Sunday, January 23, 2011

মাশরাফির কান্না যেন অমঙ্গলের ছায়া না ফেলে

'আশরাফুলকে ফিরিয়ে দাও' শিরোনামে কালের কণ্ঠে একটি লেখা লিখেছিলেন প্রভাষ আমিন। আশরাফুলকে কতটা ফিরে পাওয়া যাবে, সেই প্রশ্ন এখনো আছে, কিন্তু বিশ্বকাপ দলে আশরাফুল আছেন। নেই মাশরাফি। না থাকায় কেঁদেছেনও তিনি। সেই কান্না যেন বিশ্বকাপ যাত্রায় কোনো কুপ্রভাব না ফেলে-হাজারো ক্রকেটামোদীর মতো এ প্রার্থনাটুকু একসময়ের এ ক্রীড়া সাংবাদিকেরও

কয়েক দিন আগে কালের কণ্ঠে 'আশরাফুলকে ফিরিয়ে দাও' শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর বিপুল প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, প্রতিক্রিয়া মিশ্র হবে তা অনুমিতই ছিল। এত বড় লেখা এত লোক পড়বে, এটা ছিল রীতিমতো বিস্ময়ের। তবে এটা আমার লেখার গুণে নয়, মানুষ পড়েছে আশরাফুলকে নিয়ে লেখা বলেই। যতক্ষণ আইসক্রিম থাকে, ততক্ষণই কাঠির দাম। আশরাফুলকে পছন্দ-অপছন্দ দুটিই মানুষ করে তীব্রভাবে। তীব্র সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ পাল্টা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন এ দলে আশরাফুলের কোনো জায়গা নেই। চুপ করে শুনেছি, তাঁর আবেগকে সম্মান দেখিয়েছি। আমি যেমন আবেগ থেকে লিখেছি, তিনিও তো বিপরীত আবেগ থেকেই বলছেন। গত ১৯ জানুয়ারি বিশ্বকাপের দল ঘোষণার পর অনেকেই ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, আপনার আশরাফুল আছে। আমি অবাক হয়েছি, আশরাফুল আমার হতে যাবেন কেন? আমি কে? আশরাফুল তো বাংলাদেশের। আশরাফুল বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকবেন না, এমন আশঙ্কা আমার কখনোই ছিল না। আশরাফুলকে দলে রাখা হোক, এমন কোনো আবেদনও আমি কারো কাছে করিনি। আশরাফুলকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চলছে বটে, তবে এখনই তাঁকে বাদ দেওয়ার সাহস নির্বাচকদের নেই। নির্বাচকরা সে সাহস দেখানওনি। তবে নির্বাচকদের দেওয়া দল নিয়ে নয়ছয় করার চেষ্টা করেছিল টেকনিক্যাল কমিটি। তারা আশরাফুলকে বাদ দিয়ে অলক কাপালিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। নির্বাচকদের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
কেউ যেন ভাববেন না আমি অলক কাপালির বিপক্ষে। আমার দলে অলক থাকতেনই। আইসিএলের চোরাবালিতে পথ না হারালে অলক হতেন বাংলাদেশ দলের আরেক অটোম্যাটিক চয়েস। অলকও আশরাফুল ঘরানার, মানে শিল্পী ঘরানার ক্রিকেটার। দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনুপস্থিত-এ অজুহাতে অলককে বাদ দেওয়া হলো। কিন্তু নির্বাচকরা অলককে যদি বিশ্বকাপ পরিকল্পনায় রাখবেনই, তাহলে তাঁকে নিউজিল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ে সিরিজে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ দিলেন না কেন? দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেই, এটা তো নতুন কোনো তথ্য নয়। তাহলে তাঁকে ২৩ জনের দলেই বা রাখা হলো কেন? যেহেতু উপমহাদেশে বিশ্বকাপ, তাই দলের বোলিং স্পিন নির্ভর হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সাকিব, রাজ্জাক, শুভ-তিনজনই বাঁহাতি স্পিনার নিতে হবে! অলকের লেগ স্পিন বোলিং আক্রমণে বৈচিত্র্য আনতে পারত। আর লেগ স্পিন নয়, শুধু ব্যাটিং সামর্থ্য দিয়েই দলে থাকতে পারতেন অলক। লোয়ার অর্ডারে অলকের সামর্থ্য নিশ্চিন্ত করতে পারত টিম ম্যানেজমেন্টকে। অলক অনেকবারই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জাত চিনিয়েছেন, এমনকি আইসিএল খেলতে গিয়েও সেঞ্চুরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ভিভ রিচার্ডসের মতো সর্বকালের সেরারাও অলককে আলাদা ডেকে নিয়ে প্রশংসা করেছেন।
অলকের জন্য আফসোস হয়। তাও না হয় তাঁর না থাকাটা আইসিএল বিভ্রান্তির শাস্তি হিসেবে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মাশরাফির জন্য বুক ভেঙে যায় কষ্টে। যাঁর এ বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করার কথা ছিল, তিনিই কিনা বারবার দলে থাকতে চেয়েও বাদ পড়লেন! মাশরাফির গল্প নিয়ে কোনো সিনেমা বানালে শেষটা এর চেয়ে ট্র্যাজিক হতে পারত না। এটা ঠিক, মাশরাফির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই, যত সংশয় তাঁর ফিটনেস নিয়ে। ইনজুরি তো মাশরাফির নামেরই অংশ হয়ে গেছে। এটা স্রেফ দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। তবে মাশরাফির এ ইনজুরি প্রবণতার জন্য কি বিসিবির কোনো দায় নেই? মাশরাফিকে তো বোর্ড গড়ে তোলেনি। নড়াইলের একটি পাগলা ছেলে জোরে বল করতে পারে, এটুকু জেনেই তাঁকে এনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নামিয়ে দেওয়া হলো। অচর্চিত মাশরাফি গতি দিয়ে, সাহস দিয়ে গোটা বিশ্বকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পরিচর্যার অভাবে শুরুতেই যে ক্ষতি হয়েছে, এখন শত চেষ্টা করেও তা পূরণ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম 'পুরুষ' মাশরাফিকে আমি আমার স্কোয়াডে রাখতামই। বিশ্বকাপ শুরু হতে আরো এক মাস বাকি। মাশরাফি যেভাবে ফিট হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, তাতে তাঁকে নিয়ে একটু ঝুঁকি নেওয়াই যেত। ফিফটি পারসেন্ট মাশরাফি অন্য অনেক শতভাগের চেয়েও অনেক বেশি। ম্যাচের শুরুতে গতি আর আগ্রাসন দিয়ে প্রতিপক্ষ থেকে যে সমীহ আদায় করতে পারেন মাশরাফি, তা গোটা ইনিংসজুড়েই সঞ্চারিত হয়। আর উল্টো শুরুতেই পুতুপুতু বোলিং পেলে প্রতিপক্ষ চড়াও হয়ে যায়, যা পরে সামলানো কঠিন। মাশরাফি না হয় বোলিং একটু কমই করতেন। মাশরাফি থাকলে ড্রেসিং রুমের আবহটাও অনেক ইতিবাচক ও আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। মাশরাফিকে স্কোয়াডে নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত। তাহলে তিনি ফিট হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতেন। আর না হলে রিপ্লেসমেন্ট পেতে তো এক মিনিটও লাগত না। এখন মাশরাফির বিশ্বকাপ খেলার যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তা নিছক ছেলে ভোলানো গল্প। হতোদ্যম মাশরাফির পক্ষে আর ফিট হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ নেই বললেই চলে। আরেকজন কেউ ইনজুরিতে পড়লে তাঁর জায়গায় খেলার অপেক্ষায় থাকার মতো কাপুরুষ অন্তত মাশরাফি নন। ডেভিড হাসি যখন হাসপাতালে সার্জনের ছুরির নিচে, তখন অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডে আছেন তিনি। ইনজুরি নিয়ে দেশে ফিরে আসা শচীন, শেবাগ ও গম্ভীর আছেন ভারতীয় দলে। সবাই দলের সেরা খেলোয়াড়দের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি। অস্ট্রেলিয়া তো হাসিকে প্রয়োজনে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলাতেও প্রস্তুত। কিন্তু মাশরাফিকে নিয়ে জুয়া খেলার সাহস নেই আমাদের নির্বাচকদের। যেন আমরা বিশ্বকাপ জিততে মাঠে নামছি। দল ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে একপর্যায়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি ফাইটার হিসেবে খ্যাতি পাওয়া মাশরাফি, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ইনজুরি থেকে বারবার লড়াই করে ফিরেছেন। কিন্তু এবার বিশ্বকাপ খেলতে না পারলে তো আর কখনোই দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাবেন না। তাই কান্না ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর কান্না কাঁদিয়েছে দেশের কোটি ভক্তকে। প্রতিবাদে হরতাল হয়েছে, মানববন্ধন হয়েছে, বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু এখন আর এসব করে লাভ কি! এ হলো মাশরাফির দুর্ভাগ্য আর নির্বাচকদের ঝুঁকি নিতে পারার সাহসের অভাব। অদৃষ্টে আমার এক ফোঁটাও বিশ্বাস নেই। কিন্তু মাশরাফির কান্না দেখে মনটা খুঁত খুঁত করছে। আশরাফুলকে ভালোবাসি, মাশরাফির জন্য কষ্ট হয়, অলকের জন্য আফসোস হয়; কিন্তু সব কিছুর ওপর তো 'সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি'-বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment