Sunday, January 23, 2011

গুলি চালানো শিখতে লেগেছিল মাত্র আধঘণ্টাঃ শিরিন বানু মিতিল

মি তখন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী। আমার মা সেলিনা বানু বামপন্থী আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী ছিলেন। আমার নানার বাড়ি ছিল এককালে বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। সুতরাং এই বাড়ির সবাই আমরা রাজনৈতিকভাবে বিশেষ সচেতন ছিলাম।

একাত্তরের মার্চের সেই দিনগুলোতে রাজনৈতিক উত্তাপে বাইরের অঙ্গন ও আমাদের গৃহের প্রাঙ্গণ এক হয়ে গিয়েছিল। পাবনার প্রাথমিক প্রতিরোধ পর্ব হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকেই। চলে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা পাবনা শহরে ঢোকে। জারি হয় কারফিউ। ২৬ মার্চ তারা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। সাধারণ মানুষের ওপরও নেমে আসে অত্যাচার। জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় পাল্টা আঘাত হানার। ২৭ মার্চ রাতে পুলিশ লাইনের যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে। ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামার কথা ভাবতে শুরু করে। তাদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, এসিড বাল্ব, বঁটি ও দা। আমাদের মানসিকতা ছিল 'মেরে মরো'। পুরুষরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বান অনুযায়ী যার যা কিছু আছে_দা, বল্লম, মাছ মারার কোচ, মাছ কাটার বঁটি, লাঙলের ফলা এসব নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পরে আমাদের হাতেও অস্ত্র চলে আসে।
আমার মনে পড়ে, মাত্র আধাঘণ্টা লেগেছিল গুলি চালানো শিখতে। সে ছিল এক অদ্ভুত দিন। আমার দুই কাজিন জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে। এই মায়ের কথা না বললেই নয়। তিনি তাঁর ছেলেদের বলতেন, 'তোমাদের কি মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্য? মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো।' তিনি ছিলেন পাবনা মহিলা পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সভানেত্রী রাকিবা বেগম। এমন পরিস্থিতিতে আমার ঘরে থাকাটা কষ্টকরই ছিল।
আমার ভাই জিঞ্জির বলল, 'বুজি, প্রীতিলতার মতো তুমিও পারো ছেলেদের পোশাক পরে যুদ্ধে যেতে।' ওর এই কথাটা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। আমার বড় খালা রাফিয়া বানুর কাছে আমি থাকতাম। তিনি আমাকে শার্ট-প্যান্ট পরা দেখে বললেন, 'হ্যাঁ, এখন তুমি নিশ্চিন্তে যুদ্ধে যেতে পারো।'
২৮ মার্চ শহরের জেল রোডে টেলিফোন একচেঞ্জ ভবনে দখলদার ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ওরা সবাই মারা পড়ে। আমাদের দুজন শহীদ হয়। এভাবে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতেই থাকে। ৩০ মার্চ পাবনা শহর স্বাধীন হয়।
তখন যুদ্ধ চলছিল নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে। পাশের জেলা কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে। তাদের বিভিন্ন দল পিছিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার দিকে।
পাবনার ছাত্রনেতা ইকবালের দল একটি গাড়িতে করে কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হলো। গাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমি ও আমার এক ভাই থেকে যাই কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার ক্যাম্পে দেখা হয় পাবনার পুলিশ ইনচার্জ ও রাজনৈতিক নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশার সঙ্গে। ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁদের জিপে করে আমরা চুয়াডাঙ্গার ক্যাম্পে যাই। তখন গোলাবারুদের অভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক দলকে পাঠানো হলো গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য। সেই দলের সদস্য হয়ে আমিও মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কমিটিতে পেঁৗছাই। সেখানে দেখা হলো আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে। এখানে এসে জানতে পারি, পাবনায় যে সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি আমার ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছেপে দিয়েছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ছেলে সেজে যুদ্ধ করার যে সুযোগ ছিল, তা আর আমি পেলাম না।
আমার সঙ্গীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমি চলে গেলাম কলকাতার উপকণ্ঠে গোবরা ক্যাম্পে আরো প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে আমাকে আশ্রয় দিলেন নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র। তাঁর স্বামী রমেন মিত্র আমার বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদকে চিনতেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হিসেবে। এখান থেকে আমি যোগাযোগ করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তিনি আশ্বাস দিলেন মেয়েদের নিয়ে আলাদা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠনের।
প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন। আমি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিই। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে থাকি। আমাদের প্রচেষ্টা ও বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় অবশেষে ৩৬ জন নারী নিয়ে আমাদের ক্যাম্প শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে বিভা সরকারের কথা বলতেই হয়। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্সের ছাত্রী তিনি। তিনিসহ পাঁচজনের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। জিন্নাত আরা, লায়লা, লীনা চক্রবর্তী, কৃষ্ণা ও আমি ছিলাম ওই কমিটিতে। আমাদের কাজ ছিল ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে আগ্রহী মেয়েদের সংগ্রহ করা। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা। ক্যাম্পের দেখাশোনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি প্রতিদিন আমাদের ক্যাম্পে আসতেন। আমাদের অস্ত্র ও অন্যান্য প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ শুরু করেন খুলনার হাসিনা শিরিন। আস্তে আস্তে সদস্যসংখ্যা বেড়ে যায়। আমরা যখন ক্যাম্প ছাড়ি তখন সদস্যসংখ্যা ছিল ২৪০-এর ওপরে। অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। আমাদের প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিক্যাল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করি তাঁর দলে কাজ করার জন্য। তিনি রাজি হন, কিন্তু সমস্যা ছিল অস্ত্রের অভাব। তবু যুদ্ধ থেমে থাকেনি আমাদের।
বিজয়ের পর আসে দেশে ফেরার পালা। সেই ক্যাম্পের সহযোদ্ধাদের অনেকের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। জানি না কোথায় আছে বিভা সরকার, তুষার কন্যা, নাজমা মাজেদা কিংবা লায়লা। মনে পড়ে একেকটি নাম_তৃপ্তি, সন্ধ্যা, গীতা, শাহীন, মুক্তি, ইরা, গীতা (২) ও সালমা। এখনো মনে পড়ে জোবেদা, মিরা, কমলা, জিনাত, যুথিকা, মণিকা, ভক্তিসহ অনেকের কথা। নাম না জানা অনেকের ছবি ভাসে চোখে। এখনো কান পাতলে শুনি সেই সমবেত সংগীত_'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি...'।
মাঝেমধ্যে ভাবি কুষ্টিয়ার পথে রাতে দেখা হওয়া সেই ভাইদের কথা। আর সেই বৃদ্ধ পিতার কথা, যিনি আমাকে ছেলের পোশাক পরা মেয়েযোদ্ধা জেনে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, 'আর আমাদের ভয় নেই। আমাদের মেয়েরা যেখানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে নেমেছে, আমাদের আর কেউই দমাতে পারবে না।'
এখনো ভাবি, বাংলাদেশের মানুষের আছে অশেষ প্রাণশক্তি, যাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে কোনো সমস্যাই আর থাকে না। প্রয়োজন শুধু সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কে ফিরিয়ে এনে প্রাণের আবাহন করা।
পরিচিতি: পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লার খান বাহাদুর লজ-এ ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর শিরিন বানু মিতিল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা প্রখ্যাত বামনেত্রী সেলিনা বানু ও বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ। ৭ নম্বর সেক্টরে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বা সনদের জন্য কোনো আবেদন না করায় তাঁর কোনো সনদ নেই।

No comments:

Post a Comment