Thursday, February 03, 2011

বিবেকের কড়া নেড়ে গেল কিশোরী হেনা

মা আকলিমা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। হেঁটে মেয়ের লাশের পাশেও যেতে পারছেন না। বাবা দরবেশ খাঁ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। বিড়বিড় করে বলছেন, ‘আমার মেয়েটি এভাবে মেরে ফেললো, কেউ প্রতিবাদ করলো না। আল্লাহ, তুমি পাষণ্ডদের শাস্তি দিয়ো।’ সমাজপতিদের দোররার আঘাতে তাঁদের কিশোরী মেয়ে হেনা আক্তার মারা গেছে সোমবার রাতে। গতকাল বুধবার বিকেল চারটায় মেয়ের লাশ বাড়ি এসেছে।
কান্নায় ভেঙে পড়েছে পরিবার-প্রতিবেশীরা। দরিদ্র দরবেশ খাঁর বাড়িতে কাল যেন মানুষের ঠাঁই ধরে না। শত শত মানুষ ছুটে এসেছে। হেনার পরিবারের সদস্যদের কান্নার ঢেউ গিয়ে লেগেছে তাদের অনেকের মনে। চোখ ভিজে গেছে তাদের। হেনার করুণ মৃত্যু ক্ষুব্ধ করেছে অনেককে, নাড়া দিয়েছে বিবেকে। দোষীদের শাস্তি চেয়েছে তারা।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামে ফতোয়াবাজেরা ধর্ষণের শিকার ১৪ বছরের কিশোরী হেনাকে ৭০-৮০টি দোররা মারলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়। গ্রামের অনেকের সামনেই ঘটেছে এই দোররা মারার ঘটনা, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। ধর্ষক মাহাবুবের স্ত্রীর বড় বোন জাহানারা হেনাকে দোররা মেরেছেন।
হেনাদের প্রতিবেশী হোসনে আরা বলেন, ‘সালিসে আমরা উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মাওলানারা প্রথম হেনাকে মাটিতে গেড়ে পাথর মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্য সালিসদারদের অনুরোধে পাথর মারার পরিবর্তে তাকে দোররা মারার রায় দেওয়া হয়। আমরা উপস্থিত থেকে শুধু চোখের পানি ফেলেছি। কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি।’
আরেক প্রতিবেশী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সালিসে কথা বলার কোনো সুযোগ পাইনি। দাঁড়িয়ে থেকে আক্ষেপ করেছি। গরিব লোক বলে তাদের সঙ্গে এটা করা সম্ভব হয়েছে।’
বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন: তবে হেনার মৃত্যু আবার বিবেকবোধে তাড়িত করেছে অনেককে। তারা ধর্ষক মাহাবুব ও ফতোয়াবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শরীয়তপুরে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। বেলা ১১টায় পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট, আমরাই পারি নারীর বিরুদ্ধে সব নির্যাতন বন্ধ করতে, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন এসডিএস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে। মানববন্ধন শেষে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। বিক্ষোভ শেষে সমাবেশে বক্তব্য দেন রওশন আরা, অমল দাস, আসমত আলী খান, আহসান উল্লাহ ইসমাইলী প্রমুখ।
দুপুর ১২টায় প্রথম আলো বন্ধুসভা শরীয়তপুর সরকারি কলেজ সড়কে মানববন্ধন করে।
লাশ দাফন: শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ গতকাল দুপুর ১২টায় হেনার মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। বিকেল পাঁচটায় চামটা গ্রামে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. সানোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান জানাজায় অংশ নেন।
চারজন রিমান্ডে, অন্যরা অধরা: মঙ্গলবার রাত ১০টায় নিহত হেনার বাবা বাদী হয়ে নড়িয়া থানায় ১৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ গ্রেপ্তার হওয়া চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করলে বিচারিক হাকিম আবদুল মান্নান আসামি শিল্পী বেগমের তিন দিন, মসজিদের ইমাম মফিজ উদ্দিনের দুই দিন, জয়নাল মীরমালত ও আলাবক্স করাতীর এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রধান আসামি ধর্ষক মাহাবুব ও অন্য ফতোয়াবাজদের পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কেউ রেহাই পাবে না। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় সোর্স লাগানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি আমাদের হতভম্ব করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক সমন্বয় করছি।’
প্রলোভন: নিহত হেনার পরিবারের অভিযোগ, ঘটনা ধামাচাপা দিতে হেনার পরিবারকে সাত লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন হেনা হত্যা মামলার আসামি চামটা ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইদ্রিস ফকির। হেনার ভাই ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমরা হতদরিদ্র মানুষ। এর সুযোগ নিয়ে টাকা দিয়ে মাহাবুব ও ফতোয়াবাজদের নেতা ইদ্রিস মেম্বার মীমাংসা করতে চায়। মামলা না চালানোর শর্তে তারা আমাদের সাত লাখ টাকা দিতে চায়।’ তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতে ইদ্রিস মেম্বারের এক আত্মীয়ের বাড়িতে সভা করে টাকা দিয়ে মীমাংসা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বোন চলে গেছে, টাকা দিয়ে কী হবে? আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ বলেন, ‘আমার মেয়েকে ধর্ষণ করার পর কোনো বিচার পেলাম না। উল্টো মেয়েকে বিচারের মুখোমুখি হয়ে জীবন দিতে হলো। এমন সমাজে বসবাস করতেও কষ্ট লাগছে। আমি কোনো টাকাপয়সা চাই না, মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
চামটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন রাঢ়ী বলেন, নৃশংস এই ঘটনায় এলাকার মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। সবাই অভিযুুক্তদের শাস্তি দাবি করছে। তিনি বলেন, ‘একটি চক্র হেনার পরিবারকে টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে শুনেছি।’
পূর্বাপর হেনা: হেনা পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। অর্থকষ্টের কারণে ২০০৮ সালে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। রোববার রাত আটটার দিকে প্রাকৃতিক কাজে ঘরের বাইরে গেলে হেনাকে প্রতিবেশী মাহাবুব (৪০) ধর্ষণ করেন। হেনার চিৎকারে দুই পরিবারের লোকজন বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে মাহাবুবের স্ত্রী শিল্পী বেগম ও দেবর নিপু ঘটনার জন্য হেনাকে দোষারোপ করে মারধর করেন। সোমবার বিকেলে সালিস বৈঠকে মাহাবুবের পাশাপাশি হেনাকেও ১০০ দোররা মারার রায় দেন সমাজপতিরা। ৭০-৮০টি দোররা মারার পর হেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নিলে সে মারা যায়।
গ্রামের আবুল হাশেম মীর বলেন, হেনার বাবা সহজ-সরল গরিব কৃষক। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সংসার। ছোট মেয়ে হেনা শান্ত স্বভাবের ছিল। এমন একটি অসহায় পরিবারের সঙ্গে এই নির্মমতা এলাকার মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে।’
হেনাদের বাড়িতে দুটি ছোট টিনের ঘর। একটিতে হেনার চাচা থাকেন। আরেকটি ঘরে থাকে হেনারা। গতকাল টিনের সে ঘরটি ঘিরে ছিল এলাকার কয়েক শ মানুষ। স্বজনেরা ঘর আর আঙিনায় বসে বিলাপ করছে।
মুন্সিগঞ্জেও মানববন্ধন: মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মুন্সিগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে মানববন্ধন হয়েছে। দুপুর দুইটার দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বন্ধুসভার কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক সাইদুজ্জামান রওশন, বন্ধুসভার সভাপতি খালেদা খানম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মতিউল ইসলাম, বন্ধুসভার উপদেষ্টা তানভীর হাসানসহ বন্ধুসভার সদস্যরা অংশ নেন।

No comments:

Post a Comment