Sunday, July 03, 2011

৯০ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস, সেটা গৌরবের ইতিহাস। এই বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করেছে, সেটা অসাধারণ। ১৯২১ সালের পরে আমাদের দেশে আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কাজ করেছে। এর কারণ কেবল এটা নয় যে এর আয়তন বড় অথবা এখানে শিক্ষার্থীসংখ্যা অধিক, শিক্ষকও প্রচুর। মূল কারণ হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে যে ভূমিকা পালন করেছে, সেই ভূমিকা আমাদের দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে পালন করার সুযোগ ঘটেনি। এমনও দেখা যাবে, পৃথিবীর খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে, যাকে এত বড় দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এক হিসেবে অনন্য সাধারণ। আমরা যদি শিক্ষার দিকটা দেখি, যেটাকে আমি বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান বলছি, তাহলে দেখতে পাবো যে এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর পেছনের কারণটা ছিল রাজনৈতিক। এবং একটা রাজনৈতিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ যখন রদ হয়ে যায় ১৯১১ সালে, তখন পূর্ববঙ্গকে একটা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে প্রতিশ্রুতি পালন হলো ১৯২১ সালে এসে। এই যে এত দিন বিলম্ব হলো, এর পেছনে একটা কারণও ছিল। এর বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদী শক্তিও গড়ে উঠেছিল। ধরা যাক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এটা একক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কাজেই তারা চাইত না আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। এমনকি ঢাকা শহরেও একটা বিরুদ্ধ শক্তি ছিল; এখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক যারা এটা চায়নি। কেননা এই বিশ্ববিদ্যালয় হলে মুসলিম সম্প্রদায় একটা সুযোগ পাবে_এ সুযোগ পাওয়াটা তারা পছন্দ করেনি।
দেখা গেল এই বিশ্ববিদ্যালয় বেশ সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদানের কথা বলছিলাম, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখা যাবে যে এখান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে গেছেন; তাঁরা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছেন। তাঁদের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা একাত্মতা বোধ আছে। এই যে অবদান_আমরা কেবল সেটাকে শিক্ষাগত অবদান বলব না; এটাকে সামাজিক অবদান বলব। মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশে এ বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করেছে, সেটা অসাধারণ। এটা যেমন মধ্যবিত্ত বিকাশের সঙ্গে জড়িত আবার সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গেও। এখান থেকে জ্ঞানের যে চর্চা হলো; তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতাও লক্ষ করা গেল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল এখানকার ছেলেমেয়েরা। ঢাকা শহরে যেমন অংশগ্রহণ ছিল, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল। পরে এখানে সাম্প্রদায়িক বিরোধটা দেখা গেল। মধ্যবিত্তের বিরোধ; এটা সাধারণ মানুষের বিরোধ নয়।
যখন পাকিস্তান আন্দোলনটা হচ্ছে, তখন মুসলিম মধ্যবিত্ত পাকিস্তান আমলটাকে সমর্থন করল। এটা গেল সাতচলি্লশের আগের ঘটনা। পরে দেশভাগ হলো। এটা ছিল মূলত ক্ষমতা হস্তান্তর করা। পরে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা ঘটল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পরে স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো। চুয়ান্ন সালে নির্বাচন। ছেষট্টির আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভুত্থ্যান এবং চূড়ান্ত পরিণতি হলো মুক্তিযুদ্ধে। ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা নিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পতাকা উত্তোলন করা হলো। আবার কালরাতে হানাদার বাহিনীরা নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাল। প্রাণ দিল ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। পরবর্তী সময়ে আলবদররা দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য আমাদের শিক্ষকদের হত্যা করল। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্য দিতে হয়েছে।
পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে '৭৩-এর অধ্যাদেশ হলো। এটা একেবারেই গণতান্ত্রিক ছিল। এটা ছিল দীর্ঘদিনের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠত না যদি বাংলাদেশ না হতো। গণতান্ত্রিক চর্চায় দৃষ্টান্ত রচিত হলো, কিন্তু সেটা আর ধরে রাখা যায়নি। এ দেশে বিভিন্ন সামরিক সরকার, স্বৈর সরকার, নির্বাচিত স্বৈর সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ শুরু করে দিল। ফলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বেড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা। কিন্তু এতেও রাষ্ট্র আর আগ্রহ প্রকাশ করেনি। আমাদের গ্রন্থাগারে দেখা যায়, সব বইয়ের ৭৫ শতাংশই ইংরেজিতে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জীবন স্তিমিত হয়ে এসেছে। হল সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে স্তব্ধ হয়ে গেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। আগে দেখেছি ক্যাম্পাস অনেক জীবন্ত ছিল। এখন নেই। মেধা অনেকটা বাইরেও চলে গেছে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য গেলেও আর ফিরে এল না।
তৃতীয় আর একটি ঘটনা ঘটল যে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ভূমিকা রাখবে। তরুণরা আদর্শবান হবে। কিন্তু সোভিয়েত পতনের পরে পুঁজিবাদী আক্রমণ বেড়ে যেতে থাকল। মুনাফা লাভের সুযোগ বেড়ে গেল। ফলে সেই স্বপ্নটা ধরে রাখা গেল না। বাস্তবায়ন তো দূরের কথা।
তবে আশার কথা, ছাত্ররা সচেতন হয়ে উঠছে। আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার চেতনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা দেশেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য যূথবদ্ধ চেষ্টা করবে_এটাই প্রত্যাশা।
শ্রুতিলিখন- নুরে আলম দুর্জয়

No comments:

Post a Comment