি নিয়ে। এর সঙ্গে বোধকরি অগ্নিদেবের একটা যোগ আছে। চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আগুনে ঝলসে সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল দোকানটা। তার আগে লুটপাট তো হয়েছেই। আইয়ুবি আমলের কী সুমতি হলো, ক্ষতিপূরণ দিলে, বোধকরি, আন্তর্জাতিক চাপে মান বাঁচানোর তাগিদে। কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতে একাত্তরে আবার লুটের কবলে! মজা কী, এত যে ঝুটঝামেলা গেল, দাস কোম্পানি কিন্তু আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—মাথা নুইয়ে পালায়নি কোথাও।
আরেকটু এগোলেই একটা বইয়ের দোকান। নামহীন। হঠাৎ চোখে পড়ত না। নানা সাইনবোর্ডে আকীর্ণ সেকেলে ঝাঁজি-ধরা বাড়িটার কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, ধরার উপায় ছিল না। দুই-আড়াই হাত চওড়া সরু এক চিলতে গোলকধাঁধা—সুড়ঙ্গের মতো কোথায় যে শেষ, ধরার উপায় ছিল না। কলকাতিয়া কাঁচি উর্দুওয়ালার দোকান। কিছু হালকা বাংলা-ইংরেজি পত্রপত্রিকা ছাড়া সিংহ ভাগ জুড়েই ছিল উর্দু পত্রপত্রিকা ও গল্প-উপন্যাসে ঠাসা। পত্রিকার ভিড়ে শামা তো অবধারিত ছিল। দিল্লি ও করাচি থেকে বেরোত। বহু বছর ভারতবর্ষে আঞ্চলিক ভাষায় মুদ্রিত পত্রিকার মধ্যে কাটতির দিক থেকে ছিল প্রথম। এখনো বোধকরি জায়গাটা বেহাত হয়নি। এরপর গল্প-উপন্যাসের রাজ্যে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন আমাদের শরৎবাবুর মতো, তিনি সাদৎ হাসান মান্টো। কৃষণ চন্দর, ইসমত চুগতাই, খাজা আহমদ আব্বাস, গোলাম আব্বাস প্রমুখও কম জনপ্রিয় ছিলেন না। তবে যে বইয়ের বেশি কাটতি ছিল, যারা লঘু লেখা পছন্দ করেন, পৃথিবীর আর সব পাঠকের মতোই, সে তো জাসুসি দুনিয়া; অর্থাৎ গোয়েন্দাদের ভুবন। জাসুসি দুনিয়া নামেই একটা পত্রিকা ছিল, যার জনপ্রিয়তা ঈর্ষা করার মতো। এসব বই, পত্রপত্রিকা লাহোর, করাচি, দিল্লি থেকে আসা মাত্র বিক্রি হয়ে যেত, আমাদের বাংলা বইয়ের মতো বছর গুনতে হতো না। সবারই তো ক্রয়ক্ষমতা থাকত না বা সংগ্রহ করার বাতিকও ছিল না। তাদের বেলায় ছিল lending library-র সুব্যবস্থা। এখনো ‘মানসী’ সিনেমা হলের কাছে একটা বইয়ের দোকান আছে, যার মালিক বাঙালি, কিন্তু ব্যবসা অধিকাংশ উর্দু বই ও পত্রিকার, জামানত ও কিছু অর্থের বিনিময়ে বই-পত্রিকা ধার নিয়ে পড়া যায়। সন্ধে হলেই এই দোকানে ঘরমুখো উর্দু-পাঠকের ভিড় দেখে মনে শ্রদ্ধা জাগে। নিজের ভাষার প্রতি এদের কী সান্দ্র মায়া! কথায় কথায় জানতে পারি, এই ব্যবসা করে কুমিল্লার ভদ্রলোক জুরাইনে জায়গা কিনেছেন, বাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি সবকিছু সাঙ্গ করেছেন।
আর নূরু মিঞার দোকান সম্পর্কে না বললে অনেকটাই অবলা থেকে যাবে এ সম্পর্কে। গুলিস্তানের পেছনে ওই যেখানে ফুচকার দোকানগুলো ছিল, তার পাশেই ছিল নূরু মিঞার দোকান। কে বলবে এ বিহারি নয়, নোয়াখালীর লোক! যৌবনে পালিয়ে কলকাতায় গিয়েছিল ভাগ্যান্বেষণে ওই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে। প্রথমে সহকারী হিসেবে, পরে নিজেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফুটপাতে পত্রপত্রিকার দোকান খুলে বসে। কমিক স্ট্রিপ, হলদে ম্যাগাজিন ও প্যারিস কার্ডের রমরমা ব্যবসা গড়ে ওঠে ওর। জি আই ব্লু ও টমিদের ক্রেতা হিসেবে পেয়ে আহ্লাদ আর ধরে না! কিন্তু সুদিন ফুরিয়ে আসে যুদ্ধ শেষে, যখন একে একে সৈনিকেরা বাড়িমুখো হয়। এক জি আই যুবা বাড়ি যাওয়ার আগে ওর সঞ্চিত সব বইপত্র এবং এক ‘থলে’ টাকা দিয়ে যায় নূরু মিঞাকে। এক গাল হেসে কেলেকিষ্টি নূরু মিঞা ওর কলকাতাই বুলিতে বলে ওঠে, মেরা সর্ ঘুমা গায়া আওর সাদি কর লিয়া!
[একটি অধ্যায়]

No comments:

Post a Comment