Tuesday, February 15, 2011

নিঃস্ব লাখো বিনিয়োগকারী

দিন যত গড়াচ্ছে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমাণ তত বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তাঁদের ক্ষোভের মাত্রা। প্রায় দুই মাস ধরে চলা অব্যাহত দরপতনে এরই মধ্যে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে।

এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার দেশের শেয়ারবাজারে আবারও বড় ধরনের দরপতন ঘটে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা বাজার নিয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও নীতিনির্ধারকসহ বিভিন্ন মহলের সমন্বয়হীন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। একপর্যায়ে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় লিপ্ত হন। এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে থেকে পুলিশ কমপক্ষে ৬১ জন বিনিয়োগকারীকে আটক করে।
এদিকে সরকার ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার ঘোষণা আপতত কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গতকাল সকালেই সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে দুপুরে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর নিজ কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুঁজিবাজারে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ শেয়ারের দাম কমাচ্ছে, তার প্রমাণও আছে আমাদের কাছে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এখনই বাজারে ছাড়া হবে না। এ ব্যাপারে ২০ ফেব্রুয়ারির পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ সময় অর্থমন্ত্রী আবারও চলতি সপ্তাহের মধ্যে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার ইঙ্গিত দেন।
সরকার গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়ার দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। এরপর প্রথম লেনদেন দিবসে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। বিশেষ করে সরকারি কোম্পানিগুলো একেবারে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। বাজারে যখন চাহিদা বাড়ানো দরকার, তখন জোগান বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগ সময়োচিত হয়নি বলে সমালোচনা করেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
আগের দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল ডিএসইতে সাধারণ মূল্যসূচক ৪৭৩ পয়েন্ট বা ৭ দশমিক ৮১ পয়েন্ট কমে পাঁচ হাজার ৫৭৯ পয়েন্টে নেমে আসে। এ নিয়ে গত তিন মাসেরও কম সময়ে সূচক কমেছে তিন হাজার ৩৩০ পয়েন্টের বেশি। সূচক কমার এ হার প্রায় ৪০ শতাংশের মতো। আর এতে বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রামীণফোনের তালিকাভুক্তির সময় কৃত্রিমভাবে বাড়ানো সূচকের অংশটুকু বাদ দিলে বাজারের প্রকৃত সূচক আরও কম হবে।
যোগাযোগ করা হলে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিনিয়োগকারীদের আরও যৌক্তিক আচরণ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই বাজার তার মৌলভিত্তির চেয়ে নিচে নেমে এসেছে। তালিকাভুক্ত অন্তত ৮০ থেকে ১০০টি কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই ১০ থেকে ২০-এর নিচে নেমে গেছে। এ ধরনের শেয়ার যাঁদের হাতে রয়েছে, তাঁদের সেগুলো বিক্রি করা উচিত নয়। এতে সরবরাহ কমে গিয়ে বাজার এমনিতেই ঘুরে দাঁড়াবে।
একই সঙ্গে তিনি বাজারে চাহিদা সৃষ্টির জন্য মিউচুয়াল ফান্ড ও মার্চেন্ট ব্যাংককে আরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ডিএসই সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বাজারের গড় পিই ১৩ দশমিক ৭৭।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বাজার এমনিতেই আস্থার সংকটে ভুগছিল। তার ওপর নানা মহলের বক্তব্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। এ অবস্থায় কেবল প্রণোদনা দিয়ে বাজারে আস্থা ফেরানো যাবে না, এ জন্য উদ্ধার বা বেইল-আউট কর্মসূচি নিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অংগ্রণী ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), সাধারণ বিমা ও জীবন বিমার সমন্বয়ে একটি মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে শেয়ার কেনার কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ব্যাপক দরপতনের মধ্য দিয়ে গতকাল ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয়। আধঘণ্টার মধ্যে সাধারণ মূল্যসূচক ৪৩৬ পয়েন্ট কমে যায়। এ সময় পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ডিএসইর সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বেরিয়ে এসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অংশ নেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ডিএসইর বিপরীত পাশে অবস্থিত মধুমিতা ভবনের ভেতর থেকে কিছু বিনিয়োগকারী ভবনের কাচ ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় ওই ভবনের সামনের সড়কে ভাঙা কাচের টুকরো পড়তে থাকে। একই সঙ্গে মধুমিতা ভবনসহ বিভিন্ন ভবন থেকে ইট, পানির বোতল ও বড় পানির জার নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর মূল ভবন ও সমবায় ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ বিনিয়োগকারীদের ধাওয়া দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অপর দিকে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগকারীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। এতে ওই এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দুপুর ১২টায় বিনিয়োগকারীরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করেন এবং গাড়ির চালক জয়নাল আবেদিনকে মারধর করেন। এ ছাড়া দৈনিক বাংলা মোড়ে আরও অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে।
এ সময় বিনিয়োগকারীরা সেখানে কর্তব্যরত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন। তাঁদের আঘাতে আরটিভির ক্যামেরাম্যান মাসুদ, চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরাম্যান আবদুর রব এবং মোহনা টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান আবুল কালাম আজাদ আহত হন।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিনিয়োগকারীরা মধুমিতা ভবনের ছয় তলায় আগুন লাগিয়ে দেন। প্রায় ২০ মিনিট পর নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণব্যবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। একই সময় ডিএসইর সামনে ঝুলন্ত তারে আগুন লাগিয়ে দেন বিনিয়োগকারীরা। তবে ডিএসইর নিরাপত্তাকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ সময় ডিএসইর কর্মচারীদের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
একপর্যায়ে বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বেলা পৌনে একটার দিকে পুলিশ সড়কের দুই পাশে অবস্থানরত বিনিয়োগকারীদের সরাতে বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে। একই সঙ্গে শুরু করে গণআটক। পুলিশ ডিএসই ভবনের (৯/ই) নিচতলাসহ বিভিন্ন ভবনে অবস্থিত ব্রোকারেজ হাউসে ঢুকে বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে এবং সেখান থেকে সাইদুর রহমান, সুমন, মাসুম ও নিপুনা সার্ভিস স্টেশনের সামনে থেকে রাসেল, মোজাম্মেলসহ অন্তত ৩০ জনকে আটক করে। সংঘর্ষ চলাকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অন্তত আটটি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।
পরে বেলা আড়াইটার দিকে মধুমিতা ভবনে অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ২৭ জন আটককে করে পুলিশ। এর আগে ডিএসইর সামনে থেকে আরও চারজনকে আটক করা হয়। এ নিয়ে আটকের সংখ্যা ৬১ জনে দাঁড়ায়। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে ৪৫ জনকে আটক করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে বিনিয়োগকারী ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত যান-চলাচল বন্ধ থাকে। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে পুলিশ বিনিয়োগকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে যান-চলাচল স্বাভাবিক হয়।
আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সেখানে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছে। অব্যাহত দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা জুতা মিছিল নিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টাকালে নগরের ডাকবাংলা মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেছেন। এ সময় তাঁরা অর্থমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আ হ ম মুস্তফা কামালের পদত্যাগ দাবি করেন। কুমিল্লায় বিনিয়োগকারীরা ঝাড়ু ও জুতা মিছিল করেছেন। এ সময় বিনিয়োগকারীরা শহরের কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে আগুন লাগাতে চেষ্টা করলে পুলিশের বাধায় পিছু হটতে বাধ্য হন। সিলেটের বিনিয়োগকারীরাও দরপতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। তাঁরা নগরে মিছিল ও রাস্তায় গাড়ির টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দরপতনের প্রতিবাদে বন্দরনগর চট্টগ্রামের বিনিয়োগকারীরা আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) কার্যালয়ের সামনের সড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
সিএসইতে গতকাল সাধারণ মূল্যসূচক এক হাজার ৩০০ পয়েন্ট বা ৭ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট কমে ১৬ হাজার ১১২-তে নেমে এসেছে। আর লেনদেন হয়েছে ৮১ কোটি টাকার শেয়ার।
অর্থমন্ত্রীর সংবাদ ব্রিফিং: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি তো বলেছিলাম এ সপ্তাহের মধ্যে বাজার স্থিতিশীল হবে। সপ্তাহ তো এখনো শেষ হয়নি।’
রোববার এক সেমিনারে দেশের পুঁজিবাজারকে ক্যাসিনোর (জুয়া খেলা) সঙ্গে তুলনা করেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রেহমান সোবহান এটা প্রতীকী অর্থে বলেছেন। আর আমি তো আগেই বলেছি, শেয়ারবাজার কোনো জুয়া খেলার জায়গা নয়। তবে এখানে কেউ কেউ আজ ১০০ টাকা এনে কালই ২০০ টাকা বানাতে চাইছেন। এমন প্রবণতা জুয়া খেলার মতোই মনে হয় তাঁর কাছে।
অর্থমন্ত্রী উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘পতনোন্মুখ অবস্থার মধ্যেও বাজারে এক লাখ নতুন বিনিয়োগকারী এসেছেন। তার মানে কী?’
ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করা) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিএসইর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। প্রথমে আপত্তি করলেও এখন তারা রাজি। ডিমিউচুয়ালাইজেশন সম্ভব না হলে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের চিন্তার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য একটি বাজারই যথেষ্ট।’
ট্রিগার সেলের আতঙ্ক: যেসব বিনিয়োগকারী মার্চেন্ট ব্যাংক ও বা ব্রোকারেজ হাউস থেকে তাঁর মূলধনের বিপরীতে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই মূলধন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এতে ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তা বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে। বাজারে এ ধরনের ঋণ সমন্বয়ের জন্য শেয়ার বিক্রির বিষয়টি বাজারে ট্রিগার সেল নামে পরিচিত। বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে বলেছেন, গতকালের দরপতনের পেছনে অন্যতম কারণ এই ট্রিগার সেল। তাঁরা বলেন, সূচক আরও কমলে ট্রিগার সেলের পরিমাণও বাড়বে। তখন বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ট্রিগার সেল বন্ধে তাঁরা সরকারি উদ্যোগের আহ্বান জানান।
বিশেষ ফান্ড অনুমোদন: এসইসি গতকাল ৫০০ কোটি টাকার ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড নামের একটি বিশেষ মিউচুয়াল ফান্ড গঠনের জন্য ট্রাস্ট চুক্তি ও নিবন্ধনের অনুমোদন দিয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ফান্ডটির মূল উদ্যোক্তা। এই চারটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ২০০ কোটি টাকার জোগান দেবে। এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের অংশ এখনই বিনিয়োগের শর্তে ফান্ডটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ফান্ডটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকছে বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ইমাম জানান, আজ মঙ্গলবার ট্রাস্ট চুক্তি ও নিবন্ধন সম্পন্ন হবে। এরপরই তাঁরা উদ্যোক্তাদের অংশ বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন।

মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে

তিহাসিক স্থান বগুড়ার মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে! মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন বিভিন্ন স্থাপনা থেকে দিনে-দুপুরে ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সেই ইট আবার বিক্রি হচ্ছে প্রতি ভ্যান ৩০-৩৫ টাকায়।

মহাস্থানগড় এলাকার দুর্লভ প্রত্নসম্পদ থেকে লুণ্ঠিত আকারে বড় ও কারুকাজসম্পন্ন এসব ইট দিয়ে তৈরি হয়েছে অর্ধশতাধিক বাড়ি। কয়েক বছর ধরে এসব অপকর্ম চললেও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
এদিকে মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ
ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় জমি দখলের অপরাধে মামলা দায়ের করার জন্য বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কেউ পুরাকীর্তি নষ্ট করতে এলে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত সোমবার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতান বলখি (রহ.) মাজার শরিফের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়িই তৈরি হয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্ন ইট দিয়ে। যে যার ইচ্ছেমতো মাটি খুঁড়ে বের করেছে ঐতিহাসিক সব নিদর্শন। এরপর তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাড়িঘর। অনেক বাড়িতে প্লাস্টার (আস্তর) করা হয়নি, যাতে প্রত্ন ইটের গায়ের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দৃশ্যমান। বিশাল আকৃতির একেকটি বাড়িতে সেই প্রাচীন আমলের হাজার হাজার ইট ব্যবহার করা হয়েছে। পুণ্ড্রনগরের মহামূল্য পোড়া ইটের কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে। কিনে নেওয়া ছাড়াও কিছু ইট জমিতে কাজ করতে গিয়ে লাঙ্গলের ফলায় উঠে এসেছে। কিছু চুরি করে আনা হয়েছে খনন করা ঢিপি এবং পুণ্ড্রনগরীর প্রাচীর থেকে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর স্থানীয় অধিবাসীদের অজ্ঞতায় প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে এই অমূল্য সম্পদ।
স্থানীয় দোকানদার নুরুল ইসলাম জানান, এলাকায় রফিকুল নামের এক যুবক পুরনো এসব ইট বিক্রি করে। প্রতি ভ্যান ইটের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এক ভ্যানে সর্বোচ্চ ২০০টি ইট বহন করা যায়। এ ছাড়া এই ইট বিক্রির সঙ্গে আরো সংশ্লিষ্ট রয়েছে সফিকুল, মিরাজুল ও আকবর। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে প্রত্নসম্পদ রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে প্রকাশ্যে ইট বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তার পরও লুকিয়ে এসব ইট বিক্রি করা হচ্ছে। গফুর নামের আরেকজন মুদি দোকানি জানান, মাটি খুঁড়ে শুধু ইট নয়, আরো পাওয়া যায় দুর্লভ মূর্তি, সোনার পাত্রের ভাঙা অংশ। এগুলো কখনো পাওয়া গেলে তার ভাগ্য ফিরে যায়। কখনোই এসব ব্যাপার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হয় না। রাতের আঁধারে চলে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ।
মহাস্থানের পাশে মথুরা এলাকায় প্রত্নতত্ত্ব ইট দিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন আবদুল ওয়াহাব নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ভ্যানে করে এসব ইট এনেছেন। কিনেছেন ৪০ টাকা ভ্যান হিসেবে। প্রায় ১০ হাজার ইট লেগেছে তাঁর তিন কক্ষের বাড়িটি বানাতে। কেন এই ইট ব্যবহার করেছেন, এগুলোর প্রত্নতাত্তি্বক মূল্য কী সেটা জানেন_এমন প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহাব জানান, 'এই ইটাই কিনা লাভ। বেশি দাম দিয়্যা ইটা কিনবার যামু ক্যা। হামাক্যেরোক কেউ কুনুদিন ম্যানা করেনি যে, এই ইটা দিয়্যা বাড়ি করার যাবি না। তালে হামাকেরে কী দোষ।' তিনি জানান, মাত্র ১৫ দিন হলো তাঁর বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এই বাড়ি ভাড়া দেবেন।
এলাকা ঘুরে আরো দেখা গেছে, মাজারসংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা কাসেম উদ্দিন, রনজু মিয়া, আবদুল মান্নান, কাসেম আলী, মীর আলম ও সবুর মিয়ার বাড়িও প্রত্নসম্পদের ইট দিয়ে তৈরি। গড়ের আশপাশে এ ধরনের আরো অর্ধশতাধিক বাড়ি রয়েছে। তবে কোনো বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিককে পাওয়া যায়নি। এসব বাড়ি ভাড়া দিয়ে মালিকরা অন্যত্র থাকেন।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, সংরক্ষিত এই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রত্নসম্পদের ইট ব্যবহারে বাধা দিতে গেলে তাঁদের পাল্টা হুমকি দেওয়া হয়। তিনি জানান, মহাস্থান এলাকায় কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেও তিনি সেটা খনন করে এসব প্রত্ন নিদর্শন বিক্রি বা ব্যবহার করার অধিকার রাখেন না। এসব ঐতিহাসিক স্থানের সব নিদর্শনের মালিক সরকার। তিনি জানান, বর্তমানে মহাস্থানের যে সম্পত্তি রয়েছে তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সম্পত্তির মালিক বনে গেছে এলাকার কিছু মানুষ। সম্প্রতি সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এসব সম্পদ অধিগ্রহণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনার। সেই মতো কাজ চলছে। অনেককে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে জমি ফেরত নেওয়া হয়েছে। তবে আফজাল হোসেন স্বীকার করেন, প্রত্নসম্পদ নষ্ট করে যেভাবে ঘরবাড়ি করা হচ্ছে তা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার জন্য রীতিমতো হুমকি।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) নাহিদ সুলতানা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের অবস্থা হয়েছে 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার'-এর মতো। বিশাল এলাকার নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর রয়েছে মাত্র ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে আনসার রয়েছে মাত্র সাতজন, যা দিয়ে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়।
অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, মহাস্থানগড়ের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দখলে রয়েছে। বাকি ৮০০ একরেরও বেশি এলাকা এখনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তহবিলের অভাবে সরকার এত দিন সেগুলো অধিগ্রহণ করেনি। পুরো এলাকাটি সে কারণে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত স্থাপনা, বাড়িঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপের ওপরই মাটিতে চাষাবাদ চলছে। নানা জাতের শীতকালীন সবজি ফলানো হয়েছে। আর জমি তৈরি করতে গিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির নিচ থেকে পুরো অথবা ভাঙা ইট তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আলের পাশে। এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন জানান, স্থানীয় লোকজন গড়ের ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি তৈরি করছে। প্রশাসনের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কখনোই কোনো বাধা তাঁরা পাননি।
আওয়ামী লীগ নেতাকে হাইকোর্টের তিরস্কার
হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বলেছেন, মহাস্থানগড়ের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধী ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। যে শ্রমিকরা এটা নষ্ট করেছে, খোঁড়াখুঁড়ি করেছে, তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাদের নিয়োগদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে।
আদালতের আদেশে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর এবং মহাস্থানগড় মাজার কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মমতাজ উদ্দিন গতকাল সকালে হাইকোর্টে হাজির হন। আদালত ডিসি ও এসপিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকে আজ মঙ্গলবার আবার আদালতে হাজির থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন রক্ষা এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে ডিসি ও এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত এ সময় আওয়ামী লীগ নেতাকে তিরস্কার করেন।
আদালত বগুড়ার জেলা প্রশাসককে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, 'পত্রিকায় এ রকম সংবাদ যেন আর লেখা না হয় সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। শুধু বিচারক হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবেও এ দেশের প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।'
কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে মাজারসংলগ্ন মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায় কি না, জানতে চান আদালত। জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এ মসজিদটিও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং প্রত্নতত্ত্বের অংশ।
মহাস্থানগড়ের নিদর্শন রক্ষার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচপিআরবি) গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রিট আবেদন দাখিল করে। এরপর মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক স্থাপনার আশপাশের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

যুদ্ধাপরাধ : দালাল আইনে বন্দির তালিকা মন্ত্রণালয়ে

৯৭২ সালে দালাল আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়ে যারা কারাগারে ছিল, তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ রকম ৭৭৫ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। সেগুলো কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েও দিয়েছে।

সূত্র জানায়, ওই সময় দেশে মোট ২৩টি কারাগার ছিল। এর মধ্যে চারটি ছিল কেন্দ্রীয় কারাগার, বাকি ১৯টি জেলা করাগার। মূলত এই ২৩টি কারাগারেই সে সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে বন্দি করা হয়েছিল। তবে এদের অধিকাংশই ছিল জেলা (বৃহত্তর জেলা) কারাগারগুলোতে। এখন পর্যন্ত আটটি কারাগারে বন্দি করে রাখাদের মধ্য থেকে ওই ৭৭৫ জনের নাম-ঠিকানা জোগাড় করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। যথেষ্ট কাগজপত্রের অভাবে বাকি কারাগারগুলোর তালিকা এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাকি কারাগারগুলোতে থাকা যুদ্ধাপরাধের আসামিদের নামও খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কারা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কারা সদর দপ্তর থেকে ২০১০ সালের জুন মাসে তাঁরা নির্দেশ পান ১৯৭২ সালে দালাল আইনে আটক বন্দিদের তালিকা খুঁজে বের করার। এ নির্দেশের পর তাঁরা সর্বোচ্চ গুরুত
্ব দিয়ে ওই তালিকা খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু এই কারাগারে সে রকম কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই বিষয়টি তাঁরা সদর দপ্তরে লিখে জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এখনো নানাভাবে খোঁজার চেষ্টা চলছে। পাওয়া গেলে সদর দপ্তরে তালিকা পাঠানো হবে।
কারা সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বাহাত্তরের দালাল আইনে বন্দি যে ৭৭৫ জনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ৩০৯ জন, নওগাঁ কারাগারের ২৮৬ জন, পাবনা কারাগারের ১০, কুমিল্লা কারাগারের ৮৩, পটুয়াখালী কারাগারের ৮, ময়মনসিংহ কারাগারের ২৪, জামালপুর কারাগারের ৩২ ও মুন্সীগঞ্জ কারাগারের ২৩ জন। এসব নাম পাওয়ার পর গত বছর জুলাই মাসে কারা সদর দপ্তর থেকে ওই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৩৭ হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭২ সালে দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ২৬ হাজার কারাবন্দি মুক্তি পায়। আর হত্যা, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টা, অগি্নসংযোগ, নির্যাতনসহ ১৮টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত বাকি ১১ হাজার বন্দি ওই সাধারণ ক্ষমার আওতায় না আসায় তারা সে সময় মুক্তি পায়নি। পরে তাদের বিচারের জন্য ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ওইসব ট্রাইব্যুনালে কিছু আসামির বিচার সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল। বাকিদের বিচার চলছিল। পরে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দিলে বিচার হওয়া ও বিচারাধীন সব আসামিই মুক্তি পেয়ে যায়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পুস্তিকা 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচালের ষড়যন্ত্র : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়' থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে দালাল আইন বাতিল হলেও ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি বহাল আছে। এই আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া সম্ভব।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বছর ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরে দালাল আইনে বন্দিদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কারা অধিদপ্তর থেকে সেই নির্দেশনা পাঠানো হয় দেশের সব কটি কারাগারে। বর্তমানে দেশে ৬৮টি কারাগার থাকলেও ওই সময় বৃহত্তর জেলাগুলোতে একটি করে কারাগার ছিল।
একটি কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ পাওয়ার পরই আমরা কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু কাগজপত্র পাওয়া বেশ কষ্টকর। অনেক খুঁজে যাদের নাম পেয়েছি তা পাঠিয়ে দিয়েছি সদর দপ্তরে।'
কারা মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুল ইসলাম খান বলেন, 'মন্ত্রণালয় দালাল আইনে বন্দিদের নাম-ঠিকানা চাওয়ার পর আমরা যদ্দূর পারি কালেক্ট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আরো পাওয়া যায় কি না তার চেষ্টা চলছে।'
যাদের তালিকা পাওয়া গেছে তাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, 'বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ঢাকা সিটি আমির ও একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নেতা খালেক মজুমদারকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। দালাল আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়নি। আমি মনে করি, এখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হওয়া দরকার।'
একজন সাবেক কারা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর হাজার হাজার রাজাকারকে ফৌজদারি আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল। পরে তাদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই আইনে বিচারও হয় অনেকের। অনেকে সাজাও পায়। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে একটি অর্ডার হয়_যেসব রাজাকার সাজার অর্ধেক ভোগ করেছে, তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হোক। এভাবে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে অনেকে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যায়।
কারা সূত্র জানায়, ওই সময় দেশে যে ২৩টি কারাগার ছিল, তার মধ্যে ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোরে চারটি কেন্দ্রীয় ও বাকি ১৯টি ছিল জেলা কারাগার। মহকুমাগুলোতেও কিছু সাব-জেল ছিল। তবে যুদ্ধাপরাধীদের জেলা কারাগারগুলোতেই বেশি রাখা হয়েছিল।