ঐতিহাসিক স্থান বগুড়ার মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে! মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন বিভিন্ন স্থাপনা থেকে দিনে-দুপুরে ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সেই ইট আবার বিক্রি হচ্ছে প্রতি ভ্যান ৩০-৩৫ টাকায়।
মহাস্থানগড় এলাকার দুর্লভ প্রত্নসম্পদ থেকে লুণ্ঠিত আকারে বড় ও কারুকাজসম্পন্ন এসব ইট দিয়ে তৈরি হয়েছে অর্ধশতাধিক বাড়ি। কয়েক বছর ধরে এসব অপকর্ম চললেও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
এদিকে মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ
ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় জমি দখলের অপরাধে মামলা দায়ের করার জন্য বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কেউ পুরাকীর্তি নষ্ট করতে এলে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত সোমবার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতান বলখি (রহ.) মাজার শরিফের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়িই তৈরি হয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্ন ইট দিয়ে। যে যার ইচ্ছেমতো মাটি খুঁড়ে বের করেছে ঐতিহাসিক সব নিদর্শন। এরপর তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাড়িঘর। অনেক বাড়িতে প্লাস্টার (আস্তর) করা হয়নি, যাতে প্রত্ন ইটের গায়ের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দৃশ্যমান। বিশাল আকৃতির একেকটি বাড়িতে সেই প্রাচীন আমলের হাজার হাজার ইট ব্যবহার করা হয়েছে। পুণ্ড্রনগরের মহামূল্য পোড়া ইটের কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে। কিনে নেওয়া ছাড়াও কিছু ইট জমিতে কাজ করতে গিয়ে লাঙ্গলের ফলায় উঠে এসেছে। কিছু চুরি করে আনা হয়েছে খনন করা ঢিপি এবং পুণ্ড্রনগরীর প্রাচীর থেকে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর স্থানীয় অধিবাসীদের অজ্ঞতায় প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে এই অমূল্য সম্পদ।
স্থানীয় দোকানদার নুরুল ইসলাম জানান, এলাকায় রফিকুল নামের এক যুবক পুরনো এসব ইট বিক্রি করে। প্রতি ভ্যান ইটের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এক ভ্যানে সর্বোচ্চ ২০০টি ইট বহন করা যায়। এ ছাড়া এই ইট বিক্রির সঙ্গে আরো সংশ্লিষ্ট রয়েছে সফিকুল, মিরাজুল ও আকবর। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে প্রত্নসম্পদ রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে প্রকাশ্যে ইট বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তার পরও লুকিয়ে এসব ইট বিক্রি করা হচ্ছে। গফুর নামের আরেকজন মুদি দোকানি জানান, মাটি খুঁড়ে শুধু ইট নয়, আরো পাওয়া যায় দুর্লভ মূর্তি, সোনার পাত্রের ভাঙা অংশ। এগুলো কখনো পাওয়া গেলে তার ভাগ্য ফিরে যায়। কখনোই এসব ব্যাপার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হয় না। রাতের আঁধারে চলে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ।
মহাস্থানের পাশে মথুরা এলাকায় প্রত্নতত্ত্ব ইট দিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন আবদুল ওয়াহাব নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ভ্যানে করে এসব ইট এনেছেন। কিনেছেন ৪০ টাকা ভ্যান হিসেবে। প্রায় ১০ হাজার ইট লেগেছে তাঁর তিন কক্ষের বাড়িটি বানাতে। কেন এই ইট ব্যবহার করেছেন, এগুলোর প্রত্নতাত্তি্বক মূল্য কী সেটা জানেন_এমন প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহাব জানান, 'এই ইটাই কিনা লাভ। বেশি দাম দিয়্যা ইটা কিনবার যামু ক্যা। হামাক্যেরোক কেউ কুনুদিন ম্যানা করেনি যে, এই ইটা দিয়্যা বাড়ি করার যাবি না। তালে হামাকেরে কী দোষ।' তিনি জানান, মাত্র ১৫ দিন হলো তাঁর বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এই বাড়ি ভাড়া দেবেন।
এলাকা ঘুরে আরো দেখা গেছে, মাজারসংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা কাসেম উদ্দিন, রনজু মিয়া, আবদুল মান্নান, কাসেম আলী, মীর আলম ও সবুর মিয়ার বাড়িও প্রত্নসম্পদের ইট দিয়ে তৈরি। গড়ের আশপাশে এ ধরনের আরো অর্ধশতাধিক বাড়ি রয়েছে। তবে কোনো বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিককে পাওয়া যায়নি। এসব বাড়ি ভাড়া দিয়ে মালিকরা অন্যত্র থাকেন।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, সংরক্ষিত এই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রত্নসম্পদের ইট ব্যবহারে বাধা দিতে গেলে তাঁদের পাল্টা হুমকি দেওয়া হয়। তিনি জানান, মহাস্থান এলাকায় কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেও তিনি সেটা খনন করে এসব প্রত্ন নিদর্শন বিক্রি বা ব্যবহার করার অধিকার রাখেন না। এসব ঐতিহাসিক স্থানের সব নিদর্শনের মালিক সরকার। তিনি জানান, বর্তমানে মহাস্থানের যে সম্পত্তি রয়েছে তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সম্পত্তির মালিক বনে গেছে এলাকার কিছু মানুষ। সম্প্রতি সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এসব সম্পদ অধিগ্রহণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনার। সেই মতো কাজ চলছে। অনেককে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে জমি ফেরত নেওয়া হয়েছে। তবে আফজাল হোসেন স্বীকার করেন, প্রত্নসম্পদ নষ্ট করে যেভাবে ঘরবাড়ি করা হচ্ছে তা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার জন্য রীতিমতো হুমকি।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) নাহিদ সুলতানা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের অবস্থা হয়েছে 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার'-এর মতো। বিশাল এলাকার নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর রয়েছে মাত্র ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে আনসার রয়েছে মাত্র সাতজন, যা দিয়ে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়।
অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, মহাস্থানগড়ের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দখলে রয়েছে। বাকি ৮০০ একরেরও বেশি এলাকা এখনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তহবিলের অভাবে সরকার এত দিন সেগুলো অধিগ্রহণ করেনি। পুরো এলাকাটি সে কারণে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত স্থাপনা, বাড়িঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপের ওপরই মাটিতে চাষাবাদ চলছে। নানা জাতের শীতকালীন সবজি ফলানো হয়েছে। আর জমি তৈরি করতে গিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির নিচ থেকে পুরো অথবা ভাঙা ইট তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আলের পাশে। এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন জানান, স্থানীয় লোকজন গড়ের ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি তৈরি করছে। প্রশাসনের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কখনোই কোনো বাধা তাঁরা পাননি।
আওয়ামী লীগ নেতাকে হাইকোর্টের তিরস্কার
হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বলেছেন, মহাস্থানগড়ের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধী ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। যে শ্রমিকরা এটা নষ্ট করেছে, খোঁড়াখুঁড়ি করেছে, তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাদের নিয়োগদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে।
আদালতের আদেশে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর এবং মহাস্থানগড় মাজার কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মমতাজ উদ্দিন গতকাল সকালে হাইকোর্টে হাজির হন। আদালত ডিসি ও এসপিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকে আজ মঙ্গলবার আবার আদালতে হাজির থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন রক্ষা এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে ডিসি ও এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত এ সময় আওয়ামী লীগ নেতাকে তিরস্কার করেন।
আদালত বগুড়ার জেলা প্রশাসককে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, 'পত্রিকায় এ রকম সংবাদ যেন আর লেখা না হয় সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। শুধু বিচারক হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবেও এ দেশের প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।'
কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে মাজারসংলগ্ন মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায় কি না, জানতে চান আদালত। জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এ মসজিদটিও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং প্রত্নতত্ত্বের অংশ।
মহাস্থানগড়ের নিদর্শন রক্ষার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচপিআরবি) গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রিট আবেদন দাখিল করে। এরপর মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক স্থাপনার আশপাশের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এদিকে মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ
ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় জমি দখলের অপরাধে মামলা দায়ের করার জন্য বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কেউ পুরাকীর্তি নষ্ট করতে এলে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত সোমবার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতান বলখি (রহ.) মাজার শরিফের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়িই তৈরি হয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্ন ইট দিয়ে। যে যার ইচ্ছেমতো মাটি খুঁড়ে বের করেছে ঐতিহাসিক সব নিদর্শন। এরপর তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাড়িঘর। অনেক বাড়িতে প্লাস্টার (আস্তর) করা হয়নি, যাতে প্রত্ন ইটের গায়ের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দৃশ্যমান। বিশাল আকৃতির একেকটি বাড়িতে সেই প্রাচীন আমলের হাজার হাজার ইট ব্যবহার করা হয়েছে। পুণ্ড্রনগরের মহামূল্য পোড়া ইটের কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে। কিনে নেওয়া ছাড়াও কিছু ইট জমিতে কাজ করতে গিয়ে লাঙ্গলের ফলায় উঠে এসেছে। কিছু চুরি করে আনা হয়েছে খনন করা ঢিপি এবং পুণ্ড্রনগরীর প্রাচীর থেকে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর স্থানীয় অধিবাসীদের অজ্ঞতায় প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে এই অমূল্য সম্পদ।
স্থানীয় দোকানদার নুরুল ইসলাম জানান, এলাকায় রফিকুল নামের এক যুবক পুরনো এসব ইট বিক্রি করে। প্রতি ভ্যান ইটের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এক ভ্যানে সর্বোচ্চ ২০০টি ইট বহন করা যায়। এ ছাড়া এই ইট বিক্রির সঙ্গে আরো সংশ্লিষ্ট রয়েছে সফিকুল, মিরাজুল ও আকবর। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে প্রত্নসম্পদ রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে প্রকাশ্যে ইট বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তার পরও লুকিয়ে এসব ইট বিক্রি করা হচ্ছে। গফুর নামের আরেকজন মুদি দোকানি জানান, মাটি খুঁড়ে শুধু ইট নয়, আরো পাওয়া যায় দুর্লভ মূর্তি, সোনার পাত্রের ভাঙা অংশ। এগুলো কখনো পাওয়া গেলে তার ভাগ্য ফিরে যায়। কখনোই এসব ব্যাপার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হয় না। রাতের আঁধারে চলে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ।
মহাস্থানের পাশে মথুরা এলাকায় প্রত্নতত্ত্ব ইট দিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন আবদুল ওয়াহাব নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ভ্যানে করে এসব ইট এনেছেন। কিনেছেন ৪০ টাকা ভ্যান হিসেবে। প্রায় ১০ হাজার ইট লেগেছে তাঁর তিন কক্ষের বাড়িটি বানাতে। কেন এই ইট ব্যবহার করেছেন, এগুলোর প্রত্নতাত্তি্বক মূল্য কী সেটা জানেন_এমন প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহাব জানান, 'এই ইটাই কিনা লাভ। বেশি দাম দিয়্যা ইটা কিনবার যামু ক্যা। হামাক্যেরোক কেউ কুনুদিন ম্যানা করেনি যে, এই ইটা দিয়্যা বাড়ি করার যাবি না। তালে হামাকেরে কী দোষ।' তিনি জানান, মাত্র ১৫ দিন হলো তাঁর বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এই বাড়ি ভাড়া দেবেন।
এলাকা ঘুরে আরো দেখা গেছে, মাজারসংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা কাসেম উদ্দিন, রনজু মিয়া, আবদুল মান্নান, কাসেম আলী, মীর আলম ও সবুর মিয়ার বাড়িও প্রত্নসম্পদের ইট দিয়ে তৈরি। গড়ের আশপাশে এ ধরনের আরো অর্ধশতাধিক বাড়ি রয়েছে। তবে কোনো বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিককে পাওয়া যায়নি। এসব বাড়ি ভাড়া দিয়ে মালিকরা অন্যত্র থাকেন।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, সংরক্ষিত এই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রত্নসম্পদের ইট ব্যবহারে বাধা দিতে গেলে তাঁদের পাল্টা হুমকি দেওয়া হয়। তিনি জানান, মহাস্থান এলাকায় কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেও তিনি সেটা খনন করে এসব প্রত্ন নিদর্শন বিক্রি বা ব্যবহার করার অধিকার রাখেন না। এসব ঐতিহাসিক স্থানের সব নিদর্শনের মালিক সরকার। তিনি জানান, বর্তমানে মহাস্থানের যে সম্পত্তি রয়েছে তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সম্পত্তির মালিক বনে গেছে এলাকার কিছু মানুষ। সম্প্রতি সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এসব সম্পদ অধিগ্রহণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনার। সেই মতো কাজ চলছে। অনেককে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে জমি ফেরত নেওয়া হয়েছে। তবে আফজাল হোসেন স্বীকার করেন, প্রত্নসম্পদ নষ্ট করে যেভাবে ঘরবাড়ি করা হচ্ছে তা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার জন্য রীতিমতো হুমকি।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) নাহিদ সুলতানা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের অবস্থা হয়েছে 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার'-এর মতো। বিশাল এলাকার নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর রয়েছে মাত্র ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে আনসার রয়েছে মাত্র সাতজন, যা দিয়ে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়।
অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, মহাস্থানগড়ের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দখলে রয়েছে। বাকি ৮০০ একরেরও বেশি এলাকা এখনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তহবিলের অভাবে সরকার এত দিন সেগুলো অধিগ্রহণ করেনি। পুরো এলাকাটি সে কারণে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত স্থাপনা, বাড়িঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপের ওপরই মাটিতে চাষাবাদ চলছে। নানা জাতের শীতকালীন সবজি ফলানো হয়েছে। আর জমি তৈরি করতে গিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির নিচ থেকে পুরো অথবা ভাঙা ইট তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আলের পাশে। এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন জানান, স্থানীয় লোকজন গড়ের ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি তৈরি করছে। প্রশাসনের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কখনোই কোনো বাধা তাঁরা পাননি।
আওয়ামী লীগ নেতাকে হাইকোর্টের তিরস্কার
হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বলেছেন, মহাস্থানগড়ের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধী ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। যে শ্রমিকরা এটা নষ্ট করেছে, খোঁড়াখুঁড়ি করেছে, তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাদের নিয়োগদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে।
আদালতের আদেশে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর এবং মহাস্থানগড় মাজার কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মমতাজ উদ্দিন গতকাল সকালে হাইকোর্টে হাজির হন। আদালত ডিসি ও এসপিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকে আজ মঙ্গলবার আবার আদালতে হাজির থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন রক্ষা এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে ডিসি ও এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত এ সময় আওয়ামী লীগ নেতাকে তিরস্কার করেন।
আদালত বগুড়ার জেলা প্রশাসককে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, 'পত্রিকায় এ রকম সংবাদ যেন আর লেখা না হয় সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। শুধু বিচারক হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবেও এ দেশের প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।'
কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে মাজারসংলগ্ন মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায় কি না, জানতে চান আদালত। জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এ মসজিদটিও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং প্রত্নতত্ত্বের অংশ।
মহাস্থানগড়ের নিদর্শন রক্ষার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচপিআরবি) গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রিট আবেদন দাখিল করে। এরপর মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক স্থাপনার আশপাশের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
No comments:
Post a Comment