ঢাকার দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কারণে প্রতি তিনজন কোমলমতি স্কুলশিক্ষার্থীর মধ্যে দুজনই অ্যাজমায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের কেউই উত্তরাধিকার বা পারিবারিক সূত্রে শ্বাসকষ্টের রোগী নয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত 'ঢাকার স্কুলশিশুদের মধ্যে বায়ুদূষণের প্রভাব' শীর্ষক গবেষণায় এ ভয়াবহ তথ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ১৮০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪২ দিন গবেষণা করে ১২০ জনকেই অ্যাজমায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ার আণবিক কণা মারাত্মক ক্ষতিকর। বাতাসে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা মানুষের অ্যাজমাসহ নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তিনি বুয়েটের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, দেশের বায়ুদূষণের শতকরা ৩০ ভাগের জন্য দায়ী ইটভাটাগুলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. তৈমুর এ কে মাহমুদ বলেন, বায়ুদূষণ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মারাত্দক ক্ষতিকর। এটা কোমলমতি শিশুদের জন্য বিষস্বরূপ। দূষিত বায়ুর পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ পেটের পীড়া থেকে শুরু করে কিডনি রোগসহ ফুসফুসের ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে। মহিলারা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু।
জাতিসংঘের গবেষণা পরিচালনায় যুক্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ুদূষন রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ভবিষ্যতে এর পরিণাম আরো ভয়াবহ হবে। বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিজ্ঞানী ও দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান বলেন, ঢাকা মহানগরীর গাড়ির কারণে প্রায় ৭০ শতাংশ আর ৩০ শতাংশ বায়ুদূষিত হয় নগরীর আশপাশের ইটখোলার কারণে।
ফসলি মাটি যাচ্ছে ইটভাটার পেটে : সরকারি হিসাবে দেশে ইটখোলার সংখ্যা চার হাজার ৫১০। এর মধ্যে অবৈধ (পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই) এক হাজার ১৯৯টি। এসব ইটখোলায় প্রতিবছর পোড়ানো হয় তিন হাজার ২৪০ কোটি ইট। প্রতি হাজার ইটের জন্য কাঠ পোড়াতে হয় আট থেকে ১০ মণ। তবে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ইটখোলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এসব ইটখোলার প্রতিটিতে উৎপাদন বছরে গড়ে ৭৫ লাখ ইট। এ হিসাবে ছয় হাজার ইটখোলায় উৎপাদন হয় বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি ইট। গড় মানের সাড়ে ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, সাড়ে চার ইঞ্চি প্রস্থ ও তিন ইঞ্চি পুরুত্বের একেকটি ইটে মাটি লাগে তিন কেজি থেকে সাড়ে তিন কেজি। গড়ে তিন কেজি ধরলেও সাড়ে চার হাজার কোটি ইটে মাটি লাগে বছরে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি কেজি বা সাড়ে ১৩ কোটি টন, যার পুরোটাই পুড়ে লাল হয়ে যায়।
ইট-শ্রমিকরা জানায়, ভূমির উপরি অংশের এক থেকে দেড় ফুট মাটি কেটে নিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। ইটখোলায় ব্যবহৃত মাটির অধিকাংশই এঁটেল-দোআঁশ ও বালি-দোআঁশ (ফসলি) মাটি। কৃষিবিদ ও মৃত্তিকা গবেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক নিয়মে জমির উপরিভাগে পলি জমে জমে এক ফুট পুরু হতে সময় নেয় তিন থেকে চার দশক। তাঁদের হিসাবে, ইটখোলা যে পরিমাণ ফসলি মাটি ধ্বংস করছে, তা বন্ধ হলে বছরে অন্তত ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ত। তাঁদের হিসাবে, ছয় হাজার ইটখোলার দখলে রয়েছে (প্রতিটি গড়ে সোয়া আট একর) প্রায় ৫০ হাজার একর আবাদি জমি। তাঁরা ইউএনডিপির আওতাধীন স্টকহোমের এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. প্যাট্রিক ও ড. লিসার গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, ইটখোলাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশ বছরে দশমিক চার বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায় ২৮০ কোটি টাকার ধান, গম, সয়াবিন ও আলু) সমমূল্যের কৃষি ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি বলছে, দেশের ছয় হাজার ইটখোলায় বছরে বিনিয়োগ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ খাতে কর্মসংস্থান প্রায় ২০ লাখ মানুষের। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বছরে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা, যা ক্রমে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ চাহিদা বাড়ায় এবং ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় বছরে যোগ হচ্ছে দেড় শ থেকে ২০০টি নতুন ইটখোলা। এদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরো জমি কমে যাওয়ার ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। তারা বলছে, ১৯৮৬ সালে দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। ২০০৩ সালে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর। ২০০৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭ লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে। এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৬৫ হাজার হেক্টর জমি কমে গেছে। সর্বশেষ শুমারির উদ্ধৃতি দিয়ে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৯৮৬ সালে দেশে এক কোটি ৩৮ লাখ ১৮ হাজার বসতবাড়ি ছিল। ২০০৩ সালে এ সংখ্যা হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ ৪২ হাজার, আর ২০০৭ সালে প্রায় এক কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার। প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭০৫টি বাড়ি নির্মাণ বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০ বছর পর দেশের চাষযোগ্য কৃষিজমি নেমে আসবে মাত্র ৫০ হাজার হেক্টরে। তাদের হিসাবে, ইট তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে প্রতিবছর ব্যবহার হচ্ছে লক্ষাধিক হেক্টর জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি। এ ছাড়া ১৯৭৩ সালে আট লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত ছিল। ২০০০ সালে তা ১৮ লাখ হেক্টর ছাড়িয়েছে।
ইটখোলার লাইসেন্স বন্ধের সুপারিশ: পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. জাফর আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, জনবহুল এ দেশের প্রেক্ষাপটে ইটখোলা খুবই ক্ষতিকর। ইটখোলার প্রভাবে শুধু কৃষিজমিই কমছে না, ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ছে পরিবেশের ভারসাম্য। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ইটখোলার লাইসেন্স প্রদান বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিনিয়তই চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি জানান, অবৈধ ইটখোলার মালিকদের ৩১ আগস্টের মধ্যে সরকারি ছাড়পত্র নিতে বলা হয়েছে; যদিও এরই মধ্যে ইটখোলায় নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো এবং ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে পদস্থ কর্মকর্তা, ইটখোলার মালিক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১২ সদস্যের 'ন্যাশনাল ব্রিক অ্যাডভাইজরি কমিটি' নামের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ইটখোলা স্থাপন, ইট পোড়ানোর পদ্ধতি আধুনিকায়নের পদক্ষেপ, ইটখোলাগুলোর গৃহীত কার্যক্রম এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ ইটখোলাগুলোকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই গণবিজ্ঞপ্তি জারি হবে। তাঁরা বলেছেন, ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৫ ধারায় ইট পোড়াতে কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ পরিহার এবং বায়ুদূষণকারী উচ্চ সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাখা হয়েছে আইন অমান্যকারীদের এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ ইটখোলার প্রধান জ্বালানি কাঠ ও সালফারযুক্ত নিম্নমানের কয়লা। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ইটখোলার মালিকদের অধিকাংশই প্রভাবশালী। তারা অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দুর্দান্ত দাপটে ক্রমাগত পরিবেশদূষণসহ কৃষিজমি ধ্বংস করে চলছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তারের তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা মো. তহিদুল ইসলাম জানান, ইটখোলার নির্গত ধোঁয়ায় নাইট্রোজেন ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে ওজোন নামের গ্যাস তৈরি করে, যা পাতাজাতীয় ফসলের সরাসরি ক্ষতি করে। পাতা ফুটো করে দাগ দাগ হওয়াসহ গাছকে রোগাক্রান্ত করে ফেলে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও প্রয়োজনীয় খাবার শোষণে ব্যর্থ হয়। ফলে ফসল আকারে ছোট হয়, উৎপাদন কমে যায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. জহুরুল করিম বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ফসলি জমির পরিমাণ খুবই সীমিত। মৃত্তিকা সম্পদ সহজে নষ্ট করা গেলেও তা পুনরুদ্ধার খুবই কঠিন। ইট তৈরিতে মাটির উপরি অংশ ব্যবহৃত হয়। আর ফসলেও পুষ্টি জোগায় ওপরের ছয় ইঞ্চি মাটি। তিনি বলেন, ইটখোলার ধোঁয়া, ধুলাবালির কারণে আবহাওয়া ঘোলাটে থাকে। ফসলি গাছ খাদ্য গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে উৎপাদন কমে। কৃষি ও পরিবেশের দিক বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশ মাটি পুড়িয়ে ইট উৎপাদন বন্ধ করেছে। অথচ অবৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে ইট উৎপাদন বাড়ছেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, 'আমাদের দেশের ইটখোলায় ব্যবহৃত কয়লার অধিকাংশই ভারতের মেঘালয় থেকে আমদানি করা, যা অত্যন্ত নিম্নমানের। এগুলো ব্যবহারে সালফার নির্গত হয় ৭ থেকে ১০ শতাংশ।' তিনি বলেন, জ্বালানি ব্যবহারের দিক থেকে বিবেচনা করলে দেশের প্রায় সব ইটখোলাই নিয়ম ভঙ্গ করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দ রেজোয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ আইনে ইটখোলা স্থাপনে বসতি ও বনভূমি থেকে যে দূরত্বের কথা বলা আছে, তা মানা হচ্ছে না। নিষিদ্ধ জ্বালানি ব্যবহারসহ নানা দিকে আইন অমান্য করলেও ইটখোলার মালিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির মহাসচিব মাইজউদ্দিন বলেন, 'অবৈধ ইটখোলাগুলোর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই নেওয়া হোক, আমরা এর পক্ষে আছি।' তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই এসব অবৈধ ইটখোলা চালানো হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, উন্নত বিশ্বের মতো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে ইটখোলার মালিকরা সম্প্রতি ট্রেড লাইসেন্স, টিন, আয়কর, ভূমি উন্নয়ন কর, বিএসটিআই, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ নানা ক্ষেত্রের অন্তহীন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তিনি জানান, দেশে এক লাখ আট হাজার থেকে এক লাখ ২৪ হাজার ঘনফুট আয়তনের এক সেকশন, দেড় ও দুই সেকশন ইটখোলার সংখ্যা বেশি। এসব ইটখোলায় বছরে প্রায় সাত মিলিয়ন টন কয়লা পুড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, ইট পোড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকে সবাইকে অবগত করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন প্রতিষ্ঠান যাতে অর্থ সহায়তা না পায়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর-বছিলা হয়ে পশ্চিম দিকে এগোলেই পোড়া মবিলের মতো দেখতে দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির ছোট খাল। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমরপানির খালটি পেরোলেই শলমাসি, ওয়াসপুর ও আটিগ্রাম। গ্রামগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। গ্রামের দুই পাশে অসংখ্য ইটখোলা। বাড়ির উঠানেও ইটখোলা। মাথা তুলে দাঁড়ানো অধিকাংশ চিমনির মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। উড়ন্ত ধোঁয়া, ধুলোবালি ও দুর্গন্ধে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া কষ্টকর।
আটিগ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব কৃষক সোলাইমান আলী, মোশারফ হোসেন ও সামছুল জানান, পাঁচ বছর আগেও এসব মাঠে এত বেশি ইটখোলা ছিল না। সে সময় এ মাঠে গম, পেঁয়াজ, আলুর চাষ হতো। এখন তেমন জমি নেই বললেই চলে। ইটখোলার ফাঁকে ফাঁকে খণ্ড খণ্ড প্লটে দুই বছর ধরে কিছু ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। কারণ, ইটখোলার কালো ধোঁয়া আর ইট বহনকারী ট্রাকের ধুলায় ফসলের মাথা ঢেকে যায়। ফলে ফসলের গাছ অঙ্কুরেই মারা যায়। তাঁরা জানান, এসব মাঠে এখন চাষের জমি নেই বললেই চলে। ইট তৈরির প্রয়োজনে জমির ওপরের অংশের মাটি ইটখোলার মালিকরা কিনে নিচ্ছেন। পাশের শলমাসি গ্রামের একসময়ের কৃষক (এখন দিনমজুর) লুৎফর রহমান বলেন, 'ফসল হয় না, তাই জমি চাষ করি না। ১০ কাঠা জমির মাটি দেড় ফুট গভীর করে নগদ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি।' একই ধরনের তথ্য জানান তিন গ্রামের অসংখ্য মানুষ।
আটিগ্রামের দিনমজুর আইয়ুব আলী জানান, তাঁর আট বছরের ছেলে আমিন বছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তিন বছর ধরে আমিনের শরীরে খোসপাচড়া লেগেই আছে। এখন প্রায় সারাক্ষণই হাত-পা ও শরীর চুলকায়। তার তিন বছরের মেয়ে আমেনাও হয়েছে প্রতিবন্ধী (এক পা অসম্পন্ন)। সাইফুল, কায়েম, মধু, সালেকসহ অনেকেই জানান, এ গ্রামের অধিকাংশ শিশু রোগাক্রান্ত। লালুর ছয় বছরের ছেলে ফাহিম, মজিদের ১০ বছরের মেয়ে সকিনা, মোহাম্মদ আলীর সাত বছরের মেয়ে করুণার মতো অনেকেই শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছে।
এলাকাবাসী জানায়, বছরের অন্যান্য সময় কিছুটা কম হলেও অক্টোবর-নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিলের প্রায় ছয় মাস এ এলাকায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়। এ সময় আর্থিক অবস্থা ভালো এমন অনেকেই এলাকা ছেড়ে যান। রাজধানী ঘিরে দেড় হাজার ইটখোলা: জনবসতির তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটখোলা নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকলেও রাজধানী ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় হাজার ইটখোলা। এসব ইটখোলায় পোড়ানো নিম্নমানের কয়লা, টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবারের টুকরার নির্গত কালো ধোঁয়া প্রতিনিয়তই দূষিত করছে ঢাকার বাতাস। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার দেড় কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ পড়ছে হুমকির মুখে। অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, ইটখোলা ও গাড়ির ধোঁয়ার কারণে ঢাকার বাতাসে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। এসব বস্তুকণার পরিমাণ শীতকালের ১২০ দিন আরো বেশি থাকে। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বিবেচনা করে প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির ইট তৈরি পর্যায়ক্রমে বদ্ধ করে পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জনবসতির তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটখোলা নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। এ ছাড়া নির্ধারিত ১২০ ফুট চিমনিও অনেকে ব্যবহার করছে না। তিনি বলেন, ইটখোলা শুধু বায়ুদূষণই করছে না, সেই সঙ্গে ফসলি জমিকে নিষ্ফলা করছে। ইটখোলার কর্মচারীদের থেকে জানা গেছে, খোলায় কয়লা ও কাঠ পোড়ানো হয়। আগুনের তাপমাত্রা বাড়াতে ও দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী করতে ভারতীয় (নিম্নমান) কয়লার পাশাপাশি শত শত মণ নিষিদ্ধ টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবারের টুকরা পোড়ানো হয়। ঝাঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত এসব পোড়ানোয় পুরো এলাকা ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে যায়।
ইটখোলার কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেন, ইটখোলায় আগুন ধরানোর সময় কিছু কাঠ ব্যবহার করা হয়। কয়লার মজুদ ফুরিয়ে গেলেও কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব এলাকার জমি ও ফ্ল্যাট দামে-দরে পছন্দ হলেও ইটখোলার ধোঁয়ার কারণে অনেকেই কিনতে আগ্রহী হয় না।
রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইবিসিআর) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুসতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার বাতাসে মিশে থাকা কার্বন পার্টিকেল, সালফার, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মানবদেহের ভয়াবহ ক্ষতি করে। দূষিত বায়ুতে নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, লিভার ও কিডনি অকেজোসহ মূত্রথলি ও খাদ্যনালি ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া নতুন নতুন রোগেরও উপসর্গ দেখা দেয়। এতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটে, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিজ্ঞানী ড. এম খলীকুজ্জমান বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ১২ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা পরিবেশগত কারণে ঘটে উল্লেখ করে বলেন, পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো গেলে জাতীয় আয়ের সাড়ে ৩ শতাংশ অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করা সম্ভব। গবেষণার উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজধানীতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বছরে এক হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৩০০ মৃত্যু এড়ানো এবং আট কোটি মানুষের গুরুতর অসুস্থতা রোধ করা সম্ভব। এতে জাতীয় আয়ের দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ সাশ্রয় হতে পারে। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে বছরে সাত হাজার ৬০০ থেকে ৩০ হাজার ৪০০ মৃত্যু এড়ানো এবং তিন লাখ থেকে ১২ লাখ পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এতে ১১৪ থেকে ৪৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় সম্ভব, যা জাতীয় আয়ের দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে দশমিক ৯২ শতাংশ।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলেন, বায়ুদূষণের কারণে নবজাতক, শিশু, বয়স্ক এবং হুদরোগে আক্রান্তরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এতে শিশুরা হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসসহ অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।
ইটের বিকল্প 'কংক্রিট ব্লক' চালু করার উদ্যোগ নেই
সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা পরিবেশদূষণের পাশাপাশি কৃষিজমি ক্রমাগত গ্রাস করে চললেও ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ও দামে সস্তা 'কংক্রিট ব্লক' চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে বিকল্প ইট তৈরির জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগকারী শিল্পোদ্যোক্তারা হতাশায় পড়েছেন।
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ১৯৯৯ সাল থেকে কংক্রিটের ব্লক নির্মাণকাজে ব্যবহার শুরু হয়েছে। বসুন্ধরা, কনকর্ড, আলফা, রূপসী, স্কাইভিউ, মীরসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠান হলো ও সলিড কংক্রিটের সিলিং, পেডিং ব্লক, কার্ব স্টোনসহ পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি ও বিপণন করছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচারণা না থাকায় এর কার্যক্রম প্রসারিত হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ইটখোলার নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের পাশাপাশি পরিবেশের মারাত্দক বিপর্যয় ডেকে আনছে। তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনেই কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি এবং এটা সময়ের দাবি।
কনকর্ড গ্রুপের রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রোডাক্ট লিমিটেড, মীর রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. ও স্কাইভিউ ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, পোড়ামাটির ইট বাংলাদেশের জন্য যুগোপযোগী নির্মাণসামগ্রী নয়। এর তৈরি প্রক্রিয়া একদিকে যেমন পরিবেশবিধ্বংসী, অন্যদিকে দামেও বেশি। অথচ কংক্রিটের সলিড ও হলো ব্লক আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী। এর ব্যয়ও ইটের তুলনায় অর্ধেকেরও কম এবং স্থাপনা দীর্ঘস্থায়ী। কংক্রিট ইট পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভূমিকম্প প্রতিরোধক। তাঁরা বলছেন, শুধু প্রচারণার অভাবে কংক্রিট ব্লকের বিকাশ ঘটছে না। অথচ এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ শতকোটি টাকার বেশি। সরকার ইচ্ছা করলেই বিশেষ নির্দেশনায় সরকারি স্থাপনাগুলোতে কংক্রিট ব্লক ব্যবহার করতে পারে।
জানা যায়, কংক্রিট ব্লকের স্থাপনা হালকা হওয়ায় লোহার রড ও প্লাস্টার-গাঁথুনিতে সিমেন্ট-বালু কম লাগে। ইলেকট্রিক লাইন স্থাপন সহজ হয়। তাপ ও শব্দ প্রতিরোধক হওয়ায় ঘর তুলনামূলক শীতে গরম ও গরমে ঠাণ্ডা থাকে। অল্প সময়ে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। কংক্রিটের ব্লক বিভিন্ন আকৃতির করা যায়। বেশি পরিচিত হিসেবে কাজে লাগে ১৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ৮ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ৪ ও ৬ ইঞ্চি পুরুত্বের হলো ব্লক, যা একটি ইটের প্রায় তিন গুণ। কংক্রিট ব্লকের অন্যতম কাঁচামাল নুড়িপাথর, বালু ও সিমেন্ট। অন্যদিকে ইটের কাঁচামাল কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর ফসলি মাটি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে প্রতিষ্ঠিত অর্ধশত কারখানায় কংক্রিট ব্লক উৎপাদনের ক্ষমতা বছরে প্রায় এক হাজার কোটি ইটের সমান। কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়লে পোড়ামাটির ইটের চাহিদা কমে আসবে। পরিবেশ-গাছপালা ধ্বংস হবে না। আবাদি জমি কমবে না। পঙ্গু-রোগা শিশু জন্ম নেবে না।
জানা যায়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কংক্রিট ব্লক ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একচেটিয়া। বাংলাদেশের বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে কংক্রিট ব্লক ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা পেভিং ব্লক দিয়ে করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ইয়ার্ড, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রাস্তা, রাজশাহী শিশুপার্ক উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সিলিং ও হলো ব্লকে নির্মিত হয়েছে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেল, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ইউএসটিসি ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বসুন্ধরা টেকনোলজিস লিমিটেডে তৈরি হচ্ছে পেভিং ও হলো ব্লক, কনকর্ড রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. সিলিং ব্লক, আলফা রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. পেভিং ব্লক, রূপসী রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. কার্ব স্টোন, মীর রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. সলিড ব্লক, স্কাইভিউ ফাউন্ডেশন। এদিকে ইটখোলার মালিকদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইটখোলা পরিবেশ দূষণ করছে, এটা ঠিক; কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়লে এ দূষণ কিছুটা কমবে।
সানমুন কম্পানির ম্যানেজার (মার্কেটিং) জাহিদুল ইসলাম বলেন, 'বিশ্বব্যাপী পরিচিত কংক্রিটের ব্লক আমাদের দেশে বেশি পরিচিত হতে পারেনি। সরকার উদ্যোগ নিলে এ শিল্পের বিকাশ সহজেই ঘটাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ৪৩৫ কোটি টাকা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে ইটখোলা ও পরিবহন খাতকে চিহ্নিত করে ঢাকা ও এর আশপাশের শহরগুলোর বায়ুদূষণ কমিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত বছরের ১২ এপ্রিল ৬২ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি করে বানানো ইট ভারতে রপ্তানি করার কারণে বিশ্বব্যাংকের অনুদানের প্রায় ৪৩৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাতছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশের পরিবেশ নষ্ট করে ইট রপ্তানির বিষয়ে জানতে চেয়েছে বিশ্বব্যাংক।
ইট রপ্তানির কারণে পরিবেশ দূষণ রোধে বিশ্বব্যাংকের এ কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখার জন্য পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে অনুরোধ জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম। গত ২৪ আগস্ট পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, ইট উৎপাদন করে কৃষিজমি নষ্ট করবে না বলে ভারত আমদানির পক্ষে কাজ করছে। আর বাংলাদেশ কৃষিজমি ও পরিবেশ নষ্ট করে ইট রপ্তানি করছে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়কেও মুখ্য করে তুলে ধরায় বিভান্তিকর নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ কে এম মাঈদুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ দেশে ভালো কাজ করা যাবে না। ভালো কাজের জন্য পদেক্ষপ নিলে সেটাও অনেকের কাছেই অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ইটখোলার মালিকদের মতো যাদের টাকা বেশি তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেকেই কালার করা হয়।'
জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর ইটখোলার মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধে ১২৩ কোটি টাকার 'টেকনোলজি চেঞ্জ' করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতে ইট রপ্তানি : বাংলাদেশের ফসলি জমির উর্বর মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা ইট ভারতে রপ্তানি শুরু হয়েছে। গত বছরের ২০ আগস্ট ভারতের ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতো আখাউড়া বন্দর দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইট রপ্তানির কনসাইনমেন্ট উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরী। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ইট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার মে. টন। প্রতিটনের গড় মূল্য সাড়ে ৪১ হাজার টাকা হিসেবে মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
ইট রপ্তানির আগে গত ১৯ আগস্ট মতিঝিলের ফেডারেশন চেম্বারে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা তুলে ধরে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ও নিটল গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবদুল মাতলুব আহমাদ জানান, ত্রিপুরার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ইট উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ায় সেখানে বাংলাদেশি ইটের ব্যাপক চাহিদা। ত্রিপুরা সীমান্ত-সংলগ্ন বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সিলেটে প্রচুর ইটখোলা রয়েছে। ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা এসব এলাকা থেকে ইট নিতে আগ্রহী। তাঁরা প্রতিটি ইটের দাম সাত টাকা করে দিতে এবং বছরে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৪০ কোটি পিস ইট নিতে চায়। তাঁর মতে, ইট রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বছরে ৩০০ কোটি ডলার কমাতে সহায়তা করবে। এর আগে থেকে ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশের উৎপাদিত সিমেন্ট, প্লাস্টিক পাইপ, সিরামিক ফার্নিচারসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তিনি অবশ্য বলেন, বাংলাদেশি যেসব ইটখোলার মালিক পরিবেশসম্মতভাবে ইট তৈরি করবেন, কেবল তাঁরাই রপ্তানির সুযোগ পাবেন। বায়ুদূষণ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মাতলুব আহমাদ বলেন, যেকোনো শিল্প স্থাপন করলে দূষণ হবে। কিন্তু দেখতে হবে দূষণের মাত্রা কত? বেশি হলে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিন মন্ত্রীর ভাষ্য: কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'ইট রপ্তানি হোক--এটা আমিও চাই। তবে কৃষি ও পরিবেশ নষ্ট করে নয়।' তিনি জানান, ইট রপ্তানির আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে তাতে তিনি বলেছিলেন, 'ইছামতীর ওপারে ভারত ৫২টি ইটখোলার জন্য নদী থেকে মাটি তুলে ইট বানাচ্ছে। বাংলাদেশের ইটখোলার মালিকরা যদি তাঁদের মতো (সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে) নদী থেকে ড্রেজারের সাহায্যে এঁটেল মাটি তুলে ইট বানাতে পারে, তাহলে রপ্তানিতে আপত্তি নেই। কারণ এতে নদীর খননও হয়, আবার বৈদেশিক আয়ও বাড়ে। তিনি আরো জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় এখন উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টায় মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইটখোলার মালিকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলা করার সময় নেই। মন্ত্রী বলেন, 'মাটির টপ সয়েল কাটলে আমি আহত হই।'
ইট রপ্তানির ফলে একদিকে পরিবেশ দূষণ, অন্যদিকে কৃষি জমি ধ্বংস_পরিবেশবাদীদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, সরকারের আয় বাড়ানোর চিন্তা থেকেই ইট রপ্তানি শুরু করা হয়েছে। দেশের ইটখোলাগুলো পরিবেশ আইনের আলোকেই পরিচালিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ যাতে না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণকারী ইটখোলার মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদ বলেন, ইটখোলার কালো ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করে। তবে পরিবেশ নীতিমালার আওতায় ইটখোলা পরিচালিত হলে এ ক্ষতি কমে আসতে বাধ্য। কালো ধোঁয়া রোধে জিগজ্যাগ ও হোপক্লিনস ব্যবহারের কঠোর নির্দেশনা সম্প্রতি মাঠপর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। শিল্পায়নের প্রয়োজনে ইটখোলা লোকালয় থেকে দূর করতে বলা হয়েছে। তিনি মনে করেন, দেশে যে পরিমাণ ইটখোলা রয়েছে তার প্রয়োজন নেই। বরং ইটখোলার সংখ্যা কমিয়ে সেগুলোতে পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে উৎপাদন আরো বাড়ানো যেতে পারে। তিনি বলেন, কৃষি ও পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো উচিত।