Sunday, January 23, 2011

দুশো বছরে বাংলায় লালনভাব ও লালনসঙ্গীতের ক্রম ধারাপাত

লালনশাহী ঘরানার সাধুসঙ্গ এ কালামযোগে সূচিত হয়ে থাকে। কোনো গলদ না রেখে আমরাও আলোচনার গোড়ায় তাই শাঁইজির এ মহতী কালামের অনুসরণে তাঁর চরণে প্রার্থনা করি: দয়াল, আমাদের অন্তরে সেই সুরস ও সুমতি দাও যাতে আমরা তোমার ভাবলোকে ডুব দিয়ে অমূল্য রতন পেতে পারি। লালনভাবজগত মহাসমুদ্রের মতো।

তাঁর অতলে লুকিয়ে আছে অমূল্য মণিমাণিক্য। এ মহাধন শুধু আত্মহারা মুক্তি পাগল সাধকদের পক্ষে লভ্য। আমাদের উদ্ধৃত এ কালামের শব্দ-বাক্যগুলোর মর্মার্থ খুব রহস্যময় হলেও অত্যন্ত বাস্তব সত্য। যেমন 'এলাহি' কথাটির অর্থ 'উপাস্য প্রভুগুরু' তথা 'সদ্গুরু'। 'আলম' অর্থ জগত। এর আরবি বহুবচন হলো আলামিন। অর্থাৎ জগতসমূহ। এখানে অবশ্য জগত মানে বিশেষ মনোজগত। উপরোক্ত কালামে শাঁইজির বলছেন, আলস্নাহর চেহারা আছে। তাঁর হাতও আছে। সম্যক গুরু একজন সামাদ আলস্নাহরূপে ভক্তদের মনোজগতের বাদশাহ্ আলমপানা। তিনিই নানা বিপদাপদে ফেলে শিষ্যের দৃঢ়তা পরীক্ষা করেন। আবার তিনিই পরিত্রাণ করেন ভক্তের বাঁচামরা সবই দয়াল মোর্শেদের মর্জিনির্ভর। তাই ভক্তের আমিত্ব বা অহম্ বলতে কিছু থাকে না। তিনি সর্বদা আপন গুরুমুখি তন্ময় আশেক।

এরপর বাকি দুটি অন্তরাতে শাঁইজি গুরুশিষ্যের আন্তসম্পর্ক কোরানে বর্ণিত নূহ নবী থেকে ভারতবর্ষে মোহাম্মদী ইসলাম ধর্মের মহান প্রচারক খাজাবাবা নিজামউদ্দিন আউলিয়া পর্যন্ত পরম্পরা আমাদের মানসপটে ফুটিয়ে তুলেন। পরিশেষে বলছেন 'লালন কয় মোর কী হয় জানি'। এমন দৈন্যভাব প্রকাশের মাধ্যমে দ্বীনে এলাহির সর্বকালীন-সর্বজনীন সত্যকে অখণ্ডভাবে আমাদের সামনে দাঁড় করান।

প্রবীণ সাধুদের মুখে শুনেছি তাঁরা শাঁইজির এ কালামকে প্রচলিত আরবি কোরানের 'দ্বার উদঘাটিকা' সূরা ফাতেহার বাংলা তফসিররূপে মূল্যায়ন করেন। নূহ থেকে নিজামউদ্দিন সবাই একেশ্বরে বিলীন। আমরা বাইরে থেকে দুই দেখলেও শাঁইজি দেখেন এক। খণ্ড খণ্ড বিকাশের মধ্যে অখণ্ডমণ্ডলের মাণ্ডলীনৃত্য চলছেই নূহ নবী থেকে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার বিস্তৃত পরম্পরায়। মধ্যবতর্ী নবী-রসুলগণ যেমন দাউদ, সোলায়মান, মুসা, ঈসা, মোহাম্মদ, আলী, হোসাইন, খাজা গরীবে নেওয়াজ হয়ে নিজামউদ্দিনে যার বিকাশক্রিয়া অব্যাহত আছে। লালন শাঁইজিকে আমাদের অ্যাকাডেমিক বুদ্ধিবেনিয়াগণ খণ্ড একটি দেহমাত্র মনে করে হিন্দু-বাউল-নিম্নবর্গীয় সংস্কারের গণ্ডিতে ধরতে গিয়ে নিজেরাই ধরা খায়। তাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে ২০০ বছরের একটি কালসীমার মধ্যে আবদ্ধ করে ধরতে গিয়ে বারবার পিছলে পড়লেও শাঁইজি তাঁর ভাবলোকে হাজার বছরের সব খণ্ডতাকে অতিক্রম করে কালজয়ী মহাসত্যের অভিব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তিনি স্থানকালমুক্ত মহাপুরুষ বলেই অখণ্ডসত্তা। কিন্তু আমরা স্থানকালের গণ্ডিতে বাঁধা বদ্ধজীব। দুশো বছরের অাঁকশি দিয়ে তাঁকে আমরা ধরতে চাই। অথচ তিনি পেরিয়ে আসেন হাজারো বছরের সব ধারণাতান্ত্রিক ক্ষুদ্রতাকে। সত্য প্রকাশের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ ধরে জন্ম-জন্মান্তরে বহুরূপে নানা নামে তিনিই তিনিময় মহান শুদ্ধসত্তা।

ফকির লালন শাঁইজির আলোচিত কালামে বর্ণিত নিজামউদ্দিন আউলিয়া আসলে কে ? তাঁর মতো মহাপুরুষকে কতটুকুই বা উপলব্ধির ক্ষমতা রাখি আমরা? অল্পকথায় তাঁর আত্মিকশক্তি সম্বন্ধে যদি কেউ জানতে চাই তাহলে যাযাবরের লেখা 'দৃষ্টিপাত' নামক উপন্যাস থেকে একটি ঘটনার উলেস্নখ করা যায়। এখানে অসামান্য সে কাহিনির ছোট একটি অংশ তুরে ধরা হলো:

'দরজা খুলে গেল ইতিহাসের এক অতীত অধ্যায়ের। পাঠান সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি তৈরী করলেন একটি মসজিদ সেদিনকার দিলস্নীর একপ্রান্তে। তার মৃতু্যর দীর্ঘকাল পরে একদা এক ফকির এলেন সেই মসজিদে। ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। স্থানটি তাঁর পছন্দ হলো। সেখানেই রয়ে গেলেন এই মহাপুরুষ। ক্রমে প্রচারিত হলো তাঁর পুণ্যখ্যাতি। অনুরাগী ভক্তসংখ্যা বেড়ে উঠল দ্রুতবেগে।

স্থানীয় গ্রামের জলাভাবের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো তাঁর। মনস্থ করলেন খনন করবেন একটি দিঘি যেখানে তৃষ্ণার্তেরা পাবে জল, গ্রামের বঁধূরা ভরবে ঘট এবং নামাজের পূর্বে প্রক্ষালন দ্বারা পবিত্র হবে মসজিদে প্রার্থনাকারীর দল। কিন্তু সংকল্পে বাধা পড়ল অপ্রত্যাশিতরূপে। উদ্দীপ্ত হলো রাজরোষ। প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন তোগলকের বিরক্তিভাজন হলেন এ সামান্য ফকির দিওয়ানা নিজামউদ্দিন আউলিয়া।

তোগলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিনের পিতৃপরিচয় কৌলিন্যমুক্ত নয়। ক্রীতদাসরূপে তার জীবন আরম্ভ। কিন্তু বীর্য এবং বুদ্ধি দ্বারা আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালেই গিয়াসউদ্দিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন বিশিষ্ট ওমরাহরূপে। সম্রাটের 'মালিকদের' মধ্যে তিনি হয়েছিলেন অন্যতম। আলাউদ্দীনের মৃতু্যর পরে ছয় বছর পরপর রাজত্ব করলো দুজন অপদার্থ সুলতান, যারা আপন অ গম শাসনের দ্বারা দেশকে পৌঁছে দিলো অরাজকতার প্রায় প্র্রান্তসীমানায়। গিয়াসউদ্দীন তখন পাঞ্জাবের শাসনকর্তা। এমন সময় খসরু খান নামক এক ধর্মত্যাগী অন্ত্যজ হিন্দু দখল করলো দিলস্নীর সিংহাসন। গিয়াসউদ্দিন তার সৈন্যদল নিয়ে অভিযান করলেন পাঞ্জাব থেকে দিলস্নী, পরাজিত ও নিহত করলেন খসরু খানকে। সগৌরবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন বাদশাহী তখতে।

গিয়াসউদ্দিনের দৃঢ়তা ছিল, রাজ্যজয়ের শক্তি ছিল, শাসনের দক্ষতা ছিল। কিন্তু ঠিক সে অনুপাতে তার নিষ্ঠুরতাও ছিল ভয়াবহ। একদা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকের অসাবধানী রসনায় রটনা শোনা গেল গিয়াসউদ্দিনে মৃতু্যর। সুলতানের কানেও পেঁৗছালো সে ভিত্তিহীন জনরব। কিছুমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ না করে সুলতান আদেশ করলেন তার সিপাহসালারকে, 'লোক আমাকে মিথ্যা কবরস্থ করেছে। কাজেই আমি তাদের সত্যিসত্যি কবরে পাঠাতে চাই'। অগণিত হতভাগ্যের জীবনাবসান ঘটলো নিমেষে, গোরস্থানে শবভূক পশুপাখির হলো মহোৎসব।

কিন্তু গিয়াসুদ্দিনের বিচক্ষণতা ছিল। সেকালে মুগলদের আক্রমণ এবং তার আনুষাঙ্গিক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন ছিল উত্তর ভারতের এক নিরন্তর বিভীষিকা। গিয়াসুদ্দিন তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করতে পত্তন করলেন নতুন নগর, তৈরি করলেন নগর ঘিরে দুর্ভেদ্য প্রাচীর এবং প্রাচীর দ্বারে দুর্জয় দুর্গ। একদিকে ক্ষুদ্র পর্বত আর একদিকে প্রাচীর বেষ্টীত নগরী মাঝখানে খনিত হলো বিশাল জলাশয়। সংবৎসরের পানীয় সম্পর্কে নিশ্চিত আশা থাকতো প্রজাপুঞ্জের।

ফকির সুলতান সংঘর্ষ ঘটালো এই নগর নির্মাণ, কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় নগর প্রাচীর নির্মাণ উপলক্ষ করেই। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দিঘি কাটাতে মজুর চাই প্রচুর। গিয়াসুদ্দীনের নগর তৈরী করতেও মজুর আবশ্যক সহস্র সহস্র। অথচ দিলস্নীতে মজুরের সংখ্যা অত্যন্ত পরিমিত, দুজায়গায় প্রয়োজন মেটানো অসম্ভব। অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, বাদশাহ চাইলেন মজুরেরা আগে শেষ করবে তার কাজ, ততক্ষণ অপেক্ষ করুক ফকিরের খয়রাতি খনন। কিন্তু রাজার জোর অর্থের, সেটা পরিমাপ করা যায়। ফকিরের জোর হূদয়ের, তার সীমা শেষ নেই। মজুরেরা বিনা মজুরিতে দলে দলে কাটতে লাগলো নিজামুদ্দিনের দিঘি। সুলতান হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, 'তবে রে'। কিন্তু তার ধ্বনি আকাশে মিলাবার আগেই এত্তালা এলো আশু কর্তব্যের। বাংলাদেশ বিদ্রোহ দমন করতে ছুটতে হলো সৈন্যসামন্ত নিয়ে।

শাহজাদা মুহম্মদ তোগলক রইলেন রাজধানীতে রাজ প্রতিভুরূপে। তিনি নিজামুদ্দিনের অনুরাগীদের অন্যতম। তার আনুকূল্যে দিবারাত্রি খননের ফলে পরহিতব্রতী সন্যাসীর জলাশয় জলে পূর্ণ হলো অনতিবিলম্বে। তোগলকদের নগর রইলো অসমাপ্ত। অবশেষে সুলতানের ফিরবার সময় হলো নিকটবতর্ী। প্রমাদ গণনা করল নিজামুদ্দিনের অনুরাগীরা। তারা ফকিরকে অবিলম্বে নগরত্যাগ করে পলায়নের পরামর্শ দিলো। ফকির মৃদুহাস্যে তাদের নিরস্ত করলেন, 'দিলস্নী দূর অস্ত' দিলস্নী অনেক দূরে। প্রত্যহ যোজন পথ অত্রিক্রম করছেন সুলতান। নিকট হতে নিকটতম হচ্ছেন রাজধানীর পথে। প্রত্যহ ভক্তেরা অনুনয় করে ফকিরকে। প্রত্যহ একই উত্তর দেন নিজামউদ্দিন 'দিলস্নী দূর অস্ত'।

সুলতানের নগর প্রবেশ হলো আসন্ন, আর মাত্র একদিনের পথ অতিক্রমণের অপেক্ষা। ব্যাকুল হয়ে শিষ্য-প্রশিষ্যেরা অনুনয় করলো সন্ন্যাসীকে, 'এখনও সময় আছে, এইবেলা পালান'। গিয়াসুদ্দিনের ক্রোধ এবং নিষ্ঠুরতা অবিদিত ছিলো না কারো কাছে। ফকিরকে হাতে পেলে তাঁর কী দশা হবে সেকথা কল্পনা করে তারা ভয়ে শিউরে উঠলো বারংবার। স্মিতহাস্যে সেদিনও উত্তর করলেন বিগত ভয়, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, 'দিলস্নী হনুজ দূর অস্ত'। 'দিলস্নী এখনও অনেক দূর' বলে হাতে জপের মালা ঘোরাতে লাগলেন নিশ্চিত ঔদাসীন্যে।

নগরপ্রান্তে পিতার অভ্যর্থনার জন্য মুহম্মদ তৈরী করেছেন মহার্ঘ মণ্ডপ। কিংখাবের শামিয়ানা। জরিতে জহরতে ঝলমল। বাদ্য-ভাণ্ড, লোক-লস্কর, আমীর-ওমরাহ মিলে সমারোহের চরমতম আয়োজন। বিশাল ভোজের ব্যবস্থা। ভোজের পরে হস্তিযূথের প্রদর্শনী প্যারেড।

মণ্ডপের কেন্দ্র ভূমিতে ঈষৎ উন্নতভূমিতে বাদশাহের আসন। তার পাশেই তার উত্তরাধিকারীর। পরদিন গোধূলি বেলায় সুলতান প্রবেশ করলেন অভ্যর্থনা মণ্ডপে। প্রবল আনন্দোচ্ছ্বাসের মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। সিংহাসনের পাশে বসালেন নিজ প্রিয়তম পুত্রকে। কিন্তু সে মুহম্মদ নয়, তার অনুজ।

ভোজনান্তে অতিবিনয়াবনত কণ্ঠে মুহম্মদ অনুমতি প্রার্থনা করেন সম্রাটের কাছে: জাহাপনার হুকুম হলে এবার হাতির কুচকাওয়াজ শুরু হয়, হস্তীযূথ নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি নিজে। গিয়াসুদ্দিন অনুমোদন করলেন স্মিতহাস্যে। মুহম্মদ মণ্ডপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো ধীর শান্ত পদক্ষেপে।

কড়্ কড়্ কড়র কড়াৎ।

একটি হাতির শিরসঞ্চালনে স্থানচু্যত হলো একটি স্তম্ভ। মুহূর্তের মধ্যে সশব্দে ভূপাতিত হলো সমগ্র মণ্ডপটি। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো অসংখ্য কাঠের থাম। চাপাপড়া মানুষের আর্তকণ্ঠে বিদীর্ণ হলো অন্ধকার রাত্রির আকাশ। ধুলোয় আচ্ছন্ন হলো দৃষ্টি। ভীত সচকিত ইতস্তত ধাবমান হস্তীযূথের গুরুভার পদতলে নিষ্পিষ্ট হলো অগণিত হতভাগ্যের দল। এবং বিভ্রান্তকর বিশৃঙ্খলার মধ্যে উদ্ধারকমর্ীরা ব্যর্থ অনুসন্ধান করলো বাদশাহের।

পরদিন প্রাতে মণ্ডপের ভগ্নস্তূপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হলো বৃদ্ধ সুলতানের মৃতদেহ। যে প্রিয়তম পুত্রকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন মনে মনে তার প্রাণহীন দেহের উপরে সুলতানের দু বাহু প্রসারিত। বোধ করি আপন দেহের বর্মে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তার স্নেহাস্পদকে।

সমস্ত ঐহিক ঐশ্বর্য প্রতাপ মহিমা নিয়ে সপুত্র গিয়াসুদ্দিনের শোচনীয় জীবনান্ত ঘটলো নগরপ্রান্তে। দিলস্নী রইলো চিরকালের জন্য তার জীবিত পদক্ষেপের অতীত। দিলস্নী দূর অস্ত। দিলস্নী অনেক দূর।

নিজামুদ্দিনের দরগায় প্রবেশ করে আজও প্রথমেই চোখে পড়ে আউলিয়া খনিত পুকুরটি। তার পাশে দিয়ে এক প্রশস্ত চত্বর যার মাঝখানে সমাধিস্থ হয়েছে তাঁর দেহ। সমাধির উপরে ও আশেপাশে রচিত হয়েছে সুদৃশ্য ভবন ও অলিন্দ। উত্তরকালের সম্রাট শাজাহান সমাধির চারিদিক ঘিরে তৈরী করেছেন সমাধির শ্বেতপাথরের খিলান; প্রাঙ্গণ বেষ্টিত করেছেন সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত জালিকাটা পাথরের দেয়ালে। দ্বিতীয় আকবর রচনা করেছেন সমাধির উপরস্থ গম্বুজ। ফকিরের পুণ্যনামের সঙ্গে আপনাকে যুক্ত করে নিজেকে তারা ধন্যজ্ঞান করেছেন।

গিয়াসুদ্দিনের রাজধানী তোগলকাবাদ আজ বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বিবিসিআই রেলওয়ের লাইন গেছে তার উপর দিয়ে। একমাত্র প্রত্নতাত্তি্বকের গবেষণার এবং টু্যরিস্টদের দ্রষ্টব্য হিসেবে আজ তার গুরুত্ব। নিজামুদ্দিনের দরগায় আজও মেলা বসে প্রতিবছর। দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যকামীরা আসে দর্শনাকাঙ্ক্ষায়। সেদিনের রাজধানী তার অভ্রভেদী অহঙ্কার নিয়ে বহুদিন আগে মিশেছে ধুলোয়। দীন সন্ন্যাসীর মহিমা পুরুষানুক্রমে ভক্তজনের সশ্রদ্ধ অন্তরের মধ্যে দিয়ে রয়েছে অমস্নান। যার আকর্ষণ দূরকালে প্রসারিত।

দুনিয়ার রাজা-বাদশারা আধ্যাত্মজগতের মহাপুরুষ-শাহেনশাহ্দের কাছে কত না দুর্বল আর তুচ্ছ তা এ দৃষ্টান্ত থেকে সহজে অনুমান করা যায়। হ্যা, তোগলোকি রাজাদের মতো আমরা যারা বৈষয়িক বৈভবের আকর্ষণ আর আমিত্বের অহঙ্কারে অন্ধ তাদের পক্ষে লালন শাহের মতো মহাপুরুষকে চেনা-জানা 'দূর অস্ত'ঃ'হনুজ দূর অস্ত"।


আবদেল মাননান
২৬ নভেম্বর ২০১০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লালন বিশ্বসংঘ আয়োজিত সেমিনারে পঠিত মূল প্রবন্ধ।

No comments:

Post a Comment