Sunday, July 03, 2011

৯০ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস, সেটা গৌরবের ইতিহাস। এই বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করেছে, সেটা অসাধারণ। ১৯২১ সালের পরে আমাদের দেশে আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কাজ করেছে। এর কারণ কেবল এটা নয় যে এর আয়তন বড় অথবা এখানে শিক্ষার্থীসংখ্যা অধিক, শিক্ষকও প্রচুর। মূল কারণ হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে যে ভূমিকা পালন করেছে, সেই ভূমিকা আমাদের দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে পালন করার সুযোগ ঘটেনি। এমনও দেখা যাবে, পৃথিবীর খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে, যাকে এত বড় দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এক হিসেবে অনন্য সাধারণ। আমরা যদি শিক্ষার দিকটা দেখি, যেটাকে আমি বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান বলছি, তাহলে দেখতে পাবো যে এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর পেছনের কারণটা ছিল রাজনৈতিক। এবং একটা রাজনৈতিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ যখন রদ হয়ে যায় ১৯১১ সালে, তখন পূর্ববঙ্গকে একটা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে প্রতিশ্রুতি পালন হলো ১৯২১ সালে এসে। এই যে এত দিন বিলম্ব হলো, এর পেছনে একটা কারণও ছিল। এর বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদী শক্তিও গড়ে উঠেছিল। ধরা যাক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এটা একক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কাজেই তারা চাইত না আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। এমনকি ঢাকা শহরেও একটা বিরুদ্ধ শক্তি ছিল; এখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক যারা এটা চায়নি। কেননা এই বিশ্ববিদ্যালয় হলে মুসলিম সম্প্রদায় একটা সুযোগ পাবে_এ সুযোগ পাওয়াটা তারা পছন্দ করেনি।
দেখা গেল এই বিশ্ববিদ্যালয় বেশ সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদানের কথা বলছিলাম, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখা যাবে যে এখান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে গেছেন; তাঁরা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছেন। তাঁদের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা একাত্মতা বোধ আছে। এই যে অবদান_আমরা কেবল সেটাকে শিক্ষাগত অবদান বলব না; এটাকে সামাজিক অবদান বলব। মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশে এ বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করেছে, সেটা অসাধারণ। এটা যেমন মধ্যবিত্ত বিকাশের সঙ্গে জড়িত আবার সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গেও। এখান থেকে জ্ঞানের যে চর্চা হলো; তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতাও লক্ষ করা গেল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল এখানকার ছেলেমেয়েরা। ঢাকা শহরে যেমন অংশগ্রহণ ছিল, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল। পরে এখানে সাম্প্রদায়িক বিরোধটা দেখা গেল। মধ্যবিত্তের বিরোধ; এটা সাধারণ মানুষের বিরোধ নয়।
যখন পাকিস্তান আন্দোলনটা হচ্ছে, তখন মুসলিম মধ্যবিত্ত পাকিস্তান আমলটাকে সমর্থন করল। এটা গেল সাতচলি্লশের আগের ঘটনা। পরে দেশভাগ হলো। এটা ছিল মূলত ক্ষমতা হস্তান্তর করা। পরে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা ঘটল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পরে স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো। চুয়ান্ন সালে নির্বাচন। ছেষট্টির আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভুত্থ্যান এবং চূড়ান্ত পরিণতি হলো মুক্তিযুদ্ধে। ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা নিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পতাকা উত্তোলন করা হলো। আবার কালরাতে হানাদার বাহিনীরা নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাল। প্রাণ দিল ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। পরবর্তী সময়ে আলবদররা দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য আমাদের শিক্ষকদের হত্যা করল। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্য দিতে হয়েছে।
পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে '৭৩-এর অধ্যাদেশ হলো। এটা একেবারেই গণতান্ত্রিক ছিল। এটা ছিল দীর্ঘদিনের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠত না যদি বাংলাদেশ না হতো। গণতান্ত্রিক চর্চায় দৃষ্টান্ত রচিত হলো, কিন্তু সেটা আর ধরে রাখা যায়নি। এ দেশে বিভিন্ন সামরিক সরকার, স্বৈর সরকার, নির্বাচিত স্বৈর সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ শুরু করে দিল। ফলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বেড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা। কিন্তু এতেও রাষ্ট্র আর আগ্রহ প্রকাশ করেনি। আমাদের গ্রন্থাগারে দেখা যায়, সব বইয়ের ৭৫ শতাংশই ইংরেজিতে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জীবন স্তিমিত হয়ে এসেছে। হল সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে স্তব্ধ হয়ে গেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। আগে দেখেছি ক্যাম্পাস অনেক জীবন্ত ছিল। এখন নেই। মেধা অনেকটা বাইরেও চলে গেছে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য গেলেও আর ফিরে এল না।
তৃতীয় আর একটি ঘটনা ঘটল যে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ভূমিকা রাখবে। তরুণরা আদর্শবান হবে। কিন্তু সোভিয়েত পতনের পরে পুঁজিবাদী আক্রমণ বেড়ে যেতে থাকল। মুনাফা লাভের সুযোগ বেড়ে গেল। ফলে সেই স্বপ্নটা ধরে রাখা গেল না। বাস্তবায়ন তো দূরের কথা।
তবে আশার কথা, ছাত্ররা সচেতন হয়ে উঠছে। আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার চেতনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা দেশেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য যূথবদ্ধ চেষ্টা করবে_এটাই প্রত্যাশা।
শ্রুতিলিখন- নুরে আলম দুর্জয়

মণিপুরি তাঁত শিল্প কি হারিয়েই যাবে?

সিলেট বলতেই যে দুই-তিনটি বিষয় সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার অন্যতম মণিপুরি তাঁত শিল্প। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে এর চাহিদা ও খ্যাতি ছড়িয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি তাঁত শিল্প সময়ের ব্যবধানে আজ বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনীয় মূলধন, প্রশিক্ষণ আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। অথচ প্রতিকূলতা কাটাতে পারলে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি তাঁত শিল্প হতে পারত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় মূলত অধিকাংশ মণিপুরি বসবাস করে। সিলেট নগরীর মাছিমপুর, লালদীঘিরপাড়, লামাবাজার, জল্লারপাড়, রাজবাড়ি, মির্জাজাঙ্গাল, বাগবাড়ি, সাগরদীঘিরপাড়, সুবিদবাজার, মিরের ময়দান, আম্বরখানা, কুশিঘাট, গোয়াইপাড়া, খাদিমনগর, গঙ্গানগর এলাকায় মণিপুরি সম্প্রদায়ের বসবাস। মণিপুরি পরিবারের মহিলারা তাঁতে কাপড় বোনার ব্যাপারে স্বশিক্ষিত এবং তারাই মূলত এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি বৈচিত্র্যময় নকশাখচিত মনিপুরি বস্ত্র দেশের পাশাপাশি বিদেশেও সমাদৃত। পর্যটকরা সিলেটে এলে তাই খোঁজ করে মণিপুরি তাঁতবস্ত্রের। ২০০৪ সালে জার্মানি ও ইতালিতে এবং ২০০৭ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় মনিপুরি তাঁতবস্ত্র ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। এর আগে ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকার বস্ত্র মেলায় মণিপুরি তাঁতের স্টল দেওয়া হয়েছিল। ওই মেলায় মণিপুরি তাঁতবস্ত্র সম্মানসূচক পুরস্কার অর্জন করে। প্রতিবছর ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচুর মনিপুরি বস্ত্র বিদেশে গেলেও যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় এখনো সরাসরি বিদেশে বাজারজাত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এ পণ্যের।
সাধারণত মণিপুরী মহিলারা নিজেদের পরিবারের ব্যবহারের পোশাক কোমর তাঁতে নিজেরাই তৈরি করে। পাশাপাশি ঘরে উৎপাদিত বাড়তি কাপড়গুলো তারা বিক্রি করে। এই কাপড় নিয়ে নগরীর কিছু এলাকায় কেবল মণিপুরি বস্ত্রের দোকান গড়ে উঠেছে। লামাবাজার, জিন্দাবাজার, শাহজালাল (রহ.) দরগাগেট, সুবিদবাজার, খাদিমনগর এলাকায় বেশ কিছু মণিপুরি কাপড়ের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে মণিপুরিদের তৈরি শাড়ি, চাদর, বিছানার চাদর, গামছা, মাফলার, ওড়না, থ্রিপিস, ব্যাগ, টেবিল ক্লথ পাওয়া যায়। এসব পণ্যের রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। এ কারণেই তা অনেকের পছন্দের জিনিস। মণিপুরি নারী সত্যবামা দেবী জানান, আগে কেবল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মেলায় মণিপুরি তঁাঁতবস্ত্রের স্টল দেখা যেত। এখন নগরীর অনেক এলাকায় মণিপুরি বস্ত্রের স্থায়ী দোকান গড়ে উঠেছে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মণিপুরি বস্ত্রের ফ্যাশনেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। তবে মনিপুরি তাঁত শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে তার ছাপ পড়েনি। বরং নানা সংকটের কারণে নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, সরে যাচ্ছে এ পেশা থেকে। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানায়, তাদের বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত তাঁত শিল্প আজ গভীর সংকটের মুখে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে এই শিল্পকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর এই শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও দুষপ্রাপ্যতা, সেই সঙ্গে ভারতীয় পণ্যের আগ্রাসনে মণিপুরি তাঁত শিল্প পার করছে চরম সংকটকাল। তাতে মণিপুরিরা ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের ব্যাপারে।
কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে জানিয়ে নগরীর লামাবাজারের সিলেট মণিপুরি শাড়ি ঘরের বিক্রয়কর্মী মঙ্গলা দেবী বলেন, 'সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি বস্ত্রের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধি করতে হয়েছে। এতে করে বেচাকেনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এভাবে চললে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।' সংশ্লিষ্টরা জানায়, তাঁতের একটি শাড়ি বুনতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। চাদর তৈরি করতে লাগে দুই থেকে চার দিন। কিন্তু তৈরিকৃত পণ্য বিক্রি করে সে তুলনায় পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না। তাঁরা অভিযোগ করে বলেন, বাজারে অবাধে ভারতীয় শাড়ি ও চাদর আসায় এসব কাপড়ের সঙ্গে মণিপুরিদের হাতে তৈরি কাপড় প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে। তাঁদের প্রশ্ন, সাত-আট দিনে একটি শাড়ি তৈরি করে পর্যাপ্ত দাম না পেলে কাপড় বুনে লাভ কি। তাই বর্তমানে যারা বিকল্প কাজ পাচ্ছে না, কেবল তারাই একেবারে বেকার থাকার চেয়ে ঘরে বসে কাপড় তৈরি করছে। একসময় মণিপুরি মহিলাদের প্রায় সবাই তাঁতে কাপড় বুনলেও এখন তাদের অনেকেই পা বাড়াচ্ছে বিকল্প পেশার দিকে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের মণিপুরি সম্প্রদায়ের অল্পসংখ্যক লোকই বাণিজ্যিকভাবে কাপড় তৈরির সঙ্গে জড়িত।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় অনেকে অর্থের সংস্থান করতে বিভিন্ন এনজিওর দ্বারস্থ হচ্ছে। কিন্তু চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুবিধা করতে পারছে না। তারা জানায়, কোমর তাঁত বসাতে বেশি পুঁজি লাগে না বলে এটি অনেক মণিপুরি পরিবারেই বসানো হয়। কিন্তু এতে বেড শিট, বেড কাভার, পিলোর মতো হাতেগোনা কয়েকটি পণ্য ছাড়া অন্য কোনো বস্ত্র বোনা যায় না। শাড়ি, থ্রিপিস, ওড়নার মতো পরিধেয় বস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তাঁত বসানোর ব্যয় অনেক বেশি। একটি যন্ত্রচালিত ব্রড ব্র্যান্ডের তাঁতের সরঞ্জাম কিনতে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে। তাই যাদের পুঁজি কম, তারা বাধ্য হয়ে কোমর তাঁত ব্যবহার করে। পুঁজির অভাব ছাড়াও আরো কিছু কারণে মণিপুর িতাঁত শিল্পের প্রসার হচ্ছে না। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানায়, 'প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সিলেটে পাওয়া যায় না। নরসিংদী ও ঢাকা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়।'
১৯৭৯ সালে সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১০টি তাঁত দিয়ে সিলেট নগরীর শিবগঞ্জে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়েছিল। পরে সরকারি সাহায্য বন্ধ এবং প্রশিক্ষণ ও কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়ায় চালু হওয়ার আট বছরের মাথায় তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশ মণিপুরি আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে মহিলা তাঁতি সম্মেলনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মণিপুরি তাঁত শিল্পের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস দেন। তবে পরে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। মণিপুরি তাঁত শিল্পের আধুনিকায়নে কোনো ধরনের উদ্যোগ না নেওয়ায় মান্ধাতার আমলের ধারায় এখনো চলছে এর বুনন ও উৎপাদন কাজ। পাশাপাশি সরকারিভাবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না থাকায় ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে মণিপুরি তাঁত শিল্প।
বাংলাদেশ মণিপুরি মহিলা সমিতির চেয়ারপারসন এস রিনা দেবী বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। পাশাপাশি এই শিল্পে নিয়োজিতদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং ঋণ সুবিধা দিলে এটি আরো বিকশিত হবে।' তিনি বলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এর ফলে দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ৯০ বছর উৎসবের রঙে রাঙা ক্যাম্পাস

টিপটিপ বৃষ্টি, ঢাকঢোলের মধুর বাদ্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদচারণ, জাতীয়সংগীত এবং কেক কাটার মধ্যদিয়ে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালনের আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার আয়োজিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় সাবেক শিক্ষার্থীদের উল্লাসমুখর উপস্থিতিও পুরো পরিবেশকে করে তোলে আরো প্রাণবন্ত। গৌরবদীপ্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে যেন উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। অন্যদিকে আলোচনা সভায় বক্তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই থেকে ৯০টি বছর পেরিয়ে ৯১ বছরে পদার্পণ করল এ প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশ ভাগের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসক পতনের আন্দোলন এবং সব শেষে ২০০৭ সালের আগস্টে সেনা কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১২টি বিভাগ ও ৮৭৭ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিভাগ হয়েছে ৭৭টি।
৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল পুরো ক্যাম্পাস সাজানো হয় মনোরম সাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো আকর্ষণীয় আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের কর্মসূচির মধ্যে ছিল আলোচনা সভা ও স্মৃতিচারণা, শোভাযাত্রা, কেক কাটা, গবেষণা ও আবিষ্কারবিষয়ক প্রদর্শনী,
বিতর্ক, প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ, প্রীতি ভলিবল ম্যাচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি।
সকাল ৯টায় জাতীয়সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা এবং হলগুলোর পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে বেলুন ও ৯টি পায়রা অবমুক্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ, কোষাধ্যক্ষ ড. মীজানুর রহমানসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এরপর উপাচার্য ৯০ পাউন্ডের একটি কেক কাটেন। পরে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়। এর আগে শিক্ষার্থীরা সবকটি হল থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের মল চত্বরে মিলিত হন।
জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা : এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল 'জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা'। সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে এ বিষয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাবেক উপাচার্যসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 'জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা' শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন, অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশরাফ উদ্দিন প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'আজকের বাস্তবতা হলো_রাষ্ট্র পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তন হয়নি। ভয়াবহ বৈষম্য ও বেকারত্ব বিরাজ করছে। এগুলো থেকে মুক্তি পেতে যে চেতনা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই লক্ষ্যে কাজ করবে_এটাই প্রত্যাশা।'
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, 'এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে_মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষারীতি বাস্তবায়ন করা।'
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে।'
'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে অবদান রেখেছে পৃথিবীতে এরকম বিশ্ববিদ্যালয় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না' বলে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, 'কিন্তু গবেষণার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের গ্রন্থাগারের সমস্যা, ল্যাবরেটরি নেই। এর জন্য চাই প্রয়োজনীয় ব্যয়বরাদ্দ। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অনেক মেধাবী।'
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, 'আমরা বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। উচ্চশিক্ষার সমৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন জড়িত। উচ্চশিক্ষা হচ্ছে এমন মাধ্যম, যা দিয়ে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়।'
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'একজন মানুষের মধ্যে যদি মনুষ্যত্ববোধ না জন্মায়, তাহলে সে মানুষ হয় না। আমরা শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু ডিগ্রি কিংবা কৃতিত্বের সঙ্গে ফার্স্টক্লাস পাওয়া, কেবল সনদ পাওয়া কোনো লক্ষ্য নয়। কিন্তু এগুলোই এখন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
আইনস্টাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে উপাচার্য আরো বলেন, 'প্রশিক্ষিত কুকুর সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়; প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করাই কাজ। এই বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে।'
ড. এ কে আজাদ বলেন, 'অগ্রগতি চাইলে, গণতন্ত্র চাইলে, শান্তি চাইলে উচ্চশিক্ষায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। বরাদ্দ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে গবেষণা করবে?'
শিক্ষায় গত বছরের তুলনায় এ বছর বরাদ্দ আরো কমে গেছে বলে উল্লেখ করে এ কে আজাদ আরো বলেন, 'অন্যান্য দেশে শিক্ষায় জিডিপির সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২.৪ শতাংশ। দেশের উচ্চশিক্ষায় এতসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।'
আলোচনা সভা শেষে দুপুর আড়াইটায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির আয়োজনে প্রাণবন্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা পদক প্রদর্শনী, বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নিজ নিজ বিভাগ ও অনুষদে বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান; বিকেল পৌনে ৩টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে গ্রান্ডমাস্টার্স র‌্যাপিড দাবা প্রতিযোগিতা, সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রীতি ফুটবল এবং বিকেল ৫টায় প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় টিএসসি মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে সংগীত বিভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তন প্রাঙ্গণে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপি প্রদর্শনী এবং বিকেল ৪টায় প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন মল চত্বরে ব্যান্ডসংগীত পরিবেশন করা হয়। এতে সংগীত পরিবেশন করে ব্যান্ড দল লালন, দলছুট ও মনোসরণি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী নাট্যমেলার আয়োজন করে নাট্যকলা বিভাগ। এ ছাড়া এ বিভাগের উদ্যোগে মঞ্চস্থ করা হয়েছে ব্রেখটের নাটক 'সিদ্ধান্ত'।

জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি চট্টগ্রামবাসীর

লাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুুক্তি পাচ্ছে না চট্টগ্রামবাসী। বিগত তিন সরকারের আমলেও নাগরিক এই দুর্ভোগের সমাধান হয়নি এবং ভবিষ্যতেও স্থায়ী কোনো সমাধানের লক্ষণ নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে টানা তিন ঘণ্টায় মাত্র ৬৫ মিলিমিটারের বৃষ্টি ও সাগরের জোয়ারের মিলিত প্রভাবে জলমগ্ন হয়েছে নগরীর নিচু এলাকা। এ ছাড়া থেমে থেমে দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় অনেক জায়গায় তা দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত পতেঙ্গা বিমানবন্দরে ৩০ মিলিমিটার ও আমবাগান কেন্দ্রে ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আরো বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় বিমানবন্দর কেন্দ্রে ৫৫ মিলিমিটার ও আমবাগান কেন্দ্রে ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং আরো কয়েক দিন তা অব্যাহত থাকতে পারে।' তবে গতকাল দুপুরের পর বৃষ্টির মাত্রা কমে এসেছে।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে প্রতিবছর বর্ষাকালীন বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধসের পর তা বন্ধে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র এম মঞ্জুর আলম জলাবদ্ধতাকে ইস্যু করে নির্বাচনে জয়ী হলেও তা সমাধানে এখনো সফল হননি।
জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন খাল খননের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মঞ্জুর আলম বলেন, টানা বৃষ্টির পাশাপাশি সাগরের জোয়ার মিলিত হওয়ায় নগরীর নিচু এলাকাগুলোতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে। কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটেল ড্রেজিং না হওয়া পর্যন্ত জোয়ারের এই সমস্যা থেকে চট্টগ্রামবাসী শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছে না। তবে তা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন খালের মুখে স্লুইস গেইট দেওয়া ও সিল্টট্র্যাপগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
কালভার্ট নির্মাণ ও নালা অপরিষ্কার থাকার কারণে নিচু এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে জানিয়ে মঞ্জুর আলম বলেন, বৃষ্টিপাতের কারণে নির্মাণকাজ শেষ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া নালা ও খালের মুখ আটকে যাওয়ায় পানি সহজে নামতে পারছে না। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কাজ অবশ্যই এক বছরে শেষ করা যাবে না।
আগ্রাবাদ সিডিএ, ছোটপুল পুলিশ লাইন, হালিশহর কে-ব্লক ও এল-ব্লক এলাকায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে জোয়ারের মিলিত প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা দেখা গেলেও চকবাজার, মুরাদপুর ও বহদ্দারহাট প্রভৃতি এলাকায় সকালে জলাবদ্ধতা ছিল। সকালে চকবাজারের কাঁচাবাজার এলাকায় কোমর সমান পানি ওঠায় কাঁচাবাজারের শাকসবজি, পানসহ বিভিন্ন দ্রব্য পানিতে ভাসতে থাকে। মাইনুদ্দিন নামের এক সবজি ব্যবসায়ী বলেন, বিএনপি সরকারের আমলেও আমরা পানি খেয়েছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বাদ যাইনি এবং সর্বশেষ এই মহাজোট সরকারের সময়েও আমরা পানির (জলাবদ্ধতা) দুর্ভোগ থেকে মুুক্তি পাইনি। এখন বৃষ্টি হলেই পানি জমবে বলে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি।
এ ছাড়া কেবি আমান আলী রোড, কাতালগঞ্জ, বহদ্দারহাট বারইপাড়া, শুলকবহর ও মুরাদপুরের মোহাম্মদপুর এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বহদ্দারহাট ও মুরাদপুর এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে দুটি নতুন খালের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা দুর্ভোগের সুরাহা হচ্ছে না জানিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ বলেন, 'নতুন খাল খনন বা পুরনো খাল সংস্কার না করে শুধু বালি ও মাটি উত্তোলন করে জলাবদ্ধতা নিরসন করা যাবে না।'
আলী আশরাফ আরো বলেন, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন খালের উভয় পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালানো হলেও তা পরে বন্ধ হয়ে যায়। জলাবদ্ধতা নিরসনে সবার আগে মুরাদপুরে সিডিএ এভিনিউ রোডের সমান্তরালে ও বহদ্দারহাটে খাজা রোডের সমান্তরালে দুটি খাল খনন করতে হবে।

অম্লমধুর লটকন by সুমন বর্মণ ও বিশ্বজিৎ ভট্টচার্য

র্ষার সঙ্গে সখ্য পেতেছে লটকন। আগে জংলী বলে অপবাদ থাকলেও এখন দেশীয় এই ফলটি জনপ্রিয়। মানুষ চাষবাস করে বাণিজ্যিকভাবেই উৎপাদন করছে। বাজারে গেলে ফলের ঝুড়িতে ফলটি পাওয়া যাবে। স্বাদে অম্লমধুর এই ফল জিভে জল নিয়ে আসে। গ্রীষ্মের তাপদাহে বিবর্ণ প্রকৃতিতে বৃষ্টির পরশের বার্তা নিয়েও হাজির হয় লটকন।
সুগোল ফলটি আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম Burmese grape। বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida। গাছ ছোটখাটো ঝাঁকড়া ধরনের। পাতা ডিম্বাকৃতির, গাঢ় সবুজ।
বসন্তে ফুল আসা শুরু হয়। ফল পাকতে পাকতে বর্ষা। কাঁচা অবস্থায় সবুজ, পাকলে হলদে বর্ণ ধারণ করে। ডুমুরের মতো লটকনও গাছের কাণ্ড ও ডালের বাকল ফেটে লম্বা বৃন্তে গুচ্ছাকারে ধরে। একটি গুচ্ছে ২০ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ফল ধরে। মোটা খোসার ভেতরে তিন-চারটি রসালো কোষ থাকে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এটি চাষ করতে বাড়তি কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আঙিনায় বা বড় বড় গাছের নিচে অধিক ছায়াযুক্ত জায়গায় খুব সহজেই লটকনের আবাদ করা যায়। কলমে লাগানো গাছে সাধারণত চার বছর বয়স থেকে ফল আসা শুরু হয়। অবস্থাভেদে গাছের বয়সের ওপর ভিত্তি করে গাছপ্রতি চার থেকে ১২০-১৩০ কেজি পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে। একটানা ১৮-২০ বছরের গাছে সর্বোচ্চ ফলন হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লটকন গাছের কাণ্ড থেকে মাথা পর্যন্ত ফল ধরে। এটি খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশীয় বৃক্ষ। আমাদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এ বৃক্ষটিকে তালিকাভুক্ত করে এর ব্যাপক প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। কারণ এটি একদিকে মানুষেরও খাদ্য আবার বন্য প্রাণীও এই ফল খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।'
পরিচিতি : অঞ্চলভিত্তিক কিছু নামে লুকানো রয়েছে লটকনের পরিচিতি। চট্টগ্রামে এর নাম 'হাড়ফাটা'। বৃহত্তর সিলেটবাসী 'ডুবি' বা 'বুবি' নামে চেনে ফলটিকে। আবার ময়মনসিংহে এর নাম 'কানাইজু'। এ ছাড়া 'লটকা', 'লটকাউ', 'কিছুয়ান'_এসব নামেও ফলটি আঞ্চলিকতার মায়াজলে বাঁধা রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে।
প্রাপ্তিস্থান : নরসিংদী জেলার সর্বত্র কমবেশি লটকনের ফলন হয়। তবে বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা ও পলাশ উপজেলার মাটি লটকন চাষের উপযোগী। এ চার উপজেলার লটকন আকারে বড়, দেখতে হলদে মসৃণ আর স্বাদে সুমিষ্ট। এ অঞ্চলের কৃষকরা মনে করেন, যেকোনো কৃষি ফলনের চেয়ে লটকন চাষে লাভও বেশি। কৃষকরাও লটকন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে তাঁত ও কলার জন্য বিখ্যাত নরসিংদী হালে পরিচিত হয়ে উঠেছে লটকনের রাজ্য হিসেবে। নরসিংদী ছাড়াও টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, সিলেট প্রভৃতি এলাকায় ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে।
লটকন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। গবেষকরা বারি-১ নামে আমাদের দেশে চাষ উপযোগী লটকনের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। বাজারে লটকনের খুচরা মূল্য ৬০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। এক কেজিতে আকারভেদে ২৫ থেকে ৭০টি পর্যন্ত লটকন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, নরসিংদী এলাকায়ই এখন সবচেয়ে বেশি লটকন চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এই ফলের গাছ। লটকন গাছ পরিবেশের জন্যও ভালো।
পুষ্টি ও ভেষজ গুণ : টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত লটকন খাদ্যমানের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে লটকনের পুষ্টিগুণ প্রচুর। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে খাদ্যশক্তি রয়েছে ৯১ কিলোক্যালরি, যা আমলকীর প্রায় পাঁচ গুণ। এ ছাড়া আমিষ রয়েছে ১ দশমিক ৪২ গ্রাম, স্নেহ শূন্য দশমিক ৪৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৯ গ্রাম, ভিটামিন বি-১ শূন্য দশমিক ০৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক ১৯ মিলিগ্রাম, লৌহ শূন্য দশমিক ৩ মিলিগ্রামসহ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। তাই বলা হয়ে থাকে, রোজ দু-চারটি লটকন আমাদের দেহের ভিটামিন সি-এর চাহিদা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। এ ফল খেলে হঠাৎ ওঠা বমি বমি ভাব দূর হয়। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ করতেও সক্ষম। শুকনো লটকন পাতার গুঁড়ো খেলে ডায়রিয়ার প্রকোপ ও মানসিক চাপ দূর হয়।

মতিউর রহমান কি আইনের ঊর্ধ্বে? by কালের কণ্ঠ ওয়েব

১ আগস্ট। দেশের ইতিহাসের একটি কালো দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।
এ ঘটনার বিচার হয়নি এখনো। দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে জানা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ওই দিন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। কিন্তু গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় অল্পের জন্য বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
জোট সরকার আমলে এ ঘটনার তদন্ত হয়। তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদন্ত হয়। সেখানে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। চার্জশিট হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নেতা মুফতি হান্নান, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, আরো জঙ্গি সদস্যসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের তদন্তে ঘটনার পেছনের শক্তি কারা, তা উদ্ঘাটিত না হওয়ায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার মামলার অধিকতর তদন্ত দাবি করা হয়। আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত চলছে।
গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দুটি মামলার উদ্ভব হয়। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা। দুটি মামলারই অধিকতর তদন্ত করছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ। তিনি বারবার অধিকতর তদন্তের সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়েছেন আদালতের কাছ থেকে। তবে এখন তদন্ত চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে বলে তদন্ত কর্মকর্তার সর্বশেষ একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
তদন্ত নিয়ে সংশয়
এ ঘটনাটির তদন্ত নিয়ে বারবার সংশয় থেকে যায়। জোট আমলে জজ মিয়া নামের এক নিরীহ ব্যক্তির স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। ওই স্বীকারোক্তিতে আওয়ামীপন্থী বেশ কিছু সন্ত্রাসীকে জড়ানো হয়। তদন্তে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে আওয়ামী লীগই ঘটনাটি ঘটিয়ে সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেয়েছে। কিন্তু ওই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় মুফতি হান্নান জবানবন্দি দেওয়ার পর। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের তদন্তে ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের নাম উঠে আসে। কিন্তু ঘটনার ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা হয়নি। ওই সময় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, এ ঘটনায় সরকারের প্রভাবশালীরা জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে আবার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্তও করা হয়।
আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে। কিন্তু এবারের তদন্তেও এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এখনো পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।
তিনি কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন?
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ওই বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন ধারাছোঁয়ার বাইরে। এর কারণ কী তা স্পষ্ট নয়। জানা গেছে, সিআইডি কয়েকবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের চিন্তাভাবনা করেও সরকারের সবুজ সংকেত না পেয়ে পিছিয়ে যায়।
গত ১৯ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেস ব্রিফিং করেন। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের চমকে দিয়ে তিনি যে তথ্যটি উপস্থাপন করেন, তা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর। তিনি সরাসরি বলেন, ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সঙ্গে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেই নন, ন্যাশনাল কমিটি ফর ইন্টেলিজেন্স কো-অর্ডিনেশনের (এনসিআইসি) সমন্বয়ক হিসেবেও তিনি বক্তব্য পেশ করেন এবং বলেন, 'দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার চক্রান্ত চলছে। এ চক্রান্তের সঙ্গে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক জড়িত। ওই পত্রিকায় ৪০ দিনে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৪৮টি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদকের কর্মকাণ্ডে অনেকেরই প্রশ্ন্ন, তিনি কি পার্ট অব জঙ্গি? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে তাঁর কী লাভ? র‌্যাবের সফলতায় তিনি কি মনঃক্ষুণ্ন? আগেরও কিছু ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্রব রয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় অভিযুক্ত এক জঙ্গি তাদের সঙ্গে ওই সম্পাদকের বৈঠক হয়েছে বলে জানিয়েছে। সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স তাঁকে চক্রান্তকারী হিসেবেই শনাক্ত করে। এসব কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে প্রধানমন্ত্রী এখনো তা চান না।'
এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের জন্য কালের কণ্ঠকে চিহ্নিত করা হয়েছে 'হলুদ সংবাদপত্র' হিসেবে এবং সেটা করেছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। সুদীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের যে সম্পাদক সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তাঁকে 'হলুদ সম্পাদকের এবং অপসাংবাদিকতার' দায়ে অভিযুক্ত করে সতর্ক করে দেওয়া হলো। আর সেদিন এই প্রেস ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনেরই যেন প্রতিধ্বনি তোলা হলো।
গত বছরের ১০ মে প্রকাশিত সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, তাঁর ভাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার হোতা জঙ্গি নেতা তাজউদ্দিনের সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। গোয়েন্দারা যে তাজউদ্দিনকে খুঁজছেন, সেটা মতিউর রহমান তাঁকে আগাম জানিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছিলেন। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে এসব তথ্য লেখা হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক উপমন্ত্রী পিন্টুর একটি জবানবন্দির ভিত্তিতে।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে মামলা ঠুকে দেন। সেই মামলা বিচারের পর প্রেস কাউন্সিলের দেওয়া রায়ে বলা হয়, কালের কণ্ঠ হলুদ সাংবাদিকতা করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার প্রেস ব্রিফিংয়ে একই অভিযোগের প্রতিধ্বনি ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এল, তাহলে প্রেস কাউন্সিল কেন কালের কণ্ঠকে হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত করল?
অবশ্য প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনার সময় অভিযুক্ত পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদকের নাম বলেননি। তবে কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদন, প্রথম আলো সম্পাদকের মামলা এবং প্রেস কাউন্সিলের রায়ের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সব সাংবাদিকের কাছেই পরিষ্কার হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা কোন সম্পাদকের কথা বলেছেন। জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত এই সম্পাদক যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, তা আর কারো বুঝতে বাকি রইল না।
তারিক আহমেদ সিদ্দিক যেহেতু একাধারে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা এবং এনসিআইসির সমন্বয়ক, কাজেই তাঁর মুখ থেকে যখন এ অভিযোগ আসছে, তাই ধরে নিতে আর কোনো দ্বিধা নেই যে, এ অভিযোগের ভিত্তি অনেক দৃঢ়। তিনি নিশ্চিত হয়েই অভিযোগ তুলেছেন এবং তাঁর বক্তব্য সরকারেরই বক্তব্য।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা এবং এনসিআইসির সমন্বয়ক মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের এই বক্তব্য দেশের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য অবশ্যই সরকারি বক্তব্য। তিনি তাঁর বাসায় বা অনুষ্ঠানে এ বক্তব্য দেননি। এটাকে ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকারের এমন স্বীকারোক্তির পরও ওই পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ না করে পুলিশ এমন একটি বর্বর গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিট দিতে যাচ্ছে কেন? তাহলে এই চার্জশিটও কি ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে? এ প্রশ্নটি এখন সংশ্লিষ্ট সবার।
সরকারের এমন বক্তব্যের পরও ওই সম্পাদক ধারাছোঁয়ার বাইরে কেন? তাঁর পেছনে কোন শক্তি রয়েছে যে, তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে।
উপদেষ্টার বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার চক্রান্ত!
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা যে পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সংশ্লিষ্টতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছেন, দেশের মানুষ মনে করে, যথেষ্ট তথ্য-প্রমানসহ তিনি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এমন একটি সংবাদ সম্মেলনের পরও অভিযুক্ত ওই সম্পাদক ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন_এটা মানতে পারছে না দেশের সচেতন মানুষ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, একটি মহল ওই সম্পাদককে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করতেই ওই সম্পাদককে জিজ্ঞাসাবাদ না করতে বাধা সৃষ্টি করছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিট দেওয়ার পরে চক্রান্তকারী ওই মহল যাতে বলতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মিথ্যা বলেছেন।
আইনের নিজস্ব গতি নেই!
আইনের মূল বক্তব্য হচ্ছে_আইন তাঁর নিজস্ব গতিতে চলবে। বর্তমান সরকার আমলে লিমনের ওপর র‌্যাবের গুলিবর্ষণের ঘটনা একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। র‌্যাবকে অভিযুক্ত করে মামলা হয়েছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে সুশীল সমাজসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার। কিন্তু র‌্যাবের পক্ষে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ঊধ্বর্তন মহল র‌্যাবকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে লিমনের বিরুদ্ধে র‌্যাবের বিতর্কিত মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বলেছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
শুধু লিমনের বিষয়ে নয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়েছে। এসব মামলার বিষয়েও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।
কিন্তু ওই সম্পাদকের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ থাকার পরও তাঁকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা নেই। এক সাবেক উপমন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে এই সম্পাদকের সখ্য সর্বজনবিদিত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাবেক উপমন্ত্রীর এই ভাই হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড সরবরাহ করেন। এ ছাড়া হামলার বিষয়ে আগে থেকেই ওই সম্পাদককে অবহিত করেন সাবেক উপমন্ত্রীর ভাই। সাবেক উপমন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেন আলোচিত সম্পাদকের অধীন এক রিপোর্টার। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে এই রিপোর্টার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলে আলোচিত সম্পাদক তাঁকে পুঁজি করে বাণিজ্য করেন। এ রিপোর্টারেরও ২১ আগস্ট গেনেড হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনিও হামলার বিষয়টি আগেই জানতেন বলে জানা গেছে। এখন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আলোচিত সম্পাদক, সাবেক উপমন্ত্রীর ভাই ও সেই রিপোর্টারকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে কি বলা যাবে_আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে?
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী ওই সম্পাদকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তা হলো_এক. তাঁর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দুই. তাঁর জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিন. তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার চক্রান্তকারী। এসব অভিযোগ অবশ্যই মারাত্মক। ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চক্রান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। আর জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তাঁকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সোপর্দ করা যায়। তাহলে কেন আইনের হাতে ওই সম্পাদককে সোপর্দ করা হচ্ছে না? প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকার সম্পাদক বলেই কি তিনি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন। তাহলে কি বলতে হয়, আইনের নিজস্ব কোনো গতি নেই!
ওই সম্পাদকের কর্মকাণ্ড
অপসাংবাদিকতার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই দৈনিকটি ও তাঁর সম্পাদকের। কখনো তিনি ক্ষমা চেয়েছেন মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে, আবার কখনো দুঃখ প্রকাশ করেছেন অবৈধ অগণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষ নেওয়ার কারণে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির নানা বাঁকে ওই সম্পাদক ও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার অবস্থান ছিল অস্বচ্ছ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজনীতি থেকে রাজনীতিকদের উচ্ছেদ করে সুশীল নাগরিকদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। দেশকে অকার্যকর ও ব্যর্থ-তত্ত্ব দিয়ে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতারোহণে উৎসাহ জুগিয়েছে তিনি ও তাঁর পত্রিকা।
২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি এটিএন বাংলার 'মিট দ্য প্রেস' অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেশে জরুরি অবস্থার পক্ষে তিনি সাফাই গান, সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি ভূমিকা রাখার উসকানি দেন। এমনকি বিদেশি রাষ্ট্র, বিশেষ করে দাতা দেশগুলোর ভূমিকারও প্রশংসা করেন তিনি। এটিএন বাংলার স্টুডিও থেকে সরাসরি সমপ্রচারিত ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল কোনো এক ষড়যন্ত্রকারী নেপথ্যশক্তির তল্পিবাহক হিসেবে। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই 'সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই'_শিরোনামে তিনি এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, 'দেশের সব পরিবর্তনের পেছনে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তাহলো সশস্ত্র বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগই এখন পর্যন্ত প্রধান। এসব পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা বড় নয়।' সব মন্তব্য প্রতিবেদনেরই সারবস্তু ছিল অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক শক্তিকে উসকে দেওয়া।
রাজনীতিকদের হেনস্তা করে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে একের পর এক নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে পত্রিকাটি জরুরি অবস্থার সময় রাজনীতিকদের অপদস্থ করে।
২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থানকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখে। এর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি সব মহল, বিশেষভাবে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন বলে লেখায় উল্লেখ করা হয়।
২০০৭ সালের ১১ জুন 'দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে' শিরোনামে তাঁর পত্রিকায় এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, 'দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পটভূমিতে দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ কী হবে, কী হওয়া উচিত তা নিয়ে এখন আবার ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁরা কি রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন?' বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বলতে পারি, গত ১৬ বছরে আপনাদের দুজনের ক্ষমতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির অনেক অত্যাচার দেশবাসী নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। দয়া করে আপনারা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন নেতৃত্বকে সামনে আসার এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিন। দুর্নীতি আর অপশাসন ছাড়া আপনাদের দেশকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই!'
বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন ওই সম্পাদক। ২০০৮ সালের ১০ মে 'নির্বাচন চাই, ১১ জানুয়ারির আগের অবস্থায় ফিরতে চাই না' শিরোনামে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে বারবার একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালান তিনি।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই পত্রিকার রম্য ম্যাগাজিনে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন ও মুসলমানদের উসকে দেন। একপর্যায়ে পত্রিকাটি এই কার্টুন প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ও ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়।
ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সভাপতিত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে সালিসি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ওই সম্পাদক করজোড়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের তৎকালীন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান।
সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন ওই সম্পাদক। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিক সমিতির (নোয়াব) নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ওই সম্পাদক বলেন, 'ওয়ান-ইলেভেনপরবর্তী আমাদের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এ জন্য আমরা দুঃখিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটা করা ছাড়া তখন আমাদের উপায় ছিল না। তবে ওই ভূমিকা ভুল ছিল।' বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।

পাহাড়ে পিষ্ট মানুষ

ট্টগ্রামে আবারও ভয়াবহ পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। টাইগারপাস বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ও মাটি গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ধসে পড়ে। দুর্ঘটনার পর গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ রয়েছে আরো একজন।
এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বৃষ্টির মধ্যে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু ও ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রতিরক্ষা দেয়ালটি বাটালি হিলের মাটিসহ ধসে পড়ে। এর নিচে প্রায় ২০টি বস্তিঘর চাপা পড়ে। এসব ঘরের বাসিন্দাদের গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। পরে অনেকে অন্যত্র চলে গেলেও বাচ্চু মিয়া, মোহাম্মদ শফিক, আমজাদ হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও হোসনে আরা বেগমের পরিবার আবারও নিজেদের ঘরে ফিরে আসে। গতকাল সকালে আনোয়ার হোসেনের পরিবার ছাড়া বাকি চারটি পরিবারের সদস্যরা মাটিচাপা পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী আরিফা হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শফি মিয়ার স্ত্রীকে ডাকার জন্য এসে দেখতে পাই, পেছনের দেয়ালটি ধসে পড়ছে। আমার চিৎকারে আনোয়ার হোসেনের পরিবারের সাত-আটজন সদস্য ঘর থেকে বের হয়ে এলেও বাচ্চু মিয়া, মোহাম্মদ শফি, আমজাদ হোসেন ও হোসনে আরা বেগমের পরিবারের লোকজন বের হতে পারেনি।'
এরপর স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী রেহানা আকতার (৩৫), বড় মেয়ে শারমিন (১৮), মেয়ে ফাতেমা (১২), ছেলে আজাদ (১০) ও তানজিনার (২) লাশ উদ্ধার করেন। স্ত্রী ও সন্তানদের হারিয়ে শোকাহত বাচ্চু মিয়া বলেন, 'আমি সকালে রিকশা চালাতে চলে গিয়েছিলাম। বড় মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি থেকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) বেড়াতে এসেছিল। এখন আমি সবাইকে হারালাম।'
মাটি চাপা পড়া আমজাদ হোসেন (৪০), তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম (২৭) ও মেয়ে শারমিনের (১২) লাশ দুপুর ২টার দিকে উদ্ধার করা হয়। ধসে যাওয়া প্রতিরক্ষা দেয়াল কেটে এর নিচে পাওয়া যায় মোহাম্মদ শফি (৩৫), তাঁর স্ত্রী মিনু আরা বেগম (২৫), ছেলে মিনহাজ (৮) ও মেয়ে সোনিয়ার (৪) মৃতদেহ। রাত সোয়া ১০টার দিকে উদ্ধার করা হয় দুই শিশু সাজ্জাদ হোসেন (১২) ও মেয়ে সাহেদার (৮) মৃতদেহ। স্থানীয় লোকজন সন্ধ্যায় জানায়, এই দুই শিশুর মা মাটির নিচে তখনো চাপা পড়ে আছেন। রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। এর আগে ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১১ জনের মৃত্যুর পর চট্টগ্রামে গতকাল আবারও বড় ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটল। বাটালি হিল ধসে প্রাণহানির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাটালি হিলের পাশে রেলওয়ের জায়গায় বেশ কয়েকটি পরিবার অবৈধ ঘর তুলে বসবাস করছে। তাদের উচ্ছেদের জন্য সিটি করপোরেশন অভিযান পরিচালনা করলেও তেমন কোনো ফল হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা মীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সরকারি জায়গায় থাকব না তো কোথায় থাকব! সিটি করপোরেশন বৃহস্পতিবার আমাদের এখান থেকে তুলে দিলেও আশ্রয় নেওয়ার জন্য স্কুল খুলে দেয়নি। স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক পরিবার আবার আগের জায়গায়ই ফিরে গিয়েছিল।'
গতকালের দুর্ঘটনার পর প্রথম উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। এরপর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সেবক, রেড ক্রিসেন্টের কর্মী এবং সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরাও উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপপরিচালক রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের চারটি ইউনিট উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে। দেয়ালের নিচে চাপা পড়া আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে পাঁচ ঘণ্টা পর আহতাবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।'
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মঞ্জুর আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ বসতির লোকজনকে বৃহস্পতিবারও উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকে পরে ফিরে আসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।' অন্যদিকে জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমদ বলেন, 'প্রবল বৃষ্টির কারণে উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য বারবার মাইকিং করা হয়েছে। এর পরও অনেকে থেকে যাওয়ায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।'
স্থানীয় লোকজন পাহাড়ের প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। তবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, 'আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দেয়ালের পাশের মাটি সরে যাওয়া এবং বৃষ্টির পানি নামতে না পারার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে।'
বস্তিঘরেই নিভল প্রাণ : মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। শেষ অবলম্বন ছিল বস্তির ৩০০ টাকায় ভাড়া নেওয়া একটি ছোট কক্ষ। সেখানে গাদাগাদি করে চলত জীবনযাপনের মরিয়া চেষ্টা। সেই শেষ আশ্রয়স্থল বস্তিঘরেই নিভে গেল চার পরিবারের ১৪টি মানুষের প্রাণ।
বাটালি হিলের ধস বাচ্চু মিয়ার পরিবারের স্ত্রী, সন্তানসহ পাঁচজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। রিকশা চালানোর সময় সকাল ৭টার দিকে পাহাড়ধসের খবর পান বাচ্চু মিয়া। পরে স্ত্রী-সন্তানের লাশ দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। বাচ্চু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিয়ে করার পর আট থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখিনি। এরপর প্রথম স্ত্রী রেনু বেগম আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করায়। এর এক বছর পর সংসার আলো করে সন্তান আসে। আজ (শুক্রবার) পাহাড়চাপায় আমার জীবন আবার অন্ধকার হয়ে গেছে।'
ধস ঠেকাতে পারেনি প্রতিরক্ষা দেয়াল : বাটালি হিলের ধস ঠেকাতে গত বছরের প্রথম দিকে ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। প্রায় ৩০ ফুট প্রস্থ ও ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের দেয়ালটি গতকাল পাহাড়ধস ঠেকাতে পারেনি। বরং এটি ভেঙে পড়ায় ক্ষতির মাত্রা বেশি হয়েছে বলে অভিযোগ করে এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মঞ্জুর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিরক্ষা দেয়াল নিয়ে এলাকাবাসী যে অভিযোগ করছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। নির্মাণকাজে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বৃহস্পতিবার ঝুঁকিপূর্ণ ওই এলাকায় আমি নিজে গিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। তার পরও লোকজন আবার সেখানে ফিরে আসে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই সবার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা থেকে সরে যাওয়া উচিত।'
প্রতিরক্ষা দেয়ালটি নির্মাণকাজের ঠিকাদার গিয়াস আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা গত বছরের প্রথম দিকে কাজ শেষে সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দিই। তখন ত্রুটিপূর্ণ কাজ করার অভিযোগ কেউ করেনি। এখন একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর সবাই নির্মাণকাজে ত্রুটির কথা বলছে। আমরা যে জায়গায় দেয়ালটি নির্মাণ করি, তার নিচ থেকে মাটি কেটে ঘর তৈরি করায় সেটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়সহ দেয়ালটি ধসে পড়তে পারে।'
নিহত প্রত্যেকের জন্য ১০ হাজার টাকা অনুদান : পাহাড়ধসে নিহত প্রত্যেকের জন্য ১০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের দ্রুত উচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব পাহাড়ের মালিক এ নির্দেশ অমান্য করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি বৈঠকে জেলা প্রশাসক এ নির্দেশ দেন। গত বছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার এক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পাহাড়-মালিকদেরই ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা সেটা বাস্তবায়ন করেননি। তাঁরা ব্যর্থ হলে পাহাড়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে।'
বৈঠকে আরো চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেগুলো হলো_দুর্যোগকবলিত এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে পিডিবি, বাটালি হিল এলাকার ধসে যাওয়া দেয়াল দ্রুত অপসারণ করবে সিটি করপোরেশন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনে পাঠদান বন্ধ রেখে গৃহহীনদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং চাপা পড়া অন্য তিনজনকে দ্রুত উদ্ধারের ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। এ ছাড়া পাহাড়ধসের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) এহসান এ ইলাহীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

তত্ত্বাবধায়কের ২০ বছর by অমিতোষ পাল

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাস সময়কেই অন্তর্বর্তীকাল হিসেবে গণ্য করা হয় তখন; যদিও সংবিধানে 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার' শব্দগুলো ছিল না। সে সময় রাষ্ট্রপতির পরামর্শক্রমে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিল। আর ওই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে না পারার বিধান ছিল বাহাত্তরের সংবিধানেও। গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে, সেখানেও অনুরূপ অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান রাখা হয়েছে। তবে কোনো নাম দেওয়া হয়নি। আর এর মাধ্যমে বিলুপ্ত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় দফায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তবে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসন শেষে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয়েছিল ১১ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার। তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে আগের পদে ফিরে যান মো. সাহাবুদ্দীন। পরে গেজেট প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের নাম দেওয়া হয়েছিল নির্দলীয় 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার'।
নব্বইয়ের ওই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে জায়গা করে নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের একটি অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা। এরপর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দিয়ে গত ২০ বছরে পাঁচটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। ওই পাঁচটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ দেশে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একটি সরকার নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয়। নির্ধারিত মেয়াদও সম্পন্ন করতে পারেনি ওই সরকার। আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের পরিবর্তে ক্ষমতায় থেকেছে দুটি বছর।
১৯৯১ সালে বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নিতে শুরু করে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন বিএনপি অবস্থান নেয় এর বিপক্ষে। পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় একটি ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয় বিএনপি। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে সংবিধানে যুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি।
সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। ২০০৬ সালের ১২ জুন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তিন মাসের মধ্যেই বিদায় নেন তিনি। পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন বিচারপতি লতিফুর রহমান। তিনিও নির্বাচন করে ফিরে যান। ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এই জোট সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৭ করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নতুন জটিলতা। ওই ঘটনায় বেঁকে বসে আওয়ামী লীগসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দল। তারা অভিযোগ করে, তখনকার প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্দেশ্য নিয়েই বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়ানো হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে বিচারপতি কে এম হাসানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও তোলা হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর একজন খুনির আত্মীয় হলেন কে এম হাসান। এসব নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক প্রচার ও আন্দোলন। ফল হিসেবে একসময় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের কয়েকটি বিকল্পকে ডিঙিয়ে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন। তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয় ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধেও বিএনপির হয়ে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ ওঠে। কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেন। ওই সময় দেশের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি ঘোষিত নির্বাচন আর তাঁর পক্ষে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে জারি হয় জরুরি আইন। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন ফিরে যান রাষ্ট্রপতির পদে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা : ১৯৯১ সালে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। উপদেষ্টারা ছিলেন বিচারপতি এম এ খালেক, কফিলউদ্দিন মাহমুদ, ফখরুদ্দীন আহমদ, রেহমান সোবহান, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আলমগীর এম এ কবীর, এ কে এম মুসা, ডা. এম এ মাজেদ, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, এ বি এম জি কিবরিয়া, কাজী ফজলুর রহমান, ইমাম উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, এম আনিসুজ্জামান ও চৌধুরী এম এ আমিনুল হক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬ : প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। উপদেষ্টা_সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক মো. শামসুল হক, সেগুফতা বখত চৌধুরী, এ জেড এ নাসিরউদ্দিন, মেজর জে. (অব.) আবদুর রহমান খান, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ড. নাজমা চৌধুরী ও ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০১ : প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান। উপদেষ্টা_সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী, এ এস এম শাহজাহান, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, এ কে এম আমানুল ইসলাম চৌধুরী, এম হাফিজ উদ্দিন খান, ব্রিগেডিয়ার (অব.) অধ্যাপক আবদুল মালেক, মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী ও রোকেয়া আফজাল রহমান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৬ : প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। উপদেষ্টা_ড. আকবর আলি খান, লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরী, সি এম শফি সামী, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সফিকুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মইনউদ্দিন আহমেদ, রুহুল আমিন চৌধুরী, ড. শোয়েব আহমেদ, বিচারপতি ফজলুল হক, আজিজুল হক, ধীরাজ কুমার নাথ, মাহবুবুল আলম, সুফিয়া রহমান ও ইয়াসমিন মুরশেদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ : প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। উপদেষ্টা_মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, আনোয়ারুল ইকবাল, ড. চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম, ড. এ এম এম শওকত আলী, এ এফ হাসান আরিফ, মেজর জে. (অব.) গোলাম কাদের, রাশেদা কে চৌধুরী, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, তপন চৌধুরী, গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মতিউর রহমান ও আইয়ুব কাদরী।

বিদায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা

বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই পাস হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন বিল। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রথমে কণ্ঠভোটে এবং পরে বিভক্তি ভোটে পাস হয় বিলটি। এ বিল পাস হওয়ায় সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত হয়েছে। পুনর্বহাল হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও বহাল রাখা হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ। দুই সামরিক শাসকের আমলে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করা হয়েছিল সংবিধানে।
অবশ্য বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির দুই সদস্য আপত্তি জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালতও বলেছিলেন, সংবিধানকে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে পরিবর্তনের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে।
সংসদীয় আনুষ্ঠানিকতার পর গতকাল সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া চলাকালে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল।
সংশোধিত সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হলেও অন্যান্য ধর্মও পেয়েছে সমমর্যাদা ও অধিকার। ২(ক) অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, 'হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে।'
বাম দল ও সুধী সমাজের একটি অংশের দাবি থাকলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি সংশোধিত সংবিধানে। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার বা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে কোনো সংগঠন করা যাবে না বলে এতে উল্লেখ রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৩৮-এ বলা হয়েছে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গঠিত কোনো সংগঠনও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।
স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে গতকাল শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিলের ওপর জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন স্বতন্ত্র সদস্য মো. ফজলুল আজিম। তাঁর এই প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর বিলটির ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের হাসানুল হক ইনু, মইনউদ্দীন খান বাদল ও শাহ জিকরুল আহমেদ, ন্যাপের আমিনা আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরী ও কামাল আহমেদ মজুমদার এবং স্বতন্ত্র সদস্য মো. ফজলুল আজিম। তাঁদের ৬৫টি সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়নি। সব প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় কণ্ঠভোটে। পরে বিলটি পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং বেলা ২টা ৫৩ মিনিটে বিভক্তি ভোটের ফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিলটি পাস হয়।
'এবার পাস হলো দিনের আলোতে'
স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বিভক্তি ভোটের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মহাজোটের সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানান। ওই সময় স্পিকার বলেন, 'এর আগে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়েছে রাতের আঁধারে। আর এবার পাস হলো দিনের আলোতে।' পরে তিনি এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফ্লোর দেন।
বিপক্ষে এক ভোট
সংসদে বিলটি বিভক্তি ভোটের আগে বেলা ২টা ২৫ মিনিটে কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলটি পাসের পক্ষে ২৯১টি এবং বিপক্ষে একটি ভোট পড়ে। এর আগে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশোধনীসহ বিলটি পাসের জন্য বিবেচনার প্রস্তাব গ্রহণকালে বিভক্তি ভোটে পক্ষে ২৮৯টি এবং বিপক্ষে একটি ভোট পড়ে। বিলটি পাসের সময় দুজন বেশি ভোট দিয়েছেন। আর তিন টেকনোক্র্যাটমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, দিলীপ বড়ুয়া ও ইয়াফেস ওসমান সংসদে থাকলেও তাঁরা ছিলেন দর্শক।
সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও গঠন করা হবে অনধিক পাঁচ সদস্যের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। আর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা পর্যন্ত অর্থাৎ নির্বাচনী মেয়াদে নির্বাচন সংক্রান্ত মামলায় নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য না শুনে কোনো আদেশ দেবে না আদালত_এমন বিধান যোগ করা হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তাঁর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানে সংশোধনী এনে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংবিধান সংশোধন করে অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা দখলকে অপরাধ বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তি নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
সংশোধিত বিল অনুযায়ী সংবিধানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩ (ক) নতুন অনুচ্ছেদ সনি্নবেশিত হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ ছাড়া সংসদে নারী আসন আরো পাঁচটি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
মৌলিক বিধান সংশোধন অযোগ্য
সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় আগামী দিনে সংবিধানের মৌলিক বিধান সংশোধনের সুযোগ থাকবে না। সংবিধানের মৌলিক বিধান সংশোধনের অযোগ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, 'এ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহাই কিছু থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথমভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম ক-ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০-সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।'
বামপন্থী সদস্যদের নিয়ে জটিলতা
সংবিধান সংশোধন বিলের ওপর বিভক্তি ভোটগ্রহণের সময় মহাজোটের শরিক বামপন্থী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তাদের ভোট নিয়ে টেনশন বেড়ে যায় আওয়ামী লীগের শীর্ষমহলে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও ন্যাপের ছয় সংসদ সদস্য বিলের কয়েকটি দফায় সংশোধনী প্রস্তাব দেন। এসব প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান আইনমন্ত্রী। এতে নাখোশ হন বাম নেতারা। তাঁরা সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্যরা তাঁদের বোঝান, ভোটদানে বিরত থাকলে ফ্লোর ক্রসিং হবে এবং সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। কারণ সব বাম নেতাই আওয়াম লীগের প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। এ পরিস্থিতিতে বাম নেতারা দোটানায় পড়ে যান। পরে আধা ঘণ্টা পর্যালোচনা শেষে তাঁরা বিভক্ত ভোটে অংশ নিতে সংসদ লবিতে যান। তবে তাঁরা তাদের সংশোধানীগুলো উল্লেখ করে ভোট দেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, পলিটব্যুরো সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দীন খান বাদল, শাহ জিকরুল আলম ও ন্যাপের আমিনা আহমেদ সংবিধান সংশোধন বিলে বেশ কয়েকটি সংশোধনীর প্রস্তাব দেন। এসবের মধ্যে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং জাতি হিসেবে বাঙালি শব্দগুলো বাতিল করার প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী তাঁদের এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কণ্ঠভোটেও এসব প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। পরে সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভক্তি ভোট অনুষ্ঠিত হলে স্পিকার বলেন, যাঁরা সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেবেন, তাঁরা 'হ্যাঁ' লবিতে যাবেন, আর যাঁরা 'না' ভোট দেবেন, তাঁরা 'না' লবিতে যাবেন। যাঁরা ভোটদানে বিরত থাকবেন, তাঁরা সংসদের নিজ আসনে বসে থাকবেন। বিভক্তি ভোট চলাকালে নিজ আসনে বসে থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন বাম নেতারা। এতে আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বাম নেতাদের কাছে ছুটে যান তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, ফজলে রাবি্ব, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ অনেকে। তাঁরা বারবার তাঁদের ভোট দিতে অনুরোধ করেন। এ অনুরোধ বাম নেতারা প্রত্যাখ্যান করলে একসময় ক্ষুব্ধ হয়ে সৈয়দ আশরাফ ও শেখ সেলিম প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। এ পর্যায়ে অ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ে বাম নেতাদের বোঝাতে থাকেন। পরে তাঁরা সংসদ লবিতে গিয়ে ভোট দেন।
সংবিধান সংশোধনের জন্য গত বছরের ২১ জুলাই সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন করে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। গত ৮ জুন ৫১টি সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করে বিশেষ কমিটি। এ সুপারিশের আলোকে প্রস্তুত করা বিলে ২০ জুন মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। এরপর ২৫ জুন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংসদে বিলটি উত্থাপন করলে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি ২৯ জুন সংসদে প্রতিবেদন উত্থাপন করেন।
এ বিল পাসের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলকে যুক্ত করার জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।