Thursday, February 03, 2011

কেমন আছেন রিতা-মিতা

বাড়িটা এখনো ভূতের বাড়ি বলে পরিচিত। সেই বাড়িতে থাকেন রহস্যময় দুই বোন। মনে আছে তাঁদের কথা? মনে পড়ে যাওয়ারই কথা। যদিও মাঝে পাঁচ বছর কেটে গেছে। কেমন আছেন সেই দুই বোন রিতা-মিতা? তাঁদের কথা জানতে প্রথমে যোগাযোগ করা হয় আইনজীবী এলিনা খানের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী হিসেবে বর্তমানে কর্মরত। ২০০৫ সালের ৭ জুলাই দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর মিরপুরের সেই বাড়ি থেকে দুই বোনকে প্রথমে বের করে আনেন তিনি।
এলিনা খানই জানান, দুই বছর হলো তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ নেই। তবে আগের বাড়িতেই আছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এলিনা খান ও তাঁর দুই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম রিতা-মিতার বাড়ির সামনে। এলিনা খান দেখিয়ে দিলেন কোন দোকান থেকে তাঁরা প্রতি মাসে ভাড়া পান। উডল্যান্ড ফার্নিচারের সেই দোকানের স্বত্বাধিকারীকে দোকানে না পেয়ে টেলিফোনে কথা হয়। দোকানের স্বত্বাধিকারী পনু বললেন, ‘প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা দোকানভাড়া নিয়ে যান রিতা। মিতা কখনো আসেন না। মাঝেমধ্যে সকাল ছয়টা-আটটার দিকে হাঁটতে বের হন দুই বোন। মেয়েকে সকালে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখি তাঁদের। পাউরুটি, দুধই তাঁরা এখন খেয়ে থাকেন। আমার মনে হয়েছে, মিতা বেশ অসুস্থ। তাঁর চিকিৎসা দরকার।’ মিরপুরের সেই বাড়ির সামনে চিকিৎসক আইনুন নাহার রিতার একটি সাইনবোর্ড লাগানো। বাড়ির গেটে আর্বজনার স্তূপ। ভেতর থেকে বড় তালা ঝোলানো। পাশের নির্মাণাধীন বাড়ির দারোয়ান বললেন, ‘আমি বের হতে দেখি না। বড় বোন বের হয়। তাও সপ্তাহে একদিন। তখন শুধু তরল দুধের প্যাকেট আর পাউরুটি কিনতে দেখি। রাতে ১১টার পরে বের হয়।’ এলিনা খান বললেন, ‘এটি খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। প্রথম দিকে যখন ওরা মানসিকভাবে বেশি অসুস্থ ছিল, তখন দুধ, পাউরুটি খেয়ে থাকত। সুস্থ হওয়ার পর স্বাভাবিক সব খাবারই খেয়েছে।’ গেটে ধাক্কা দিয়ে ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিত্যক্ত বাড়ির মতো লাগছে। ঝোপঝাড়, চারপাশে আর্বজনা, পোকামাকড়ের বসতি যেন। দেয়াল টপকে গেলেন সঙ্গে থাকা আলোকচিত্রী। অনবরত জানালায় শব্দ করে, ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া আসছিল না ভেতর থেকে। সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ, হঠাৎ ঘরের মধ্য থেকে বের হলেন একজন। এলিনা খান ও তাঁর সহকর্মী মাহমুদাকে দেখেই বারান্দার গ্রিলের ওপাশ থেকে রিতা রাগে গজগজ করতে থাকেন। রিতা বলেন, ‘আল্লাহর গজব নাজিল হবে। শান্তিতে থাকতে দিতে চাও না। আবার সম্পত্তির লোভে আসছ?’ বলেই ভেতরে ঢুকে যান। পরে আর বের হননি দুই বোনের কেউই। পরে এলিনা খান বললেন, ‘আমাকে দেখলে ভাবেন, বোধহয় বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাব। আইনুন নাহার রিতা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। আর মিতা বুয়েট থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। তাঁদের বাবা মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি নিয়ে নানা ধরনের ঝামেলা হয়। সেখান থেকেই সমস্যাটার শুরু হয়। তাঁদের মা প্রায় ১০ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপন করেননি। জানা যায়, তিনিও সিজোফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। রিতা-মিতাও সেই রোগে আক্রান্ত। তাঁরা অপুষ্টি আর নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। অনেক চেষ্টা করে বের করে এনেছিলাম। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার বের করি। অনেক নাটক করতে হয়। তাঁদের আরেক বোন আছেন, যাঁর সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পাইনি। তাঁদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া যেকোনো কাজে মনটাকে ব্যস্ত রাখলে হয়তো তাঁরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে, তাঁরা যদি খুব অসুস্থ হন কিংবা মৃতপ্রায় অবস্থা হলেও তো কেউ জানবে না।’
২০০৫ সালে যখন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত, তখন তাঁদের প্রথমে ঢাকার ধানমন্ডি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক সেহেরীন এফ সিদ্দিকা, খাজা নাজিমুদ্দিন ও মোহিত কামাল দুই বোনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। বর্তমানে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেহেরীন এফ সিদ্দিকার সঙ্গে কথা হয় তাঁদের নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা তিন চিকিৎসক মিলেই ওদের চিকিৎসা দিয়েছিলাম। ওদের মেয়েলি কিছু রোগ ছিল। তার চিকিৎসা দিয়েছিলাম। সেরেও ছিল। ফলোআপের জন্য পরেও এসেছিল বেশ কয়েকবার।’ রিতার চিকিৎসক বন্ধুদের কাছে খোঁজখবর করেছিলাম। পরে তাঁরাও আর কিছু বলতে পারেনি।

No comments:

Post a Comment