Sunday, July 03, 2011

মতিউর রহমান কি আইনের ঊর্ধ্বে? by কালের কণ্ঠ ওয়েব

১ আগস্ট। দেশের ইতিহাসের একটি কালো দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।
এ ঘটনার বিচার হয়নি এখনো। দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে জানা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ওই দিন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। কিন্তু গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় অল্পের জন্য বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
জোট সরকার আমলে এ ঘটনার তদন্ত হয়। তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদন্ত হয়। সেখানে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। চার্জশিট হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নেতা মুফতি হান্নান, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, আরো জঙ্গি সদস্যসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের তদন্তে ঘটনার পেছনের শক্তি কারা, তা উদ্ঘাটিত না হওয়ায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার মামলার অধিকতর তদন্ত দাবি করা হয়। আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত চলছে।
গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দুটি মামলার উদ্ভব হয়। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা। দুটি মামলারই অধিকতর তদন্ত করছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ। তিনি বারবার অধিকতর তদন্তের সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়েছেন আদালতের কাছ থেকে। তবে এখন তদন্ত চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে বলে তদন্ত কর্মকর্তার সর্বশেষ একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
তদন্ত নিয়ে সংশয়
এ ঘটনাটির তদন্ত নিয়ে বারবার সংশয় থেকে যায়। জোট আমলে জজ মিয়া নামের এক নিরীহ ব্যক্তির স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। ওই স্বীকারোক্তিতে আওয়ামীপন্থী বেশ কিছু সন্ত্রাসীকে জড়ানো হয়। তদন্তে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে আওয়ামী লীগই ঘটনাটি ঘটিয়ে সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেয়েছে। কিন্তু ওই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় মুফতি হান্নান জবানবন্দি দেওয়ার পর। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের তদন্তে ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের নাম উঠে আসে। কিন্তু ঘটনার ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা হয়নি। ওই সময় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, এ ঘটনায় সরকারের প্রভাবশালীরা জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে আবার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্তও করা হয়।
আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে। কিন্তু এবারের তদন্তেও এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এখনো পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।
তিনি কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন?
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ওই বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন ধারাছোঁয়ার বাইরে। এর কারণ কী তা স্পষ্ট নয়। জানা গেছে, সিআইডি কয়েকবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের চিন্তাভাবনা করেও সরকারের সবুজ সংকেত না পেয়ে পিছিয়ে যায়।
গত ১৯ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেস ব্রিফিং করেন। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের চমকে দিয়ে তিনি যে তথ্যটি উপস্থাপন করেন, তা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর। তিনি সরাসরি বলেন, ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সঙ্গে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেই নন, ন্যাশনাল কমিটি ফর ইন্টেলিজেন্স কো-অর্ডিনেশনের (এনসিআইসি) সমন্বয়ক হিসেবেও তিনি বক্তব্য পেশ করেন এবং বলেন, 'দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার চক্রান্ত চলছে। এ চক্রান্তের সঙ্গে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক জড়িত। ওই পত্রিকায় ৪০ দিনে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৪৮টি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদকের কর্মকাণ্ডে অনেকেরই প্রশ্ন্ন, তিনি কি পার্ট অব জঙ্গি? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে তাঁর কী লাভ? র‌্যাবের সফলতায় তিনি কি মনঃক্ষুণ্ন? আগেরও কিছু ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্রব রয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় অভিযুক্ত এক জঙ্গি তাদের সঙ্গে ওই সম্পাদকের বৈঠক হয়েছে বলে জানিয়েছে। সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স তাঁকে চক্রান্তকারী হিসেবেই শনাক্ত করে। এসব কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে প্রধানমন্ত্রী এখনো তা চান না।'
এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের জন্য কালের কণ্ঠকে চিহ্নিত করা হয়েছে 'হলুদ সংবাদপত্র' হিসেবে এবং সেটা করেছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। সুদীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের যে সম্পাদক সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তাঁকে 'হলুদ সম্পাদকের এবং অপসাংবাদিকতার' দায়ে অভিযুক্ত করে সতর্ক করে দেওয়া হলো। আর সেদিন এই প্রেস ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনেরই যেন প্রতিধ্বনি তোলা হলো।
গত বছরের ১০ মে প্রকাশিত সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, তাঁর ভাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার হোতা জঙ্গি নেতা তাজউদ্দিনের সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। গোয়েন্দারা যে তাজউদ্দিনকে খুঁজছেন, সেটা মতিউর রহমান তাঁকে আগাম জানিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছিলেন। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে এসব তথ্য লেখা হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক উপমন্ত্রী পিন্টুর একটি জবানবন্দির ভিত্তিতে।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে মামলা ঠুকে দেন। সেই মামলা বিচারের পর প্রেস কাউন্সিলের দেওয়া রায়ে বলা হয়, কালের কণ্ঠ হলুদ সাংবাদিকতা করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার প্রেস ব্রিফিংয়ে একই অভিযোগের প্রতিধ্বনি ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এল, তাহলে প্রেস কাউন্সিল কেন কালের কণ্ঠকে হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত করল?
অবশ্য প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনার সময় অভিযুক্ত পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদকের নাম বলেননি। তবে কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদন, প্রথম আলো সম্পাদকের মামলা এবং প্রেস কাউন্সিলের রায়ের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সব সাংবাদিকের কাছেই পরিষ্কার হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা কোন সম্পাদকের কথা বলেছেন। জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত এই সম্পাদক যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, তা আর কারো বুঝতে বাকি রইল না।
তারিক আহমেদ সিদ্দিক যেহেতু একাধারে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা এবং এনসিআইসির সমন্বয়ক, কাজেই তাঁর মুখ থেকে যখন এ অভিযোগ আসছে, তাই ধরে নিতে আর কোনো দ্বিধা নেই যে, এ অভিযোগের ভিত্তি অনেক দৃঢ়। তিনি নিশ্চিত হয়েই অভিযোগ তুলেছেন এবং তাঁর বক্তব্য সরকারেরই বক্তব্য।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা এবং এনসিআইসির সমন্বয়ক মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের এই বক্তব্য দেশের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য অবশ্যই সরকারি বক্তব্য। তিনি তাঁর বাসায় বা অনুষ্ঠানে এ বক্তব্য দেননি। এটাকে ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকারের এমন স্বীকারোক্তির পরও ওই পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ না করে পুলিশ এমন একটি বর্বর গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিট দিতে যাচ্ছে কেন? তাহলে এই চার্জশিটও কি ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে? এ প্রশ্নটি এখন সংশ্লিষ্ট সবার।
সরকারের এমন বক্তব্যের পরও ওই সম্পাদক ধারাছোঁয়ার বাইরে কেন? তাঁর পেছনে কোন শক্তি রয়েছে যে, তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে।
উপদেষ্টার বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার চক্রান্ত!
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা যে পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সংশ্লিষ্টতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছেন, দেশের মানুষ মনে করে, যথেষ্ট তথ্য-প্রমানসহ তিনি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এমন একটি সংবাদ সম্মেলনের পরও অভিযুক্ত ওই সম্পাদক ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন_এটা মানতে পারছে না দেশের সচেতন মানুষ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, একটি মহল ওই সম্পাদককে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করতেই ওই সম্পাদককে জিজ্ঞাসাবাদ না করতে বাধা সৃষ্টি করছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিট দেওয়ার পরে চক্রান্তকারী ওই মহল যাতে বলতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মিথ্যা বলেছেন।
আইনের নিজস্ব গতি নেই!
আইনের মূল বক্তব্য হচ্ছে_আইন তাঁর নিজস্ব গতিতে চলবে। বর্তমান সরকার আমলে লিমনের ওপর র‌্যাবের গুলিবর্ষণের ঘটনা একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। র‌্যাবকে অভিযুক্ত করে মামলা হয়েছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে সুশীল সমাজসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার। কিন্তু র‌্যাবের পক্ষে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ঊধ্বর্তন মহল র‌্যাবকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে লিমনের বিরুদ্ধে র‌্যাবের বিতর্কিত মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বলেছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
শুধু লিমনের বিষয়ে নয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়েছে। এসব মামলার বিষয়েও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।
কিন্তু ওই সম্পাদকের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ থাকার পরও তাঁকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা নেই। এক সাবেক উপমন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে এই সম্পাদকের সখ্য সর্বজনবিদিত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাবেক উপমন্ত্রীর এই ভাই হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড সরবরাহ করেন। এ ছাড়া হামলার বিষয়ে আগে থেকেই ওই সম্পাদককে অবহিত করেন সাবেক উপমন্ত্রীর ভাই। সাবেক উপমন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেন আলোচিত সম্পাদকের অধীন এক রিপোর্টার। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে এই রিপোর্টার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলে আলোচিত সম্পাদক তাঁকে পুঁজি করে বাণিজ্য করেন। এ রিপোর্টারেরও ২১ আগস্ট গেনেড হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনিও হামলার বিষয়টি আগেই জানতেন বলে জানা গেছে। এখন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আলোচিত সম্পাদক, সাবেক উপমন্ত্রীর ভাই ও সেই রিপোর্টারকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে কি বলা যাবে_আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে?
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী ওই সম্পাদকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তা হলো_এক. তাঁর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দুই. তাঁর জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিন. তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার চক্রান্তকারী। এসব অভিযোগ অবশ্যই মারাত্মক। ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চক্রান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। আর জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তাঁকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সোপর্দ করা যায়। তাহলে কেন আইনের হাতে ওই সম্পাদককে সোপর্দ করা হচ্ছে না? প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকার সম্পাদক বলেই কি তিনি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন। তাহলে কি বলতে হয়, আইনের নিজস্ব কোনো গতি নেই!
ওই সম্পাদকের কর্মকাণ্ড
অপসাংবাদিকতার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই দৈনিকটি ও তাঁর সম্পাদকের। কখনো তিনি ক্ষমা চেয়েছেন মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে, আবার কখনো দুঃখ প্রকাশ করেছেন অবৈধ অগণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষ নেওয়ার কারণে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির নানা বাঁকে ওই সম্পাদক ও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার অবস্থান ছিল অস্বচ্ছ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজনীতি থেকে রাজনীতিকদের উচ্ছেদ করে সুশীল নাগরিকদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। দেশকে অকার্যকর ও ব্যর্থ-তত্ত্ব দিয়ে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতারোহণে উৎসাহ জুগিয়েছে তিনি ও তাঁর পত্রিকা।
২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি এটিএন বাংলার 'মিট দ্য প্রেস' অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেশে জরুরি অবস্থার পক্ষে তিনি সাফাই গান, সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি ভূমিকা রাখার উসকানি দেন। এমনকি বিদেশি রাষ্ট্র, বিশেষ করে দাতা দেশগুলোর ভূমিকারও প্রশংসা করেন তিনি। এটিএন বাংলার স্টুডিও থেকে সরাসরি সমপ্রচারিত ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল কোনো এক ষড়যন্ত্রকারী নেপথ্যশক্তির তল্পিবাহক হিসেবে। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই 'সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই'_শিরোনামে তিনি এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, 'দেশের সব পরিবর্তনের পেছনে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তাহলো সশস্ত্র বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগই এখন পর্যন্ত প্রধান। এসব পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা বড় নয়।' সব মন্তব্য প্রতিবেদনেরই সারবস্তু ছিল অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক শক্তিকে উসকে দেওয়া।
রাজনীতিকদের হেনস্তা করে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে একের পর এক নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে পত্রিকাটি জরুরি অবস্থার সময় রাজনীতিকদের অপদস্থ করে।
২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থানকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখে। এর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি সব মহল, বিশেষভাবে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন বলে লেখায় উল্লেখ করা হয়।
২০০৭ সালের ১১ জুন 'দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে' শিরোনামে তাঁর পত্রিকায় এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, 'দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পটভূমিতে দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ কী হবে, কী হওয়া উচিত তা নিয়ে এখন আবার ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁরা কি রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন?' বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বলতে পারি, গত ১৬ বছরে আপনাদের দুজনের ক্ষমতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির অনেক অত্যাচার দেশবাসী নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। দয়া করে আপনারা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন নেতৃত্বকে সামনে আসার এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিন। দুর্নীতি আর অপশাসন ছাড়া আপনাদের দেশকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই!'
বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন ওই সম্পাদক। ২০০৮ সালের ১০ মে 'নির্বাচন চাই, ১১ জানুয়ারির আগের অবস্থায় ফিরতে চাই না' শিরোনামে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে বারবার একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালান তিনি।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই পত্রিকার রম্য ম্যাগাজিনে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন ও মুসলমানদের উসকে দেন। একপর্যায়ে পত্রিকাটি এই কার্টুন প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ও ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়।
ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সভাপতিত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে সালিসি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ওই সম্পাদক করজোড়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের তৎকালীন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান।
সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন ওই সম্পাদক। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিক সমিতির (নোয়াব) নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ওই সম্পাদক বলেন, 'ওয়ান-ইলেভেনপরবর্তী আমাদের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এ জন্য আমরা দুঃখিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটা করা ছাড়া তখন আমাদের উপায় ছিল না। তবে ওই ভূমিকা ভুল ছিল।' বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।

No comments:

Post a Comment