Sunday, July 03, 2011

অম্লমধুর লটকন by সুমন বর্মণ ও বিশ্বজিৎ ভট্টচার্য

র্ষার সঙ্গে সখ্য পেতেছে লটকন। আগে জংলী বলে অপবাদ থাকলেও এখন দেশীয় এই ফলটি জনপ্রিয়। মানুষ চাষবাস করে বাণিজ্যিকভাবেই উৎপাদন করছে। বাজারে গেলে ফলের ঝুড়িতে ফলটি পাওয়া যাবে। স্বাদে অম্লমধুর এই ফল জিভে জল নিয়ে আসে। গ্রীষ্মের তাপদাহে বিবর্ণ প্রকৃতিতে বৃষ্টির পরশের বার্তা নিয়েও হাজির হয় লটকন।
সুগোল ফলটি আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম Burmese grape। বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida। গাছ ছোটখাটো ঝাঁকড়া ধরনের। পাতা ডিম্বাকৃতির, গাঢ় সবুজ।
বসন্তে ফুল আসা শুরু হয়। ফল পাকতে পাকতে বর্ষা। কাঁচা অবস্থায় সবুজ, পাকলে হলদে বর্ণ ধারণ করে। ডুমুরের মতো লটকনও গাছের কাণ্ড ও ডালের বাকল ফেটে লম্বা বৃন্তে গুচ্ছাকারে ধরে। একটি গুচ্ছে ২০ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ফল ধরে। মোটা খোসার ভেতরে তিন-চারটি রসালো কোষ থাকে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এটি চাষ করতে বাড়তি কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আঙিনায় বা বড় বড় গাছের নিচে অধিক ছায়াযুক্ত জায়গায় খুব সহজেই লটকনের আবাদ করা যায়। কলমে লাগানো গাছে সাধারণত চার বছর বয়স থেকে ফল আসা শুরু হয়। অবস্থাভেদে গাছের বয়সের ওপর ভিত্তি করে গাছপ্রতি চার থেকে ১২০-১৩০ কেজি পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে। একটানা ১৮-২০ বছরের গাছে সর্বোচ্চ ফলন হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লটকন গাছের কাণ্ড থেকে মাথা পর্যন্ত ফল ধরে। এটি খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশীয় বৃক্ষ। আমাদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এ বৃক্ষটিকে তালিকাভুক্ত করে এর ব্যাপক প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। কারণ এটি একদিকে মানুষেরও খাদ্য আবার বন্য প্রাণীও এই ফল খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।'
পরিচিতি : অঞ্চলভিত্তিক কিছু নামে লুকানো রয়েছে লটকনের পরিচিতি। চট্টগ্রামে এর নাম 'হাড়ফাটা'। বৃহত্তর সিলেটবাসী 'ডুবি' বা 'বুবি' নামে চেনে ফলটিকে। আবার ময়মনসিংহে এর নাম 'কানাইজু'। এ ছাড়া 'লটকা', 'লটকাউ', 'কিছুয়ান'_এসব নামেও ফলটি আঞ্চলিকতার মায়াজলে বাঁধা রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে।
প্রাপ্তিস্থান : নরসিংদী জেলার সর্বত্র কমবেশি লটকনের ফলন হয়। তবে বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা ও পলাশ উপজেলার মাটি লটকন চাষের উপযোগী। এ চার উপজেলার লটকন আকারে বড়, দেখতে হলদে মসৃণ আর স্বাদে সুমিষ্ট। এ অঞ্চলের কৃষকরা মনে করেন, যেকোনো কৃষি ফলনের চেয়ে লটকন চাষে লাভও বেশি। কৃষকরাও লটকন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে তাঁত ও কলার জন্য বিখ্যাত নরসিংদী হালে পরিচিত হয়ে উঠেছে লটকনের রাজ্য হিসেবে। নরসিংদী ছাড়াও টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, সিলেট প্রভৃতি এলাকায় ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে।
লটকন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। গবেষকরা বারি-১ নামে আমাদের দেশে চাষ উপযোগী লটকনের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। বাজারে লটকনের খুচরা মূল্য ৬০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। এক কেজিতে আকারভেদে ২৫ থেকে ৭০টি পর্যন্ত লটকন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, নরসিংদী এলাকায়ই এখন সবচেয়ে বেশি লটকন চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এই ফলের গাছ। লটকন গাছ পরিবেশের জন্যও ভালো।
পুষ্টি ও ভেষজ গুণ : টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত লটকন খাদ্যমানের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে লটকনের পুষ্টিগুণ প্রচুর। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে খাদ্যশক্তি রয়েছে ৯১ কিলোক্যালরি, যা আমলকীর প্রায় পাঁচ গুণ। এ ছাড়া আমিষ রয়েছে ১ দশমিক ৪২ গ্রাম, স্নেহ শূন্য দশমিক ৪৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৯ গ্রাম, ভিটামিন বি-১ শূন্য দশমিক ০৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক ১৯ মিলিগ্রাম, লৌহ শূন্য দশমিক ৩ মিলিগ্রামসহ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। তাই বলা হয়ে থাকে, রোজ দু-চারটি লটকন আমাদের দেহের ভিটামিন সি-এর চাহিদা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। এ ফল খেলে হঠাৎ ওঠা বমি বমি ভাব দূর হয়। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ করতেও সক্ষম। শুকনো লটকন পাতার গুঁড়ো খেলে ডায়রিয়ার প্রকোপ ও মানসিক চাপ দূর হয়।

No comments:

Post a Comment