Sunday, January 23, 2011

আনওয়ার আহমদ স্মৃতিতে, শ্রদ্ধায় by মনি হায়দার

তিনি ছিলেন কবি ও গল্পকার। কিন্তু সৃজনশীল এই দুটি মাধ্যমের মানুষ হয়েও আনওয়ার আহমদ এদেশের মানুষের অন্তরে বেঁচে আছেন সম্পাদক হিসেবে। কেনো তাঁর এই পরিচয়? এই পরিচয় তিনি তার কাজের ভেতর দিয়ে অর্জন করেছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই_ সম্পাদক হওয়ার জন্যই তিনি জন্মেছিলেন এই বাংলায়।
আর একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়_ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি লালনের জন্য আনওয়ার আহমদ সারা জীবন সাধনা করেছেন। শিল্পের মানুষদের বিপদে আপদে না ডাকলেও তিনি মমতার মন নিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। না, বিনিময়ে তিনি কিছু কখনও চাইতেন না।। আমার ধারণা_ তিনি জানতেন_ এই সমাজের সবাই দুহাত পেতে নেয়, দিতে পারে না কিছুই। নেয়াটাই মোক্ষ। নেয়াটাই ধ্যান। নেয়াটাই যেন অধিকার। নিঃশেষে প্রাণ উজাড় করে দিতে পারে কম লোক। আনওয়ার আহমদ এই 'কম' দলের মানুষ ছিলেন আজীবন, আমৃতু্য।

১৯৬৫ সালে সম্পাদক হিসেবে তিনি সিনে পত্রিকা 'রূপম' প্রকাশ শুরু করলেন। ১৯৪১ সালে জন্ম নিলে তখন তাঁর কতইবা বয়স? চবি্বশ বছর মাত্র। চবি্বশ বছরের যুবকের সম্পাদক হওয়া, স্বপ্ন ও সাহিত্য ফেরি করে বেড়ানো_ সেকালের প্রাদেশিক রাজ্য পূর্ব বাংলায় ছিল সাহসী এবং ব্যতিক্রম। কালের পরিভ্রমণে বাংলাদেশে 'রূপম' হয়ে দাঁড়ালো গদ্যের বা গল্প বিষয়ক একমাত্র পত্রিকা। মৃতু্যর কয়েকদিন আগে শেষ সংখ্যাটি প্রকাশ করেছিলেন পেনশনের টাকায়। বগুড়া তাঁর জন্মস্থান। বগুড়ার তরুণ লেখকদের তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। কেবল বগুড়া নয়_ঢাকার অনেক লেখক তাঁর বাসায় দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছেন। তাঁর অর্থে লালিত হয়েছেন। অনেক লেখকের প্রথম বই নিজের টাকায় প্রকাশ করেছেন তার 'রূপম' প্রকাশনী থেকে। সেই বই আবার নিজে জনে জনে বিলি করেছেন। পত্রিকা অফিসের সাহিত্য সম্পাদককে দিয়ে আলোচনা ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন।

আশির দশকের শুরুতে ঢাকা শহরের জাতক হলেও আনওয়ার আহমদ সম্পর্কে জানতে পারি আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কয়েকবার তাঁর ইস্কাটনের বাসায় গেলেও তাঁর সঙ্গে তখন অভিজ্ঞতাবোধের কারণে খাপ খাওয়াতে পারিনি। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার জমেনি। কিন্তু জমলো তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ ছয় বছরে। আমার অফিস ছিল শাহবাগে, বেতারে। তিনি থাকতেন লালমাটিয়ায়। প্রায় প্রতিদিন দুপুরে আসতেন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে। আমিও আসতাম। জমে উঠতো আড্ডা। তখনও আজিজ মার্কেটে হাল ফ্যাশনের পোশাকের আসর বসেনি। লেখক-শিল্পীদের পদভারে মুখরিত থাকতো। সেই জমানো আলাপে আড্ডায় দেখেছি_ তাঁর ভেতরে বাস করে এক আশ্চর্য অবোধ অভিমানী শিশুমন। তিনি কোলকাতায় কি একটা কাজে বেড়াতে যাবেন। আমাকে বরলেন_ কাউকে দিয়ে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে। পাসপোর্টের কাজ করে এমন একজনকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আনওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। তাকে টাকা পয়সাও দিলেন আনওয়ার ভাই। কিন্তু পাসপোর্ট পেতে দুদিন কি তিনদিন দেরি হলো। আনওয়ার ভাই আমার ওপর অসম্ভব চটে গেলেন। পাসপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ে হাতে না পাওয়া যেন আমার অপরাধ। খুব কড়া কথা বললেন।

আমি মনে মনে ভাবলাম_এমন অবিবেচক মানুষের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবো না। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর গণ প্রকাশনীর দোকানে আমার কাছে চিঠি লিখলেন দুঃখ প্রকাশ করে। আমাকে দুপুরে ভুড়িভোজ করালেন। আমাদের স্বল্পকালীন অভিমার পর্ব এখানেই সমাপ্তি ঘটে। অবশ্য এই রকম অভিমান পর্ব প্রায়ই ঘটতো_ যার কোনো প্রয়োজন থাকতো না। কিন্তু ওই যে তাঁর ভেতরে বাস করতো এক অবাক অভিমানী মন! আমি শুনেছি তাঁর অন্যতম সুহূদ বন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকতো। দুমাস, ছয় মাস কথা বা যোগাযোগ বন্ধ থাকতো দুজনের মধ্যে। আবার একদিন মান ভুলে দু'জনে আড্ডায় মেতে উঠতেন। আমি অনেক লেখককে দেখেছি_ আনওয়ার ভাইকে দেখে পালিয়ে বেড়াতেন। কারণ_ সম্পাদক আনওয়ার আহমদ তাঁর গল্প পত্রিকা 'রূপম' অথবা কবিতা পত্রিকা 'কিচ্ছুধ্বনী'র জন্য লেখা চেয়েছেন। তিনি লেখা চেয়ে লেখা না পাওয়া পর্যন্ত লেখককে অতীষ্ঠ করে তুলতেন। তিনি যে লেখককে নির্দিষ্ট করতেন তার আগামী সংখ্যার লেখার জন্য, তার কাছ থেকে দুই পদ্ধতিতে লেখা আদায় করতেন। প্রায় দুদিন পর পর ছোট্ট কাগজে তাগাদা দিয়ে খামে চিঠি লিখতেন। নইলে বাসায় ফোন থাকলে_ সকালে দুপুরে বিকেলে রাতে ফোন করে করে লেখা আদায় করে তবে ক্ষান্ত হতেন।

আনওয়ার ভাই মাঝারি গড়নের প্রায় কালো রঙের মানুষ ছিলেন। মুখটা ছিল মায়াবি। চোখে থাকতো স্বপ্ন। সব সময়ে পড়তেন সাদা শার্ট আর প্যান্ট। এখন আমার মনে হয়_ সাদা পোশাক পরিধানের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর ভেতরের সাদা সত্তাকে প্রকাশ করতেন।

শেষ জীবনে একা থাকতেন লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে আনওয়ার আহমদ। চারপাশে তাঁর সবই ছিল, তারপরও কিছু ছিল না। প্রথম জীবনের মানুষগুলো তাঁর কাছ থেকে নানা কারণে দূরে ছিল। তবে তিনি কখনও একা থাকতেন না। সব সময় তাকে ঘিরে একটা আড্ডা গড়ে উঠতোই। আজিজ মার্কেটের নিচতলায় দুটো বইয়ের দোকান ছিল পাশাপাশি। একটা গণ প্রকাশ। অন্যটি পলল প্রকাশনী । এই দুটি দোকান ঘিরে আড্ডা জমতো। তবে বেশি জমতো গণ প্রকাশে। তার বন্ধুরা বা আড্ডার মানুষেরা সব সময়ে তাঁর বয়সের চেয়ে অনেক কম বয়সের থাকতো। তিনি আশ্চর্য দক্ষতায় ও মমতায় তরুণদের ভেতরে নিজেকে জারিত করতে পারতেন। পারতেন উজ্জীবিত করতে।

মনে পড়ে তাঁর মৃতু্যদিনের গল্প। হঁ্যা_ গল্পই। ২০০৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি সাহিত্য সংগঠন বেশ কয়েকজনকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। তার মধ্যে আনওয়ার ভাইও ছিলেন। যেহেতু আনওয়ার ভাই সংবর্ধিত ব্যক্তি, সেহেতু আমরাও সেখানে উপস্থিত হলাম। সংবর্ধনা শেষে আনওয়ার ভাই হঠাৎ ঘামতে শুরু করলেন। আমরা_ মানে আমি, কবি মিজান রহমান, খায়রুল আলম সবুজসহ আরও অনেকে। সবুজ ভাই তাঁকে বিশ্রাম নিতে বললেন। আনওয়ার ভাই একটা টেবিলের উপর শুয়ে পড়লেন। কে কোথা থেকে কি একটা ঔষধ এনে দিলে আনওয়ার ভাই মুখে দিলেন এবং আমাদের সঙ্গে আম গাছতলায় এসে আড্ডায় বসলেন। সবুজ ভাই তাঁকে যতো শুয়ে থাকতে বলেন তিনি কেয়ার করেন না। আসলে তিনি আড্ডা ছেড়ে শুয়ে আছেন ভাবাই যায় না। আড্ডা দিতে দিতে রাত নটার দিকে, তাও সবুজ ভাইয়ের ধমকে _ আমরা উঠতে বাধ্য হলাম। বাংলা মোটরেরর মোড়ে এসে একটা রিকশায় তুলে রিকশাঅলাকে বললাম_ রিকশাঅলা ভাই, এই বয়স্ক মানুষটাকে যত্নের সঙ্গে পৌঁছে দিও।

আনওয়ার ভাই প্রতিবাদ করে বললেন_ এই রিকশাঅলা, আমি না ওরাই বয়স্ক। আমি চির তরুণ। রিকশাঅলা সহ আমরা হাসলাম। রিকশা চলে গেলে আমরা যে যার বাসায় চলে গেলাম। পরের দিন সকাল সাড়ে নটার দিকে 'উষালোকে' সম্পাদক মোহাম্মদ শাকেরউলস্নাহ ফোন করে মর্মান্তিক খবরটা জানালেন। আনওয়ার ভাই ছোট ছোট গল্প লিখেছেন অনেক। প্রায় অণু গল্প। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর একলা ঘরে তিনি নিজেই একটা অণুগল্প হয়ে গেলেন_ ২৪ ডিসেম্বর ২০০৩ এ রাতে পরম মৃতু্যকে আলিঙ্গন করে।

পরের দিন বিকেলে আজিজ মার্কেটে পলল প্রকাশনীতে তাৎক্ষণিক এক স্মরণসভার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে অনেক মানুষের সমাবেশ হয়েছিল আনওয়ার ভাইকে মনে রেখে। শুধুমাত্র শিল্পের জন্য একজন মানুষ কতোবড় ত্যাগ করতে পারেন, তিনি তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর মৃতু্যর পর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক স্মরণসভায় আবদুলস্নাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন_ 'আনওয়ার আহমদ শিল্পের শহীদ'। তিনি যথার্থই বলেছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যের পুরুষোত্তম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একটা লেখায় আনওয়ার আহমদকে সত্যিকারের সম্পাদক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন , দুজনেরই জীবদ্দশায়। এই বাংলাদেশে তিনি তাঁর কাজের তেমন কোনো স্বীকৃতি পাননি। তাঁর ভেতরে দুঃখবোধ থাকলেও কখনও প্রকাশ করেননি।

আনওয়ার আহমদের প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা_পনেরোটি। বিখ্যাত কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ_ রিলকের গোলাপ, মানবসম্মত বিরোধ, নির্মাণে আছি, হঠাৎ চলে যাবো, শেষ সম্বল শেষ দান। গল্পের বই চারটি। আরও বেরিয়েছিল_ আনওয়ার আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, আনওয়ার আহমদের গল্প। এ ছাড়াও আর অনেক কাজ তিনি করেছেন, যা আমরা মনে রাখিনি।

আগেই বলেছি, এদেশে আনওয়ার আহমদ কোনো পুরস্কার পাননি। ট্রাজেডি হচ্ছে তাঁর মৃতু্যর সাত মাস পর কোলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে তাঁকে পুরস্কৃত করে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি ও পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পুত্র নাজিম আনওয়ার রূপম। এটাও একটা গল্প।

আনওয়ার ভাই, আপনার সপ্তম মৃতু্যদিবসে আপনাকে প্রণতি জানাই। মরণসাগর পাড়ে আপনি ভালো থাকুন। জানি_আমাদের যাবতীয় দীনতাকে ক্ষমা চাইবার আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন আপনি আপনার স্বভাব অনুসারে।

No comments:

Post a Comment