Sunday, January 23, 2011

অপরাজেয় সেই ট্যাংক

কাত্তরের রণাঙ্গনে মিত্র বাহিনীর অপরাজেয় সেই ঐতিহাসিক ট্যাংকটি কলকাতার ব্রিগেড মাঠে সংরক্ষিত রয়েছে। যুদ্ধজয়ী এ ট্যাংকটি দেখতে অনেকেই সেখানে যান।

রেইনট্রির ছায়ায় দাঁড়িয়ে ট্যাংক দেখেন, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড এ ট্যাংকটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে উপহার দিয়েছিল। এর পর থেকে যত্ন করে ট্যাংকটি ঐতিহাসিক গড়ের মাঠের পাশে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবদান কম নয়। এক কোটি শরণার্থীর খাবারের পাশাপাশি ভারত সরকার তাদের সেনাবাহিনীকে রণাঙ্গনে পাঠায়। অনেক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মার্চ মাসেই বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। বিএসএফ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী শিবির চালু করা হয়। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। ওই শরণার্থীর পেছনে যুদ্ধকালীন ৯ মাসে ভারত সরকারের খরচ প্রায় হয় ৩৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যায় ২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। (সূত্র : আনন্দ বাজার)। ভারতের সেনাবাহিনী গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল ওবানের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয় মুজিব বাহিনী। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠনের পর এর অধিনায়ক করা হয় লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে। এর পর যৌথ বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। ৬ ডিসেম্বর যশোর জেলাকে শত্রুমুক্ত করে যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে যৌথ বাহিনী রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করে। বিকেলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে যৌথ বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষে লে. জে. নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন দেশ বাংলাদেশ। কলকাতার সংরক্ষিত সেই ঐতিহাসিক অপরাজেয় ট্যাংকের মতো একাত্তরের রণাঙ্গনের কোনো ট্যাংক, বিমান, কামান দেশে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

একজন ডাকাতের কাল্পনিক সাক্ষাৎকার

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে ডাকাতি বেশ বেড়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা একজন ডাকাতের কাল্পনিক সাক্ষাৎকার পাঠকের জন্য উপস্থাপন করছি।
প্রশ্ন : আপনার নাম?
ডাকাত : আমার নাম হাতকাটা হাবলু।
প্রশ্ন : হাতকাটা হাবলু কেন?
ডাকাত : আমার নাম আসলে হাবিবুর রহমান হাবলু। একবার ডাকাতি করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েছিলাম। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা আমার হাত কেটে দিয়েছিল। সেই থেকে আমার নাম হাতকাটা হাবলু।
প্রশ্ন : এ নামটি আপনার কেমন লাগে?
ডাকাত : খুব ভালো লাগে।
প্রশ্ন : কেন?
ডাকাত : কারণ হাতকাটা হাবলু নাম শুনলেই সবাই ভয় পায়। কোনো বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে যখন বলি, আমি হাতকাটা হাবলু, যা আছে সব দিয়ে দে। অমনি মানুষ সব দিয়ে দেয়।
প্রশ্ন : শুনেছি, আপনি অনেক টাকার মালিক। এর পরও ডাকাতি কেন করছেন?
ডাকাত : ডাকাতি আমার পেশা। দীর্ঘ ৩০ বছরের পেশা। এটা কিভাবে ছাড়ি বলেন।
প্রশ্ন : ৩০ বছর ধরে ডাকাতি করেন?
ডাকাত : জি।
প্রশ্ন : এ পর্যন্ত কয়বার ধরা পড়েছেন?
ডাকাত : একবার। তখনই আমার হাতটা কেটে দিয়েছিল।
প্রশ্ন : মাত্র একবার!
ডাকাত : জি। তখনো ধরা পড়তাম না। সেটা ছিল প্রথম দিকের ঘটনা।
প্রশ্ন : এখন ধরা পড়ছেন না কেন?
ডাকাত : এখন তো আমি অনেক অভিজ্ঞ। তা ছাড়া পুলিশকে ঠিকঠাকমতো টাকা-পয়সা দিচ্ছি। কাজেই কোনো সমস্যা নেই।
প্রশ্ন : প্রথমবার কি পুলিশকে টাকা দেননি?
ডাকাত : এ কাজ করতে গেলে যে পুলিশকে টাকা-পয়সা দিতে হয় তা বুঝতে পারিনি।
প্রশ্ন : পুলিশকে কখন টাকা দেন, ডাকাতির আগে না পরে?
ডাকাত : পুলিশের টাকা কি বাকি রাখা যায়? আগেই দিতে হয়।
প্রশ্ন : যদি ডাকাতি করতে ব্যর্থ হন_
ডাকাত : তার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আগে থেকেই ঠিক করে নিই, কোন বাসায় ডাকাতি করব! তারপর পুলিশকে জানাই। পুলিশই তখন আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
প্রশ্ন : তাই নাকি!
ডাকাত : জি।
প্রশ্ন : ডাকাতি করতে গিয়ে দেখলেন, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার কিছু পেলেন না। তখন কী করেন?
ডাকাত : আপনি কি মনে করছেন আমরা না জেনে যাই? জেনেশুনেই যাই।
প্রশ্ন : কিভাবে জানেন?
ডাকাত : গোয়েন্দা আছে না! আমার বেতনভুক্ত গোয়েন্দা দল আছে। তারা সারা শহর চষে বেড়াচ্ছে। আগে বাসাবাড়ি টার্গেট করে গোয়েন্দা লাগাই। কী পরিমাণ টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না আছে তা জেনে তারপর ডাকাতি করতে যাই।
প্রশ্ন : তার মানে ডাকাতি করেই সংসার চালান?
ডাকাত : জি।
প্রশ্ন : পড়াশোনা কিছু করেছিলেন?
ডাকাত : জি। ডিগ্রি পাস করেছি। এর পর থেকেই ডাকাতি পেশায়।
প্রশ্ন : আপনার কয় ছেলেমেয়ে?
ডাকাত : দুই ছেলে দুই মেয়ে।
প্রশ্ন : তারা কী করে?
ডাকাত : বড় দুই ছেলে আমেরিকায় থাকে। তারা সেখানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ওখানেই পড়াশোনা করেছে। ছোট দুই মেয়ে ডাক্তার। তাদের দুজনকেই দুই ডাক্তারের কাছে বিয়ে দিয়েছি। তারা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
প্রশ্ন : বলেন কী!
ডাকাত : কেন, বিশ্বাস হয় না?
প্রশ্ন : বিশ্বাস কিভাবে হবে? আপনি ডাকাতি করেন, আপনার ছেলেমেয়ে তো সে রকমই হওয়ার কথা।
ডাকাত : জি না। আমি এ ব্যাপারে খুবই কঠোর ছিলাম। আমি জানি, আমার পেশাটা খারাপ। আমার ছেলেমেয়ে এ পেশায় আসুক সেটা আমি চাইনি। তাই তাদের কঠোর অনুশাসনে মানুষ করেছি।
প্রশ্ন : আপনার কথা শুনে আমি অবাক হচ্ছি।
ডাকাত : অবাক হওয়ারই কথা।
প্রশ্ন : আপনার ছেলেমেয়েরা জানে, আপনি ডাকাত?
ডাকাত : আগে জানত না। এখন জানে।
প্রশ্ন : তারা কিছু বলে না?
ডাকাত : বলে। কিন্তু আমি কিছুতেই ছাড়তে পারছি না। আমার তো এখন কোনো কিছুরই অভাব নেই। তার পরও ছাড়তে পারছি না। আমাকে বলতে বলতে ছেলেমেয়েরাও বিরক্ত।
প্রশ্ন : ডাকাতি করতে গিয়ে মারধর কেন করেন?
ডাকাত : আমি কাউকে মারধর করি না। করার প্রয়োজন হয় না। আমার নাম শুনলেই সব কিছু দিয়ে দেয়। তবে অনেকে মারধর করে। এটা খুব খারাপ। মারধর কেন করবে? এ দেশের মানুষ খুব ভালো। ভয় দেখালেই সব দিয়ে দেয়।
প্রশ্ন : ইদানীং ঢাকা শহরে ডাকাতি খুব বেড়েছে। কেন?
ডাকাত : বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ডাকাতি বেড়েছে।
প্রশ্ন : আপনি যেমন পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এ রকম অনেকেই হয়তো এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে।
ডাকাত : কিছু তো পেশাদার ডাকাত আছেই। আবার অনেকে দায়ে ঠেকে ডাকাতি করছে।
প্রশ্ন : ডাকাতি বন্ধের জন্য কী করা উচিত?
ডাকাত : পুলিশের তদারকি বাড়াতে হবে এবং তাদের বখরা খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এটা না করতে পারলে কোনো দিনও ডাকাতি বন্ধ হবে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

নদ-নদী দখলমুক্ত হোক

চ্চ আদালত ঢাকার চারপাশের নদীগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে নির্বাহী বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একটি ‘বাস্তব পরিস্থিতি’র সম্মুখীন হয়েছেন।

সেটি এমনই এক পরিস্থিতি যে আদৌ আর নদী দখলমুক্ত হবে কি না, আদালতের নির্দেশ পালিত হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসকরা নদী রক্ষা বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের দশম সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সভায় তাঁরা উচ্চ আদালতের নির্দেশ পালন করার ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়েছেন তা তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ওই আদেশ পালন করা যাচ্ছে না। যেমন সিএস রেকর্ড অনুযায়ী আগে বুড়িগঙ্গার তীর যেখানে ছিল সেখানে এখন ঘনবসতি। কোথাও কোথাও মূল তীর যেখানে নির্দেশ করা ছিল সেখান থেকে চার কিলোমিটার নদীর অভ্যন্তরে ঢুকে গেছে। এখন সিএস (ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে) মেনে দখলমুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুধু ৭০ বছর আগের সিএস রেকর্ড নয়, এখন বিভিন্ন নদীতীরবর্তী আরএস রেকর্ডভুক্ত জমিও বেদখল হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকদের সে সভায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, নদীর তীরের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে যেখানে যেখানে সিএস রেকর্ড বাস্তবায়ন সম্ভব সেখানে সিএস অনুসারে এবং যেখানে আরএস অনুসারে কাজ করা সম্ভব সেখানে আরএস ধরে কাজ করতে হবে। তবে তার আগে উচ্চ আদালতের কাছে পরিস্থিতি জানিয়ে নতুন নির্দেশনা চাওয়া হবে।
নদীর তীর দখল এবং রেকর্ড-সংক্রান্ত জটিলতা শুধু ঢাকা এবং তার আশপাশেই নয়, দেশের প্রায় সর্বত্র। জেলা শহরগুলোর ভেতর দিয়ে যেসব নদী বা খাল বহমান ছিল বড় অংশই দখল হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও একসময়ের স্রোতের খালের এখন চিহ্নটুকুও নেই। যাঁরা এসব নদীর দখলে গেছেন তাঁদের প্রায় সবাই রেকর্ড-সংক্রান্ত একটি জটিলতা তৈরি করে নিয়েছেন। সরকার এ নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হলে বছর পেরিয়ে, যুগ-যুগ পেরিয়ে এক জীবন পার হয়ে যাচ্ছে। তা হলে কি এমন অবস্থা চলতেই থাকবে? সরকার অনেক সময় জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনায় এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সাহস করে না। কিন্তু একটি দেশে যাচ্ছেতাই তো চলতে পারে না। এ জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব হলো, এ বিষয়ে বিচারকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করা হোক। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মতো সে কমিশন সারা দেশে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত দিয়ে আসবে। কমিশনের সিদ্ধান্ত রায় হিসেবে বিবেচনা করবেন এবং এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে নাÑএ রকম উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এমন কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আমরা মনে করি না।

রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস

বাংলাদেশ মানেই নেতিবাচক সংবাদ নয়। বাংলাদেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয়ই এখন তেমন ভাবনা বদলে যেতে শুরু করবে। কারণ দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস লাগতে শুরু করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অর্জন সেই অনুভূতির মূল কারণ।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ইতিবাচক বাণিজ্য দৃশ্যমান। চলতি পঞ্জিকাবর্ষের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশ যে পরিমাণ মার্কিন দ্রব্য আমদানি করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি রপ্তানি করেছে সে দেশে। এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আগের বছর একই সময় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৩১৮ কোটি ৮৬ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। আর এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে_৩৫১ কোটি ৮১ লাখ ডলারে। তবে এই অর্জনের পেছনে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদানই বেশি। তাই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য দ্রব্যও যদি সেখানে রপ্তানি করা যেত তাহলে এই প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় যেভাবে উচ্চহারে শুল্ক পরিশোধ করতে হয় তাও বাংলাদেশের বাণিজ্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পেঁৗছাতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক লিডারশিপ কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আদায় করেছে। এই শুল্ক হারকে শূন্য মাত্রায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের তদবির এখনো সফল হয়নি। শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানিতে যদি বাংলাদেশ সুবিধা পেয়ে যায়, তাহলে অন্য কিছু উন্নত দেশেও বাংলাদেশ সেই সুবিধাপ্রাপ্তিকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্জনও হবে আশানুরূপ।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামগ্রিক রপ্তানি চিত্রও আশাব্যঞ্জক। একটি হিসাবে দেখা যায়, গত জুলাই-অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। আর শুধু অক্টোবর মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬৪ শতাংশ। সংগত কারণেই রপ্তানি বাণিজ্য আমাদের অদূর ভবিষ্যতের দৃঢ় অর্থনীতির মাত্রাকে চিহ্নিত করবে। কিন্তু ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের সে দিকটি এখনো ঋণাত্মক চিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে। বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনার জন্য যেসব আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক সেগুলো পরিপূর্ণ না হলে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা দিতে না পারলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণই থেকে যাবে। আবার রপ্তানি বৃদ্ধির সূত্রেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ যেসব দেশে আমাদের বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে সেসব দেশে আমাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোর ভূমিকা হতে পারে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে আমাদের রপ্তানি-বাণিজ্যকে আরো বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজনে বহির্বিশ্বে আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলো যদি যথার্থ ভূমিকা পালন করে, তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

বাগবোকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে নইলে ইইউয়ের অবরোধ

ইভরি কোস্টে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট লরাঁ বাগবোর ওপর আন্তর্জাতিক চাপবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সত্ত্বেও বাগবো তাঁর অবস্থানে অনড় থাকায় দেশটিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এই সপ্তাহের মধ্যেই আলেসান ওয়াতারার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থ হলে বাগবো ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কঠোর অবরোধের মুখে পড়বেন বলে জানিয়েছে ফ্রান্স। বাগবোর সমর্থকদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পদের আরেক দাবিদার ওয়াতারার সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন নিহত হওয়ার এক দিন পর গত শুক্রবার প্রধান শহর আবিদজানের রাস্তায় সেনাপুলিশের উপস্থিতি ব্যাপক বাড়ানো হয়েছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বাগবোকে অবশ্যই এ সপ্তাহের মধ্যে সরে যেতে হবে। তা না হলে তাঁর ওপর ইইউ কঠোর অবরোধ আরোপ করবে। সারকোজি বলেন, 'বাগবো ও তাঁর স্ত্রীর ভাগ্য তাঁদের হাতেই নির্ভর করছে। জনগণের রায় লঙ্ঘন করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বাগবো এই সপ্তাহের মধ্যেই যদি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ত্যাগ না করেন, তবে ইইউর অবরোধের তালিকায় তাঁদের নাম উঠবে।'
ইউরোপীয় ইউনিয়নও অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়ে আইভরি কোস্টের সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন বাগবোর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং ওয়াতারার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ব্রাসেলসে ইইউর সম্মেলন শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'আইভরি কোস্টের সব রাজনৈতিক নেতা, সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনীর প্রতি ইইউ আহ্বান জানাচ্ছে, তারা যেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ওয়াতারার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে।'
কেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী রায়লা ওদিঙ্গা প্রয়োজন হলে বাগবোকে জোর করে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আফ্রিকান জাতিগুলোর প্রতি। ওদিঙ্গা বলেন, 'আফ্রিকান ইউনিয়নের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।' এদিকে, দুুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য আফ্রিকান ইউনিয়নের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জঁ্য পিং গত শুক্রবার আবিদজানে পেঁৗছেছেন।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইকোয়াসসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ২৮ নভেম্বরের নির্বাচনে ওয়াতারাকে বিজয়ী বলে সমর্থন দিয়ে আসছে।
প্রধান শহর আবিদজানে বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ৩০ জন নিহত হওয়ার এক দিন পর ওয়াতারার সমর্থকরা জানিয়েছে, তারা রাজপথ থেকে সরছে না। সাংবাদিকরা জানান, আবিদজানের পরিস্থিতি আগের তুলনায় শান্ত। তবে বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সূত্র : বিবিসি, এপি।

অ্যাসাঞ্জ গুপ্তচর! যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ গঠনের চেষ্টা

ইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ অভিযোগ করেছেন, গোপন কমিটি করে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। খুব শিগগির এ অভিযোগ চূড়ান্ত করে দেশটি তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেবে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তিনি।

গত শুক্রবার সাংবাদিকদের এ কথা বলেন অ্যাসাঞ্জ। ৯ দিন আটক থাকার পর এর আগের দিনই ব্রিটেনের কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখছে বিচার বিভাগ। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে তারা উইকিলিকসের কাছে তথ্য পাচারের দায়ে আটক মার্কিন সেনা ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করছে। ম্যানিং তাঁর তথ্য চুরির পেছনে অ্যাসাঞ্জের অনুপ্রেরণা ও সহায়তা থাকার কথা বললে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা সহজ হবে। ম্যানিং বর্তমানে ভার্জিনিয়ার একটি সেনাঘাঁটির গোপন কারাগারে বন্দি আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এ যাবৎ উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া সব মার্কিন গোপন নথি তিনিই সরবরাহ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আড়াই লাখ গোপন নথি প্রকাশ করে চলতি মাসের শুরুতে সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে উইকিলিকস। এ ঘটনায় বিব্রত যুক্তরাষ্ট্র সরকার অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। এই ফাঁকে দুই সুইডিশ নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগে স্টকহোমের একটি আদালত তাঁর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অভিযোগ অস্বীকার করলেও ৭ ডিসেম্বর লন্ডন পুলিশের কাছে ধরা দেন অ্যাসাঞ্জ। এর ৯ দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার তিন লাখ ৭৪ হাজার ডলারের বিনিময়ে তিনি জামিনে মুক্তি পান। জামিনে থাকা অবস্থায় অ্যাসাঞ্জকে ইংল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে 'ইলিংহাম হল' নামের একটি বাড়িতে অবস্থান করতে হবে। এ বাড়িতেই শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
অ্যাসাঞ্জ ধর্ষণের অভিযোগকে 'একটি সফল প্রচারণা' হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, উইকিলিকস ও তাঁকে কলঙ্কিত করার লক্ষ্যেই একটি মহল এ প্রচারণা চালিয়েছে। অ্যাসাঞ্জ বলেন, 'মার্কিন আইনজীবীরা আমাকে জানিয়েছেন যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের লক্ষ্যে দেশটি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেছে। আমি আশঙ্কা করছি, তারা আক্রমণাত্মক কোনো অভিযোগের পরিকল্পনা করছে।' অ্যাসাঞ্জ এ কমিটির বিষয়টি গোপন রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে বলেন, 'নিশ্চয়ই তারা অস্বাভাবিক কিছু করার চেষ্টা করছে।' তিনি দাবি করেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার আগে তিনি কখনো ম্যানিংয়ের নাম শোনেননি। তিনি বলেন, 'উইকিলিকস ওয়েবসাইটটি এমনভাবে তৈরি যে আমরা সূত্রের নাম জানতে পারি না।' সূত্র : এএফপি, এপি।

কাশ্মীরি বন্দিদের ওপর 'নির্যাতন' চালিয়েছে ভারত

ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জম্মু ও কাশ্মীরে বন্দিদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতন চালাত। সেখানকার বিভিন্ন বন্দিশালা ঘুরে দেখার পর রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি ২০০৫ সালে বিষয়টি নয়াদিলি্লতে নিয়োজিত মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিকদের জানিয়েছিল।

তাদের দাবি, ভারত সরকার নির্যাতনের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তারবার্তা থেকে গত শুক্রবার এ কথা জানা গেছে। বার্তা অনুযায়ী, ২০০৫ সালের এপ্রিলে রেডক্রস নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বন্দি নির্যাতনের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ নয়াদিলি্লতে মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে পাঠায়। তারা জানায়, বৈদ্যুতিক শক, যৌন নিপীড়ন, পানিতে চুবিয়ে নির্যাতন, ঝুলিয়ে রাখা ছাড়াও বসা অবস্থায় পায়ের ওপর ভারী ধাতব জিনিস রেখে তার ওপরে নিরাপত্তা কর্মীরা বসে নির্যাতন চালাত। ভারত সরকার এসব নির্যাতনের ঘটনা দেখেও না দেখার ভান করেছে।
রেডক্রস কূটনীতিকদের জানায়, ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রেডক্রসের কর্মীরা কাশ্মীরের বিভিন্ন বন্দিশিবির ১৭৭ বার পরিদর্শন করে। এ সময় তারা প্রায় দেড় হাজার বন্দির সঙ্গে কথা বলে। বেশির ভাগ বন্দিই ছিল সাধারণ নাগরিক। সন্দেহবশত তাদের অনেককে দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে। তারাই নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে জানায়।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এই তারবার্তার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি জানিয়েছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এ বিষয়ে শুক্রবার এনডিটিভিকে জানান, তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এসব ঘটনা ঘটেছে। কাজেই তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। 'আমি এসব ঘটনার মধ্যে নেই। এটা ২০০৫ সালের ঘটনা। আপনারা জানেন, তখন কারা ক্ষমতায় ছিল। আমাদের সময়ে এমন ঘটনা ঘটেনি, ভবিষ্যতে কখনো ঘটবেও না।' তাঁর সরকারের আমলেই প্রথম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি দলকে কাশ্মীর সফরের অনুমতি দেওয়া হয় বলেও জানান আবদুল্লাহ।
২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) জোট সরকার ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ক্ষমতায় ছিল।
কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিদর্শক এস এম সোহাই বলেন, রেডক্রসের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবর ভিত্তিহীন ও অপপ্রচার। 'নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি জানি না, রেডক্রস কিভাবে এসব তথ্য পেয়েছে। কারণ কাশ্মীরের ওই সব জায়গায় তাদের প্রবেশাধিকার নেই। কাজেই এ খবরের কোনো ভিত্তি নেই।' সূত্র : এএফপি।

মুসলিম জঙ্গিদের চেয়ে হিন্দু চরমপন্থীরা বিপজ্জনক : রাহুল

মুসলিম জঙ্গিদের চেয়ে হিন্দু চরমপন্থীদের ভারতের জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেন কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী। উইকিলিকসে নয়াদিলি্লর মার্কিন দূতাবাসের ফাঁস হওয়া তারবার্তায় এ কথা জানা গেছে।

গত শুক্রবার প্রকাশিত তারবার্তায় বলা হয়, গত বছর ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত টিমোথি রোমারের সঙ্গে আলাপকালে কংগ্রেস দলের প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল জানান, ভারতের মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক হয়তো ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার জন্য দায়ী লস্কর-ই-তৈয়বার মতো জঙ্গি গ্রুপগুলোকে সমর্থন করে। তবে ভারতের জন্য আরো বড় হুমকি হচ্ছে হিন্দু মৌলবাদী দলগুলোর উত্থান। এরা ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধে জড়ায়।
বার্তায় বলা হয়, সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা ভারতের জন্য হুমকি বলে জোরালো যুক্তি দেন রাহুল। তিনি বলেন, 'কে কে সন্ত্রাস করছে তাতে কিছু আসে-যায় না, আসল কথা হচ্ছে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।'
একটি ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলকে নিষিদ্ধ ইসলামী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তুলনা করে গত অক্টোবরে এক রাজনৈতিক বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালেন রাহুল। তাঁর মতে, উভয় গোষ্ঠীই চরম মৌলবাদী ভাবধারাকে উৎসাহ দেয়।
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া রাহুলের ওই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিবসেনা দলের প্রধান বাল ঠাকরে এবং বিরোধী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বিজেপির মুখপাত্র প্রকাশ জাভদেকার বলেন, 'রাহুলরা ভারত এবং হিন্দু মূল্যবোধ সম্পর্কে জানেন না বলেই এ কথা বলছেন।'
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, 'উইকিলিকসের তথ্যে এখন বোঝা যাচ্ছে, মার্কিনিদের কাছে কে তথ্য যুগিয়ে আসছে। এখন পরিষ্কার, কেন আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।' বাল ঠাকরে হিন্দু সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করার ব্যাপারে রাহুলের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি রাহুলকে অতি স্মার্ট না হওয়ার উপদেশ দেন। সূত্র : এএফপি।

শিশুশ্রমের তালিকায় আরো ১২ দেশ

শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার এবং মানুষকে শ্রমদানে বাধ্য করার তালিকায় নতুন করে আরো ১২টি দেশকে যুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

পাশাপাশি দেশটির কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এ ধরনের শোষণ আরো বাড়তে পারে। গত বুধবার প্রকাশ করা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমদপ্তর এ-সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে এ সতর্কতা উচ্চারণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এল-সালভাদরের কফি উৎপাদন থেকে শুরু করে মাদাগাস্কারের মূল্যবান ধাতব খনি_সব জায়গায় শিশুরা কাজ করছে। ৭০টি দেশে ১২৮টি পণ্য উৎপাদনে শিশুশ্রম, বাধ্যতামূলক শ্রম বা এই দুই ধরনের শ্রমই ব্যবহার করা হচ্ছে।
নতুন করে তালিকায় যুক্ত হওয়া দেশগুলো হচ্ছে_অ্যাঙ্গোলা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, শাদ, এল সালভাদর, ইথিওপিয়া, লেসোথো, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, রুয়ান্ডা, জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী হিলদা সোলিস বলেন, 'আধুনিক বিশ্বে শিশু শ্রমের কোনো জায়গা নেই এবং একে মেনে নেওয়া ঠিক হবে না_ সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে এ বিষয়টি বোঝাতেই এ সমস্যার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।'
শ্রম দপ্তর জানায়, কোনো দেশকে সাজা কিংবা লজ্জা দেওয়ার জন্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। এ সমস্যা সমাধান ও শিশুশ্রম বন্ধের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতেই এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সূত্র : এপি।

শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গড়তে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গড়তে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। স্বচ্ছ প্রশাসন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

এর জন্য সরকারের ধারাবাহিকতারও প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, এবারের বিজয় দিবসে জাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপহার হচ্ছে সাকা চৌধুরীর গ্রেপ্তার। এই গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে একটি মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। মৌলভীবাজারের রাজনগরে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ড. এম জি মৌলা মিয়ার প্রতিষ্ঠিত এমবিএম বিল্ডার্স মার্ট বিডি-ইউকে লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী আরো বলেন, 'পৃথিবীর অনেক বিত্তশালী ও শিল্পোন্নত দেশ অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের অর্থনীতি কুঁজো হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহের ওপর ভর করে আমাদের অর্থনীতি সটান দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের একটি বড় অংশ সিলেটের অধিবাসী। তাদের কষ্টার্জিত টাকায় এ দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। এমবিএম বিল্ডার্স মার্ট বিডি-ইউকে লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দেশের অন্যান্য এলাকার উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করবে।' এমবিএম বিল্ডার্স মার্ট বিডি-ইউকে লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. এম জি মৌলা মিয়ার সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান, পুলিশ সুপার হারুন-অর রশীদ, শিল্পমন্ত্রীর একান্ত সচিব জাহেদ মোস্তাক, রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান সরকার, সাবেক উপসচিব অজিত কুমার পাল ও এমবিএম বিল্ডার্স মার্ট বিডি-ইউকে লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ফারহানা মৌলা।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন দৈনিক বাংলার দিন সম্পাদক বকসি ইকবাল আহমদ। আগে মন্ত্রী মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
এদিকে গত শনিবার সকালে নরসিংদী বিসিক শিল্পনগরীর বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনকালে শিল্পমন্ত্রী বলেন, দেশকে শিল্পসমৃদ্ধ করা বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। শিল্পসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণেও গুরুত্ব দিতে হবে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এসময় পুলিশ সুপার ড. মো. আক্কাস উদ্দিন ভূঞা ও বিসিক শিল্পনগরীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

গুলি চালানো শিখতে লেগেছিল মাত্র আধঘণ্টাঃ শিরিন বানু মিতিল

মি তখন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী। আমার মা সেলিনা বানু বামপন্থী আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী ছিলেন। আমার নানার বাড়ি ছিল এককালে বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। সুতরাং এই বাড়ির সবাই আমরা রাজনৈতিকভাবে বিশেষ সচেতন ছিলাম।

একাত্তরের মার্চের সেই দিনগুলোতে রাজনৈতিক উত্তাপে বাইরের অঙ্গন ও আমাদের গৃহের প্রাঙ্গণ এক হয়ে গিয়েছিল। পাবনার প্রাথমিক প্রতিরোধ পর্ব হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকেই। চলে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা পাবনা শহরে ঢোকে। জারি হয় কারফিউ। ২৬ মার্চ তারা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। সাধারণ মানুষের ওপরও নেমে আসে অত্যাচার। জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় পাল্টা আঘাত হানার। ২৭ মার্চ রাতে পুলিশ লাইনের যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে। ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামার কথা ভাবতে শুরু করে। তাদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, এসিড বাল্ব, বঁটি ও দা। আমাদের মানসিকতা ছিল 'মেরে মরো'। পুরুষরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বান অনুযায়ী যার যা কিছু আছে_দা, বল্লম, মাছ মারার কোচ, মাছ কাটার বঁটি, লাঙলের ফলা এসব নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পরে আমাদের হাতেও অস্ত্র চলে আসে।
আমার মনে পড়ে, মাত্র আধাঘণ্টা লেগেছিল গুলি চালানো শিখতে। সে ছিল এক অদ্ভুত দিন। আমার দুই কাজিন জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে। এই মায়ের কথা না বললেই নয়। তিনি তাঁর ছেলেদের বলতেন, 'তোমাদের কি মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্য? মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো।' তিনি ছিলেন পাবনা মহিলা পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সভানেত্রী রাকিবা বেগম। এমন পরিস্থিতিতে আমার ঘরে থাকাটা কষ্টকরই ছিল।
আমার ভাই জিঞ্জির বলল, 'বুজি, প্রীতিলতার মতো তুমিও পারো ছেলেদের পোশাক পরে যুদ্ধে যেতে।' ওর এই কথাটা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। আমার বড় খালা রাফিয়া বানুর কাছে আমি থাকতাম। তিনি আমাকে শার্ট-প্যান্ট পরা দেখে বললেন, 'হ্যাঁ, এখন তুমি নিশ্চিন্তে যুদ্ধে যেতে পারো।'
২৮ মার্চ শহরের জেল রোডে টেলিফোন একচেঞ্জ ভবনে দখলদার ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ওরা সবাই মারা পড়ে। আমাদের দুজন শহীদ হয়। এভাবে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতেই থাকে। ৩০ মার্চ পাবনা শহর স্বাধীন হয়।
তখন যুদ্ধ চলছিল নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে। পাশের জেলা কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে। তাদের বিভিন্ন দল পিছিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার দিকে।
পাবনার ছাত্রনেতা ইকবালের দল একটি গাড়িতে করে কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হলো। গাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমি ও আমার এক ভাই থেকে যাই কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার ক্যাম্পে দেখা হয় পাবনার পুলিশ ইনচার্জ ও রাজনৈতিক নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশার সঙ্গে। ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁদের জিপে করে আমরা চুয়াডাঙ্গার ক্যাম্পে যাই। তখন গোলাবারুদের অভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক দলকে পাঠানো হলো গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য। সেই দলের সদস্য হয়ে আমিও মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কমিটিতে পেঁৗছাই। সেখানে দেখা হলো আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে। এখানে এসে জানতে পারি, পাবনায় যে সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি আমার ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছেপে দিয়েছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ছেলে সেজে যুদ্ধ করার যে সুযোগ ছিল, তা আর আমি পেলাম না।
আমার সঙ্গীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমি চলে গেলাম কলকাতার উপকণ্ঠে গোবরা ক্যাম্পে আরো প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে আমাকে আশ্রয় দিলেন নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র। তাঁর স্বামী রমেন মিত্র আমার বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদকে চিনতেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হিসেবে। এখান থেকে আমি যোগাযোগ করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তিনি আশ্বাস দিলেন মেয়েদের নিয়ে আলাদা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠনের।
প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন। আমি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিই। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে থাকি। আমাদের প্রচেষ্টা ও বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় অবশেষে ৩৬ জন নারী নিয়ে আমাদের ক্যাম্প শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে বিভা সরকারের কথা বলতেই হয়। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্সের ছাত্রী তিনি। তিনিসহ পাঁচজনের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। জিন্নাত আরা, লায়লা, লীনা চক্রবর্তী, কৃষ্ণা ও আমি ছিলাম ওই কমিটিতে। আমাদের কাজ ছিল ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে আগ্রহী মেয়েদের সংগ্রহ করা। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা। ক্যাম্পের দেখাশোনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি প্রতিদিন আমাদের ক্যাম্পে আসতেন। আমাদের অস্ত্র ও অন্যান্য প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ শুরু করেন খুলনার হাসিনা শিরিন। আস্তে আস্তে সদস্যসংখ্যা বেড়ে যায়। আমরা যখন ক্যাম্প ছাড়ি তখন সদস্যসংখ্যা ছিল ২৪০-এর ওপরে। অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। আমাদের প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিক্যাল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করি তাঁর দলে কাজ করার জন্য। তিনি রাজি হন, কিন্তু সমস্যা ছিল অস্ত্রের অভাব। তবু যুদ্ধ থেমে থাকেনি আমাদের।
বিজয়ের পর আসে দেশে ফেরার পালা। সেই ক্যাম্পের সহযোদ্ধাদের অনেকের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। জানি না কোথায় আছে বিভা সরকার, তুষার কন্যা, নাজমা মাজেদা কিংবা লায়লা। মনে পড়ে একেকটি নাম_তৃপ্তি, সন্ধ্যা, গীতা, শাহীন, মুক্তি, ইরা, গীতা (২) ও সালমা। এখনো মনে পড়ে জোবেদা, মিরা, কমলা, জিনাত, যুথিকা, মণিকা, ভক্তিসহ অনেকের কথা। নাম না জানা অনেকের ছবি ভাসে চোখে। এখনো কান পাতলে শুনি সেই সমবেত সংগীত_'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি...'।
মাঝেমধ্যে ভাবি কুষ্টিয়ার পথে রাতে দেখা হওয়া সেই ভাইদের কথা। আর সেই বৃদ্ধ পিতার কথা, যিনি আমাকে ছেলের পোশাক পরা মেয়েযোদ্ধা জেনে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, 'আর আমাদের ভয় নেই। আমাদের মেয়েরা যেখানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে নেমেছে, আমাদের আর কেউই দমাতে পারবে না।'
এখনো ভাবি, বাংলাদেশের মানুষের আছে অশেষ প্রাণশক্তি, যাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে কোনো সমস্যাই আর থাকে না। প্রয়োজন শুধু সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কে ফিরিয়ে এনে প্রাণের আবাহন করা।
পরিচিতি: পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লার খান বাহাদুর লজ-এ ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর শিরিন বানু মিতিল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা প্রখ্যাত বামনেত্রী সেলিনা বানু ও বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ। ৭ নম্বর সেক্টরে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বা সনদের জন্য কোনো আবেদন না করায় তাঁর কোনো সনদ নেই।

অভিযোগ অস্বীকার না করলেও সাকার ভাব - কিছুই হবে না

দালতে হাজির করার সময় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন। এমনকি আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের সাহায্য ছাড়া যেন হাঁটতেই পারছিলেন না তিনি।

কিন্তু সেখান থেকে ডিবির হাজতখানায় নেওয়ার পর সাকা চৌধুরী ফিরে যান তাঁর সেই পুরনো চেহারায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে জবাব দিচ্ছেন কিংবা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বিব্রত করছেন জিজ্ঞাসাবাদকারীদের। অনেক অভিযোগই স্বীকার করছেন স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত এই নেতা; কিন্তু এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন এতে কিছুই হবে না তাঁর। এমনকি হাজতখানায় থাকা অন্য আসামিদের দিয়ে শরীরও ম্যাসাজ করিয়েছেন তিনি। গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, শুক্রবার রাতে একই হাজতে ছয় গাড়িচোরকে রাখা হয়েছিল সাকা চৌধুরীর সঙ্গে। পরে ওই গাড়িচোরদের দিয়ে রাতভর শরীর ম্যাসাজ করান তিনি। হাজতখানায় থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, একসঙ্গে ছয়জনই সাকার শরীর ম্যাসাজ করছে। চোরদের কেউ হাত, কেউ পা, আবার কেউ তাঁর শরীর ম্যাসাজ করছিল। এ সময় তিনি (সাকা) শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছিলেন। ডিবি কর্মকর্তারা বিষয়টি জানার পর গতকাল শনিবার সকালে সাকা চৌধুরীকে হাজতখানা থেকে সরিয়ে পাশের ছোট একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই কক্ষে কড়া পাহারা বসানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ফারুক হত্যা মামলার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জিজ্ঞাসাবাদকারীদের বলেন, 'আপনারা যদি খেয়াল করেন, দেখবেন হরতালের পক্ষে আমি একটি কথাও বলিনি। এ বিষয়টি আমি এর আগেও বলেছি। বিএনপির মধ্যে কারা হরতালের আগে গাড়ি ভাঙচুর বা অগি্নসংযোগের জন্য লোক ভাড়া করে, কারা টাকা দেয় তা ভালো করেই জানেন আপনারা। তাদের দু-একজনকে আপনারা ধরেছিলেন।'
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সালাহউদ্দিন কাদেরের কাছে যুদ্ধাপরাধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এ সময় তিনি হাসতে হাসতে বলেন, 'এগুলো তো বহু পুরনো অভিযোগ। এসবের মাত্রা কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে।' জিজ্ঞাসাবাদকারীরা জানতে চান, তাহলে অভিযোগ কি সত্য? জবাবে সাকা জোরে হাসতে হাসতে বলেন, 'সময়ের সঙ্গে সত্য-মিথ্যার গতি পরিবর্তন হয়।' পরে অভিযোগের বেশ কিছু প্রমাণ হাজির করা হয় তাঁর সামনে। সেসব দেখে সাকা বলেন, 'এগুলোও আগে দেখেছি।'
একটি সূত্র জানায়, ফারুক হত্যার বিষয়টি জানতেন বলে তথ্য দিয়েছেন সাকা। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে আনা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব বিষয়েই এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে এসব অভিযোগে তাঁর কিছুই হবে না।
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কখনো তুমি, আবার কখনো আপনি বলে সম্বোধন করছেন সাকা। তবে হাজতখানায় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখা যায় তাঁকে।
এদিকে গতকাল সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে যান। পরে তাঁদের পক্ষ থেকে সাকার জন্য জ্যাকেট, মাফলার, চাদরসহ কিছু শীতবস্ত্র তাঁর কাছে পাঠানো হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মনিরুল ইসলাম জানান, মানাবাধিকার সমুন্নত রেখে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
বুধবার মধ্যরাতে বনানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। বৃহস্পতিবার তাঁকে আদালতে হাজির করে রমনা থানায় দায়ের করা ফারুক হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গত ২৬ জুন বিএনপির ডাকা হরতালের আগের রাতে মগবাজার এলাকায় একটি ট্যাঙ্েিত আগুন দিয়ে ফারুক নামের ওই যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছিল।
সালাহউদ্দিন কাদেরকে রিমান্ডে নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

কোকোর দুর্নীতি জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের হ্যান্ডবুকে

জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের একটি যৌথ প্রকাশনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কয়েক লাখ ডলার আত্মসাতের প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর (ইউএনওডিসি) এবং বিশ্বব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগ-স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভের প্রস্তুত করা একটি পুস্তিকায় সিমেন্স কম্পানির কাছ থেকে কোকোর ঘুষ গ্রহণের অভিযোগকে 'জাতীয় মুদ্রা সরানোর' উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
'অ্যাসেট রিকভারি হ্যান্ডবুক_এ গাইড ফর প্র্যাকটিশনার্স' নামের পুস্তিকাটি গত ১৬ ডিসেম্বর ভিয়েনায় প্রকাশ করা হয়। ২৭০ পৃষ্ঠার পুস্তিকায় বলা হয়েছে_ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিবছর দুই হাজার থেকে চার হাজার কোটি ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে মাত্র ৫০০ কোটি ডলার উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে ফিরিয়ে দেওয়া গেছে। বেহাত হওয়া অর্থ উদ্ধার প্রচেষ্টা জোরদার করার বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ওই পুস্তিকায়।
পুস্তিকার ৩৬ ও ১৭৯ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশে সিমেন্স কম্পানির সঙ্গে আরাফাত রহমান কোকোর অনৈতিক আর্থিক যোগসাজশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান করে দেখেছে, সিমেন্স বিভিন্ন দেশে সরকারি কাজ পেতে জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কনসালট্যান্টদের ঘুষ দেওয়া হতো। কনসালট্যান্টরা এর বিনিময়ে সরকারি কর্মকর্তা ও সিমেন্স কর্তৃপক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছেন। আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ ও ভেনিজুয়েলায় এ ধরনের ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে সিমেন্সকে শেষ পর্যন্ত ৪৫ কোটি ডলার জরিমানা করা হয়।
পুস্তিকার ১৭৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে ঘুষ হিসেবে বিদেশি একটি কম্পানির দেওয়া অর্থ ২০০৯ সালে বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের যুক্তি ছিল, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমেরিকান মুদ্রার বিনিময় কাজটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী ব্যাংকের মাধ্যমেই হতে পারে। ঘুষ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি (সিমেন্স) বিদেশি হলেও সেটি নিউইয়র্ক স্টক এঙ্েেচঞ্জে নিবন্ধিত, আর তাই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের আইনের ঊধর্ে্ব নয়।
এর আগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ ৩০ লাখ ডলার পুনরুদ্ধারের জন্য আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে। কোকো এই অর্থ জার্মানির প্রতিষ্ঠান সিমেন্সের কাছ থেকে গ্রহণ করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি ব্যাংকে জমা রাখেন।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত গত ৩০ নভেম্বর কোকো ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সাইমনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলায় অভিযোগ গঠন করেছেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হলো। কোকো ও সাইমনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ ডলার ও সিঙ্গাপুরে ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ ডলার পাচারের অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশন (এসিসি) গত বছরের ১৭ মার্চ কাফরুল থানায় মামলাটি দায়ের করে।
প্রসঙ্গত, চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে আরাফাত রহমান কোকো এখন থাইল্যান্ডে আছেন।

আবাসন শিল্পঃ অস্থিরতা, বিপাকে লাখ লাখ শ্রমিক by নওশাদ জামিল

সাত্তার মিয়া আজমিরী স্টিল করপোরেশনের স্টিল, রডসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। বয়স চল্লিশের ঘরে। দোকানের সামনের ফুটপাতে তাঁর রিকশাভ্যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘সারা দিন বইসা আছি, একখান কাজও পাই নাই। বাড়িত চাল নিয়া যাওয়ার ট্যাহাও নাই।
ক্যামনে সংসার চলবে হেইডাই ভাবতে পারতেছি না।’ নির্মাণ শ্রমিক তোফায়েল মিয়া বললেন, ‘আগে সারা দিন কাজ কইরা পাইতাম ৫০০ টাকা। এখন ২০০ টাকাও পাই না। কাজ নাই, আগের মতো টাকাও নাই।
এ টাকায় তিনবেলা খাবারও জোটে না।’ তিনিও রিকশাভ্যানে করে স্টিল-রডসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে রড ওঠানো-নামানোর কাজ করেন আবদুল কাদের। ‘গত এক সপ্তাহে কাজ পাইছি তিনটা। আগে প্রতিদিনই তিন-চারটা কাজ পাইতাম। এখন সারা দিন বইসা থাকলেও একটা কাজও পাই না’, বলেন কাদের।
রাজধানীর শ্যামলীর রিং রোডের মেসার্স শাহ্জালাল অ্যান্ড ব্রাদার্স, নিজাম স্টিল করপোরেশন, মাহীর স্টিল এজেন্সি, ভূঁইয়া স্টিল করপোরেশন, মদিনা স্টিল করপোরেশনসহ নির্মাণসামগ্রীর দোকান আছে প্রায় ২০টি। দোকানগুলোয় পাইকারি ও খুচরা দরে স্টিল-রডসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী বিক্রি করা হয়। দোকান থেকে স্টিল পরিবহনের কাজে নিয়োজিত পাঁচ শতাধিক শ্রমিক। এ মৌসুমে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ বেশি থাকার কথা হলেও এখন তাঁদের কাজ নেই। দেশের বেশির ভাগ নির্মাণ শ্রমিকেরই এ দশা।
সম্প্রতি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প বন্ধ হয়ে পড়ায় নির্মাণ শিল্পে দেখা দেয় চরম অস্থিরতা। গত পাঁচ মাসে হুহু করে বেড়েছে রডের দাম। গত দুই মাস আগে ৪০ গ্রেডের রড বিক্রি হতো ৪৬ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। একইভাবে ৬০ গ্রেডের রড ৫১ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৫৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে নির্মাণ শিল্পে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে হাজার হাজার ডেভেলপার কম্পানির প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রডমিস্ত্রি-রাজমিস্ত্রিদেরও কাজ নেই। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রডের দোকানগুলো। রডের ডিলার-এজেন্টদের আয়ও বন্ধ। রড পরিবহনের কাজে প্রয়োজনীয় ট্রাক শ্রমিকদেরও আয় বন্ধ। প্রায় ৯৯ শতাংশ দেশীয় মালিকানাধীন স্টিল ও রি-রোলিং মিল লোকসানের মুখে বন্ধ হওয়ার শঙ্কায়। হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার ও পেশাজীবী চাকরি হারানোর শঙ্কায়। এই শুকনো মৌসুমে যখন রডের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকার কথা, তখন কাঁচামাল আমদানি বন্ধ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এর প্রভাব শুধু রড-স্টিল শিল্পের ওপরই পড়বে না, সিমেন্ট, বালু, পাথরসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি ৫০০টি রি-রোলিং ও ২৫টি স্টিল মিল বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকার কারণে গত ছয় মাস ধরে লোহজাত শিল্পে অস্থিরতা তৈরি হয়। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো রকম স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, লোহাজাত শিল্পের এ অস্থিরতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক। অনেক স্টিল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম প্রধান তিনটি স্টিল মিল বিএসআরএম, আবুল খায়ের স্টিল ও কেএসআরএম প্রতিষ্ঠানেও বিরাজ করছে শ্রমিক অসন্তোষ।
রডের দাম বাড়ায় বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ৬০ গ্রেডের রড কিনতে গিয়ে খালিহাতে ফিরে এসেছি। বাড়ির কাজই বন্ধ করে দিয়েছি।’ আলমগীর হোসেন আরো জানান, এক বছর আগে তিনি যখন বাড়ির কাজ শুরু করেন, তখন প্রতিটন রডের মূল্য ছিল আনুমানিক ৪০ হাজার টাকা। বছরের এই সময়ে শুকনো মৌসুমে বাড়ির কাজ করেন। এখন রডের দাম টনপ্রতি ৫৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
গুলিস্তানের রড ব্যবসায়ীরা জানান, রডের দাম বাড়ায় ক্রেতাও কমে গেছে। দোকানের কর্মচারীও ছাঁটাই করেছেন তাঁরা।
জানা যায়, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্টিলের চাহিদা ছিল ৫ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। এর মূল্য টনপ্রতি ৫৫ হাজার টাকা করে হিসাব করলে হয় ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাত বৃদ্ধিতে এখন স্টিলের চাহিদা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে বাজারে লোহাজাত দ্রব্যের পর্যাপ্ত সরবাহ নেই।

অর্থনীতি ধ্বংসে পরিকল্পিত চেষ্টা

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাব ও শিল্পবিরোধী নানা রকমের নির্দেশনায় প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে দেড় গুণের বেশি অর্থ বিনিয়োগকারী আবাসন, জাহাজ ভাঙা ও স্টিল, রি-রোলিং, অটো রি-রোলিংসহ ২০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্রমেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে বেকার হয়ে গেছে এসব খাতের লক্ষাধিক শ্রমিক। কয়েকটি এনজিও পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মাধ্যমে সরকারকে বিপাকে ফেলার ষড়যন্ত্রে নামায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতি পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টির বদলে বেসরকারি শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শঙ্কিত বিনিয়োগকারী এবং জীবিকা হারানো শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের ওপর।
লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তাঁদের মতে, বেসরকারি খাতের এই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগকে গতিশীল করতে না পারলে ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে।
আবাসন খাতের বিনিয়োগ ৭০ হাজার কোটি টাকা। জাহাজ ভাঙা, স্টিল, রি-রোলিং, অটো রি-রোলিং খাতের মোট বিনিয়োগ এক লাখ কোটি টাকা। এসব খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। তাদের সঙ্গে জড়িত একটি করে পরিবার। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্রের জোগান আসে এসব খাত থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বর্তমানে। পরিবেশবাদী কয়েকটি এনজিওকে সামনে নিয়ে অদৃশ্য মহল সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগকারী এবং এসব খাতে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে খেপিয়ে তোলার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অংশীদার হচ্ছে আবাসন খাত। ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে আবাসন খাত অন্যান্য খাতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আবাসন খাতের সঙ্গে নির্মাণ শিল্পের অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান জড়িত। যেমনÑরড, সিমেন্ট, ইট, রং, কাঠ, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, আসবাবপত্রসহ হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান। মূলত আবাসন খাত ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট মূল এবং উপশিল্প খাতকে অস্থিতিশীল করে তোলার চক্রান্ত করছে ওই বিশেষ মহল। আবাসন খাত ধ্বংস হলে বাকিগুলো এমনিতেই বসে যাবে। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত চক্রটি দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ করে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানির সুযোগ তৈরির জন্যই এসব করছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। তাঁদের মতে, চক্রটি পরিবেশবাদী কয়েকটি এনজিওকে সামনে রেখে নিজেদের শক্তিশালী করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে বিগত সরকারগুলোর সময় থেকেই। বর্তমানে তারা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিষয়েও তারা অসন্তোষ প্রকাশ করছে। গণতান্ত্রিক পন্থায় ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) বাস্তবায়নের বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেও নাখোশ হয়েছে চক্রটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশবাদী কিছু এনজিও পরিবেশ রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এসব পরিবেশবাদী এনজিও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করে না। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এসব সংগঠন সোচ্চার হলে বছরে বৈধভাবে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার হার বর্তমানের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেত। উল্লেখ্য, বর্তমানে বছরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের অর্থ দেশে আসছে। অর্থপ্রবাহ বাড়লে দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হতো। সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পেত। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো সংগঠন কথা বলে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট তীব্র। এর ফলে লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন মানুষের হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব প্রকট। এসব সমস্যা নিয়ে কোনো সংগঠনের মাথাব্যথা নেই। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সোচ্চার না হয়ে অর্থ উপার্জনকারী খাতগুলো নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেছে চক্রটি। তারা আইনের মারপ্যাঁচে এসব খাতের উন্নয়ন স্থবির করে দেওয়ার চক্রান্তে নেমেছে। তারা দেশ, জাতি ও সরকারের বিরুদ্ধে কোন মাত্রার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তা এখনই নিরূপণ করা জরুরি বলে তাঁরা মন্তব্য করেন।
বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রণয়ন করে বিগত বিএনপি তথা জোট সরকার। এ বিধিমালায় স্ববিরোধী কিছু বিষয় থাকায় এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সরকার বিপাকে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিধিমালাটি যুগোপযোগী করার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একাধিক বৈঠক করে নতুন নতুন প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাব সংযোজন করে এখন পর্যন্ত বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে না। এর পেছনেও সেই চক্রের অদৃশ্য হাত থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রাজউকের হিসাব অনুযায়ী আবাসিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজউক ২৬টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে না, আবার স্পষ্ট করে কিছু বলাও হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসন খাতের অবদান শতকরা ২১ ভাগ। এ খাতে বিনিয়োগ করা টাকার ৩০ শতাংশ এসেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে। তাঁরা ২১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এসব খাতে সরাসরি প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এই ৫০ লাখ শ্রমিকের সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এসব মানুষের অন্নসংস্থান হচ্ছে উল্লিখিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকেই। আবাসন ও ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ৩০০টি শিল্প উপখাত। এসব খাতেও বিনিয়োগ করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ শিল্পগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে দেড় কোটি এবং পরোক্ষভাবে এর ওপর নির্ভরশীল তিন কোটি মানুষ। তাদের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের পরিবার। আবাসিক এবং ভূমি উন্নয়নকাজ কোনোভাবে ব্যাহত হলে কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে যাবে। চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে এই শ্রমিকদের পরিবার।
ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান পর্যালোচনার জন্য সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৬টি আবাসন প্রকল্প ও স্থাপনা এবং দুই হাজার ৭২৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ড্যাপের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ (নন-কনফর্মিং) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কমিটি প্রকল্পগুলোর অনুমোদন না দিতে এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি ও ১০টি বেসরকারি প্রকল্প রয়েছে। ড্যাপ নিয়ে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেÑএ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে আগামী ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে ঢাকা ও এর আশপাশের ২৯টি সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যরা ড্যাপ মেনে নিতে পারছেন না। সরকারদলীয় সদস্যরাও ড্যাপের প্রচণ্ড বিরোধিতা করছেন। এই ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে পাঁচ লাখেরও বেশি স্থাপনা ভাঙতে হবে। এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ড্যাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। এই সুযোগে বিরোধী দলও একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে সরকারকে ঠেলে দেওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে ঢাকার বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থাকে আমলে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
চার পৃষ্ঠার ওই গোপন প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘রাজধানী ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নে প্রতিকূলতা প্রসঙ্গে’। সরকার যাতে বিপাকে না পড়ে এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘মন্তব্য ও সুপারিশ’ শীর্ষক উপশিরোনামের ‘ক’ থেকে ‘চ’ পর্যন্ত রয়েছে ছয়টি সুপারিশ। একটিতে বলা হয়েছে, ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে আর্মি হাউজিং সোসাইটি প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। এতে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে, যা বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিছু এনজিও পরিবেশ রক্ষার নামে সরকারকে দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সফল হলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীরা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবেন। এনজিওগুলো মূলত পরিকল্পিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ব্যবসায়ী নয়, সাধারণ মানুষকেও নানাভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে এর প্রমাণ দিয়েছে। কাজেই এসব এনজিও কাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে, তারা কাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মাঠে নেমেছে, তা এখনই খুঁজে বের করা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে এমন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যাতে এ ধরনের এনজিওগুলো আর সরকার ও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে।
নতুন করে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগ না দেওয়ায় চরম সংকটে পড়েছে দেশের গৃহায়ণ শিল্প। এ কারণে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে, যার অর্থমূল্য হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকা। এসব ফ্ল্যাট কেনার জন্য চার হাজারের বেশি ক্রেতা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ফলে ক্রেতাদের একদিকে বাড়ি ভাড়া, অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি একসঙ্গে পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে তিন শতাধিক নতুন প্রকল্পের অধীন তিন হাজার ৬০০ অ্যাপার্টমেন্টের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। ক্ষতির শিকার হয়েছে দুই লাখের বেশি মানুষ। গৃহায়ণ শিল্প খাতের বর্তমান অবস্থা দেখে নতুন ক্রেতারা এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন। এ কারণে ফ্ল্যাট বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কমেছে গৃহায়ণ শিল্পে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ। গৃহায়ণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা চরম সংকটের মধ্যে পড়েছেন। তাঁরা বিনিয়োগ তুলেও আনতে পারছেন না। অথচ এসব বিষয় নিয়ে কোনো সংগঠন প্রতিবাদ করছে না।
বিএলডিএর মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবেশ রক্ষা যেকোনো সুনাগরিকের দায়িত্ব। সচেতন নাগরিক মাত্রই পরিবেশ রক্ষার বিরোধিতা করতে পারেন না। তবে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত অনেক দেশ পরিবেশবিষয়ক বিশ্ব সনদে স্বাক্ষর করেনি। যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি। এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন এবং উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রথম দিকে থাকা ভারতও পরিবেশ রক্ষার নামে উন্নত দেশগুলোর চাপিয়ে দেওয়া শিল্পবিরোধী শর্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কেননা রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা মনে করেছে, পরিবেশ রক্ষা যেমন জরুরি, এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এই সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেই পরিবেশ রক্ষা করা উচিত। তিনি বলেন, মিল-কারখানা বন্ধ করে দিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে, বেকারত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে, তাদের বুভুক্ষু রেখে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন মানবতার সঙ্গে পরিহাস ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হলেই কেবল পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্দোলন করা যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন বিএলডিএর মহাসচিব। তিনি বলেন, বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এতে শিশুমৃত্যুসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য কারো তেমন জোরালো উদ্যোগ নেই। এসব সংগঠন আছে শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার কাজে।
বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ ফজলুর রহমান বকুল কালের কণ্ঠকে জানান, স্টিল মিলগুলোর কাঁচামালের বড় অংশই আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় কাঁচামালের অভাবে প্রায় ২০০ কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে। চালু থাকা ২০০ কারখানাও কাঁচামালের সংকটে ভুগছে। তিনি বলেন, ‘৩০-৪০ বছর ধরে জাহাজ ভাঙা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার নামে হঠাৎ করে জাহাজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আমরাও চাই পরিবেশসম্মতভাবে এ শিল্প গড়ে উঠুক। এ জন্য হঠাৎ সিদ্ধান্ত না নিয়ে কয়েক বছর ধরে এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।’
বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আলী হোসাইন কালের কণ্ঠকে জানান, বেলা নামের একটি এনজিও এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় রি-রোলিং মিলগুলো কাঁচামাল সংকটে ভুগছে। কাঁচামালের অভাবে এ খাতের ৩০০ কারখানার মধ্যে ১৮০টিই এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। বছরে মাত্র দু-একটি বর্জ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রে বর্জ্য ফেলে। কিন্তু ইয়ার্ডে কখনো ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যবাহী জাহাজ আসে না। উন্নত দেশগুলো এত দিন পরিবেশ দূষণ করে শিল্পোন্নত হয়েছে। এখন তারা পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগ দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের মতো একটি দেশ পরিবেশ রক্ষার নামে শিল্প খাত ধ্বংস করছে। তিনি আরো বলেন, ডাইং ও ফিনিশিং কারখানাগুলো থেকে যে পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক নদীতে পড়ছে, জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এর চার ভাগের এক ভাগ দূষণ ঘটছে না।

ধর্মান্ধতা এবং বিজ্ঞানবিমুখতার কুপ্রভাব by শহিদুল ইসলাম

ক. অল্প কিছু মানুষ এ দেশে একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে আসছেন অনেক দিন ধরেই। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি অক্ষয় কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কুদরাত-এ-খুদাসহ অল্প কিছু মানুষ এ নিয়ে ভেবেছেন-লিখেছেন।
তাঁদের লেখা পড়ে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং তাঁদের স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন মিলিয়ে দিয়ে আমরাও সামান্য কিছু কাজ করেছি। 'সোনার পাথরবাটির' মতো আমাদের সে স্বপ্ন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। আমরা ভেবেছি, স্কুলের পাঠ্যসূচিকে বিজ্ঞানমনস্ক করলেই আমাদের সবার চাওয়া-পাওয়ার সফল বাস্তবায়ন হবে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখনো যে বিজ্ঞানের কিছু বিষয় আমাদের পড়তে হয়নি তা নয়। পড়েছি। কিন্তু কখনো ভাবিনি তার সঙ্গে জীবনের বা বাস্তবতার কোনো সংযোগ বা সম্পর্ক আছে। মনের মধ্যে ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানবিরোধিতা পুষে রেখে যাঁরা আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন, তাঁরাও বিজ্ঞানের ওপর খুব ভরসা রাখতেন বলে আমার মনে হয় না। মুখস্থ করে বেশি নম্বর পাওয়াই যেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যপুস্তককে দুই ভাবে ভাগ করেছিলেন। তার এক ভাগ টেঙ্ট বুক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক, যাকে তিনি 'অপাঠ্য' বলে রায় দিয়েছিলেন। টেঙ্ট বুক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত 'পাঠ্য' বই পড়ে কারো মন যে জিজ্ঞাসু হয়ে উঠতে পারে, তা বাংলাদেশের বাইরে এসে উপলব্ধি করতে পারছি। গত ৩ জানুয়ারি ২০১১ ভোরের কাগজে প্রকাশিত 'সূর্যের সঙ্গে বসবাস' লেখাটি পড়লে পাঠক বুঝবেন এখানে শুধু প্রাইভেট নয়, সরকারি স্কুলেও 'স্ক্রিপচার' ক্লাস নামে ধর্মশিক্ষা চালু রয়েছে। তবে সে ক্লাস বাধ্যতামূলক নয়। শুনলাম, সেখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়ও পড়ানো হয়। ফলে ছয়-সাত বছরের শিশু সে ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, সে ক্লাসটি না করার। আমাদের দেশে এ কথাটি কেউ বিশ্বাস করবেন না। একটি ছয়-সাত বছরের শিশু কী পড়বে, না পড়বে_সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে_এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না বলেই আজকের এ লেখার অবতারণা।

দুই. ৫ জানুয়ারি ২০১১। এই লেখাটি লিখছি প্রবাসে বসে। অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের বাসায় কিছু বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম ড্রইং রুমের টেবিলে বসে। বাড়িতে আমি ও আমার সাত বছরের নাতি সূর্য। ভীষণ চঞ্চল, দারুণ বুদ্ধিমান। কিন্তু পাঠ্য বইয়ের প্রতি খুব একটা আকর্ষণ নেই। তার মা-বাবা তাকে পাঠ্য বই নিয়ে বসিয়ে রাখতে সদাব্যস্ত। কখনো-সখনো বিরক্ত-রেগেও যায়। তবু তাকে আমার বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। তার ঘর বোঝাই বই আর বই। দেয়ালে আঁটা পৃথিবীর মানচিত্র ও সমাজ-বিবর্তন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আঁকা মোটা আর্ট কাগজের বড় বড় ছবি। পৃথিবীর কোথায় কোন দেশ জিজ্ঞেস করলে সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দেয়। দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমান্ত্রিক ছবি বলতে কি বোঝায় তা সে জানে। আর্কিমিডিসের 'ইউরেকা', কপারনিকাসের সৌরজগৎ, নিউটনের আপেল_এমনকি ডারউইনের 'বানরতত্ত্ব' ও আইনস্টাইনের 'আপেক্ষিক তত্ত্ব' সবই সে জানে। তার মানে বিজ্ঞানের ইতিহাসের বড় বড় মোড় পরিবর্তন সম্বন্ধে সে ভালোই জানে। খাতার সাইজের দুই-তিন শ বই ঘরটির তিনটি দেয়ালে ঠাসা। অধিকাংশই বিজ্ঞানের। ওর সঙ্গে সারাক্ষণ গল্প করতে আমার ভালো লাগে। যা জানে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে সামান্য লজ্জা বা দ্বিধা করে না। কটা বইয়ের নাম লিখব? কয়েকটি Science Encylopedia ছাড়াও এমন কোনো বিষয় নেই, যার ওপর ২-৪ খানা বই নেই। যেমন Weather : climate & climatic change, Power, What is Inside ‡reat Inventions, Farns & the World Food Supply, Outdoor Science, From Cycle to Spauship, Special Effects in Film & Television, Fossils ছাড়াও আছে Pocket Scientists। সত্যি কথা বলতে কী, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ওর বই থেকে অনেক কিছু বুঝতে পেরেছি, যা আগে পারিনি।

তিন. আজ উত্তেজিত হয়ে সে আমাকে ডাকল। আমি তড়িঘড়ি টেলিভিশনের সামনে এলাম। সূর্য বলল_'এই দেখ, রিচার্ড হ্যামন্ড! এই বইটা ও লিখেছে।' বলে সে একটা বই আমাকে দিল। বইটার নাম 'Can you feel the FORCE?' এবিসিতে তার পরিচালনায় একটি শিশুদের বিজ্ঞান শিক্ষার অনুষ্ঠান। নাম "Richard Hammond's Blast খধন." আজকের বিষয় গ্যালিলিওর 'লস অব ফলিং বডি'। একটি ওয়াশিং মেশিন ও একটি মাইক্রোওয়েভ ক্রেনে করে ওপরে তুলে ছেড়ে দিল। অবশ্যই ওয়াশিং মেশিনটা আগে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। তারপর গ্যালিলিওর তত্ত্বটির ব্যাখ্যা দিলেন হ্যামন্ড। হ্যামন্ডের ভূমিকা থেকে একটু পড়ি। তিনি লিখছেন_'কার, বাইক (সাইকেল), বিমান, স্পিডবোট, হোভারক্র্যাফট, যা কিছু চলন্ত তা আমি ভালোবাসি। কারণ সেগুলো সব action-কাজ-চলন্ত। এসব গতিশীল জিনিস নিয়েই পদার্থবিদ্যা। যখন একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়, গাছ থেকে একটি আপেল মাটিতে পড়ে অথবা বিদ্যুৎ চমকায়, পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব তোমাকে বলে দেয় 'কি হচ্ছে?' তুমি ভাবতে পারো বিজ্ঞানীরা সব কিছুর উত্তর জানে কিন্তু সত্য হলো এই যে, বিজ্ঞানের জগৎ অজানা ও অসংখ্য প্রশ্নে ভর্তি। সেই জন্য এই বইখানা প্রশ্নের পর প্রশ্নে ভরপুর। সেসব প্রশ্নের অধিকাংশেরই সহজ উত্তর আছে কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর আজও জানা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো উত্তর তোমাকে অবাক করবে, কোনো কোনো উত্তরে তুমি অবাক হবে ও আঘাত পাবে_আবার কোনো প্রশ্ন তোমাকে চিন্তায় ফেলে দেবে। 'একটি প্রশ্ন হলো, একটি হাতি ও একটি পাখির পালকের ছবি এঁকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোনটা দ্রুত পড়বে?' মাধ্যাকর্ষণ বা gravity থেকে প্রথম চিন্তা করেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.)। অ্যারিস্টটল দেখেছিলেন এক খণ্ড ইট একটি পালকের চেয়ে দ্রুত নিচে এসে পড়ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারী জিনিস দ্রুত নিচে এসে পড়বে। কোনো পরীক্ষা ছাড়াই তিনি এ সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তর ছিল ভুল। প্রায় ২০০০ বছর কেউ বিষয়টি পরীক্ষা করে তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করেনি। গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) প্রমাণ করেন অ্যারিস্টটল ভুল। শুনলাম, ওই টিভি সিরিয়ালে আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চায় গোসল করা, নিউটনের সামনে আপেল পড়ার বিষয় নিয়ে শিশুদের সঙ্গে হ্যামন্ড নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন। এসব অনুষ্ঠান দেখে একটি পাঁচ-ছয় বছরের শিশুও বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষিত হতে বাধ্য। দৈনন্দিন জীবন থেকে শিশুরা বিজ্ঞানী মন নিয়ে বড় হতে পারে।

চার. রবীন্দ্রনাথ যাই বলুন না কেন, পাঠ্য-পুস্তকের প্রভাব আমাদের জীবনে অপরিসীম। পাঠ্য-পুস্তকে যা লেখা থাকে, সেটাই আমাদের কাছে সত্য। তাই পাঠ্য-পুস্তকের গুরুত্ব ছোট করে দেখার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানমনস্কতার স্থান খুবই কম আছে। টেঙ্ট বুক বোর্ডসহ শিক্ষা বিভাগে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা 'চাকরি' করেন। শিক্ষার্থীরা কি শিখছে, সেসব শিক্ষার ফলে তারা কি ধরনের মানুষ হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তা করা তাঁদের কোনো চাকরির শর্তের মধ্যে পড়ে না। সরকারও বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার জন্য প্রতিবছর পাঠ্যসূচিতে বেশি বেশি বিজ্ঞানের পাঠ ঢুকাচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, স্কুলের শিক্ষার প্রভাব পুরো জাতি বা সমাজের ওপর তেমন কোনো আলোড়ন তুলতে পারছে না। ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানবিমুখতাই আমাদের সমাজে আজ প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। শুধু স্কুলে বিজ্ঞানমুখী পাঠ্যসূচি তেমন কোনো ফল প্রদান করছে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবাদর্শই স্কুল পাঠ্যসূচিতে প্রতিফলিত হয়। তাই সমাজে বিজ্ঞানের প্রভাব বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বিনোদনমূলক ও খেলাধুলার ওপর যতটা জোর দেন শিক্ষা, বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রতি ততোধিক অন্যমনস্ক। হ্যামন্ডের মতো অনুষ্ঠান আমাদের টেলিভিশনের কাছে আশা করা যায় না। তার অনেক কারণ। প্রথম, মালিকপক্ষের মনমানসিকতা। তাঁরা কি চান দেশের মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে উঠুক? বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠুক? যদি চান, তাহলে যত অল্প সুযোগই থাকুক, যতই খরচ হোক না কেন, হ্যামন্ডের মতো অনুষ্ঠান করা অসম্ভব নয়। আমাদের টেলিভিশন, সিনেমা মুম্বাই ও কলকাতার অনুষ্ঠানের ধারা অনুসরণ করে কত অনুষ্ঠান করে। টেলিভিশনের মালিক, কলাকুশলী, সাংবাদিক প্রায় দেশ-বিদেশে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে যান। হ্যামন্ডের মতো অনুষ্ঠান কি তাঁদের চোখে পড়ে না? টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তক দেখে আমাদের মনে হয়, আমাদের বিশ্বাসবিরোধী কোনো সত্য তাঁরা সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেন। সমাজে প্রচলিত ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানবিরোধিতা যেন আমাদের পাঠ্যপুস্তক, মূলধারার টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং সংস্কৃতিচর্চার ওপর এখনো আধিপত্য বিস্তার করে আছে। কেবল পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্ন ও উত্তর সনি্নবেশ করে শিশুদের মনে বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো যাবে না। পরিবারে, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা শিশুদের বিজ্ঞানের পথে নিয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আনওয়ার আহমদ স্মৃতিতে, শ্রদ্ধায় by মনি হায়দার

তিনি ছিলেন কবি ও গল্পকার। কিন্তু সৃজনশীল এই দুটি মাধ্যমের মানুষ হয়েও আনওয়ার আহমদ এদেশের মানুষের অন্তরে বেঁচে আছেন সম্পাদক হিসেবে। কেনো তাঁর এই পরিচয়? এই পরিচয় তিনি তার কাজের ভেতর দিয়ে অর্জন করেছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই_ সম্পাদক হওয়ার জন্যই তিনি জন্মেছিলেন এই বাংলায়।
আর একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়_ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি লালনের জন্য আনওয়ার আহমদ সারা জীবন সাধনা করেছেন। শিল্পের মানুষদের বিপদে আপদে না ডাকলেও তিনি মমতার মন নিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। না, বিনিময়ে তিনি কিছু কখনও চাইতেন না।। আমার ধারণা_ তিনি জানতেন_ এই সমাজের সবাই দুহাত পেতে নেয়, দিতে পারে না কিছুই। নেয়াটাই মোক্ষ। নেয়াটাই ধ্যান। নেয়াটাই যেন অধিকার। নিঃশেষে প্রাণ উজাড় করে দিতে পারে কম লোক। আনওয়ার আহমদ এই 'কম' দলের মানুষ ছিলেন আজীবন, আমৃতু্য।

১৯৬৫ সালে সম্পাদক হিসেবে তিনি সিনে পত্রিকা 'রূপম' প্রকাশ শুরু করলেন। ১৯৪১ সালে জন্ম নিলে তখন তাঁর কতইবা বয়স? চবি্বশ বছর মাত্র। চবি্বশ বছরের যুবকের সম্পাদক হওয়া, স্বপ্ন ও সাহিত্য ফেরি করে বেড়ানো_ সেকালের প্রাদেশিক রাজ্য পূর্ব বাংলায় ছিল সাহসী এবং ব্যতিক্রম। কালের পরিভ্রমণে বাংলাদেশে 'রূপম' হয়ে দাঁড়ালো গদ্যের বা গল্প বিষয়ক একমাত্র পত্রিকা। মৃতু্যর কয়েকদিন আগে শেষ সংখ্যাটি প্রকাশ করেছিলেন পেনশনের টাকায়। বগুড়া তাঁর জন্মস্থান। বগুড়ার তরুণ লেখকদের তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। কেবল বগুড়া নয়_ঢাকার অনেক লেখক তাঁর বাসায় দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছেন। তাঁর অর্থে লালিত হয়েছেন। অনেক লেখকের প্রথম বই নিজের টাকায় প্রকাশ করেছেন তার 'রূপম' প্রকাশনী থেকে। সেই বই আবার নিজে জনে জনে বিলি করেছেন। পত্রিকা অফিসের সাহিত্য সম্পাদককে দিয়ে আলোচনা ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন।

আশির দশকের শুরুতে ঢাকা শহরের জাতক হলেও আনওয়ার আহমদ সম্পর্কে জানতে পারি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কয়েকবার তাঁর ইস্কাটনের বাসায় গেলেও তাঁর সঙ্গে তখন অভিজ্ঞতাবোধের কারণে খাপ খাওয়াতে পারিনি। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার জমেনি। কিন্তু জমলো তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ ছয় বছরে। আমার অফিস ছিল শাহবাগে, বেতারে। তিনি থাকতেন লালমাটিয়ায়। প্রায় প্রতিদিন দুপুরে আসতেন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে। আমিও আসতাম। জমে উঠতো আড্ডা। তখনও আজিজ মার্কেটে হাল ফ্যাশনের পোশাকের আসর বসেনি। লেখক-শিল্পীদের পদভারে মুখরিত থাকতো। সেই জমানো আলাপে আড্ডায় দেখেছি_ তাঁর ভেতরে বাস করে এক আশ্চর্য অবোধ অভিমানী শিশুমন। তিনি কোলকাতায় কি একটা কাজে বেড়াতে যাবেন। আমাকে বরলেন_ কাউকে দিয়ে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে। পাসপোর্টের কাজ করে এমন একজনকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আনওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। তাকে টাকা পয়সাও দিলেন আনওয়ার ভাই। কিন্তু পাসপোর্ট পেতে দুদিন কি তিনদিন দেরি হলো। আনওয়ার ভাই আমার ওপর অসম্ভব চটে গেলেন। পাসপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ে হাতে না পাওয়া যেন আমার অপরাধ। খুব কড়া কথা বললেন।

আমি মনে মনে ভাবলাম_এমন অবিবেচক মানুষের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবো না। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর গণ প্রকাশনীর দোকানে আমার কাছে চিঠি লিখলেন দুঃখ প্রকাশ করে। আমাকে দুপুরে ভুড়িভোজ করালেন। আমাদের স্বল্পকালীন অভিমার পর্ব এখানেই সমাপ্তি ঘটে। অবশ্য এই রকম অভিমান পর্ব প্রায়ই ঘটতো_ যার কোনো প্রয়োজন থাকতো না। কিন্তু ওই যে তাঁর ভেতরে বাস করতো এক অবাক অভিমানী মন! আমি শুনেছি তাঁর অন্যতম সুহূদ বন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকতো। দুমাস, ছয় মাস কথা বা যোগাযোগ বন্ধ থাকতো দুজনের মধ্যে। আবার একদিন মান ভুলে দু'জনে আড্ডায় মেতে উঠতেন। আমি অনেক লেখককে দেখেছি_ আনওয়ার ভাইকে দেখে পালিয়ে বেড়াতেন। কারণ_ সম্পাদক আনওয়ার আহমদ তাঁর গল্প পত্রিকা 'রূপম' অথবা কবিতা পত্রিকা 'কিচ্ছুধ্বনী'র জন্য লেখা চেয়েছেন। তিনি লেখা চেয়ে লেখা না পাওয়া পর্যন্ত লেখককে অতীষ্ঠ করে তুলতেন। তিনি যে লেখককে নির্দিষ্ট করতেন তার আগামী সংখ্যার লেখার জন্য, তার কাছ থেকে দুই পদ্ধতিতে লেখা আদায় করতেন। প্রায় দুদিন পর পর ছোট্ট কাগজে তাগাদা দিয়ে খামে চিঠি লিখতেন। নইলে বাসায় ফোন থাকলে_ সকালে দুপুরে বিকেলে রাতে ফোন করে করে লেখা আদায় করে তবে ক্ষান্ত হতেন।

আনওয়ার ভাই মাঝারি গড়নের প্রায় কালো রঙের মানুষ ছিলেন। মুখটা ছিল মায়াবি। চোখে থাকতো স্বপ্ন। সব সময়ে পড়তেন সাদা শার্ট আর প্যান্ট। এখন আমার মনে হয়_ সাদা পোশাক পরিধানের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর ভেতরের সাদা সত্তাকে প্রকাশ করতেন।

শেষ জীবনে একা থাকতেন লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে আনওয়ার আহমদ। চারপাশে তাঁর সবই ছিল, তারপরও কিছু ছিল না। প্রথম জীবনের মানুষগুলো তাঁর কাছ থেকে নানা কারণে দূরে ছিল। তবে তিনি কখনও একা থাকতেন না। সব সময় তাকে ঘিরে একটা আড্ডা গড়ে উঠতোই। আজিজ মার্কেটের নিচতলায় দুটো বইয়ের দোকান ছিল পাশাপাশি। একটা গণ প্রকাশ। অন্যটি পলল প্রকাশনী । এই দুটি দোকান ঘিরে আড্ডা জমতো। তবে বেশি জমতো গণ প্রকাশে। তার বন্ধুরা বা আড্ডার মানুষেরা সব সময়ে তাঁর বয়সের চেয়ে অনেক কম বয়সের থাকতো। তিনি আশ্চর্য দক্ষতায় ও মমতায় তরুণদের ভেতরে নিজেকে জারিত করতে পারতেন। পারতেন উজ্জীবিত করতে।

মনে পড়ে তাঁর মৃতু্যদিনের গল্প। হঁ্যা_ গল্পই। ২০০৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি সাহিত্য সংগঠন বেশ কয়েকজনকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। তার মধ্যে আনওয়ার ভাইও ছিলেন। যেহেতু আনওয়ার ভাই সংবর্ধিত ব্যক্তি, সেহেতু আমরাও সেখানে উপস্থিত হলাম। সংবর্ধনা শেষে আনওয়ার ভাই হঠাৎ ঘামতে শুরু করলেন। আমরা_ মানে আমি, কবি মিজান রহমান, খায়রুল আলম সবুজসহ আরও অনেকে। সবুজ ভাই তাঁকে বিশ্রাম নিতে বললেন। আনওয়ার ভাই একটা টেবিলের উপর শুয়ে পড়লেন। কে কোথা থেকে কি একটা ঔষধ এনে দিলে আনওয়ার ভাই মুখে দিলেন এবং আমাদের সঙ্গে আম গাছতলায় এসে আড্ডায় বসলেন। সবুজ ভাই তাঁকে যতো শুয়ে থাকতে বলেন তিনি কেয়ার করেন না। আসলে তিনি আড্ডা ছেড়ে শুয়ে আছেন ভাবাই যায় না। আড্ডা দিতে দিতে রাত নটার দিকে, তাও সবুজ ভাইয়ের ধমকে _ আমরা উঠতে বাধ্য হলাম। বাংলা মোটরেরর মোড়ে এসে একটা রিকশায় তুলে রিকশাঅলাকে বললাম_ রিকশাঅলা ভাই, এই বয়স্ক মানুষটাকে যত্নের সঙ্গে পৌঁছে দিও।

আনওয়ার ভাই প্রতিবাদ করে বললেন_ এই রিকশাঅলা, আমি না ওরাই বয়স্ক। আমি চির তরুণ। রিকশাঅলা সহ আমরা হাসলাম। রিকশা চলে গেলে আমরা যে যার বাসায় চলে গেলাম। পরের দিন সকাল সাড়ে নটার দিকে 'উষালোকে' সম্পাদক মোহাম্মদ শাকেরউলস্নাহ ফোন করে মর্মান্তিক খবরটা জানালেন। আনওয়ার ভাই ছোট ছোট গল্প লিখেছেন অনেক। প্রায় অণু গল্প। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর একলা ঘরে তিনি নিজেই একটা অণুগল্প হয়ে গেলেন_ ২৪ ডিসেম্বর ২০০৩ এ রাতে পরম মৃতু্যকে আলিঙ্গন করে।

পরের দিন বিকেলে আজিজ মার্কেটে পলল প্রকাশনীতে তাৎক্ষণিক এক স্মরণসভার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে অনেক মানুষের সমাবেশ হয়েছিল আনওয়ার ভাইকে মনে রেখে। শুধুমাত্র শিল্পের জন্য একজন মানুষ কতোবড় ত্যাগ করতে পারেন, তিনি তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর মৃতু্যর পর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক স্মরণসভায় আবদুলস্নাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন_ 'আনওয়ার আহমদ শিল্পের শহীদ'। তিনি যথার্থই বলেছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যের পুরুষোত্তম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একটা লেখায় আনওয়ার আহমদকে সত্যিকারের সম্পাদক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন , দুজনেরই জীবদ্দশায়। এই বাংলাদেশে তিনি তাঁর কাজের তেমন কোনো স্বীকৃতি পাননি। তাঁর ভেতরে দুঃখবোধ থাকলেও কখনও প্রকাশ করেননি।

আনওয়ার আহমদের প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা_পনেরোটি। বিখ্যাত কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ_ রিলকের গোলাপ, মানবসম্মত বিরোধ, নির্মাণে আছি, হঠাৎ চলে যাবো, শেষ সম্বল শেষ দান। গল্পের বই চারটি। আরও বেরিয়েছিল_ আনওয়ার আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, আনওয়ার আহমদের গল্প। এ ছাড়াও আর অনেক কাজ তিনি করেছেন, যা আমরা মনে রাখিনি।

আগেই বলেছি, এদেশে আনওয়ার আহমদ কোনো পুরস্কার পাননি। ট্রাজেডি হচ্ছে তাঁর মৃতু্যর সাত মাস পর কোলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে তাঁকে পুরস্কৃত করে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি ও পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পুত্র নাজিম আনওয়ার রূপম। এটাও একটা গল্প।

আনওয়ার ভাই, আপনার সপ্তম মৃতু্যদিবসে আপনাকে প্রণতি জানাই। মরণসাগর পাড়ে আপনি ভালো থাকুন। জানি_আমাদের যাবতীয় দীনতাকে ক্ষমা চাইবার আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন আপনি আপনার স্বভাব অনুসারে।

আবুল হুসেন 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের পথিকৃৎ

'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব'_এই আপ্তবাক্য সামনে রেখে বিংশ শতাব্দীর প্রথিতযশা দার্শনিক আবুল হুসেন তাঁর 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের সূচনা করেন। বাঙালি মুসলমান সমাজের যুগ যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞান-পিপাসা জাগিয়ে তোলাই ছিল, তাঁর 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের লক্ষ্য।

তাঁর দর্শনের মূল নির্যাস ছিল মুক্তচিন্তার অনুশীলন। স্বাধীন মতপ্রকাশকে তিনি স্বজাতির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত বলে মনে করতেন। বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনীহার সমালোচনা করে আবুল হুসেন বলেন, 'আমাদের শিক্ষাঙ্গনেই আমরা জ্ঞানের সঙ্গে বিরোধ করে আসছি। দর্শন, বিজ্ঞান ও আর্টকে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্র হতে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি, এই ভয়ে_পাছে আমাদের ধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম আমাদের এতই নাজুক!'

জন্ম পরিচিতি, শিক্ষা ও রচনাবলি

অবিভক্ত বাংলার প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক, সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আবুল হুসেন ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলার পানিসারা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস যশোরের কাউরিয়া গ্রামে। পিতা হাজী মোহাম্মদ মুসা ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম।

শিক্ষা জীবনে ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে আবুল হুসেন যশোর জেলা স্কুল হতে মেট্রিকুলেশন, কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে আইএ ও বিএ এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২০ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২২ সালে বিএল এবং ১৯৩১ সালে এমএল ডিগ্রি লাভ করেন।

পেশাগত জীবনে কোলকাতার হেয়ার স্কুলের শিক্ষকতা দিয়েই কর্মজীবন শুরু করেন। বছর খানেক পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের লেকচারের পদসহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর নিযুক্ত হন ১৯২১ সালে। ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী ছেড়ে কোলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। অবিভক্ত বাংলার বিধান সভায় পাশকৃত ওয়াক্ফ আইনের খসড়া আবুল হুসেনই প্রস্তুত করেন।

মানবদরদী আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী কালীন সময় হতেই 'শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো' বিতরনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা আনায়নে কাজ শুরু করেন। কৃষি নির্ভর দেশ মাতৃকার কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশার মুক্তির পথ নির্দেশনায় তিনি কৃষকের আর্তনাদ, কৃষকের দুর্দশা, কৃষি বিপস্নবের সূচনা নামক প্রবন্ধ রচনা করেন। ঢাকায় যে 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, যার মূলমন্ত্র ছিল- "জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব' তার নেতৃত্ব দেন অগ্রভাগে থেকেই। তিনি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং এর মুখপত্র 'শিখা' সম্পাদনা ও প্রকাশ করে এর আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহ্ ও আবুল ফজল তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন।

অন্ধভাবে ধর্ম ও সমাজবিধি পালন নয়; মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা ধর্ম ও প্রথাকে যাচাই করার পক্ষে তিনি জোড়ালো মতামত উপস্থাপন করেন। এতে ঢাকার রক্ষনশীল মুসলিম সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুিরতে ইস্তফা দিয়ে কোলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন।

মাত্র ৪৩ বছর বেঁছে ছিলেন এই বাঙালি মনীষা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর কোলকাতায় মৃতু্যবরণ করেন। এই ছোট্ট জীবনকালে তিনি 'মুসলমানদের শিক্ষা সমস্যা, মুসলিম কালচার, বাঙলার নদী সমস্যা, শতকরা পঁয়তালিস্নশের জের, সুদ রিবা ও রেওয়াজ, নিষেধের বিড়ম্বনা, ঐবষড়ঃ্থং ড়ভ ইবহমধষ, জবষরমরড়হ ড়ভ ঐবষড়ঃং ড়ভ ইবহমধষ, উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ গঁংষরস ষধ িরহ ইৎরঃরংয ওহফরধ নামক গ্রন্থসমূহ রচনা করেন। তাঁর রচনায় মুক্তবুদ্ধি, উদার চিন্তা ও অসামপ্রদায়িক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতিফলন ঘটেছিল।

আবুল হুসেনের দর্শন, বুদ্ধির মুক্তি

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ঢাকায় ড. মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহ্র নেতৃত্বে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' গঠিত হয়। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের সমাজ সচেতন করে তোলা। নানারূপ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার হতে মুক্ত করা। এই সংগঠনটির নাম মুসলিম সাহিত্য সমাজ হলেও এর কর্মকান্ড আবর্তিত হত হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির জন্য। এই সংগঠনের মুখপত্র ছিল 'শিখা' সে সূত্রে এর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাঁরা 'শিখা গোষ্ঠীর' লেখকরূপে পরিচিত হন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। আর এই শিখার সম্পাদক-প্রকাশক হিসাবে আবুল হুসেন ছিলেন 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিদের অন্যতম। শিখা গোষ্ঠীর অন্যান্য লেখকদের মধ্যে কাজী আবদুল অদুদ, (১৮৮৭-১৯৪৮) কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), কাজী আনোয়ারুল কাদির (১৮৮৭-১৯৪৮) মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-৫৬) আবুল ফজল এবং আবদুল কাদির (১৮৮৭-১৯৪৮) এর নাম উলেস্নখযোগ্য। মুসলিম সাহিত্য সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আবুল হুসেন বলেন, 'বাঙালি মুসলমান সমাজের যুগ-যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞানের অদম্য পিপাসা জাগিয়ে তোলা।'

আবুল হুসেনের দর্শনের মূল নির্যাস ছিল মুক্তচিন্তার অনুশীলন। স্বাধীন মত প্রকাশকে তিনি স্বদেশের স্বজাতির আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত বলে মনে করতেন। বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার অনীহার সমালোচনা করে আবুল হুসেন বলেন- আমাদের শিক্ষাঙ্গনেই আমরা জ্ঞানের সঙ্গে বহুদিন হতে বিরোধ করে আসছি। দর্শন, বিজ্ঞান ও আর্টকে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্র হতে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি, এই ভয়ে- পাছে আমাদের ধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম আমাদের এতই নাজুক।

"ব্রিটিশের সঙ্গে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্ত মন যখন এ দেশে আসলো এবং আমাদের আড়ষ্ট মনকে আঘাত করল, তখন হিন্দু সমাজ সে আঘাতে জেগে উঠলো এবং জ্ঞানদীপ্ত মনকে বরণ করে নিল। আর আমরা মুসলমানরা সে আঘাতে জাগতে তো চাই-ই নি বরং চোখ রাঙিয়ে সে মনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ইয়োরোপের জ্ঞানকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের সে নিদারুণ ভুলের সংশোধনের চেষ্টা করি নাই। বরং সে ভুলকে বর্তমানে আরো জোর করে আঁকড়ে ধরেছি।"

জ্ঞান সাধনাই ছিল জ্ঞান তাপস আবুল হুসেনের জীবন দর্শন। তাই তো তিনি তাঁর প্রথম পেশা হিসাবে শিক্ষাকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। থাকতে চেয়েছেন শিক্ষকতায় মনে প্রাণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেবার পাশাপাশি নিজের সাহিত্য সাধনা ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষকে জ্ঞানের পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। বাঙালির মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা জাগরণে আবুল হুসেনের বাংলার বলশী (১৩৩২ বঙ্গাব্দ) এবং বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা (১৩৩৫) অসমান্য অবদান রেখেছে। আবুল হুসেনের দর্শনের মূল কথা ছিল 'জ্ঞানেই মুক্তি' আর বুদ্ধির মুক্ত চর্চা ছাড়া জ্ঞানের ফল সার্বিকতা পায় না। তাই তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র 'শিখা' সম্পাদনার মধ্য দিয়ে "জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব"। এই শেস্নাগানের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বুদ্ধির মুক্তির জন্য কাজ করেন।

আবুল হুসেন এর দর্শনে মানবতাবাদ ও অসামপ্রদায়িকতা

বাঙালি মানবতাবাদী দার্শনিক হিসাবে আবুল হুসেন মানসে লালন করতেন অসামপ্রদায়িক মানবতাবাদের আদর্শ। যার প্রমাণ আবুল হুসেন এর নিজের লেখনিতেই পাওয়া যায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে লিখিত নিবন্ধে তিনি লিখেন, 'কেহ হয়ত মনে করবেন এ সমাজের নাম 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' হওয়ায় হিন্দু সাহিত্যিকগণের কোন সম্পর্ক এতে নেই। কিন্তু এই বার্ষিক রিপোর্ট হতে আপনারা বুঝবেন যে এ সমাজ কোন একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয় কিংবা এ কোন এক বিশেষ সামপ্রদায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গঠিত হয়নি। সাহিত্য সৃষ্টি এর উদ্দেশ্য, আর সেই সাহিত্যে মুসলমানের প্রাণ ও জীবন ফুটিয়ে তোলাই ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য।'

সত্যই তাই আবুল হুসেনের সম্পাদনায় 'শিখা' বাংলার তরুণদের মনে উদার মনোভাব সৃষ্টির জন্য নিরলস ভাবে কার্যকর ছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ব্যানারে শিখা গোষ্ঠীর কার্যক্রম উভয় বাংলার জ্ঞানী গুণীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। যার প্রমান মিলে- ১৯২৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, মোহিত লাল মজুমদার, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ হিন্দু মনীষার অংশ গ্রহণ। যা আবুল হুসেনসহ সমগ্র শিখা গোষ্ঠীর অসামপ্রদায়িক উদারমনা মানবতাবাদেরই পরিচয় বহন করে।

জ্ঞানের অনুরাগী আবুল হুসেন এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও আইনকে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে আজীবন কাজ করেছেন। মানব কল্যাণে আবুল হুসেনের ভাবনা ছিল উপযোগবাদী। আবুল হুসেন নিজে একজন কমিউনিষ্ট না হলেও তৎকালীন রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হন। ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী সমাজের নিপীড়িত কৃষকের অবস্থা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে তাঁর 'বাংলার বলশী' পুস্তকে।

আবুল হুসেনের দর্শন ও কর্মের মূল্যায়ন

চিন্তাবিদ হিসাবে আবুল হুসেন ছিলেন মানবতাবাদী, সংস্কারপন্থী ও মুক্তচিন্তার পৃষ্ঠপোষক। জ্ঞান চর্চায় তিনি যুক্তি বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বাধিক। আর এই যুক্তি বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রীতির কারণেই তৎকালে তিনি লিখতে পেরেছিলেন, "অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলামও কতগুলি আদেশ ও নিষেধের সমষ্টি মাত্র। ইসলাম মানুষের জন্য, মানুষ ইসলামের জন্য নয়। কালের পরিবর্তনে ধর্মশাস্ত্রের কথা মানুষ পুরোপুরি পালন করতে পারে না। যেহেতু, সংসারের উন্নতির জন্যই মূলত ধর্ম বিধানের সৃষ্টি, সেহেতু, যুগের সাথে সংসারের উন্নতির জন্য ধর্ম বিধানও পরিবর্তনীয়। নবীজীর অমোঘ বাণী-যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীন দেশে যাও, আমরা ভুলতে বসেছি।

ইসলামের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং স্বদেশ স্বজাতির উদ্দেশ্যে ইসলামের যুক্তিনিষ্ঠ স্বরূপ উপস্থাপন করে, 'আদেশের নিগ্রহ' নামের যে প্রবন্ধ আবুল হুসেন লিখেছেন; তৎকালীন রক্ষনশীল মুসলিম সমাজে তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা আবুল হুসেনকে ইসলামের শত্রুরূপে আখ্যায়িত করে। আহসান মঞ্জিলের এক সালিসিতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। ইসলাম সবযুগের সব স্থানের সব মানুষের সব প্রয়োজন মিটাতে ও সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বলে তিনি মনে করেন এবং বলেন, 'সে প্রয়োজন মিটাতে হবে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে'। তাঁর প্রবন্ধের এটাই ছিল সারমর্ম। আবুল হুসেন পরের দিন সাহিত্য সমাজের সম্পাদকের পদ এমনকি সদস্য পদও ত্যাগ করেন এবং পরিশেষে ঢাকা ত্যাগ করে কলিকাতায় গমন করেন।

আবুল হুসেন ছিলেন সাহসী মানুষ। স্বাধীন যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তা চর্চা তখনো এদেশে সহজ ছিল না, এখনো নেই। এজন্য আহমদ শরীফ আবুল হুসেন সম্পর্কে বলেন, 'শিখা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন আবুল হুসেন। তিনি সংস্কারক বিবেকবান পুরুষ তাই তাঁর স্বল্পকালীন জীবন নিবেদিত ছিল স্বদেশের, স্বসমাজের ও স্বজাতির কল্যাণ চিন্তায় ও হিত সাধনে। দেশ, মানুষ, ধর্ম, ন্যায় ও কল্যাণ সম্বন্ধে তার চিন্তা চেতনায় কিছু কিছু অনন্যতা ছিল।'

পরিশেষে আহমদ শরীফের মূল্যায়ন দিয়েই শেষ করছি, 'আবুল হুসেন চিন্তা চেতনায় ছিলেন মানবতাবাদী। তাই তিনি অসামপ্রদায়িক, উদার, শ্রেয়োবাদী ও হিতবাদী এবং দৈশিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম মিলনকামী ও গনহিতে মিলিত প্রয়াসকামী। নিরঙ্কশ প্রীতিই এ বন্ধনসূত্র ও মিলন সেতু।'

আর আমাদের লজ্জা হলো এমন তরো দর্শন অনুরাগী বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিকে কিনা শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকুরী ছেড়ে কোলিকাতায় যেতে বাধ্য করেছে। এটি অবশ্যই বাঙালির দর্শনের অপরিমেয় ক্ষতি।

ফরিদপুরে 'সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব' by জাহারাবী রিপন

সাংসারিক চলমানতা ও যোগাযোগের নৈয়ায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে ভ্রমণের সঙ্গে গতি ও গন্তব্যের যোগ প্রত্যক্ষ করি। যে চলেছে তার গতি আছে তবে গন্তব্যের ঘরে। কিন্তু সেখানে পেঁৗছানোর পরে গতি স্তব্ধ হয় নাকি! ঘরে পেঁৗছালেই গতি শেষ হয়ে যায় না।

সে তখনও অবিরাম চলতে থাকে। তাই তো কবি বলেন_ গতিতে জীবন মম স্থিতিতে মরণ। জঙ্গম জীবনে তবে স্থিতি নেই। ক্ষণিক অবসরে যেটুকু স্থিরতা জ্ঞান করি, তাও প্রাকৃত অর্থে স্থির নয়_ চলছে। তবে কি আমরা জীবন ঘরে বসে অবিরাম চলমানতার ছবি অঙ্কন করে চলেছি? অদৃশ্য তুলি ও ক্যানভাসে মন তবে ছবি অঙ্কন করে। গতি ও গন্তব্যের ঘরে ভ্রমণের ছবি! যার দেখার প্রখর দৃষ্টি_ দেখবে বলে জীবনের চলচ্ছবিতে কিছু ভ্রমণ অভিজ্ঞতার দৃশ্য সংযোজন করছি।

ডিসেম্বরের শুরুকালে শীতের শর্ষে ফুলের ভর দুপুরে প্রান্তর পারায়ে ঢাকা থেকে গেলাম ফরিদপুরে। শুক্রবার_৩ ডিসেম্বর। শীতের কাঁপন লাগা ভোরে গন্তব্য পথে যথারীতি নির্ধারিত বাহনের জন্য ঢাকার টেকনিক্যাল মোড়ে অপেক্ষা করছি। মাথায় শীত সকালের কুয়াশামাখা মস্নান সূর্য ক্রমে কুয়াশা ভেদ করে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। ক্রমশ শীত কমে আসে। মোবাইলে রিং বাজলে ধরি। ঢাকার নাট্যসংগঠন 'স্বপ্নদল'-এর প্রধান সম্পাদক জাহিদ রিপনের কণ্ঠ। তিনি প্রায় আহত কণ্ঠে বলেন_গাড়িতে ঝামেলা হয়েছে, আসতে বিলম্ব হতে পারে_ আমরা শ্যমলী আছি, আপনি চলে আসেন। আহ্বানে সাড়া দিতে টেকনিক্যাল থেকে শ্যামলীর উদ্দেশে বাসে উঠি। পেঁৗছে পথে নেমে পকেটে হাত পড়তেই দেখি_ পকেট ফাঁকা। হায়_ কোন্ চোরায় করল রে চুরি! অর্থ পরিমাণে খুব বেশি নয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের কষ্টার্জিত অর্থের এই অনাবশ্যক বিয়োগ বেদনা আমাকে আর অন্যদের মতোই ব্যথিত করে তোলে। আহত স্বরে ভ্রমণ সঙ্গীদের অর্থ বিয়োগের ঘটনা বললে তাদের কেউ কেউ ঠাট্টার ছলে যে ভাষায় সান্ত্বনার কথা বলেন তা যেন উজ্জ্বল অনলে ঘৃতাহূতি। আরো দ্বিগুণ বেগে বেদনা জ্বলে উঠে। মধ্যবিত্তের বিড়ম্বনার তো শেষ নেই। কিছুক্ষণ নীরব থাকি।

ভ্রমণে চলেছি_ত্রিশ জনের অধিক ভ্রমণ সঙ্গী। বয়সে সকলে সমান নয়, কিন্তু মনে মনে মিলের কোনো কমতি নেই। আমরা সকলে নাট্যকর্মী_ কেবল বাসের ড্রাইভার ও হেলপার ছাড়া। তবে জীবনমঞ্চে তারাও নিশ্চয় নটের ভূমিকা বহে নিয়ে চলেছে। নারী-পুরুষ মিলে বাহনে বসেছি। আমাদের সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজও আছেন। তিনি ফরিদপুরের নাট্যোৎসবের একজন আমন্ত্রিত অতিথি। আমন্ত্রিত অতিথি যাত্রাপথের সামনে আরো একজন। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে তিনি আর কেউ নন_আমাদের প্রিয় 'পারুল ভাবি'। নাট্যগুরু সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তোরণে নেমে অপেক্ষমাণ পারুল ভাবিকে গ্রহণ করি। তিনিও সহাস্যে আমাদের বরণ করেন। অতঃপর যাত্রাপথের নির্ধারিত কর্মসূচির অংশে নাট্যগুরু সেলিম আল দীনের সমাধি প্রাঙ্গনে গমন করি। সেখানে কিছুক্ষণ শরণ ও অপেক্ষাতে পুষ্প-কৃতাঞ্জলিতে নীরব অশ্রুপাতের ক্ষরণ অনুভব করি। পাশে পূজ্যপাদ সৈয়দ আলী আহসানসহ আরো কয়েকজনার সমাধি দেখতে পাই। যার সবগুলো বাঁধাইকৃত_ মোড়কে নামের ফলকে আবৃত। কেবল সেলিম আল দীন সমাধি তখনও অপেক্ষমাণ। তবে আশা করছি_ এই সমাধিও মোড়কে ও নামের ফলকে অচিরেই শোভাময় হয়ে উঠবে নিশ্চয়। বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ ও সেলিম অনুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

পুষ্পাঞ্জলি পর্ব অন্তে আবারও যাত্রা শুরু করি। পথে চলতে চলতে সেলিম আর দীন কৃত আর স্বপ্নদলের প্রযোজনায় মঞ্চে নিয়মিত 'হরগজ' নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবিদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সে ভাবনাতেও আছে বিপত্তি_ আমার পাশের আসনে বসা প্রযোজনায় আবিদের চরিত্রে রূপদানকারী জাহিদ রিপন। অবিদের কথা মনে করার সুযোগ কোথায়? তবুও যাত্রাপথের গতির সঙ্গে সে মহৎ নাটকের অভিগমনকে সাযুজ্য জ্ঞান করি। 'হরগজ' নাটকে আবিদ ত্রাণের উদ্দেশে আর্ত মানবের সেবায় ছুটে চলে গ্রামের মাঠ, প্রান্তর ও শস্যক্ষেত্র দৃষ্টির অমৃত কুম্ভে ভরে নিয়ে। তার গমনের উদ্দেশ্য মহৎ_ মানবতার সেবা ভিন্ন আর কিছু নয়। আমরাও চলেছি_ আবিদের মতো নয়। আবার আবিদের মতোও বটে! গতির বৈচিত্র্যে চিহ্নরেখার বন্ধনে ঘাট ভিন্নতর হলেও গন্তব্য হয়তো অভিন্ন। আমাদের উদ্দেশ্যও সেবা_ শিল্পের সেবা। সে অতি মহৎ কাজ কিনা জানি না_ তবে মানবের মনে ক্ষণিক আনন্দের অবসরে নবতর চেতনার স্ফূরণে তাকে জাগিয়ে তোলে। জানি এ কাজ সহজ নয়। তবুও ফরিদপুরে 'বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী'-র 'বিজন ভট্টাচার্য পথ নাট্যমেলা- ২০১০'-এর শেষ দিনে উৎসবে যোগ দিতেই আমাদের এই নির্ধারিত যাত্রা। উদ্দেশ্য আরো আছে। শোনার আগ্রহে জমিয়ে রাখছি।

যাত্রাপথের উপান্তে এসে পদ্মার সাক্ষাৎ মিলে। হায়রে প্রমত্তা পদ্মা! ভয়ঙ্কর বিস্তার ও খরতর প্রবাহের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শীর্ণ-বিশীর্ণ মৃতপ্রায় নদী। এই নদীর সঙ্গে মানব জীবনের খানিক মিলও আছে বটে। ভর যৌবনে দেখা নদী আর জীবন সায়াহ্নে দেখা নদীতে এই বুঝি পার্থক্য। গাঙের জোয়ার অপসৃত হলে ভাটার টানে জীবন ও নদীর বাঁক ঐক্য সূত্রে বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখনও যৌবনের চোখে দেখছি নদী। দেখে মনে হয় একদিন আমাদের যৌবনও ভাটার টানে এই মৃতকায় নদীর রূপ পাবে নিশ্চয়। দেহমনের উত্তাপ একদিন একদিন কমে যাবে। মনের ফুটন্ত বালিতে তখন স্বপ্ন-বুননের খই আর ফুটবে কি? কোন মরা গাঙের স্রোতে কোন অদৃশ্য অদেখা পুরীতে পেঁৗছে যাবে এই শিল্পীমন! কে জানে?

সে যাই হোক। পদ্মাপারের অনতিদূরেই ফরিদপুর শহর। নদী পারাপারের পরে গতিপথে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। বাহন বাসটি চলছে। চলছি আমরাও। কিন্তু সে চলনে ভেদ আছে। আমরা সচল বাসের সঙ্গে। আর বাসটি সচল গতি ও পথের পরিক্রমণে গন্তব্যের ঘরে। চলতি পথের মাঠ, প্রান্তর, শীতের শর্ষে ফুলের হলুদ আভা, বিকেলের সোনা রোদে দেখা নানা দৃশ্যমালা মন ভুলিয়ে দেবার মতো আবহ সৃজন করে। তবু মনে কখনও কখনও পথের শুরুতে আকস্মিক অর্থ হারানোর বেদনা মনের ক্ষতে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। কিন্তু ফরিদপুর শহরে পেঁৗছে আমাদের গন্তব্য কবি জসীমউদ্দীন হল প্রাঙ্গণে বাস থেকে নামতে গিয়ে নাট্যকর্মীদের শ্রীহস্ত থেকে রজনীগন্ধা ফুলের যে অভ্যর্থনা পেলাম তা যেন জগৎ সংসারের সকল দুঃখ-বেদনা ভুলিয়ে দেবার মতো মতো ঘটনা। পথের শ্রান্তি ও বেদনার বিবরে তখন আনন্দ আর প্রশান্তির অদৃশ্য প্রবাহ চলতে শুরু করেছে।

কবি জসীমউদ্দীন হল চত্তরে এসে মনটা ভরে যায়। সেখানে ফরিদপুরের নানান দলের নাট্যকর্মীরা মিলে দেয়ালে পোস্টারে ঢাকার নাট্যদল স্বপ্নদলকে উদ্দেশ ও উপলক্ষ করে কিছু প্রশস্তি কথা ও নিবেদন বাণীতে যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে তা একেবারেই অভিনব। আমার মধ্য জীবনের অভিজ্ঞতাতে তো বটেই। মনে থাকবে অনেক দিন।

অতঃপর একটু দূরে রাত্রি যাপনের জায়গায় গমন করি। সেখানের পথে পথে ও তোরণে নাট্যকার সেলিম আল দীনের ছবি সম্বলিত লেখা_ 'স্মরণে নাট্যভাষে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন'। যথার্থ এই বাক্য নির্মাণ_যেন কোনো ঘোষণার গতি বিলোপন করে মনে। আর সেজন্যই তো আমাদের ফরিদপুরে আসা। সেখানে বিকেলের বিশ্রাম অন্তে উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর পথ নাট্যমেলায় যোগ দিতে গমন করি অম্বিকা ময়দানে।

অম্বিকা ময়দান_এক বিখ্যাত ব্যক্তির নামের সঙ্গে অন্বিত। ফরিদপুরের কৃতি সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক অম্বিকাচরণ মজুমদারকে স্মরণ করেই ফরিদপুরবাসীর এই নামকরণ। সার্থক নামকরণ বটে। সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও যিনি মানবতার সেবায় নিজেকে নিবেদন করেন_তিনি মহৎ বলতে হবে। অম্বিকাচরণ মজুমদার মানবসমাজের এমনই একজন।

জাহিদ রিপনের নেতৃত্বে অম্বিকা ময়দানের মেলায় প্রবেশ মাত্র আয়োজন যা দেখলাম তাতে চক্ষু একেবারে চড়ক গাছ! এক অবিশ্বাস্য আয়োজনে। মেলার প্রবেশ মুখে নাট্যমেলার নামকরণ বৈদু্যতিক আলোকের ঝলকে জ্বলছে। ভেতরে একদিকে মঞ্চ_ তার বিপরীতে থৈ থৈ দর্শক নাটক দেখছেন। আর ময়দানের তিন দিকে পোস্টার প্রদর্শনীর এক বিশাল আয়োজন। শুধু আয়োজন নয়_ আয়োজন যজ্ঞ বলতে হবে। সে যজ্ঞে শোভিত পোস্টার প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের নাট্যপ্রযোজনার গুরুত্বপূর্ণ সকল পোস্টার ও নাট্যকারদের ছবি, বিশ্ব নাট্যপ্রযোজনার উলেস্নখযোগ্য পোস্টার ও খ্যাতিমান নাট্যকারদের ছবির সঙ্গে ঢাকার স্বপ্নদল ও ফরিদপুরের বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীর উলেস্নখযোগ্য প্রযোজনা ও কর্মকৃতির দলিল সমুপস্থিত। পাশ্চাত্যের প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে প্রাচ্য-ভারতীয় প্রবীণ নাট্যকারদের সঙ্গে সমকালীন নাট্যকারদের অনেক দূর্লভ ছবি সংগৃহীত হয়েছে নাট্যমেলায়। অনন্যসাধারণ এক শ্রমসাধ্য ঘটনা বলতে হবে। হাজারের অধিক ছবি ও পোস্টারের সংগ্রহের আয়োজন তো কম কথা নয়! বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর সক্রিয় উদ্যোগের পশ্চাতে সেখানে আরো একজনকে খুঁজে পাই। তিনি সরকারি ইয়াসিন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেন। এ বিশাল পোস্টার ও ছবির আয়োজনের নেপথ্যজন অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেনকে শরণ্য জ্ঞান করি। এমন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মী এদেশে সংখ্যায় খুব কমই জন্মেছে।

নাটকের পোস্টার দর্শন শেষে স্বপ্নদলের ডাক পড়ে মঞ্চে। ইতোমধ্যে ঢাকার একটি দল নাটক প্রদর্শন সমাপ্ত করেছে, স্থানীয় আরো নাট্যদল অপেক্ষা করছে। স্বপ্নদল তাদের সর্বশেষ প্রযোজনা 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি' মঞ্চস্থ করবে। ঘোষণা অন্তে যথারীতি নাটক শুরু হলো। নাট্যকার সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিকথার নাটক। নাট্য প্রদর্শন কালে কোনা এক সময় মঞ্চে গান ও কোরিওগ্রাফির সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন নাট্যকর্মীরা। মঞ্চে তখন গানে ও পতাকার আবহে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ মূর্ত হয়ে উঠেছে। অভিভূত প্রায় হাজার তিনেক দর্শক যেন নিজেদের অজান্তেই প্রবল করতালির মধ্য দিয়ে মঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠলেন! এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। শিল্পের শক্তিকে আভূমি প্রণাম করি।

নাটক সমাপনান্তে মঞ্চে ডাক এলো। উপস্থিত হলাম। পারুল ভাবি এলেন। আরো এলেন জাহিদ রিপন। অতঃপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এবার 'স্বপ্নদল' এবং ফরিদপুরে 'সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব উদ্যাপন পরিষদ'-এর স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণার পালা। পারুল ভাবি 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি' নাট্যপ্রযোজনা ও তদীয় অনুভুতির কথা ব্যক্ত করে স্বপ্নদল ঘোষিত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বছরব্যাপী সেলিম আল দীন স্মরণোৎসবের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। ফরিদপুর থেকে শুরু হলো এ অনুষ্ঠান। আবারও প্রবল করতালি। মঞ্চ ও অম্বিকা ময়দান মুখর হয়ে উঠলো। সে এক উলেস্নখযোগ্য সন্ধ্যারাত্রি। অতঃপর 'ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি'-র নিমন্ত্রণে অম্বিকা ময়দান থেকে তাদের ভবনে নৈশভোজে গমন। উষ্ণ আতিথেয়েতায় মুগ্ধ হলাম। নাট্যকর্মীদের জন্য অত্যন্ত আন্তরিক ভোজের আয়োজন। খাদ্য তালিকায় অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে নদীর বড় পাঙ্গাস ও আইড় মাছ। মাছে ভাতে বাঙালি এই ঐতিহ্য থেকেই এ আয়োজন কিনা জানি না। তবে অনেক দিন পরে টাটকা বড় মাছ সোয়াদ মনে রাখার মতো ঘটনা বটে!

নৈশভোজে অন্তে ঘুমানোর স্থলে ফিরে এলাম। তখনও আরেক আয়োজন। ঘরোয়া পরিবেশে 'হরগজ' নাটকের রিহার্সেল। সেখানে পারুল ভাবি উপস্থিত হয়ে মহড়া উপভোগ করলেন। মধ্যরাত পেরিয়ে গেল। মহড়া অন্তে 'হরগজ' নাটক লেখার সময়কার নানা ঘটনা আর সেলিম আল দীনের রসবোধ নিয়ে দারুণ আড্ডা শেষে পারুল ভাবি ঘুমাতে গেলেন। সারা দিনের ক্লান্তি তখনও নাট্যকর্মীদের কাবু করতে পারেনি। নাট্যকর্মী দম্পতি লাবণী-পিন্জু দুজনে আমার দুই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন দালানের ছাদে ক্যাম্প ফায়ার শুরু করতে। সেখানেও সবাই আছেন। অবশেষে মধ্যরাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে শীতে অগি্নর খানিক উত্তাপ ও আনন্দ নিয়ে ঘুমালাম।

পরদিন ভোরে উঠেই পূর্ব সূচি অনুযায়ী যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের তা দেখে আমি অভিভূত। ফরিদপুরের 'জগবন্ধু আশ্রম'। প্রাকৃতিক সজ্জা ও আবহে অভিরাম পরিবেশ। দেখে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। শুনলাম এই আশ্রমে বিগত ৫০ বছরে কখনও গান থামেনি। গানের একদল আসে, গান গায় চলে যায়। আবার আরেক দল। চলছে। সেখানে আশ্রমের বিরাট আয়োজন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানুষ আসে_ অতিথি হয়ে এই আশ্রমে। রাত্রি যাপন করে চলে যায়। এখানের সকল অর্থভার বহন করছেন ফরিদপুরের কয়েক সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি। ভাবতে ভালোই লাগে।

আশ্রম দর্শন অন্তে গেলাম কবি জসীমউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি। পাশে কুমার নদী। শীর্ণকায়_ ওপাশের বালুচর দেখা যায়। আর এপাশে কবির পৈতৃক বাড়ি। দাদি, নানা পরিজন ও কবির কবর। কবির বিখ্যাত 'কবর' কবিতার ডালিম গাছও বর্তমান। আরো দেখলাম কবির মিউজিয়াম ও তদীয় নানা নিদর্শন। সেখানে বৃক্ষতলে সঙ্গীতের আয়োজন হলো। সেও এক সুখস্মৃতি।

অতঃপর নাটকের মহড়া, বিশ্রাম ও বিকেলে পর পর দু'টি প্রদর্শনী। কবি জসীমউদ্দীন মঞ্চে। 'হরগজ' নাটকের। নাটকের প্রারম্ভে সেলিম আল দীন স্মরণোৎসবকে উপলক্ষ করে কবি জসীমউদ্দীন হল চত্তরে সেলিম আল দীনকে উৎসর্গীকৃত স্বপ্নদলের সঙ্গীত-কোরিওগ্রাফির অভিনব পরিবেশনা সমবেত দর্শককে মুগ্ধ করে। তারপর 'হরগজ' নাটকের মঞ্চায়ন। হল ভর্তি দর্শক প্রযোজনাটি উপভোগ করলেন। নাটক শেষে যিনি মঞ্চে গেলেন তিনি অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে কাঁদছেন। কেন? 'হরগজ' নাটকে বিধৃত ঘটনার উপস্থাপনা দেখে। তিনি বলেন_ শিল্প এতটাই মর্মস্পশর্ী ও সুন্দর হতে পারে। আমরা জানা ছিল না। কান্নার ইতিহাস আরো আছে_ ফরিদপুর সুনিয়ম নাট্যচক্রের আমিনুর রহমান ফরিদ মঞ্চে এসে কাঁদছেন জাহিদ রিপনকে জড়িয়ে ধরে। শিষ্যের শিল্পদর্শনের সার্থকতায় গুরুর এই আনন্দাশ্রুর তুলনীয় দৃশ্য সমগ্র বিশ্বে দুর্লভ নিঃসন্দেহে! ভালো করে তাকাতেই অনুভব করা গেল হল ভর্তি দর্শকও চক্ষু মুছছেন। ধন্য হে সেলিম আল দীন_ ধন্য স্বপ্নদল!

সে উৎসবের আরো অনেক স্মৃতি_ অনেক কথা। সব তো একদিনে বলা সম্ভব নয়। সুন্দর ও সফল স্মরণোৎসব আয়োজনের জন্য ফরিদপুরের নাট্যকর্মী ও সংশিস্নষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তাঁদের আতিথ্য ও সে উৎসবের অভিজ্ঞতা কখনই তো ভুলবার নয়।

দুশো বছরে বাংলায় লালনভাব ও লালনসঙ্গীতের ক্রম ধারাপাত

লালনশাহী ঘরানার সাধুসঙ্গ এ কালামযোগে সূচিত হয়ে থাকে। কোনো গলদ না রেখে আমরাও আলোচনার গোড়ায় তাই শাঁইজির এ মহতী কালামের অনুসরণে তাঁর চরণে প্রার্থনা করি: দয়াল, আমাদের অন্তরে সেই সুরস ও সুমতি দাও যাতে আমরা তোমার ভাবলোকে ডুব দিয়ে অমূল্য রতন পেতে পারি। লালনভাবজগত মহাসমুদ্রের মতো।

তাঁর অতলে লুকিয়ে আছে অমূল্য মণিমাণিক্য। এ মহাধন শুধু আত্মহারা মুক্তি পাগল সাধকদের পক্ষে লভ্য। আমাদের উদ্ধৃত এ কালামের শব্দ-বাক্যগুলোর মর্মার্থ খুব রহস্যময় হলেও অত্যন্ত বাস্তব সত্য। যেমন 'এলাহি' কথাটির অর্থ 'উপাস্য প্রভুগুরু' তথা 'সদ্গুরু'। 'আলম' অর্থ জগত। এর আরবি বহুবচন হলো আলামিন। অর্থাৎ জগতসমূহ। এখানে অবশ্য জগত মানে বিশেষ মনোজগত। উপরোক্ত কালামে শাঁইজির বলছেন, আলস্নাহর চেহারা আছে। তাঁর হাতও আছে। সম্যক গুরু একজন সামাদ আলস্নাহরূপে ভক্তদের মনোজগতের বাদশাহ্ আলমপানা। তিনিই নানা বিপদাপদে ফেলে শিষ্যের দৃঢ়তা পরীক্ষা করেন। আবার তিনিই পরিত্রাণ করেন ভক্তের বাঁচামরা সবই দয়াল মোর্শেদের মর্জিনির্ভর। তাই ভক্তের আমিত্ব বা অহম্ বলতে কিছু থাকে না। তিনি সর্বদা আপন গুরুমুখি তন্ময় আশেক।

এরপর বাকি দুটি অন্তরাতে শাঁইজি গুরুশিষ্যের আন্তসম্পর্ক কোরানে বর্ণিত নূহ নবী থেকে ভারতবর্ষে মোহাম্মদী ইসলাম ধর্মের মহান প্রচারক খাজাবাবা নিজামউদ্দিন আউলিয়া পর্যন্ত পরম্পরা আমাদের মানসপটে ফুটিয়ে তুলেন। পরিশেষে বলছেন 'লালন কয় মোর কী হয় জানি'। এমন দৈন্যভাব প্রকাশের মাধ্যমে দ্বীনে এলাহির সর্বকালীন-সর্বজনীন সত্যকে অখণ্ডভাবে আমাদের সামনে দাঁড় করান।

প্রবীণ সাধুদের মুখে শুনেছি তাঁরা শাঁইজির এ কালামকে প্রচলিত আরবি কোরানের 'দ্বার উদঘাটিকা' সূরা ফাতেহার বাংলা তফসিররূপে মূল্যায়ন করেন। নূহ থেকে নিজামউদ্দিন সবাই একেশ্বরে বিলীন। আমরা বাইরে থেকে দুই দেখলেও শাঁইজি দেখেন এক। খণ্ড খণ্ড বিকাশের মধ্যে অখণ্ডমণ্ডলের মাণ্ডলীনৃত্য চলছেই নূহ নবী থেকে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার বিস্তৃত পরম্পরায়। মধ্যবতর্ী নবী-রসুলগণ যেমন দাউদ, সোলায়মান, মুসা, ঈসা, মোহাম্মদ, আলী, হোসাইন, খাজা গরীবে নেওয়াজ হয়ে নিজামউদ্দিনে যার বিকাশক্রিয়া অব্যাহত আছে। লালন শাঁইজিকে আমাদের অ্যাকাডেমিক বুদ্ধিবেনিয়াগণ খণ্ড একটি দেহমাত্র মনে করে হিন্দু-বাউল-নিম্নবর্গীয় সংস্কারের গণ্ডিতে ধরতে গিয়ে নিজেরাই ধরা খায়। তাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে ২০০ বছরের একটি কালসীমার মধ্যে আবদ্ধ করে ধরতে গিয়ে বারবার পিছলে পড়লেও শাঁইজি তাঁর ভাবলোকে হাজার বছরের সব খণ্ডতাকে অতিক্রম করে কালজয়ী মহাসত্যের অভিব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তিনি স্থানকালমুক্ত মহাপুরুষ বলেই অখণ্ডসত্তা। কিন্তু আমরা স্থানকালের গণ্ডিতে বাঁধা বদ্ধজীব। দুশো বছরের অাঁকশি দিয়ে তাঁকে আমরা ধরতে চাই। অথচ তিনি পেরিয়ে আসেন হাজারো বছরের সব ধারণাতান্ত্রিক ক্ষুদ্রতাকে। সত্য প্রকাশের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ ধরে জন্ম-জন্মান্তরে বহুরূপে নানা নামে তিনিই তিনিময় মহান শুদ্ধসত্তা।

ফকির লালন শাঁইজির আলোচিত কালামে বর্ণিত নিজামউদ্দিন আউলিয়া আসলে কে ? তাঁর মতো মহাপুরুষকে কতটুকুই বা উপলব্ধির ক্ষমতা রাখি আমরা? অল্পকথায় তাঁর আত্মিকশক্তি সম্বন্ধে যদি কেউ জানতে চাই তাহলে যাযাবরের লেখা 'দৃষ্টিপাত' নামক উপন্যাস থেকে একটি ঘটনার উলেস্নখ করা যায়। এখানে অসামান্য সে কাহিনির ছোট একটি অংশ তুরে ধরা হলো:

'দরজা খুলে গেল ইতিহাসের এক অতীত অধ্যায়ের। পাঠান সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি তৈরী করলেন একটি মসজিদ সেদিনকার দিলস্নীর একপ্রান্তে। তার মৃতু্যর দীর্ঘকাল পরে একদা এক ফকির এলেন সেই মসজিদে। ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। স্থানটি তাঁর পছন্দ হলো। সেখানেই রয়ে গেলেন এই মহাপুরুষ। ক্রমে প্রচারিত হলো তাঁর পুণ্যখ্যাতি। অনুরাগী ভক্তসংখ্যা বেড়ে উঠল দ্রুতবেগে।

স্থানীয় গ্রামের জলাভাবের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো তাঁর। মনস্থ করলেন খনন করবেন একটি দিঘি যেখানে তৃষ্ণার্তেরা পাবে জল, গ্রামের বঁধূরা ভরবে ঘট এবং নামাজের পূর্বে প্রক্ষালন দ্বারা পবিত্র হবে মসজিদে প্রার্থনাকারীর দল। কিন্তু সংকল্পে বাধা পড়ল অপ্রত্যাশিতরূপে। উদ্দীপ্ত হলো রাজরোষ। প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন তোগলকের বিরক্তিভাজন হলেন এ সামান্য ফকির দিওয়ানা নিজামউদ্দিন আউলিয়া।

তোগলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিনের পিতৃপরিচয় কৌলিন্যমুক্ত নয়। ক্রীতদাসরূপে তার জীবন আরম্ভ। কিন্তু বীর্য এবং বুদ্ধি দ্বারা আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালেই গিয়াসউদ্দিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন বিশিষ্ট ওমরাহরূপে। সম্রাটের 'মালিকদের' মধ্যে তিনি হয়েছিলেন অন্যতম। আলাউদ্দীনের মৃতু্যর পরে ছয় বছর পরপর রাজত্ব করলো দুজন অপদার্থ সুলতান, যারা আপন অ গম শাসনের দ্বারা দেশকে পৌঁছে দিলো অরাজকতার প্রায় প্র্রান্তসীমানায়। গিয়াসউদ্দীন তখন পাঞ্জাবের শাসনকর্তা। এমন সময় খসরু খান নামক এক ধর্মত্যাগী অন্ত্যজ হিন্দু দখল করলো দিলস্নীর সিংহাসন। গিয়াসউদ্দিন তার সৈন্যদল নিয়ে অভিযান করলেন পাঞ্জাব থেকে দিলস্নী, পরাজিত ও নিহত করলেন খসরু খানকে। সগৌরবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন বাদশাহী তখতে।

গিয়াসউদ্দিনের দৃঢ়তা ছিল, রাজ্যজয়ের শক্তি ছিল, শাসনের দক্ষতা ছিল। কিন্তু ঠিক সে অনুপাতে তার নিষ্ঠুরতাও ছিল ভয়াবহ। একদা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকের অসাবধানী রসনায় রটনা শোনা গেল গিয়াসউদ্দিনে মৃতু্যর। সুলতানের কানেও পেঁৗছালো সে ভিত্তিহীন জনরব। কিছুমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ না করে সুলতান আদেশ করলেন তার সিপাহসালারকে, 'লোক আমাকে মিথ্যা কবরস্থ করেছে। কাজেই আমি তাদের সত্যিসত্যি কবরে পাঠাতে চাই'। অগণিত হতভাগ্যের জীবনাবসান ঘটলো নিমেষে, গোরস্থানে শবভূক পশুপাখির হলো মহোৎসব।

কিন্তু গিয়াসুদ্দিনের বিচক্ষণতা ছিল। সেকালে মুগলদের আক্রমণ এবং তার আনুষাঙ্গিক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন ছিল উত্তর ভারতের এক নিরন্তর বিভীষিকা। গিয়াসুদ্দিন তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করতে পত্তন করলেন নতুন নগর, তৈরি করলেন নগর ঘিরে দুর্ভেদ্য প্রাচীর এবং প্রাচীর দ্বারে দুর্জয় দুর্গ। একদিকে ক্ষুদ্র পর্বত আর একদিকে প্রাচীর বেষ্টীত নগরী মাঝখানে খনিত হলো বিশাল জলাশয়। সংবৎসরের পানীয় সম্পর্কে নিশ্চিত আশা থাকতো প্রজাপুঞ্জের।

ফকির সুলতান সংঘর্ষ ঘটালো এই নগর নির্মাণ, কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় নগর প্রাচীর নির্মাণ উপলক্ষ করেই। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দিঘি কাটাতে মজুর চাই প্রচুর। গিয়াসুদ্দীনের নগর তৈরী করতেও মজুর আবশ্যক সহস্র সহস্র। অথচ দিলস্নীতে মজুরের সংখ্যা অত্যন্ত পরিমিত, দুজায়গায় প্রয়োজন মেটানো অসম্ভব। অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, বাদশাহ চাইলেন মজুরেরা আগে শেষ করবে তার কাজ, ততক্ষণ অপেক্ষ করুক ফকিরের খয়রাতি খনন। কিন্তু রাজার জোর অর্থের, সেটা পরিমাপ করা যায়। ফকিরের জোর হূদয়ের, তার সীমা শেষ নেই। মজুরেরা বিনা মজুরিতে দলে দলে কাটতে লাগলো নিজামুদ্দিনের দিঘি। সুলতান হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, 'তবে রে'। কিন্তু তার ধ্বনি আকাশে মিলাবার আগেই এত্তালা এলো আশু কর্তব্যের। বাংলাদেশ বিদ্রোহ দমন করতে ছুটতে হলো সৈন্যসামন্ত নিয়ে।

শাহজাদা মুহম্মদ তোগলক রইলেন রাজধানীতে রাজ প্রতিভুরূপে। তিনি নিজামুদ্দিনের অনুরাগীদের অন্যতম। তার আনুকূল্যে দিবারাত্রি খননের ফলে পরহিতব্রতী সন্যাসীর জলাশয় জলে পূর্ণ হলো অনতিবিলম্বে। তোগলকদের নগর রইলো অসমাপ্ত। অবশেষে সুলতানের ফিরবার সময় হলো নিকটবতর্ী। প্রমাদ গণনা করল নিজামুদ্দিনের অনুরাগীরা। তারা ফকিরকে অবিলম্বে নগরত্যাগ করে পলায়নের পরামর্শ দিলো। ফকির মৃদুহাস্যে তাদের নিরস্ত করলেন, 'দিলস্নী দূর অস্ত' দিলস্নী অনেক দূরে। প্রত্যহ যোজন পথ অত্রিক্রম করছেন সুলতান। নিকট হতে নিকটতম হচ্ছেন রাজধানীর পথে। প্রত্যহ ভক্তেরা অনুনয় করে ফকিরকে। প্রত্যহ একই উত্তর দেন নিজামউদ্দিন 'দিলস্নী দূর অস্ত'।

সুলতানের নগর প্রবেশ হলো আসন্ন, আর মাত্র একদিনের পথ অতিক্রমণের অপেক্ষা। ব্যাকুল হয়ে শিষ্য-প্রশিষ্যেরা অনুনয় করলো সন্ন্যাসীকে, 'এখনও সময় আছে, এইবেলা পালান'। গিয়াসুদ্দিনের ক্রোধ এবং নিষ্ঠুরতা অবিদিত ছিলো না কারো কাছে। ফকিরকে হাতে পেলে তাঁর কী দশা হবে সেকথা কল্পনা করে তারা ভয়ে শিউরে উঠলো বারংবার। স্মিতহাস্যে সেদিনও উত্তর করলেন বিগত ভয়, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, 'দিলস্নী হনুজ দূর অস্ত'। 'দিলস্নী এখনও অনেক দূর' বলে হাতে জপের মালা ঘোরাতে লাগলেন নিশ্চিত ঔদাসীন্যে।

নগরপ্রান্তে পিতার অভ্যর্থনার জন্য মুহম্মদ তৈরী করেছেন মহার্ঘ মণ্ডপ। কিংখাবের শামিয়ানা। জরিতে জহরতে ঝলমল। বাদ্য-ভাণ্ড, লোক-লস্কর, আমীর-ওমরাহ মিলে সমারোহের চরমতম আয়োজন। বিশাল ভোজের ব্যবস্থা। ভোজের পরে হস্তিযূথের প্রদর্শনী প্যারেড।

মণ্ডপের কেন্দ্র ভূমিতে ঈষৎ উন্নতভূমিতে বাদশাহের আসন। তার পাশেই তার উত্তরাধিকারীর। পরদিন গোধূলি বেলায় সুলতান প্রবেশ করলেন অভ্যর্থনা মণ্ডপে। প্রবল আনন্দোচ্ছ্বাসের মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। সিংহাসনের পাশে বসালেন নিজ প্রিয়তম পুত্রকে। কিন্তু সে মুহম্মদ নয়, তার অনুজ।

ভোজনান্তে অতিবিনয়াবনত কণ্ঠে মুহম্মদ অনুমতি প্রার্থনা করেন সম্রাটের কাছে: জাহাপনার হুকুম হলে এবার হাতির কুচকাওয়াজ শুরু হয়, হস্তীযূথ নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি নিজে। গিয়াসুদ্দিন অনুমোদন করলেন স্মিতহাস্যে। মুহম্মদ মণ্ডপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো ধীর শান্ত পদক্ষেপে।

কড়্ কড়্ কড়র কড়াৎ।

একটি হাতির শিরসঞ্চালনে স্থানচু্যত হলো একটি স্তম্ভ। মুহূর্তের মধ্যে সশব্দে ভূপাতিত হলো সমগ্র মণ্ডপটি। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো অসংখ্য কাঠের থাম। চাপাপড়া মানুষের আর্তকণ্ঠে বিদীর্ণ হলো অন্ধকার রাত্রির আকাশ। ধুলোয় আচ্ছন্ন হলো দৃষ্টি। ভীত সচকিত ইতস্তত ধাবমান হস্তীযূথের গুরুভার পদতলে নিষ্পিষ্ট হলো অগণিত হতভাগ্যের দল। এবং বিভ্রান্তকর বিশৃঙ্খলার মধ্যে উদ্ধারকমর্ীরা ব্যর্থ অনুসন্ধান করলো বাদশাহের।

পরদিন প্রাতে মণ্ডপের ভগ্নস্তূপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হলো বৃদ্ধ সুলতানের মৃতদেহ। যে প্রিয়তম পুত্রকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন মনে মনে তার প্রাণহীন দেহের উপরে সুলতানের দু বাহু প্রসারিত। বোধ করি আপন দেহের বর্মে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তার স্নেহাস্পদকে।

সমস্ত ঐহিক ঐশ্বর্য প্রতাপ মহিমা নিয়ে সপুত্র গিয়াসুদ্দিনের শোচনীয় জীবনান্ত ঘটলো নগরপ্রান্তে। দিলস্নী রইলো চিরকালের জন্য তার জীবিত পদক্ষেপের অতীত। দিলস্নী দূর অস্ত। দিলস্নী অনেক দূর।

নিজামুদ্দিনের দরগায় প্রবেশ করে আজও প্রথমেই চোখে পড়ে আউলিয়া খনিত পুকুরটি। তার পাশে দিয়ে এক প্রশস্ত চত্বর যার মাঝখানে সমাধিস্থ হয়েছে তাঁর দেহ। সমাধির উপরে ও আশেপাশে রচিত হয়েছে সুদৃশ্য ভবন ও অলিন্দ। উত্তরকালের সম্রাট শাজাহান সমাধির চারিদিক ঘিরে তৈরী করেছেন সমাধির শ্বেতপাথরের খিলান; প্রাঙ্গণ বেষ্টিত করেছেন সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত জালিকাটা পাথরের দেয়ালে। দ্বিতীয় আকবর রচনা করেছেন সমাধির উপরস্থ গম্বুজ। ফকিরের পুণ্যনামের সঙ্গে আপনাকে যুক্ত করে নিজেকে তারা ধন্যজ্ঞান করেছেন।

গিয়াসুদ্দিনের রাজধানী তোগলকাবাদ আজ বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বিবিসিআই রেলওয়ের লাইন গেছে তার উপর দিয়ে। একমাত্র প্রত্নতাত্তি্বকের গবেষণার এবং টু্যরিস্টদের দ্রষ্টব্য হিসেবে আজ তার গুরুত্ব। নিজামুদ্দিনের দরগায় আজও মেলা বসে প্রতিবছর। দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যকামীরা আসে দর্শনাকাঙ্ক্ষায়। সেদিনের রাজধানী তার অভ্রভেদী অহঙ্কার নিয়ে বহুদিন আগে মিশেছে ধুলোয়। দীন সন্ন্যাসীর মহিমা পুরুষানুক্রমে ভক্তজনের সশ্রদ্ধ অন্তরের মধ্যে দিয়ে রয়েছে অমস্নান। যার আকর্ষণ দূরকালে প্রসারিত।

দুনিয়ার রাজা-বাদশারা আধ্যাত্মজগতের মহাপুরুষ-শাহেনশাহ্দের কাছে কত না দুর্বল আর তুচ্ছ তা এ দৃষ্টান্ত থেকে সহজে অনুমান করা যায়। হ্যা, তোগলোকি রাজাদের মতো আমরা যারা বৈষয়িক বৈভবের আকর্ষণ আর আমিত্বের অহঙ্কারে অন্ধ তাদের পক্ষে লালন শাহের মতো মহাপুরুষকে চেনা-জানা 'দূর অস্ত'ঃ'হনুজ দূর অস্ত"।


আবদেল মাননান
২৬ নভেম্বর ২০১০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লালন বিশ্বসংঘ আয়োজিত সেমিনারে পঠিত মূল প্রবন্ধ।