Sunday, July 03, 2011

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ৯০ বছর উৎসবের রঙে রাঙা ক্যাম্পাস

টিপটিপ বৃষ্টি, ঢাকঢোলের মধুর বাদ্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদচারণ, জাতীয়সংগীত এবং কেক কাটার মধ্যদিয়ে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালনের আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার আয়োজিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় সাবেক শিক্ষার্থীদের উল্লাসমুখর উপস্থিতিও পুরো পরিবেশকে করে তোলে আরো প্রাণবন্ত। গৌরবদীপ্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে যেন উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। অন্যদিকে আলোচনা সভায় বক্তারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই থেকে ৯০টি বছর পেরিয়ে ৯১ বছরে পদার্পণ করল এ প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশ ভাগের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসক পতনের আন্দোলন এবং সব শেষে ২০০৭ সালের আগস্টে সেনা কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১২টি বিভাগ ও ৮৭৭ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিভাগ হয়েছে ৭৭টি।
৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল পুরো ক্যাম্পাস সাজানো হয় মনোরম সাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো আকর্ষণীয় আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের কর্মসূচির মধ্যে ছিল আলোচনা সভা ও স্মৃতিচারণা, শোভাযাত্রা, কেক কাটা, গবেষণা ও আবিষ্কারবিষয়ক প্রদর্শনী,
বিতর্ক, প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ, প্রীতি ভলিবল ম্যাচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি।
সকাল ৯টায় জাতীয়সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা এবং হলগুলোর পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে বেলুন ও ৯টি পায়রা অবমুক্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ, কোষাধ্যক্ষ ড. মীজানুর রহমানসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এরপর উপাচার্য ৯০ পাউন্ডের একটি কেক কাটেন। পরে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়। এর আগে শিক্ষার্থীরা সবকটি হল থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের মল চত্বরে মিলিত হন।
জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা : এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল 'জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা'। সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে এ বিষয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাবেক উপাচার্যসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 'জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা' শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন, অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশরাফ উদ্দিন প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'আজকের বাস্তবতা হলো_রাষ্ট্র পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তন হয়নি। ভয়াবহ বৈষম্য ও বেকারত্ব বিরাজ করছে। এগুলো থেকে মুক্তি পেতে যে চেতনা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই লক্ষ্যে কাজ করবে_এটাই প্রত্যাশা।'
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, 'এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে_মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষারীতি বাস্তবায়ন করা।'
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে।'
'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে অবদান রেখেছে পৃথিবীতে এরকম বিশ্ববিদ্যালয় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না' বলে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, 'কিন্তু গবেষণার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের গ্রন্থাগারের সমস্যা, ল্যাবরেটরি নেই। এর জন্য চাই প্রয়োজনীয় ব্যয়বরাদ্দ। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অনেক মেধাবী।'
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, 'আমরা বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। উচ্চশিক্ষার সমৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন জড়িত। উচ্চশিক্ষা হচ্ছে এমন মাধ্যম, যা দিয়ে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়।'
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'একজন মানুষের মধ্যে যদি মনুষ্যত্ববোধ না জন্মায়, তাহলে সে মানুষ হয় না। আমরা শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু ডিগ্রি কিংবা কৃতিত্বের সঙ্গে ফার্স্টক্লাস পাওয়া, কেবল সনদ পাওয়া কোনো লক্ষ্য নয়। কিন্তু এগুলোই এখন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
আইনস্টাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে উপাচার্য আরো বলেন, 'প্রশিক্ষিত কুকুর সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়; প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করাই কাজ। এই বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে।'
ড. এ কে আজাদ বলেন, 'অগ্রগতি চাইলে, গণতন্ত্র চাইলে, শান্তি চাইলে উচ্চশিক্ষায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। বরাদ্দ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে গবেষণা করবে?'
শিক্ষায় গত বছরের তুলনায় এ বছর বরাদ্দ আরো কমে গেছে বলে উল্লেখ করে এ কে আজাদ আরো বলেন, 'অন্যান্য দেশে শিক্ষায় জিডিপির সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২.৪ শতাংশ। দেশের উচ্চশিক্ষায় এতসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।'
আলোচনা সভা শেষে দুপুর আড়াইটায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির আয়োজনে প্রাণবন্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা পদক প্রদর্শনী, বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নিজ নিজ বিভাগ ও অনুষদে বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান; বিকেল পৌনে ৩টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে গ্রান্ডমাস্টার্স র‌্যাপিড দাবা প্রতিযোগিতা, সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রীতি ফুটবল এবং বিকেল ৫টায় প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় টিএসসি মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে সংগীত বিভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তন প্রাঙ্গণে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপি প্রদর্শনী এবং বিকেল ৪টায় প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন মল চত্বরে ব্যান্ডসংগীত পরিবেশন করা হয়। এতে সংগীত পরিবেশন করে ব্যান্ড দল লালন, দলছুট ও মনোসরণি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী নাট্যমেলার আয়োজন করে নাট্যকলা বিভাগ। এ ছাড়া এ বিভাগের উদ্যোগে মঞ্চস্থ করা হয়েছে ব্রেখটের নাটক 'সিদ্ধান্ত'।

No comments:

Post a Comment