Sunday, January 23, 2011

ধর্মান্ধতা এবং বিজ্ঞানবিমুখতার কুপ্রভাব by শহিদুল ইসলাম

ক. অল্প কিছু মানুষ এ দেশে একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে আসছেন অনেক দিন ধরেই। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি অক্ষয় কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কুদরাত-এ-খুদাসহ অল্প কিছু মানুষ এ নিয়ে ভেবেছেন-লিখেছেন।
তাঁদের লেখা পড়ে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং তাঁদের স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন মিলিয়ে দিয়ে আমরাও সামান্য কিছু কাজ করেছি। 'সোনার পাথরবাটির' মতো আমাদের সে স্বপ্ন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। আমরা ভেবেছি, স্কুলের পাঠ্যসূচিকে বিজ্ঞানমনস্ক করলেই আমাদের সবার চাওয়া-পাওয়ার সফল বাস্তবায়ন হবে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখনো যে বিজ্ঞানের কিছু বিষয় আমাদের পড়তে হয়নি তা নয়। পড়েছি। কিন্তু কখনো ভাবিনি তার সঙ্গে জীবনের বা বাস্তবতার কোনো সংযোগ বা সম্পর্ক আছে। মনের মধ্যে ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানবিরোধিতা পুষে রেখে যাঁরা আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন, তাঁরাও বিজ্ঞানের ওপর খুব ভরসা রাখতেন বলে আমার মনে হয় না। মুখস্থ করে বেশি নম্বর পাওয়াই যেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যপুস্তককে দুই ভাবে ভাগ করেছিলেন। তার এক ভাগ টেঙ্ট বুক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক, যাকে তিনি 'অপাঠ্য' বলে রায় দিয়েছিলেন। টেঙ্ট বুক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত 'পাঠ্য' বই পড়ে কারো মন যে জিজ্ঞাসু হয়ে উঠতে পারে, তা বাংলাদেশের বাইরে এসে উপলব্ধি করতে পারছি। গত ৩ জানুয়ারি ২০১১ ভোরের কাগজে প্রকাশিত 'সূর্যের সঙ্গে বসবাস' লেখাটি পড়লে পাঠক বুঝবেন এখানে শুধু প্রাইভেট নয়, সরকারি স্কুলেও 'স্ক্রিপচার' ক্লাস নামে ধর্মশিক্ষা চালু রয়েছে। তবে সে ক্লাস বাধ্যতামূলক নয়। শুনলাম, সেখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়ও পড়ানো হয়। ফলে ছয়-সাত বছরের শিশু সে ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, সে ক্লাসটি না করার। আমাদের দেশে এ কথাটি কেউ বিশ্বাস করবেন না। একটি ছয়-সাত বছরের শিশু কী পড়বে, না পড়বে_সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে_এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না বলেই আজকের এ লেখার অবতারণা।

দুই. ৫ জানুয়ারি ২০১১। এই লেখাটি লিখছি প্রবাসে বসে। অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের বাসায় কিছু বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম ড্রইং রুমের টেবিলে বসে। বাড়িতে আমি ও আমার সাত বছরের নাতি সূর্য। ভীষণ চঞ্চল, দারুণ বুদ্ধিমান। কিন্তু পাঠ্য বইয়ের প্রতি খুব একটা আকর্ষণ নেই। তার মা-বাবা তাকে পাঠ্য বই নিয়ে বসিয়ে রাখতে সদাব্যস্ত। কখনো-সখনো বিরক্ত-রেগেও যায়। তবু তাকে আমার বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। তার ঘর বোঝাই বই আর বই। দেয়ালে আঁটা পৃথিবীর মানচিত্র ও সমাজ-বিবর্তন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আঁকা মোটা আর্ট কাগজের বড় বড় ছবি। পৃথিবীর কোথায় কোন দেশ জিজ্ঞেস করলে সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দেয়। দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমান্ত্রিক ছবি বলতে কি বোঝায় তা সে জানে। আর্কিমিডিসের 'ইউরেকা', কপারনিকাসের সৌরজগৎ, নিউটনের আপেল_এমনকি ডারউইনের 'বানরতত্ত্ব' ও আইনস্টাইনের 'আপেক্ষিক তত্ত্ব' সবই সে জানে। তার মানে বিজ্ঞানের ইতিহাসের বড় বড় মোড় পরিবর্তন সম্বন্ধে সে ভালোই জানে। খাতার সাইজের দুই-তিন শ বই ঘরটির তিনটি দেয়ালে ঠাসা। অধিকাংশই বিজ্ঞানের। ওর সঙ্গে সারাক্ষণ গল্প করতে আমার ভালো লাগে। যা জানে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে সামান্য লজ্জা বা দ্বিধা করে না। কটা বইয়ের নাম লিখব? কয়েকটি Science Encylopedia ছাড়াও এমন কোনো বিষয় নেই, যার ওপর ২-৪ খানা বই নেই। যেমন Weather : climate & climatic change, Power, What is Inside ‡reat Inventions, Farns & the World Food Supply, Outdoor Science, From Cycle to Spauship, Special Effects in Film & Television, Fossils ছাড়াও আছে Pocket Scientists। সত্যি কথা বলতে কী, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ওর বই থেকে অনেক কিছু বুঝতে পেরেছি, যা আগে পারিনি।

তিন. আজ উত্তেজিত হয়ে সে আমাকে ডাকল। আমি তড়িঘড়ি টেলিভিশনের সামনে এলাম। সূর্য বলল_'এই দেখ, রিচার্ড হ্যামন্ড! এই বইটা ও লিখেছে।' বলে সে একটা বই আমাকে দিল। বইটার নাম 'Can you feel the FORCE?' এবিসিতে তার পরিচালনায় একটি শিশুদের বিজ্ঞান শিক্ষার অনুষ্ঠান। নাম "Richard Hammond's Blast খধন." আজকের বিষয় গ্যালিলিওর 'লস অব ফলিং বডি'। একটি ওয়াশিং মেশিন ও একটি মাইক্রোওয়েভ ক্রেনে করে ওপরে তুলে ছেড়ে দিল। অবশ্যই ওয়াশিং মেশিনটা আগে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। তারপর গ্যালিলিওর তত্ত্বটির ব্যাখ্যা দিলেন হ্যামন্ড। হ্যামন্ডের ভূমিকা থেকে একটু পড়ি। তিনি লিখছেন_'কার, বাইক (সাইকেল), বিমান, স্পিডবোট, হোভারক্র্যাফট, যা কিছু চলন্ত তা আমি ভালোবাসি। কারণ সেগুলো সব action-কাজ-চলন্ত। এসব গতিশীল জিনিস নিয়েই পদার্থবিদ্যা। যখন একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়, গাছ থেকে একটি আপেল মাটিতে পড়ে অথবা বিদ্যুৎ চমকায়, পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব তোমাকে বলে দেয় 'কি হচ্ছে?' তুমি ভাবতে পারো বিজ্ঞানীরা সব কিছুর উত্তর জানে কিন্তু সত্য হলো এই যে, বিজ্ঞানের জগৎ অজানা ও অসংখ্য প্রশ্নে ভর্তি। সেই জন্য এই বইখানা প্রশ্নের পর প্রশ্নে ভরপুর। সেসব প্রশ্নের অধিকাংশেরই সহজ উত্তর আছে কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর আজও জানা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো উত্তর তোমাকে অবাক করবে, কোনো কোনো উত্তরে তুমি অবাক হবে ও আঘাত পাবে_আবার কোনো প্রশ্ন তোমাকে চিন্তায় ফেলে দেবে। 'একটি প্রশ্ন হলো, একটি হাতি ও একটি পাখির পালকের ছবি এঁকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে কোনটা দ্রুত পড়বে?' মাধ্যাকর্ষণ বা gravity থেকে প্রথম চিন্তা করেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.)। অ্যারিস্টটল দেখেছিলেন এক খণ্ড ইট একটি পালকের চেয়ে দ্রুত নিচে এসে পড়ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারী জিনিস দ্রুত নিচে এসে পড়বে। কোনো পরীক্ষা ছাড়াই তিনি এ সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তর ছিল ভুল। প্রায় ২০০০ বছর কেউ বিষয়টি পরীক্ষা করে তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করেনি। গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) প্রমাণ করেন অ্যারিস্টটল ভুল। শুনলাম, ওই টিভি সিরিয়ালে আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চায় গোসল করা, নিউটনের সামনে আপেল পড়ার বিষয় নিয়ে শিশুদের সঙ্গে হ্যামন্ড নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন। এসব অনুষ্ঠান দেখে একটি পাঁচ-ছয় বছরের শিশুও বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষিত হতে বাধ্য। দৈনন্দিন জীবন থেকে শিশুরা বিজ্ঞানী মন নিয়ে বড় হতে পারে।

চার. রবীন্দ্রনাথ যাই বলুন না কেন, পাঠ্য-পুস্তকের প্রভাব আমাদের জীবনে অপরিসীম। পাঠ্য-পুস্তকে যা লেখা থাকে, সেটাই আমাদের কাছে সত্য। তাই পাঠ্য-পুস্তকের গুরুত্ব ছোট করে দেখার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানমনস্কতার স্থান খুবই কম আছে। টেঙ্ট বুক বোর্ডসহ শিক্ষা বিভাগে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা 'চাকরি' করেন। শিক্ষার্থীরা কি শিখছে, সেসব শিক্ষার ফলে তারা কি ধরনের মানুষ হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তা করা তাঁদের কোনো চাকরির শর্তের মধ্যে পড়ে না। সরকারও বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার জন্য প্রতিবছর পাঠ্যসূচিতে বেশি বেশি বিজ্ঞানের পাঠ ঢুকাচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, স্কুলের শিক্ষার প্রভাব পুরো জাতি বা সমাজের ওপর তেমন কোনো আলোড়ন তুলতে পারছে না। ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানবিমুখতাই আমাদের সমাজে আজ প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। শুধু স্কুলে বিজ্ঞানমুখী পাঠ্যসূচি তেমন কোনো ফল প্রদান করছে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবাদর্শই স্কুল পাঠ্যসূচিতে প্রতিফলিত হয়। তাই সমাজে বিজ্ঞানের প্রভাব বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বিনোদনমূলক ও খেলাধুলার ওপর যতটা জোর দেন শিক্ষা, বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রতি ততোধিক অন্যমনস্ক। হ্যামন্ডের মতো অনুষ্ঠান আমাদের টেলিভিশনের কাছে আশা করা যায় না। তার অনেক কারণ। প্রথম, মালিকপক্ষের মনমানসিকতা। তাঁরা কি চান দেশের মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে উঠুক? বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠুক? যদি চান, তাহলে যত অল্প সুযোগই থাকুক, যতই খরচ হোক না কেন, হ্যামন্ডের মতো অনুষ্ঠান করা অসম্ভব নয়। আমাদের টেলিভিশন, সিনেমা মুম্বাই ও কলকাতার অনুষ্ঠানের ধারা অনুসরণ করে কত অনুষ্ঠান করে। টেলিভিশনের মালিক, কলাকুশলী, সাংবাদিক প্রায় দেশ-বিদেশে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে যান। হ্যামন্ডের মতো অনুষ্ঠান কি তাঁদের চোখে পড়ে না? টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তক দেখে আমাদের মনে হয়, আমাদের বিশ্বাসবিরোধী কোনো সত্য তাঁরা সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেন। সমাজে প্রচলিত ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানবিরোধিতা যেন আমাদের পাঠ্যপুস্তক, মূলধারার টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং সংস্কৃতিচর্চার ওপর এখনো আধিপত্য বিস্তার করে আছে। কেবল পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্ন ও উত্তর সনি্নবেশ করে শিশুদের মনে বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো যাবে না। পরিবারে, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা শিশুদের বিজ্ঞানের পথে নিয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

No comments:

Post a Comment