Sunday, July 03, 2011

তত্ত্বাবধায়কের ২০ বছর by অমিতোষ পাল

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাস সময়কেই অন্তর্বর্তীকাল হিসেবে গণ্য করা হয় তখন; যদিও সংবিধানে 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার' শব্দগুলো ছিল না। সে সময় রাষ্ট্রপতির পরামর্শক্রমে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিল। আর ওই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে না পারার বিধান ছিল বাহাত্তরের সংবিধানেও। গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে, সেখানেও অনুরূপ অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান রাখা হয়েছে। তবে কোনো নাম দেওয়া হয়নি। আর এর মাধ্যমে বিলুপ্ত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় দফায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তবে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসন শেষে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয়েছিল ১১ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার। তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে আগের পদে ফিরে যান মো. সাহাবুদ্দীন। পরে গেজেট প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের নাম দেওয়া হয়েছিল নির্দলীয় 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার'।
নব্বইয়ের ওই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে জায়গা করে নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের একটি অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা। এরপর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দিয়ে গত ২০ বছরে পাঁচটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। ওই পাঁচটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ দেশে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একটি সরকার নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয়। নির্ধারিত মেয়াদও সম্পন্ন করতে পারেনি ওই সরকার। আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের পরিবর্তে ক্ষমতায় থেকেছে দুটি বছর।
১৯৯১ সালে বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নিতে শুরু করে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন বিএনপি অবস্থান নেয় এর বিপক্ষে। পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় একটি ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয় বিএনপি। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে সংবিধানে যুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি।
সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। ২০০৬ সালের ১২ জুন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তিন মাসের মধ্যেই বিদায় নেন তিনি। পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন বিচারপতি লতিফুর রহমান। তিনিও নির্বাচন করে ফিরে যান। ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এই জোট সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৭ করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নতুন জটিলতা। ওই ঘটনায় বেঁকে বসে আওয়ামী লীগসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দল। তারা অভিযোগ করে, তখনকার প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্দেশ্য নিয়েই বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়ানো হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে বিচারপতি কে এম হাসানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও তোলা হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর একজন খুনির আত্মীয় হলেন কে এম হাসান। এসব নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক প্রচার ও আন্দোলন। ফল হিসেবে একসময় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের কয়েকটি বিকল্পকে ডিঙিয়ে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন। তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয় ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধেও বিএনপির হয়ে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ ওঠে। কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেন। ওই সময় দেশের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি ঘোষিত নির্বাচন আর তাঁর পক্ষে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে জারি হয় জরুরি আইন। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন ফিরে যান রাষ্ট্রপতির পদে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা : ১৯৯১ সালে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। উপদেষ্টারা ছিলেন বিচারপতি এম এ খালেক, কফিলউদ্দিন মাহমুদ, ফখরুদ্দীন আহমদ, রেহমান সোবহান, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আলমগীর এম এ কবীর, এ কে এম মুসা, ডা. এম এ মাজেদ, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, এ বি এম জি কিবরিয়া, কাজী ফজলুর রহমান, ইমাম উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, এম আনিসুজ্জামান ও চৌধুরী এম এ আমিনুল হক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬ : প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। উপদেষ্টা_সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক মো. শামসুল হক, সেগুফতা বখত চৌধুরী, এ জেড এ নাসিরউদ্দিন, মেজর জে. (অব.) আবদুর রহমান খান, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ড. নাজমা চৌধুরী ও ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০১ : প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান। উপদেষ্টা_সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী, এ এস এম শাহজাহান, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, এ কে এম আমানুল ইসলাম চৌধুরী, এম হাফিজ উদ্দিন খান, ব্রিগেডিয়ার (অব.) অধ্যাপক আবদুল মালেক, মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী ও রোকেয়া আফজাল রহমান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৬ : প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। উপদেষ্টা_ড. আকবর আলি খান, লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরী, সি এম শফি সামী, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সফিকুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মইনউদ্দিন আহমেদ, রুহুল আমিন চৌধুরী, ড. শোয়েব আহমেদ, বিচারপতি ফজলুল হক, আজিজুল হক, ধীরাজ কুমার নাথ, মাহবুবুল আলম, সুফিয়া রহমান ও ইয়াসমিন মুরশেদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ : প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। উপদেষ্টা_মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, আনোয়ারুল ইকবাল, ড. চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম, ড. এ এম এম শওকত আলী, এ এফ হাসান আরিফ, মেজর জে. (অব.) গোলাম কাদের, রাশেদা কে চৌধুরী, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, তপন চৌধুরী, গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মতিউর রহমান ও আইয়ুব কাদরী।

No comments:

Post a Comment