Tuesday, September 06, 2011

একজন গওহর রিজভী by এম আবদুল্লাহ

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ৩৯ বছর তাকে এদেশে দেখা গেছে কমই। তবে বছর দেড়েক ধরে বাংলাদেশের সরকার তার উপস্থিতি অনুভব করছে প্রবলভাবে। আর নিজেকে তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে ফেলছেন অনায়াসে। ব্রিটেন ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী তিনি। তবে তার স্থায়ী ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যামব্রিজের ৭৯নং জন এফ কেনেডি স্ট্রিট। বড় একটা সময় কেটেছে ভারতে। লেখালেখি, ধ্যান-জ্ঞান, গবেষণা সবই ভারতকে ঘিরে। স্ত্রী ইতালির।
পারিবারিক প্রধান ভাষা উর্দু, হিন্দি। সালামের পরিবর্তে ‘আদাব’ বলে সম্ভাষণ জানাতে অভ্যস্ত। ধর্মবিশ্বাসে কাদিয়ানী। সব মিলিয়ে এক রহস্যময় চরিত্র। বাংলাদেশের এ সময়ের সবচেয়ে ব্যস্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ড. গওহর রিজভী। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। দ্রুততম সময়ে ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দেয়ার বেপরোয়া ভূমিকার জন্য দেশজুড়ে হালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিনি। তার বক্তব্য শুনে অনেক সময় ভিমরি খেতে হয়। বুঝে উঠতে কষ্ট হয় তিনি কি ঢাকার না দিল্লির প্রতিনিধি। দেশপ্রেম, দেশের স্বার্থ বিষয়েও জ্ঞান দিয়ে চলেছেন তিনি। শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে কিছুদিন পড়িয়েছেন তিনি। ড. রিজভীর পুরো পরিবার হালে অনেকটা আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো বাংলাদেশে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক কিংবা পার্টনার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পারিবারিক জীবনে ড. গওহর রিজভীরা চার ভাই ও দু’বোন। তার বাবা মরহুম নাসির উদ্দিন হায়দার রিজভী। ভাইদের মধ্যে সবার বড়জন বিমানের ক্যাপ্টেন। তিনি ক্যাপ্টেন রিজভী হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয়জন হায়দার রিজভী। তিনি বিটিভিতে প্রোগ্রাম ম্যানেজার ছিলেন। পরে বৈশাখী টিভিতে সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখন কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও অংশীদার। তার স্ত্রী পোল্যান্ডের। ভাইদের মধ্যে তৃতীয় হচ্ছেন ড. গওহর রিজভী। তার স্ত্রী ইতালির নাগরিক। ছোট ভাই সৈয়দ আলী জওহর রিজভী সাধারণত শাহেনশাহ রিজভী হিসেবে পরিচিত। বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের সহযোগী সামিট এলায়েন্স পোর্ট লি, ওশান কন্টেইনার লি, ও গ্লোবাল বেভারেজ লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। গওহর রিজভীর দুই বোনই ইংল্যান্ড প্রবাসী এবং ব্রিটিশ নাগরিক। এছাড়াও ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে রিজভী পরিবার। সামিট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচালকের তালিকায় আরও রয়েছেন সোবেরা আহমেদ রিজভী, সৈয়দ ইয়াসের হায়দার রিজভী ও সৈয়দ নাসের হায়দার রিজভী।
২০০৯ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ম উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. গওহর রিজভী। তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদা, বেতন-ভাতাদি এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অন্য ৬ উপদেষ্টার মতোই তিনিও মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশগ্রহণ করছেন রীতি ভেঙে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. গওহর রিজভী ওই বছরের ১৮ জুলাই বাংলাদেশে এসে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ড. গওহর রিজভী উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে তার নামটি এদেশে খুব একটা পরিচিত ছিল না। নিয়োগের পর মিডিয়া অত্যন্ত কৌতূহল নিয়ে তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। খোদ সরকারি দলের অধিকাংশ নেতার কাছেও নামটি ছিল অপরিচিত।
উপদেষ্টা নিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, কার্য প্রণালী বিধির ৩-এর বি (আই) ধারার আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গওহর রিজভীকে তার উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় পুরোটা সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিক গওহর রিজভীকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় উপদেষ্টা নিয়োগের বৈধতা নিয়েও তখন প্রশ্ন ওঠে। কেন তাকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে এবং কেনইবা বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে কিছুদিন পড়িয়েছিলেন তিনি। সে সুবাদেই প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। তার চেয়েও বড় বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী মইন-ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জরুরি সরকারের সময়ে তার ভূমিকা। জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেনের সেনা নায়কদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল তার। বিশেষত, সমঝোতা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বহুল আলোচিত ও প্রভাবশালী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কারাগারে গওহর রিজভীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ডে সজীব ওয়াজেদ জয়ের উপস্থিতিতে যে সেমিনারে জেনারেল মইন যোগ দিয়ে আলোচিত বক্তব্য দিয়েছিলেন তারও আয়োজক ছিলেন গওহর রিজভী। এছাড়াও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার বিষয়ে ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের সঙ্গে সেতুবন্ধন রচনায় তার মুখ্য ভূমিকা ছিল বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সঙ্গে ড. গওহর রিজভীর গভীর সম্পর্কটাও বেশ কাজে লেগেছিল।
ড. গওহর রিজভীর অফিসিয়াল জীবন বৃত্তান্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাশ ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনোভেশন এর পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগে তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত নয়াদিল্লিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারও আগে তিনি ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত একই সংগঠনের গভর্ননেন্স অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক হিসেবে নিউইয়র্কে দায়িত্ব পালন করেন। ফাউন্ডেশনে যোগদানের আগে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে পিএইচডি করেন। এছাড়া ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গওহর রিজভী আফগানিস্তান, জেনেভা, ইসলামাবাদ ও কাবুলে ইউএনডিপি’র সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
ড. গওহর রিজভী বেশ কয়েকটি জার্নালে একক ও যৌথভাবে লিখেছেন। তার বেশিরভাগ লেখাই ভারতের সমস্যা, সম্ভাবনা, পররাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে। ইন্দো-ব্রিটিশ রিলেশনস ইন রেট্রোসপেক্ট এবং বিওন্ড বাউন্ডারিজ শীর্ষক যৌথভাবে লেখা তার দুটি নিবন্ধ ভারতের উচ্চ পর্যায়ে প্রশংসিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গওহর রিজভীর ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের আকস্মিক ব্যবসায়িক উত্থান নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল ড. গওহর রিজভীর মোবাইল নম্বরে কল করলে প্রথমে জানতে চান কোত্থেকে বলছি। আমার দেশ-এর পরিচয় জানার পর বলেন, রং নম্বর। জওহর রিজভীর সঙ্গে কথা বলতে সামিট ভবনে যোগাযোগ করলে জানানো হয় তিনি বনানীর গ্লোবাল বেভারেজ অফিসে আছেন। ওই অফিসে যোগাযোগ করে কথা বলতে চাইলে পরিচয় জেনে ফোন লাইন বেশকিছু সময় হোল্ড করে রেখে কেটে দেয়া হয়। এর পর কয়েকবার ফোন করলে কেটে দেয়া হয়। কোনো অফিস থেকেই তার মোবাইল নম্বর দেয়া হয়নি।

অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ছিল নূরউদ্দীন ও মাহবুবের

ড়াই লাখ মার্কিন তারবার্তা ফাঁস করেছে উইকিলিকস। ফাঁসের তালিকায় বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার অন্দরমহলও। সাবেক সেনাপ্রধান ও ’৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ নূরউদ্দীন খান ২০০৪ সালে তৎ কালীন জোট সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎ খাত করে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস ওয়াশিংটনে পাঠানো এক গোপন বার্তায় এমন কথাই বলেছিলেন। গত ৩০ আগস্ট জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস হ্যারি কে টমাসের পাঠানো সেই তারবার্তাটি ফাঁস করেছে।

‘সম্ভাব্য অভ্যুত্থানে সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের’ শিরোনামের ওই তারবার্তা থেকে জানা যায়, নূরউদ্দীন খান তৎ কালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারকে উৎ খাত করে দুই বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। নূরউদ্দীন খানের মতে, বাংলাদেশের পরিবারতান্ত্রিক সরকার ও ইসলামি জঙ্গিবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করা। এতে ভবিষ্যতে দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সব পথ রুদ্ধ হবে। নূরউদ্দীন খান দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চান।
হ্যারি কে টমাস নূরউদ্দীনের প্রস্তাব শুনে সঙ্গে সঙ্গে এর বিরোধিতা করেন। তিনি সাবেক সেনাপ্রধানকে জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎ খাতের কোনো পরিকল্পনা সমর্থন করবে না। তিনি নূরউদ্দীনকে হুঁশিয়ার করে দেন, তৎ কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
তারবার্তায় বলা হয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নূরউদ্দীন খান ভোজনের টেবিলে যোগ দেন। সেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। সেখানে হ্যারি কে টমাস তাঁকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই গণতন্ত্রের সমর্থক ও তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কামনা করে। সংবিধানবহির্ভূত কোনো প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকার উৎ খাত করার পরিকল্পনা তারা অনুমোদন করতে পারে না। বিশেষ করে, সামরিক অভ্যুত্থান তাঁর দেশ কিছুতেই মেনে নেবে না বলে তিনি নূরউদ্দীনকে জানিয়ে দেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জবাবে নূরউদ্দীন খান তাঁকে বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এমন দুজন নারীর (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) কাছে জিম্মি, যাঁরা কখনোই দেশ ও জাতির স্বার্থের কথা বিবেচনা করে নিজেদের মতপার্থক্য দূরে ঠেলে রাখতে পারেন না। নূরউদ্দীন খান বলেন, বাংলাদেশ সরকার দেশটির সেনাবাহিনীকে একটি দেউলিয়া বাহিনীতে পরিণত করেছে। এ অবস্থার জন্য তিনি সরাসরি তৎ কালীন চারদলীয় জোট সরকারকে দায়ী করে বলেন, ‘এই মুহূর্তে (২০০৪) সেনাবাহিনীর শীর্ষ সাতজন কর্মকর্তাই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাই মেজর (অব.) সাইদ এস্কান্দারের সহপাঠী। যোগ্যতা না থাকার পরও শুধু অনুগত থাকার কারণে এসব পদে তাঁদের বসানো হয়েছে। নূরউদ্দীন এই সাতজনকে ‘পরশ্রীকাতর সাত’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি হ্যারি কে টমাসকে আরও বলেন, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিকীকরণ শুরু হয়েছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের সময় থেকে (১৯৯১-৯৬)। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা আরও বেড়েছে।
নূরউদ্দীন খান রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসকে প্রস্তাব দেন তাঁর পরিকল্পনাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি হবেন ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের তদানীন্তন কমান্ড্যান্ট আবু তৈয়ব মুহাম্মদ জহিরুল আলম (যিনি জেনারেল জহির নামে পরিচিত)। তিনি দাবি করেন, জেনারেল জহির গণতন্ত্রের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যোগ্য নেতাদের এক পতাকাতলে নিয়ে এসে অন্তর্বর্তীকালীর সরকার গঠন করবেন। দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি সেই সরকার জেনারেল জহিরের নেতৃত্বে একটি নতুন খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সংস্কার করে সেগুলোকে শক্তিশালী করে তুলবে। একই সঙ্গে সরকার বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট করবে। সবশেষে তারা একটি সর্বজনস্বীকৃত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
তারবার্তা থেকে জানা যায়, আলোচনার একপর্যায়ে নূরউদ্দীন খান হ্যারি কে টমাসকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার সব সময়ই সেনাবাহিনীর তরফ থেকে অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করে। এমনকি তারা সাইদ এস্কান্দারের ব্যাচমেটদেরও বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন, এ বছরের শুরুতেই (২০০৪) মেজর জেনারেল রোকনকে কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল হিসেবে বদলি করা হয়েছে। কারণ, সরকারের চোখে তিনি একটি হুমকি।
নূরউদ্দীনের এই কথার পিঠে রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস মন্তব্য করেন, মেজর জেনারেল রোকন খালেদা জিয়ার ভাই সাইদ এস্কান্দারের একজন কোর্সমেট। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাদের অন্যতম, যিনি একটি সেনা অভ্যুত্থান সফলভাবে সংঘটনের ক্ষমতা ও মেধা রাখেন।
নূরউদ্দীন খান হ্যারি কে টমাসের কাছে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কেও নিজের হতাশা ব্যক্ত করেন। ২০০৪ সালের গোড়ার দিকে নূরউদ্দীন খান আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর দেশের মানুষের কাছ থেকে যে ধরনের সহানুভূতি শেখ হাসিনার পাওয়ার কথা ছিল, তা তিনি পাননি। এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করার পরিবর্তে শেখ হাসিনা কেবল হরতাল ও অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে চাইছিলেন। এতে তিনি জনপ্রিয়তা হারান। এই পর্যায়ে নূরউদ্দীন হ্যারি কে টমাসকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই দেশের বিদ্যমান পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির একমাত্র বিকল্প হতে পারে।
নূরউদ্দীন আরও বলেন, প্রথমত, খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো বরাবরের মতো দেশে ভীতি ছড়াবেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করবেন এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতিকে ডোবাবেন। তিনি একইভাবে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও বোন শেখ রেহানা সম্পর্কে বিষোদগার করে বলেন, তাঁরাও তারেক-কোকোর মতো দুর্নীতিবাজ ও অর্থলোলুপ।
একপর্যায়ে নূরউদ্দীন খান দেশের বিদ্যমান দুরবস্থার জন্য নিজেকেও আংশিক দায়ী করেন। তিনি বলেন, স্বৈরশাসক লে. জেনারেল এরশাদ যখন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, তখন পাকিস্তানের তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগ (যিনি নূরউদ্দীনের একজন বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী) নূরউদ্দীনকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। নূরউদ্দীন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে আসলাম বেগ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এরশাদের পর পাকিস্তান কাকে সমর্থন দিতে পারে। আসলাম বেগের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি পাকিস্তানকে বিএনপির প্রতি সমর্থন দেওয়ার কথা বলেন। তিনি আসলাম বেগকে জানিয়েছিলেন, বিএনপিতে অনেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ী শ্রেণীও দলটিতে আছে, যাঁরা বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখেন।
তারবার্তায় বলা হয়, ওই সময় পাকিস্তান বিএনপিকে মদদ দেওয়ার জন্য তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে ব্যবহার করছিল। অন্যদিকে ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) আওয়ামী লীগকে মদদ দিচ্ছিল। নূরউদ্দীন খান বলেন, উভয় দেশ এখনো (২০০৪) এই দুই দলকে মদদ জুগিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মল্লযুদ্ধের ভূমিতে পরিণত হয়েছে। নূরউদ্দীন খান হ্যারি টমাসকে জানান, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় ভারত আওয়ামী লীগের ওপর পুরোপুরি খুশি ছিল না। সে সময় তাদের গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলকেই অর্থসহায়তা করেছিল। বিএনপির চেয়ারপারসনের ছেলে তারেক রহমান ‘র’-এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন, তাঁদের দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন ও সে দেশে গ্যাস রপ্তানির বিষয়ে তিনি তাঁর মা খালেদা জিয়াকে রাজি করাবেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তিনি তা করতে ব্যর্থ হন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন, ২০০৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে নয়াদিল্লি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
নূরউদ্দীন বলেন, ২০০৬ সালের নির্বাচনে জেতার জন্য বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ধ্বংসাত্মক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তিনি আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বইপত্র নিষিদ্ধ করার বিষয়ে চারদলীয় জোট সরকারের পদক্ষেপের কড়া সমালোচনাও করেন। একই সঙ্গে তখনো পর্যন্ত সিলেটে তদানীন্তন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ও মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নূরউদ্দীন বলেন, সরকার এই মুহূর্তে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না শুধু ইসলামি দলগুলোকে খুশি করার জন্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে একটি আলোচনার কথাও ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন হ্যারি কে টমাস। ওই বার্তায় বলা হয়, ২০০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর সঙ্গে তদানীন্তন সরকারি দল বিএনপির সাংসদ লে. জেনারেল মাহবুবের আলাপ হয়। সেই আলাপে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময়ই সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আশা করে। যুক্তরাষ্ট্র সবুজ সংকেত দিলেই তারা অভ্যুত্থান ঘটাবে।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ১৯৯৬ সালে একটি বড় ধরনের সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব বহন করে।
মাহবুবুর রহমান হ্যারি কে টমাসের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি হয়তো আরও অন্তত একটি প্রজন্ম পরিবারতন্ত্রের মধ্যে ঘুরপাক খাবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীই একমাত্র সংগঠিত প্রতিষ্ঠান এবং তারা বেসামরিক প্রশাসনে শিগগির হস্তক্ষেপ করতে চায় না।
হ্যারি টমাস উল্লেখ করেন, মাহবুবুর রহমান তাঁকে জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কিছু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনোই করবে না।
লে. জেনারেল (অব.) নূরউদ্দীন খান এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎ খাতের এ ধরনের প্রস্তাব আমি কাউকে দিইনি। আমি সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলাম, আছি এবং থাকব। ১৯৯০ সালে আমি না থাকলে ওই সময় এরশাদের পতনও হতো না, গণতন্ত্রও আসত না। তাই আমাকে নিয়ে এ ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী কথাবার্তা অসত্যই নয়, অবান্তরও।’
সাবেক সেনাপ্রধান আরও বলেন, ‘২০০৪ সালে আমি তো গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলাম না। রাস্তার মানুষ ছিলাম। এ ধরনের একজন মানুষের পক্ষে কি এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব? যে কেউ সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন।’
লে. জেনারেল (অব.) আবু তৈয়ব মুহাম্মদ জহিরুল আলম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে কেউ সরকারপ্রধান করার প্রস্তাব দেবেন—এমন কোনো আভাসও তিনি কখনো পাননি। এই প্রথম এ ধরনের একটি বিষয় শুনলেন।

মনমোহন আজ আসছেন, পানিবণ্টন চুক্তি অনিশ্চিত

তিহাসিক এক সফরে আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। তবে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে দৃশ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বহু প্রত্যাশিত তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তি। গতকাল সোমবার বিকেলে নয়াদিলি্ল থেকে পশ্চিমবঙ্গের অমতে বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তি না করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সফরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার ব্যাপারে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরের কথা ছিল, সে ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গতকাল তাঁর সফরপূর্ব বিবৃতিতে গতানুগতিক খাতগুলোর পাশাপাশি নতুন নতুন কয়েকটি খাতে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন। আর পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ঢাকা আশা ছাড়েনি। দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়ে রূপরেখা চুক্তি হতে পারে বলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত রবিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় অব্যাহত যোগাযোগের মাধ্যমে ১০টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও প্রটোকল চূড়ান্ত করেছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠক এবং পরে তাঁদের নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক শেষে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। আজ বিকেলের ওই বৈঠকের দিকে দৃষ্টি থাকবে উভয় দেশের কোটি কোটি মানুষের।
এদিকে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে অনেকটা ভাটা পড়েছে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশায়। তবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ওপরই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক প্রত্যাশা রয়েছে। এ কারণে দুই দেশের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এ সফর যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের জন্য কুল রক্ষার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন, ছিটমহল বিনিময় দুই দেশের মধ্যে কয়েক যুগ ধরে বিরাজমান অনেক ইস্যু দৃশ্যত সমাধানের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে যাওয়ার সময় মনমোহনের এ সফরকে ঘিরে আশাবাদী দুই দেশ। বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পানি, অন্যদিকে ভারতের কাছে ট্রানজিট। এই দুই ইস্যুতে কোনো চুক্তি না হলে মনমোহনের এ সফর নিয়ে দুই দেশের জনগণের আশা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিকরা। বিশেষ করে এ সফরে সম্ভাব্য বিভিন্ন চুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ধারণা দেওয়ায় জনগণের প্রত্যাশা আরো বেড়ে যায়। এ সফরকে ঘিরে উভয় দেশের জনগণের প্রত্যাশার চাপ রয়েছে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের ওপর। তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি না হলে জনগণের প্রত্যাশার সামাল দিতে হবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারকে। এসব চাপ নিয়েই আজ বিকেলে ঢাকায় তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকে বসবেন দুই প্রধানমন্ত্রী। স্পর্শকাতর অনেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে এ বৈঠক থেকে। গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সাবেক কূটনীতিক ও লেখক জি পার্থ সারথি 'স্টেপ আপ টাইস উইথ বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছেন, ঢাকার প্রতি দিলি্লর ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতনীতির সমালোচকরা শান্ত হবেন।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ বিভিন্ন মহলে শেখ হাসিনার ভারতনীতির সমালোচনা রয়েছে। দিলি্ল যদি বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পাওনা দিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ না নেয়, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচকরা মুখর হবেন বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর থেকেই মনমোহন সিংয়ের সফরের প্রত্যাশী ছিল বাংলাদেশ। দীর্ঘ ১৯ মাসের প্রতীক্ষার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী আজ দুপুর ১২টার দিকে ঢাকায় আসছেন। ১৯৯৯ সালের পর প্রথমবারের মতো কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ পেয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। গত দেড় বছরে এ দেশ সফর করেছেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারী, কংগ্রেস সভানেত্রী ও ভারতের জাতীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলের চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ, অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি, বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মাসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন মনমোহনের সফর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। সব প্রস্তুতি শেষে প্রায় ৩০ ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। গত জুন মাসের শেষ দিকে ভারতের সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বাংলাদেশ নিয়ে 'অব দ্য রেকর্ড' এক অনভিপ্রেত মন্তব্য করে দুই দেশেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন মনমোহন সিং। এরপর দৃশ্যত অনেকটা তড়িঘড়ি করেই এ সফরের তারিখ ঘোষণা করা হয়। তবুও এ সফরকে ঘিরে দুই দেশের জনগণের প্রত্যাশা অনেক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকে 'ঐতিহাসিক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, গত বছরের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের যে বিরাট যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পেঁৗছেছে। বাংলাদেশ কেবল দুই দেশের বিষয়েই নয়, পুরো অঞ্চলের উন্নয়নের কথা ভাবছে।
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও গত শনিবার বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর ঢাকা সফর সম্পর্কে বলেছেন, এ সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা ও দিলি্ল সম্পর্ক জোরদারের নতুন সুযোগ পাবে। এর আগে গত ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে মনমোহন সিং তাঁর ঢাকা সফরের কথা জানানোর সময়ও বলেছিলেন, এ সফর হবে ঐতিহাসিক।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে ফলপ্রসূ করতে দিলি্লর আন্তরিকতায় ঘাটতি ছিল না। বছরের পর বছর ধরে জিইয়ে থাকা বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলো হঠাৎই যেন ছুটতে শুরু করেছে। গতি এসেছে যৌথ ইশতেহার বাস্তবায়নপ্রক্রিয়াতেও। দীর্ঘ ৬৪ বছর পর বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের সীমানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও চুক্তির মাধ্যমে আইনি রূপ পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। যেসব ইস্যু রাতারাতি নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়, সেগুলোও সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ ঢাকায় দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও রূপরেখা মিলতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা সফরের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরের আগে গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। মুক্তিসংগ্রাম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উভয় দেশই অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষায় বিশ্বাসী।'
বিবৃতিতে মনমোহন বলেন, 'সফরের সময় আমার সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা থাকবেন। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বৃহৎ পরিসরে কাজ করার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এর মাধ্যমে আমাদের সহযোগিতার ফল সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষ পাবে।' তিনি আরো বলেন, 'বর্তমানে আমরা দুই দেশ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে চমৎকার সময় উপভোগ করছি। গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ফিরতি সফর হিসেবে আমার সফর বিবেচিত হবে। এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, নিরাপত্তা, সীমান্ত ইস্যু, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ সংযোগ, সীমান্ত অবকাঠামোর উন্নয়ন, বাণিজ্য সুবিধা, অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের ইচ্ছা, এগুলো টেকসই ও ইতিবাচক উন্নয়নের দিকেই এগিয়ে যাবে। ওই বিষয়গুলোতে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার ক্ষেত্র আমার এ সফরের মধ্য দিয়ে সম্প্রসারিত হবে বলে আমি আশা করি। গতানুগতিক খাতগুলোর পাশাপাশি নতুন কিছু খাতে আমাদের সহযোগিতা বৃদ্ধিতে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারেও আমরা আশা করছি।'
বিবৃতিতে মনমোহন সিং রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেছেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।'
বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, 'কাছের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। এটি এমনই এক অংশীদারিত্ব, যার ব্যাপক প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই পড়বে।'
সফরসূচি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে বহনকারী ভারতীয় বিশেষ বিমান ঢাকায় পেঁৗছাবে আজ সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর ১২টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ১৯ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সালাম জানাবে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ওই সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন। বিমানবন্দর থেকে সোয়া ১২টায় মনমোহন সিংয়ের মোটর শোভাযাত্রা রওনা হবে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে। ১টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে পেঁৗছে মনমোহন সিং এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারী বীর শহীদদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করবেন এবং স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে গাছের চারা রোপণ করবেন। স্মৃতিসৌধ থেকে মনমোহন সিংয়ের মোটর শোভাযাত্রা রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে পেঁৗছাবে ১টা ৫০ মিনিটে। তিনি সেখানেই দুপুরের খাবার খাবেন এবং বিশ্রাম নেবেন। বিকেল ৪টার পর মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই সাক্ষাৎ শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাবেন তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। অন্যদিকে মনমোহন সিংয়ের স্ত্রী গুরশরণ কাউর এ সময় গুরুদুয়ারা পরিদর্শন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাবেন এবং পরিদর্শন শেষে সোনারগাঁও হোটেলে ফিরবেন।
মনমোহন সিং তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পেঁৗছে শিমুল হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আধা ঘণ্টার একান্ত বৈঠকে অংশ নেবেন। এরপর বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষ চামেলিতে চলবে দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ওই বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং এরপর একটি যৌথ ঘোষণা দেওয়া হবে। এরই ফাঁকে দুই প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় থেকে সুইচ চেপে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন। সন্ধ্যা ৭টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোনারগাঁও হোটেলে ফিরবেন এবং রাত ৮টায় ওই হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আয়োজিত নৈশ ভোজে যোগ দেবেন। ওই নৈশ ভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বক্তব্য দেবেন।
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ আগামীকাল বুধবারের সফরসূচি অনুযায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোনারগাঁও হোটেলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হবেন সকাল পৌনে ১১টায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে তিনি ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত তিনি 'ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়া' (ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া) শীর্ষক বক্তব্য দেবেন। সেখান থেকে সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে তিনি বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হয়ে পেঁৗছাবেন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তিনি ১২টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে যাবেন। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জাদুঘর পরিদর্শন এবং পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করবেন। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোনারগাঁও হোটেলে ফিরবেন দুপুর দেড়টায়। সেখানে দুপুর ১টা ৩৫ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত দুপুরের খাবার খাওয়া ও বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রামের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিশ্রাম ও সাক্ষাৎ পর্ব শেষে মনমোহন সিং হোটেল থেকে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হবেন। বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এভাবেই শেষ হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঢাকা সফর।
সম্ভাব্য চুক্তি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত রবিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে তিনটি চুক্তি, পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও দুটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হতে পারে। তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনে ১৫ বছর মেয়াদি দুটি চুক্তি ছাড়া অপর চুক্তিটি হলো ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিবিষয়ক। সম্ভাব্য এমওইউ পাঁচটি হলো সুন্দরবন সুরক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ও মৎস্য খাতে সহযোগিতা, বিটিভি ও দূরদর্শন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতা। সম্ভাব্য প্রটোকল দুটি স্থল সীমানা ও বাঘ রক্ষাবিষয়ক। এ ছাড়া পুরো অঞ্চলের সহযোগিতার বিষয়ে একটি কাঠামো (রূপরেখা) স্বাক্ষর করতে পারেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এর বাইরে ট্রানজিট বিষয়ে ভবিষ্যতে যে প্রটোকল হবে, সে লক্ষ্যে দুটি 'লেটার অব এঙ্চেঞ্জ' স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে তিনি জানান।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী সম্ভাব্য চুক্তিগুলো গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে বলে জানালেও তা করা হয়নি বলে বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে। তবে গতকাল সন্ধ্যায় সীমিত পরিসরে আরেকটি বৈঠক বসেছে এবং ওই বৈঠকে সম্ভাব্য চুক্তিগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে কি না তা জানা যায়নি। শেষ পর্যন্ত কয়টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে_এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গতকাল সোমবার দুপুরে ওপরের চুক্তি, এমওইউ ও প্রটোকলগুলোর কথা উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কয়টি স্বাক্ষরিত হবে, তা শীর্ষ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হবে।
গতকাল বিকেলে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই বলেছেন_পশ্চিমবঙ্গের সম্মতি ছাড়া বাংলাদেশ-ভারত পানিবণ্টন চুক্তি হবে না। এদিকে ঢাকায় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে চুক্তি এ সফরে স্বাক্ষরিত হওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বহুল আলোচিত তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হচ্ছে না বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ব্যাপারে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস।
সফরসঙ্গী: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত রবিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকায় মনমোহনের সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন। তাঁরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গোগোই ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলা। তবে গতকাল নয়াদিলি্ল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকাকে জানানো হয়েছে, মমতা আসছেন না। অন্যদিকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গোগোই গতকাল সোমবার সকালেই ঢাকায় এসেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ, পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব টি কে এ নায়ার, পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই, গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা ড. হারিস খারিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঢাকায় আসছেন। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ঢাকা সফরকারী ১৩৭ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ৪১ জন সাংবাদিক ছাড়াও আছেন বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী।