Sunday, January 23, 2011

আবাসন শিল্পঃ অস্থিরতা, বিপাকে লাখ লাখ শ্রমিক by নওশাদ জামিল

সাত্তার মিয়া আজমিরী স্টিল করপোরেশনের স্টিল, রডসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। বয়স চল্লিশের ঘরে। দোকানের সামনের ফুটপাতে তাঁর রিকশাভ্যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘সারা দিন বইসা আছি, একখান কাজও পাই নাই। বাড়িত চাল নিয়া যাওয়ার ট্যাহাও নাই।
ক্যামনে সংসার চলবে হেইডাই ভাবতে পারতেছি না।’ নির্মাণ শ্রমিক তোফায়েল মিয়া বললেন, ‘আগে সারা দিন কাজ কইরা পাইতাম ৫০০ টাকা। এখন ২০০ টাকাও পাই না। কাজ নাই, আগের মতো টাকাও নাই।
এ টাকায় তিনবেলা খাবারও জোটে না।’ তিনিও রিকশাভ্যানে করে স্টিল-রডসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে রড ওঠানো-নামানোর কাজ করেন আবদুল কাদের। ‘গত এক সপ্তাহে কাজ পাইছি তিনটা। আগে প্রতিদিনই তিন-চারটা কাজ পাইতাম। এখন সারা দিন বইসা থাকলেও একটা কাজও পাই না’, বলেন কাদের।
রাজধানীর শ্যামলীর রিং রোডের মেসার্স শাহ্জালাল অ্যান্ড ব্রাদার্স, নিজাম স্টিল করপোরেশন, মাহীর স্টিল এজেন্সি, ভূঁইয়া স্টিল করপোরেশন, মদিনা স্টিল করপোরেশনসহ নির্মাণসামগ্রীর দোকান আছে প্রায় ২০টি। দোকানগুলোয় পাইকারি ও খুচরা দরে স্টিল-রডসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী বিক্রি করা হয়। দোকান থেকে স্টিল পরিবহনের কাজে নিয়োজিত পাঁচ শতাধিক শ্রমিক। এ মৌসুমে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ বেশি থাকার কথা হলেও এখন তাঁদের কাজ নেই। দেশের বেশির ভাগ নির্মাণ শ্রমিকেরই এ দশা।
সম্প্রতি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প বন্ধ হয়ে পড়ায় নির্মাণ শিল্পে দেখা দেয় চরম অস্থিরতা। গত পাঁচ মাসে হুহু করে বেড়েছে রডের দাম। গত দুই মাস আগে ৪০ গ্রেডের রড বিক্রি হতো ৪৬ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। একইভাবে ৬০ গ্রেডের রড ৫১ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৫৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে নির্মাণ শিল্পে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে হাজার হাজার ডেভেলপার কম্পানির প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রডমিস্ত্রি-রাজমিস্ত্রিদেরও কাজ নেই। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রডের দোকানগুলো। রডের ডিলার-এজেন্টদের আয়ও বন্ধ। রড পরিবহনের কাজে প্রয়োজনীয় ট্রাক শ্রমিকদেরও আয় বন্ধ। প্রায় ৯৯ শতাংশ দেশীয় মালিকানাধীন স্টিল ও রি-রোলিং মিল লোকসানের মুখে বন্ধ হওয়ার শঙ্কায়। হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার ও পেশাজীবী চাকরি হারানোর শঙ্কায়। এই শুকনো মৌসুমে যখন রডের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকার কথা, তখন কাঁচামাল আমদানি বন্ধ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এর প্রভাব শুধু রড-স্টিল শিল্পের ওপরই পড়বে না, সিমেন্ট, বালু, পাথরসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি ৫০০টি রি-রোলিং ও ২৫টি স্টিল মিল বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকার কারণে গত ছয় মাস ধরে লোহজাত শিল্পে অস্থিরতা তৈরি হয়। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো রকম স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, লোহাজাত শিল্পের এ অস্থিরতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক। অনেক স্টিল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম প্রধান তিনটি স্টিল মিল বিএসআরএম, আবুল খায়ের স্টিল ও কেএসআরএম প্রতিষ্ঠানেও বিরাজ করছে শ্রমিক অসন্তোষ।
রডের দাম বাড়ায় বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ৬০ গ্রেডের রড কিনতে গিয়ে খালিহাতে ফিরে এসেছি। বাড়ির কাজই বন্ধ করে দিয়েছি।’ আলমগীর হোসেন আরো জানান, এক বছর আগে তিনি যখন বাড়ির কাজ শুরু করেন, তখন প্রতিটন রডের মূল্য ছিল আনুমানিক ৪০ হাজার টাকা। বছরের এই সময়ে শুকনো মৌসুমে বাড়ির কাজ করেন। এখন রডের দাম টনপ্রতি ৫৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
গুলিস্তানের রড ব্যবসায়ীরা জানান, রডের দাম বাড়ায় ক্রেতাও কমে গেছে। দোকানের কর্মচারীও ছাঁটাই করেছেন তাঁরা।
জানা যায়, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্টিলের চাহিদা ছিল ৫ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। এর মূল্য টনপ্রতি ৫৫ হাজার টাকা করে হিসাব করলে হয় ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাত বৃদ্ধিতে এখন স্টিলের চাহিদা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে বাজারে লোহাজাত দ্রব্যের পর্যাপ্ত সরবাহ নেই।

No comments:

Post a Comment