Monday, February 07, 2011

শেয়ার বাজারের লুটপাট কাহিনী by আবুল খায়ের

শেয়ার বাজার দরপতনের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নেপথ্যে নায়করা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। তাদের স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। নির্মম, নির্দয়ভাবে প্রায় ৪০ লাখ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন তারা।

৪০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও তার পরিবারসহ প্রায় ২ কোটি মানুষ নিদারুণ আর্থিক কষ্টের শিকার। এই নির্দয় লুণ্ঠনকারীদের আলস্নাহ বিচার করবেন। গতকাল রবিবার নবমবারের মত শেয়ার বাজারে দরপতনে নিঃস্ব হওয়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশ কয়েকজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অপরদিকে বিভিন্ন সংস্থা শেয়ার বাজারে দরপতনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎকারীদের সনাক্ত এবং কিভাবে আত্মসাৎ করেছে তার বিস্তারিত তথ্য উলেস্নখ করে ইতিমধ্যে সরকারের শীর্ষ প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তারপরও শেয়ার বাজারে দরপতনের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ গতকাল শেয়ার বাজারে দরপতন হয়েছে। পাশাপাশি বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠনকারী কিছুসংখ্যক অর্থলোভীকে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এই নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। তাদের এত ক্ষমতার উৎস কি? অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীসহ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারীরা ক্ষমতাধর দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং কেউ কেউ দলীয় নেতা। রাজনীতি নিয়ে উভয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজপথে ও জনগণের সামনে কথা বলছে। দৃশ্যপট এমন যে, উভয়ের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। আসলে তা নয়, একশ্রেণীর নেতা উভয় দলের মধ্যে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগিতে একে অপরের জানিদোস্ত। কি মজার ব্যাপার শেয়ার বাজারের কোটি কোটি টাকা কেলেংকারির জন্য উভয় দল থেকে একে অপরকে দায়ী করে এবং সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা উলেস্নখ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের এক ক্ষমতাধর মন্ত্রীর পুত্র, অসীম ক্ষমতাধর দুই এমপি ও তিন ব্যবসায়ী এবং বর্তমান আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারের দুই এমপি, দুই ক্ষমতাবান শিল্পপতি ব্যবসায়ীসহ উভয় দলের ১১ জন প্রত্যক্ষভাবে শেয়ার কেলেংকারিতে জড়িত। এছাড়া তাদের সঙ্গে আরো কয়েকজন জড়িত বলে জানা গেছে। গত ৮ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত নবম দফা শেয়ার বাজারের দরপতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শেয়ার বাজার থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা শেয়ার বাজারে বার বার দরপতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকার কেলেংকারি ঘটনার দীর্ঘ তদন্ত করেছে। তদন্ত করে উভয় দলের ১১ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী শেয়ার বাজার কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ প্রশাসনকে অভিহিত করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুটপাটে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কতিপয় কর্তা জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিধি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ তাদের মূলধনের ১০% এর বেশি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারে না। কিন্তু অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক নীতিমালা লংঘন করে তাদের মূলধনের অধিকাংশই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ফলে শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ নীতিমালা অনুসরণের জন্য আদেশ দেয়ায় এবং তদারকি করায় ব্যাংকসমূহ তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করায় শেয়ার বাজারে দরপতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ ডিসেম্বর বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগের দুই হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতে শেয়ার বাজারে দরপতন ঘটে যায় বলে সংস্থার তদন্তে উলেস্নখ করা হয়।

১৯৯৬ সালে উক্ত জড়িত ব্যবসায়ী ও নেতারা কৌশলে শেয়ার বাজারে বড় ধরনের পতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যায়। সেই উভয় দলের নেতারা এবার শেয়ার বাজারে একই কেলেংকারি ঘটিয়েছেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন শেয়ার বাজারে দরপতনের সঙ্গে ১৫টি কোম্পানি জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে মামলা দায়ের করে। সেই মামলা এখন হিমাগারে। এসব লুণ্ঠনকারী কোম্পানি শেয়ার বাজারে এখন তৎপর রয়েছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন

কবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী নির্যাতনের কৌশল হিসেবে দোররার ব্যবহার দেখতে হচ্ছে। আর সেই দোররা মারার কারণে নূরজাহানেরই পথ ধরে আরেক নারীকে চলে যেতে হলো গত ১৪ ডিসেম্বর। মৌলভীবাজারের নূরজাহান ফতোয়ার অপমান সইতে না পেরে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন; কিন্তু রাজশাহীর তানোর উপজেলার কচুয়া গ্রামের সুফিয়া বেগম দোররার আঘাতেই প্রাণ হারালেন।

এই দোররা মারার ফতোয়া দিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও গ্রাম্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এমনই ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে। আমাদের সংবিধান কখনো তাদের সেই সুযোগ দেয়নি। তার পরও তারা একের পর এক এমন অনৈতিক কাজ করে চলেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ফতোয়াবাজরা নিজেদের কাজগুলোর পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকে।
নারী নির্যাতনের এমন চেহারা প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোনো না কোনো এলাকায় ঘটেই চলেছে। একই দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কুমিল্লায় আরেকটি নির্যাতনের ঘটনা। সেখানে ফতোয়ার ঘটনা না হলেও পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েছে শ্বশুর। ওই ঘটনার শিকার লাভলী বেগম মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য কখনো কখনো সে নৈতিকতা বর্জিত কাজ করে ফেলে। কিন্তু সেই অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুর মতো চরম পরিণতি কাম্য নয়।
সুফিয়া বেগমের মৃত্যুর জন্য প্রকারান্তরে দোররা মারার ঘটনাই দায়ী। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান অতি জরুরি।
দেশের উচ্চ আদালত থেকে যুগান্তকরী একটি রায় ঘোষিত হয়েছে ফতোয়ার ব্যাপারে। সেখানে স্পষ্টত বলা হয়েছে যে আইনানুগ কর্তৃপক্ষ ব্যতিরেকে কাউকে অপরাধী বিবেচনা করে এ ধরনের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা কারো নেই। তবে এই রায় ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর পছন্দ হয়নি এবং তারা আদালতে আপিল করেছে। সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হলে ফতোয়াকে পরিহার করতেই হবে। কারণ সংবিধানও নিশ্চিত করে দিয়েছে যে বিচারিক কাজ করা একমাত্র আদালতের দায়িত্ব। গ্রামে এ ধরনের ফতোয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে মূলত স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পায় না ভুক্তভোগীরা। তারা বিচারও চাইতে পারে না কোথাও। তাই ফতোয়ার কারণে মৃত্যু না ঘটলে সাধারণত সংবাদমাধ্যমে এগুলো প্রচার পায় না। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পেছনের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে যারা অমানবিক কাজ করছে তাদের টনক নড়বে। এতে ফতোয়া দেওয়ার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি নারী নির্যাতনের হারও কমতে থাকবে। ফতোয়ার মাধ্যমে আর যাতে কোনো নারীকে নির্যাতনের শিকার না হতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সে জন্য অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

কালের যাত্রা by পীষূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পোশাক শ্রমিকদের গানের প্রতিযোগিতামূলক একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। অনুষ্ঠানটির নাম গর্ব। একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং বিজিএমইএ_এই দুটি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজক। শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ ও গীতিকার আসিফ ইকবালের মিলিত উদ্যোগে এবং গানচিলের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান এবং অনুজপ্রতিম বিশ্বজিৎ ও আসিফের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে আমি যখন অনুষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত হই তখন প্রতিযোগিতার কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ৩০ হাজার আগ্রহী পোশাক শিল্পীর ভেতর থেকে ততদিনে বাছাই করা হয়েছে প্রথমে ১৮৩ এবং পরবর্তী সময়ে ৪৩। এই বাছাইয়ের কাজটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে শেষ করেছেন দেশের বেশ কয়েকজন গুণী সংগীতজ্ঞ। শুধু বাছাই নয়, প্রতিযোগীদের পরিচর্যা ও পরিশীলন এবং বড় আসরের প্রতিযোগিতার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে দেশের ৯ গুণী সংগীতজ্ঞ যেভাবে নিরলস শ্রম, অভিজ্ঞতা আর মেধা খরচ করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসা করার মতো। বাণিজ্য-সংস্কৃতির এখনকার সময়ে এই কাজটিকেই বলে 'গ্রুমিং'। শুনতে বেশ আধুনিক লাগে। স্মার্টও লাগে বোধ হয়। আমি যুক্ত হয়েছি প্রতিযোগিতা যখন ৪৩ জনের মধ্যে এসে নেমেছে তখন। আগেই শুনেছিলাম, কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে কি বুঝতাম যে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলো কী অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী! গান শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কী উদাত্ত তাদের কণ্ঠ! গায়কী, মেজাজ আর আত্মবিশ্বাস দেখে কে বলবে যে তারা স্বভাবশিল্পী। মনে হলো দীর্ঘদিন ধরে বুঝি গানের চর্চা আর সাধনা করে আসছেন। তালিম নিয়েছেন বিখ্যাত কোনো গুরুগৃহে। কিন্তু না। এরা কেউই প্রথাগত তালিম নেওয়ার সুযোগই পাননি। প্রত্যেকেই জন্মেছেন পল্লীগ্রামে। বেড়েও উঠেছেন পল্লীর খোলামেলা উদোম আবহে। যেখানে নদীর এ পাড়ে বসে গান শোনাতে হয় ওই পাড়কে। প্রত্যন্ত গ্রামের জীর্ণ মসজিদে মোয়াজ্জিন হয়ে যেখানে খালি গলায় আজান দিয়ে শতেক লোককে নামাজের আহ্বান জানাতে হয়। বয়স্ক মানুষ, মুখে মেহেদী মাখা শ্মশ্রু, সফেদ পোশাক। জিজ্ঞাসা করলাম, মসজিদের মোয়াজ্জিন হয়ে গান গাইতে সমস্যা হয় না? সবাই অন্য চোখে দেখে না? চোখে-মুখে ঈর্ষণীয় সরলতা ছড়িয়ে উত্তর দিলেন, আমি তো গানে গানেই আল্লাহকে ডাকি, নবীজিকে পেতে চাই। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। খুব একটা লেখাপড়া করেননি। অথচ এই জনপদের হাজার বছরের ঐতিহ্যিক জীবনদর্শন যেন মূর্ত হয়ে উঠল ভদ্রলোকের সহজিয়া উত্তরে। সত্যই তো, এটাই তো চিরকাল জেনে এসেছি যে ভাটি অঞ্চলের হাজার বছরের বহতা সমাজে সংগীত অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গান শোনা আর গাওয়াতে পাপ নেই। আনন্দ-বিষাদ, জন্ম-মৃত্যু, উপাসনা, উৎসব-পার্বণ, লোকজ ক্রীড়া ইত্যাদি সবখানেই সংগীত। মাঝি পাল তুলতে তুলতে, রাখাল গরুর পাল মাঠে নিয়ে যেতে যেতে গান করেন। এবড়োখেবড়ো মেঠোপথে চাকায় ক্যাচোর ক্যাচোর শব্দ তুলে ধুলো উড়িয়ে দূরে চলে যায় মহিষের গাড়ি। সব শব্দ ছাপিয়ে অতিদূর থেকে ভেসে আসে গাড়োয়ানের গান।
একজন প্রতিযোগী, এক সময় সিনেমা হলের প্রজেক্টর মেশিন চালাতেন, এখন ঢাকার কাছাকাছি এক পোশাক শিল্পকারখানায় চাকরি করেন। গান অন্তপ্রাণ। হারমোনিয়ামের সুরে গলা সেধে নয়, তিনি গান করতেন প্রজেক্টর মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দের সঙ্গে। গলা তো দরাজ হবেই। একজন প্রায় পড়ন্ত বয়সী পোশাকশিল্পী, নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন। সংসারের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ভ্যানগাড়িও চালান। শান্তির জন্য গানকেই বেছে নিয়েছেন প্রধান অবলম্বন হিসেবে। একজন প্রতিযোগী, একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। কী অবলীলায় তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে হারিনি, সংগীত সাধনাতেও হার মানব না। মহান মুক্তিযুদ্ধ ভদ্রলোককে আত্মবিশ্বাসী করেছে, হার না মানার দীক্ষায় সাহসী করেছে। সেই সঙ্গে জীবনদর্শনে ধারণ করেছেন সততা আর সৎ মানুষ হওয়ার শিক্ষা। মহান বিজয়ের পর কেটে যাওয়া ৪০ বছরে আর ১০ জনের মতো তিনি লোভী হননি, অনৈতিক পথে পা বাড়াননি। নইলে পড়ন্ত বয়সে তাঁকে পোশাক কারখানায় শ্রমজীবী হতে হবে কেন! এ রকম কত যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে গানের এই প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে। কত যে শিখছি, কত কিছুই না জানছি। বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথানত হচ্ছে তৃণমূল থেকে উঠে আসা লড়াকু শিল্পীদের কাছে। ঘরে দারিদ্র্যের কষ্ট, পিতা হারানোর বেদনা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী মাতা, স্বামীর দুর্ব্যবহার, নদীতে লুট হয়ে যাওয়া একমাত্র বসতভিটা ইত্যাদি নানারকম শোক-দুঃখ ভুলে থাকতে এসব স্বভাবশিল্পী কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন গান। ভাগ্যিস তাঁরা এই প্রতিযোগিতায় গান গাইতে এসেছিলেন! নইলে কে চিনত তাঁদের! তবে আমি জানি, দেশের পল্লীমায়ের কোলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন কত না তৃণমূল শিল্পী। অনাদরে, অবহেলায় বুকভরা অভিমান নিয়ে বেঁচে আছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকেরই মাথার ওপর এক টুকরো চাল আছে, কিন্তু ঘরে রান্নার চাল থাকে না। শরীরে রোগের বাসা, চিকিৎসার সাধ্য নেই। স্থানীয় লোভাতুর ক্ষমতাধরদের থাবায় চলে গেছে বংশগত ঠিকানা। তারপর শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব টেলিভিশন-সিনেমা এবং অডিও ক্যাসেটের পরগাছা গান। এতসব দানবের বহুমুখী চাপে টিকে থাকাই তো ভীষণ কষ্টের। তৃণমূল স্বভাবশিল্পীর মৌলিক গান লুট করে এনে নাগরিক সমাজে এখন হচ্ছে কত যে জনপ্রিয় গায়ক! তারা হয়তো জানেই না, শত বছরের পরম্পরায় অনেক কষ্টে টিকিয়ে রাখা গানগুলোর উৎস কি! মৌলিক গানগুলোর সঙ্গে কিভাবে এবং কতখানি জড়িয়ে আছে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য! এসব ক্ষেত্রে করার আছে অনেক কিছু। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কাজের কাজ কিছুই করে না। গৎবাঁধা প্রোগ্রামের বাইরে কার্যকর কিছু করার মতো সদিচ্ছা বা মেধাসম্পন্ন নেতৃত্ব কোথায়! বঙ্গবন্ধু কিন্তু শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৃণমূল শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা, বাংলার চিরায়ত লোকজ শিল্পের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ, বিশ্বমাঝে বাংলার গর্বের সংস্কৃতিকে যথার্থভাবে প্রচার করার জন্য। শুরুতে সেই ভাবেই কাজ হচ্ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে যা কিছু হয়েছে তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কোনো সম্পর্কই নেই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন, অথচ দৃশ্য আগে যা ছিল এখনো তাই। খুব একটা বদল হয়নি।
কালের যাত্রা আজ এ পর্যন্তই।

উন্নয়নকাজের নামে নৈরাজ্য by এম জেড হোসেন আরজু

স্বাধীন জাতিসত্তা বিকাশের (১৯৭১) আগে থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্র উন্নয়নের কার্যক্রমে যত নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তার মধ্যে সরকারের যেকোনো ভৌত অবকাঠামো ও শিল্পায়ন কর্মসূচির প্রতি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গণবিরোধিতা অন্যতম।

আমরা কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও প্রকল্প উদ্ভূত ঘটনাবলি কমবেশি অবগত আছি। স্থানীয় বাসিন্দারা তীব্র বিরোধিতা করেছিল সমূহ ক্ষতির আশঙ্কায়। সরকারি কিছু পুনর্বাসন কর্মসূচি তাদের জন্য বরাদ্দ হলেও যে শক্তিশালী বিরোধিতা ও উপেক্ষার আচরণে সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীতে পরিণত করেছিল, তার মাসুল এখন পর্যন্ত দেশ দিয়ে যাচ্ছে, উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসনের চুক্তি করেও তারা অবিশ্বাস ও অতৃপ্তিতে ভুগছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত শতাব্দীর সাত দশকের দিকে জাতীয় সার্বিক প্রগতি ও সামাজিক জীবনে উৎকর্ষ সাধনে তুলনামূলক অনগ্রসরতার জন্য জনপ্রশাসনের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটকে দায়ী করা হয়। প্রোজ্জ্বল রাজনৈতিক প্রতিভা জন এফ কেনেডির (১৯১৭-১৯৬৩) আকস্মিক আততায়ীর হাতে জীবন হারানোর ফলে মার্কিন জনপ্রশাসন ও রাষ্ট্র-উন্নয়নের যথাযথ রাস্তা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতীয়মান, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও সে ধরনের রাহুগ্রস্ত। সরকার কর্তৃক আরোপিত প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে জনগণকে একটি বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে গঠনের সুযোগ করে দেয় এবং সেই সুযোগ ব্যবহার করে স্বার্থলিপ্সু কিছু ব্যক্তি অথবা রাজনৈতিক দল। বিশ্বের উন্নতমানের কয়লা খনি হিসেবে স্বীকৃত আমাদের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। নূ্যনতম ১০ লাখ টন বার্ষিক উৎপাদনক্ষম এ কয়লা খনি স্থানীয় অধিবাসীদের অসন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে নিয়মিত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উপনীত হতে পারছে না। গ্রামবাসীর অভিযোগ ও অসন্তুষ্টি, তারা যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তা নিরসনে সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আন্তরিক উদ্যোগের পরিচয় পেতে প্রায় যুগ অতিক্রম করতে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি অবস্থার যে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দৃশ্যমান, তা বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের একান্ত নিজস্ব আন্তরিক চেষ্টার ফল।
সরকারের ধ্রুপদী যে সংজ্ঞা 'ড়োবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব, ঋড়ৎ ঃযব চবড়ঢ়ষব, ইু ঃযব চবড়ঢ়ষব'_বিশ্বজনীন তা মনে-মননে-বিশ্বাসে-কর্মে সক্রিয় রাখতে পারলে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে সরকার ও জনগণের পারস্পরিক প্রতিপক্ষ অবস্থানে দড়ি টানাটানির পরিস্থিতি তৈরি হতো না। বস্তুত এ ধ্রুপদী সংজ্ঞার জ্ঞান স্মরণে না রাখার ব্যর্থতা উত্তরাধুনিক যুগে বড় মাত্রার নৈতিক অপরাধ।
সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রিপরিষদকে অবশ্যই ভাবতে হবে, তাঁদের পরামর্শক ও শুভার্থীরা আবেগাপ্লুত হয়ে অথবা স্বার্থতাড়িত হয়ে অথবা প্রজ্ঞার ঘাটতিঘটিত কারণে অথবা জনবিচ্ছিন্নতার কারণে প্রকৃত মাঠপর্যায়ের অবস্থা অনুধাবন না-ও করতে পারেন। সে অবস্থায় তাঁদের পরামর্শে গুরুতর ভবিতব্যের পথ রচিত হতে পারে। জনগণের বন্ধু বঙ্গবন্ধু (১৯২০-১৯৭৫), যাঁর অবিচ্ছেদ্য স্বভাব গভীর গণসম্পৃক্তি এবং নির্বিশেষে প্রত্যেককে বুকের ভালোবাসা দিয়ে সিক্ত করা, তাঁকে পরামর্শ দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। যে ভুলের মর্মান্তিক মাসুল প্রাণের নেতাকে দিতে হয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও অভিভাবক শক্তি আওয়ামী লীগ যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার গঠন ও পরিচালনা করছে, ইতিহাসের শিক্ষায় আলোকিত হয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে গণবিরোধিতা প্রশমনের প্রক্রিয়া আজ অনুসন্ধান করা জরুরি। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু প্রায়ই সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলতেন_জনগণকে ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। এ গুণাবলি সরকারি প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের মনে নেই বলে সেখানে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন; তোয়াক্কা না করে একতরফা উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে অগ্রসর হোন। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে, প্রজাতন্ত্র বা রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।
এ প্রেক্ষাপটে আরেকটি জ্বলন্ত ঘটনা উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার মাঝেরচর ও রাঙ্গাদিয়া মৌজায় প্রায় ৫৯৬ একর জমি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণে অধিগ্রহণ ও হুকুমদখলের চূড়ান্ত অনুমোদনে প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে ২৬৪ একর জমি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লিমিটেডের বরাবরে বার্ষিক প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকার বিনিময়ে ৩০ বছরের জন্য সরকারি অনুমোদনক্রমে ২০০৬ সালে ইজারা দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানটি (ইডাবি্লউপিডি) ওই একই এলাকায় একাধিক বৃহদায়তন ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এমনকি সরকার যেখানে বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছে, সেখানে দেশি কম্পানি ইডাবি্লউপিডি একক উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের আগ্রহও সরকারের কাছে উত্থাপন করেছে। তথাপি সরকার ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তে অনড় এবং বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প গ্রহণে মরিয়া। কিন্তু স্থানীয় সচেতন জনগণ সরকারের প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিরূপ অভিব্যক্তি সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছে। সরকার ও রাষ্ট্র আমাদেরই, আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে টিকে থাকতে আমাদের সরকারের উচিত জরুরিভাবে দেশীয় বুর্জোয়া ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা করা। মালয়েশিয়ার মাহাথির সরকার (১৯৮২-২০০৩) সে রকম রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রয়োগ করে বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রবণতা ও কৌশল হলো জাতীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে হাতিয়ে নেওয়া। অধিকন্তু প্রাইভেট করপোরেট হাউসগুলো দেশে সুস্থ ও টেকসই গণতন্ত্র বিকাশের জন্যও যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারঙ্গম_সরকার সম্ভবত এ ধরনের ধারণা পাত্তা দিতে অনিচ্ছুক। তবে কি বাংলাদেশ সর্বাত্মক (টোটালিট্যারিয়ান) রাষ্ট্র হিসেবে নিজের বিকাশকে এগিয়ে নিতে চায়? আমরা টোটালিট্যারিয়ান রাষ্ট্রের পরিণতি দেখেছি ইতালিতে, যার পরিসমাপ্তি ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান মুসোলিনির (১৮৮৩-১৯৪৫) মর্মান্তিক হত্যাজনিত মৃত্যুতে। রাষ্ট্রের জনগণ যন্ত্রের মতো সক্রিয় থাকবে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে_এমন রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় জনগণের সহিষ্ণুতার ভিত ভেঙে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
সরকার বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে প্রত্যয়ী হতে পারে, গণবিরোধিতা (জমি অধিগ্রহণ অথবা যেকোনো কারণে হতে পারে) একটি মামুলি ও ক্ষণস্থায়ী বিষয় এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে যেকোনোভাবে যেকোনো অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই চট্টগ্রামের মাঝেরচর ও রাঙ্গাদিয়া মৌজায় সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা ও প্রতিকারের সম্ভাব্য পথ পাওয়া যেতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯৯২ সালে একটি আন্তদেশীয় (কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেঙ্েিকা) কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয় ডাহুক (ধিঃবৎভড়ষি) প্রজাতির এক ধরনের দৃষ্টিনন্দন পক্ষির আবাস সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে। ফলে আট লাখ ৮০ হাজার একর জলাভূমি ও প্লাবনমুক্ত উঁচু জমি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। পরিকল্পনাধীন ভূমির ৩০ শতাংশ বেসরকারি ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ছিল। এই এসিই বেসিন প্রকল্পটি সরকার ও জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রয়াস ও পরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি চমৎকার উদাহরণ। প্রকল্পের মৌলিক লক্ষ্যকে সামান্যতম বিঘি্নত না করেও বেসরকারি ভূমি মালিকরা তাদের অভ্যস্ত কর্মসূচি ও ব্যবহার ওই জমিতে চালিয়ে যেতে থাকে, যা থেকে আর্থিক সুবিধা অর্জনও সম্ভব হয়। ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা অক্ষুণ্ন রেখেও সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষ ওই একই প্রকল্প থেকে সন্তুষ্ট মাত্রায় সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে থাকে। প্রাণিজীবন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যমুখী এ অনুভূতিকাতর প্রকল্পের ভেতরে ওয়েস্ট ভ্যাকো করপোরেশন নামে একটি শিল্পকারখানা আছে, যেটি বেসরকারি ভূমি মালিকদের মধ্যে এককভাবে বৃহত্তম। শিল্পকারখানাটির ব্যক্তিগত ভূমি রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার একর। বেসরকারি খাতের ওয়েস্ট ভ্যাকো করপোরেশন ১৯৯১ সালে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক সমঝোতামূলক চুক্তিতে তার মুদ্রণ, কাগজ উৎপাদন, প্যাকেজিং এবং সংশ্লিষ্ট রাসায়নিকসহ বিশাল কর্মযজ্ঞ সেখানে পুরোপুরি চালিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে সরকার সব সময় স্থানীয় জনগণকে পীড়নমূলক পদ্ধতিতে যেকোনো শিল্প প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়ার পথ বেছে নেয়। বিবৃত তথ্যালোকে বিনয়ের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সমীপে ব্যক্ত করা প্রয়োজন মনে করছি, বাংলাদেশে বিকাশমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তথা বিজনেস করপোরেট হাউসগুলোকে মিত্র ও সহায়ক উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিশ্বাসপূর্বক সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেই গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের সাধনা পূর্ণ হয়ে যায় না। বরং এখানে রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি যখন লুণ্ঠনকারীর মতো আচরণে অভ্যস্ত, স্বদেশি শিল্পোদ্যোক্তারা যখন নিরাশার আঁধারে বেদনা-ক্লান্ত, তখন দিনবদলের প্রতিশ্রুতিশীল জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাসীন হয়ে নতুনভাবে জনগণের হৃদয়ের ধ্বনি ও অনুভূতিসম্ভারকে গভীরভাবে অনুধাবনের নিবিড় প্রচেষ্টা থাকা দরকার।

সরকারের জন্য সতর্ক সংকেত

শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী এলাকা থেকে পুলিশ পরিত্যক্ত অবস্থায় প্রায় ১৪ হাজার রাইফেলের গুলি উদ্ধার করেছে। বাঁকাকুড়া গুচ্ছগ্রামের একটি পরিত্যক্ত মাটির ঘরে আটটি বস্তায় প্লাস্টিকে মোড়ানো অবস্থায় গুলিগুলো পাওয়া যায়। এই বিপুল পরিমাণ গুলি দেখে স্থানীয় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান অবনতির পেছনেও এ ধরনের অস্ত্র ও গুলির উৎস কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, গুলিগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম বা উলফা সদস্যদের হতে পারে। এগুলো দেশীয় কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরও হতে পারে_সে আশঙ্কাও পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছে না। ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বিগত জোট সরকারের আমলে এলাকাটিতে উলফা সদস্যদের অবাধ বিচরণ ছিল বলে অভিযোগ আছে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো, বিশেষ করে হরকাতুল জিহাদ বা হুজির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তারা স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র ও গুলি বিক্রি করত বলেও বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। বর্তমান সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সদস্য ধরাও পড়ে। কাজেই গুলিগুলো কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের হওয়া বিচিত্র নয়। নিঃসন্দেহে বিষয়টি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের। যেকোনো সময় এসব গুলি হাতবদল হয়ে এ দেশীয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতে চলে আসতে পারত।
দেশব্যাপী বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছে, তা থেকে আমাদের নিষ্কৃতি পেতে হবে। আর সে জন্য সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়ার উৎস বন্ধ করতে হবে। কারণ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ যত সহজলভ্য হবে, দেশে তত বেশি নতুন নতুন সন্ত্রাসী তৈরি হবে, তত বেশি বাড়বে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। যত দূর জানা যায়, দেশের বেশ কিছু সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে অবাধে আসছে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কিছুদিন আগে সীমান্তপথে অস্ত্র চোরাচালান নিয়ে আমরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সরকারের অস্তিত্বের স্বার্থেও দেশে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামান্য অবহেলাও দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাতে দেশের চিহ্নিত কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং বিশেষ একটি গোষ্ঠী, যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। সেসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে নাশকতার ষড়যন্ত্রও রয়েছে_এ কথা সরকারের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছে। কাজেই বর্তমান সরকারকে বিষয়টি মাথায় রেখে সারা দেশ থেকে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সম্প্রীতির মহামিলন ক্ষেত্র by আবদুল হামিদ মাহবুব

কদিকে জ্বলছে ৯টি চিতা। তার পাশে সারিবদ্ধ ১২টি কবর। ১২টি লাশের জানাজা পড়াতে দাঁড়িয়েছেন একজন মৌলভী, তাঁর পিছে অস্ত্র হাতে দণ্ডায়মান একদল মুক্তিযোদ্ধা আর কিছু সাহসী মানুষ। ওদিকে চিতায় শব পোড়ানোর কাজটি একজন পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে চলছে, তাঁকে সহযোগিতা করছেন হিন্দু-মুসলিম আরেক দল মানুষ।

এই দৃশ্য ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণের। সেই ১৯৭১ সাল থেকে মৌলভীবাজারবাসীর কাছে বেদনাবিধুর একটি দিন ২০ ডিসেম্বর। এ দিনটি স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালন করেন মৌলভীবাজারবাসী। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেন। এ ধরনের একটি ক্যাম্প ছিল মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র চার দিন অতিবাহিত হয়েছে। ওই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা দুপুরের খাবার আয়োজনে ব্যস্ত। কেউ ভাতের থালা হাতে নিয়েছেন, কেউ খাবার সংগ্রহের জন্য লঙ্গরখানায় যাচ্ছেন। এ সময়ই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্প লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মুহূর্তে প্রায় অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। আকস্মিক এ ঘটনায় মৌলভীবাজারবাসী হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তখন যাঁরা শহরে ছিলেন প্রথম অবস্থায় অনেকেইে বুঝতে পারেননি, কোথায় কী ঘটেছে। পরে খবর ছড়িয়ে পড়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পের হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা। দলে দলে মানুষ ছুটে আসে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ভয়াবহ এ অবস্থা দেখে মানুষজন বুঝে উঠতে পারছিল না তাদের কী করণীয়। অবশেষে মিত্রবাহিনীর লোকজনও এখানে আসেন। তখনো আহতাবস্থায় যাঁরা ছটফট করছিলেন, তাঁদের কয়েকটি ট্রাকে উঠিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে যাঁরা শহীদ হলেন, তাঁদের কারো শরীর থেকে মাথা উড়ে গেছে, কারো বা দেহের মধ্যাংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত ক্যাম্প ভবনের পার্শ্ববর্তী গাছের ডালে কারো দেহের কোনো অংশ লেগে ঝুলে আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। না দেখলে অনুমান করা কঠিন। ছিন্নভিন্ন এই দেহগুলো সৎকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব মৃতের মধ্যে কে মুসলমান, কে হিন্দু_এসব শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার পরও যাঁদের পরিচয় কোনোভাবে মিলানো যায় সে অনুযায়ী মুসলমান-হিন্দু আলাদা করে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কবরস্থ করা ও চিতায় পোড়ানোর উদ্যোগ নেন তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা মো. আজিজুর রহমানের নেতৃতে একদল সাহসী মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন স্থানে ফেলে যাওয়া ও পুঁতে রাখা মাইন-গ্রেনেড উদ্ধার করে বিদ্যালয়ের ক্যাম্পে এনে জড়ো করে রাখা হয়েছিল। এ বিস্ফোরকগুলোই হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। হিন্দু-মুসলিম এই শহীদদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী জাতপাতের ঊধর্ে্ব উঠে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহ হিসেবে সমাহিত করা হয় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। সেই ১৯৭১ সাল থেকে এ স্থানটি হচ্ছে সম্প্রীতির এক মহামিলন ক্ষেত্র।

লালনের ননী চুরি, গৌতম ঘোষের ছলচাতুরি by বিধান রিবেরু

যার মৃতু্য তারিখ একশো বছর পার করে ফেলে, বিশেষ উদ্যোগ না থাকলে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত উদ্ধার করা কষ্টকর, আর তিনি যদি হন লালনের মতো দার্শনিক বাউল, প্রচারবিমুখ, তাহলে অনেক কাহিনীই কল্পনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সেটা হয়ে ওঠে মিথ। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন ফকির মারা যাওয়ার ১৪দিন পর 'হিতকরী' পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়, সেখানে বলা হয়_'ইঁহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না, শিষ্যেরা হয়ত তাঁহার নিষেধক্রমে, না হয় অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।' (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৬৭৪) যদিও এই পত্রিকায় 'সাধারণে প্রকাশ' দোহাই দিয়ে লালন ফকিরকে কায়স্থ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। তবে সেটা নিশ্চিত নয় বলেই তারা বলেছে 'সাধারণে প্রকাশ'। অতএব লালন হিন্দু ঘরের না মুসলমানের তা নির্দিষ্ট করে বলতে যাওয়ার মধ্যে একটা সামপ্রদায়িক গন্ধ যেমন থাকে তেমনি সেই তর্কে যাওয়া মূঢ়তারও প্রকাশ বৈকি।

অসামপ্রদায়িক মানসিকতার লালনকে নিয়ে তবুও টানাহেঁচড়া থামে না। সমপ্রতি লালনকে নিয়ে মুক্তি পাওয়া গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ সেই রকমই সামপ্রদায়িকতা ও মূঢ়তা চোখে পড়ে। এবং আমাদের পীড়া দেয়। লালনের জাতধর্মকে প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে ছবিটি যদি করা হতো, তাহলে ছবির জাত কি চলে যেত?

চলচ্চিত্রে শুরুর দিকে আমরা দেখি কিশোর লালন কবিরাজকে গান শোনাচ্ছে, 'আর আমারে মারিস নে মা, ঃননী চুরি আর করবো না'। কবিরাজ ও তার পরিবারের সঙ্গে গঙ্গা স্নানে যাওয়ার আগে নিছক এই গানটি পরিবেশনার মাধ্যমে সনাতন ধর্মের একটা আবহ সৃষ্টির চেষ্টা এখানে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একদিকে পুণ্য অর্জনের জন্য যাত্রা, অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণের আকুতি। কিন্তু কেউ কি হলফ করে বলতে পারে, লালনের জলবসন্ত হওয়ার আগে এই গান রচিত হয়েছিলো। তাছাড়া তখন তো লালনের গান সংগ্রহ করে তেমন কেউ ছিলো না। যেহেতু বাউল হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের পরই। যদি বলি, বাউল ধর্মকে গ্রহণ করার পর এই গানের সৃষ্টি? তাহলে কি বিশ্বাস করা যায়, শুধু কৃষ্ণের ক্ষমা প্রার্থনা রাষ্ট্র করার জন্যই এই গান বেঁধেছিলেন লালন? না।

আমরা মনে করি, লালনের এই গানে 'মা' পরমেশ্বরেরই একটা মেটাফোর। আর 'ননী' কামুক ভোগবিলাসি জীবনের এক অসাধারণ রূপান্তর। এই ভবে ভোগবিলাস যেমন আছে, তেমনি আছে পরমেশ্বরের সাধনা। শুদ্ধ ভোগবিলাসে ভাগ্যের রূপান্তরে পরমের মার খাওয়ার দৃশ্যকল্পই কি লালন এই গানে ধরতে চাননি? লালন গবেষকরা এই প্রশ্নের মীমাংসা করবেন। কিন্তু লালনের গানের শ্রোতা হিসেবে আমরা মনে করি, নেহায়েৎ কৃষ্ণ বন্দনার জন্য লালন এই গান রচনা করেননি। তাতে কি, সিনেমাটোগ্রাফার কাম পরিচালক গৌতম ঘোষ অবলীলায় ঐ 'ধর্মীয়' গানটি 'হিন্দু' লালনকে দিয়ে গাইয়ে নিয়েছেন।

বাউল ও লালন বিষয়ক পণ্ডিত অধ্যাপক উপেন্দ্রকিশোর ভট্টাচার্য বাউলদের 'মনের মানুষ' সম্পর্কে বলেন_

"মানব-দেহস্থিত পরমতত্ত্ব বা আত্মাকে বাউল 'মনের মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। আত্মাকে 'মানুষ' বলার তাৎপর্য মনে হয় এই যে, আত্মা মানবদেহকে অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছেন ও মানবদেহের সাধনার দ্বারাই তিনি লভ্য এবং এই মানবাকৃতি তাঁহারই রূপ মনে করিয়া বাউল তাঁহাকে 'মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। এই মানুষ অলক্ষ্য অবস্থায় হূদয়ে বা মনে অবস্থান করিতেছেন, বোধহয় এই কল্পনা করিয়া তাহারা তাঁহাকে 'মনের মানুষ' বলিয়াছে। এই আত্মাকে তাহারা 'মানুষ', 'মনের মানুষ', 'সহজ মানুষ', 'অধর মানুষ', 'রসের মানুষ', 'ভাবের মানুষ', 'আলেখ মানুষ', 'সোনার মানুষ', 'সাঁই' প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত করিয়াছে।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৪০)

লালন যেমনটা বলেন:

"এই মানুষে আছে, রে মন,

যারে বলে মানুষ রতন, লালন বলে পেয়ে সে ধন

পারলাম না রে চিনিতে।।"

(ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৫৯৪)

দুঃখের বিষয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে ভিত্তি করে নির্মিত গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ সেরকম কোনো আত্মঅনুসন্ধানের হদিসই মেলে না। যা মেলে সে শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করা একদল কামুক নারী এবং 'পালের গোদা' লালন। অবশ্য বিচ্ছিন্ন জঙ্গলে আস্তানা গাড়ার আগে দেখানো হয় সিরাজ সাঁই লালনকে এক নারীর কাছে পাঠাচ্ছেন 'নারীসঙ্গ' পাওয়ার জন্য। সেই নারীর যে মুখভঙ্গি ও সংলাপ সেটাকে দর্শক কি বলবেন? 'অমাবস্যায় পূর্ণিমা' জাগানোর নারীর কামুক অনুরোধে বিবাহিত লালন সাড়া দেন। গৌতম ঘোষের ছবি অনুযায়ী লালন তখনো লালন হয়ে ওঠেননি। তবে 'হয়ে' ওঠার প্রক্রিয়া চলছে। প্রশ্ন হলো, গৌতম ঘোষের সিরাজ সাঁইয়ের কি আর কোনো তরিকা ছিলো না? বাউল ধর্মের গূহ্য ও গূঢ় বিষয়কে এভাবে যৌনতার মোড়কে আনা ব্যবসায়িক চাতুরি ছাড়া আর কি? বাউল ধর্মে অমাবস্যাকে দেখা হয় ঘোর অন্ধকার কামের সময় হিসেবে, আর পূর্ণিমাকে ধরা হয় প্রেমের মেটাফোর। "কামের স্বরূপকে বাউলরা নিরবচ্ছিন্ন দেহ-ভোগের অন্ধকারময় শক্তি বলিয়া বুঝিয়াছে। এই 'অমাবস্যা'র মধ্যেই তাহাদের 'পূর্ণচন্দ্র' উদিত হয়। এই পূর্ণচন্দ্র 'সহজ মানুষ' বা 'অধর মানুষ', ইনিই প্রেম-স্বরূপ।ঃ এই 'অধর মানুষ' বা পরমাত্মা সহস্রারে অটল-রূপে বিরাজিত। ইনি এই যোগের সময় রস-রূপে প্রকৃতি-দেহে ক্রীড়া করেন এবং পূর্ণভাবে মূলাধারে প্রকৃতির কারণ-বারিতে আবিভর্ূত হন। এই আবির্ভাবকে তারা পূর্ণিমার যোগ বলে। ইহাই বাউলদের 'অমাবস্যার পূর্ণচন্দ্র উদয়'। এই সময় তাহাদের 'অমাবস্যা-পূর্ণিমা'র একত্র যোগ। এই যোগের তৃতীয় দিন বা কোনো সমপ্রদায়ের মতে চতুর্থদিনে 'মানুষ ধরা'র প্রশস্ত দিন।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৯১) এতো দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার একটাই কারণ, আমরা বলতে চাই বাউল ধর্ম ও তার জীবনাচরণ সাধারণের চেয়ে ভিন্ন, তাদের রয়েছে গোপন দর্শন ও চর্চা। 'নারীসঙ্গ' ও 'অমাবস্যায় পূর্ণিমা'য় চোখেমুখে কামুকতা ও পোশাকে নগ্নতা এনে পরিচালক ঘোষ যে দোষ করেছেন তা স্খলন হবে কিনা তার জবাব প্রকৃত বাউলরাই দিতে পারবেন। আমরা তো সামান্য মাত্র! এই চলচ্চিত্রে নারীকে এমন 'ভোগ্যপণ্য' ও 'কামুক'রূপে আনা হয়েছে একাধিকবার।

ছবিতে কলমি নামের এক নারী চরিত্র রয়েছে। দেখা যায় আখড়ার প্রথম নারী সদস্য সে। এক মুসলমানকে বিয়ে করে সে পালিয়ে এসেছে। তার অভিযোগ লালনের গৌতম ঘোষ কথিত 'দোস্ত' কালুয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই সে ঐ কাজ করেছে। কিন্তু এরও আগে সে একজন ব্রাহ্মণের স্ত্রী। গৌতম ঘোষের 'আনন্দবাজারে' এসে সেই নারী এমনই কাম তাড়নার শিকার হয় যে সে একবার কালুয়ার দিকে ঝোঁকে তো আরেকবার গভীর রাতে লালনের ঘরে প্রবেশ করে। লালনের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করে বলে 'তোমার শরীর জেগে উঠেছে', 'আমার জ্বালা মিটাও গো সাঁই'। এই কলমিকেই আবার লালন পরামর্শ দেন কালুয়াকে 'নারীসঙ্গ' দেয়ার জন্য।

আরেক নারীকে দেখা যায়, বিধবা হওয়ায় যাকে 'সতীদাহ' প্রথায় জীবন্ত পোড়ানো হচ্ছিলো। সেই নারীকে লালন ও তাঁর শিষ্যরা রক্ষা করে এবং কথিত 'আনন্দবাজারে' ঠাঁই দেয়। সেই নারীকে আবার কলমি লালনের কাছে পাঠায়। 'সেবা' করার জন্য। লালন আবার সেই নারীকে সাধনসঙ্গিনী করে দেন তাঁরই শিষ্য দুন্দু শাহ-এর। আখড়ায় আরেক নারীর দেখা মেলে। ইনি গ্রামীণ চেকের জামা পরা নারী বাউল। প্রকৃত নাম বিবি রাসেল। উনার জীবনের এক ট্র্যাজেডির কথা পরিচালক বলেন, এবং সেখানেও যৌনতা, ট্র্যাজেডিটা হলো ব্রাহ্মণের দ্বারা এই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো। যে মুহূর্তে এই সত্যটা দর্শকের কাছে উন্মোচিত হয়, সেটি যে নিছক হাল্কা ও সস্তা হাততালির জন্য পরিচালক করেছেন তা পরিষ্কার। নয়তো, মোলস্না ও ব্রাহ্মণের সঙ্গে বাহাসে যখন লালন 'কুলিয়ে' উঠতে পারছিলেন না তখন সেই নারী-বাউল ধর্ষণের কথা বলে ব্রাহ্মণের চোখা মুখ ভোঁতা করে দেবে কেন? এরপর লাঠালাঠির দৃশ্যে মোলস্না ও ব্রাহ্মণের হাত ধরাধরি করে পুকুরে নেমে যাওয়ার দৃশ্যটি এতোটাই স্থূল কমেডি যে দেখলে বিরক্তি ধরে যায়।

কথা হচ্ছিলো নারী ও কাম নিয়ে। বাউল ধর্মের যে সাধনা সেটি বাইরের মানুষের পক্ষে বোঝা অতো সহজ নয়। কাম মানুষের প্রবৃত্তি। জীবনকে যুক্ত করে সাধনা করতে হলে, পরমের কাছে পেঁৗছুতে হলে কামকে বাদ দেয়া যায় না। তবে নারী সেই সাধনার 'বস্তু' নয়, 'সঙ্গী'। বাউলদের কাম সম্পর্কিত নানা বিষয় হুট করে বাইরের মানুষের কাছে প্রকাশ হলে ভুল বোঝার অবকাশ আছে। আর তাই, বাউলরা প্রায়ই বলেন, "আপন ভজন-কথা না কহিবে যথা-তথা, আপনাতে আপনি হইবে সাবধান।" এই গোপনীয়তা বাউলরা ধর্মাদেশের মতোই রক্ষা করেন। বাউল গবেষক ভট্টাচার্য আমাদের জানান, তিনি রাঢ়ের বাউলদের মুখে অনেকবার শুনেছেন: "যে জানে না উপাসনা, সে যেন পদ্মলোচনের পদ শোনে না।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৬৯) দুঃখের বিষয়, না জেনে ও না বুঝে, উড়ে এসে জুড়ে বসে, 'পদ্মলোচনের পদ' নিজেরা শুদ্ধ শোনেননি, আমাদেরও শোনানো ও বোঝানোর কাজটি করতে চেয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলী ও গৌতম ঘোষ। তাঁদের এই লালনকে শুনে এবং বুঝে ভারতের বুদ্ধিজীবী তপন রায়চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন "ছবিটি শ্রেষ্ঠ অর্থে ধর্মগ্রন্থ" হয়ে উঠেছে। (রায়চৌধুরী ২০১০: ৫৪)

'মনের মানুষ' চলচ্চিত্রে জমিদার ও ভূস্বামীদের মিত্র হিসেবে লালনকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শ্রেণীচরিত্রই শুধু নয়, আপন ছলচাতুরিকেও প্রকাশ করেছেন ঘোষ-গং। প্রান্তিক মানুষের সম্রাট লালনকে, সাধনার গোপনীয়তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যৌনতার মোড়কে যেভাবে তারা উপস্থাপন করেছেন, তাতে লালন পরিণত হয়েছেন পণ্যে, যেভাবে নারীরাও এখানে পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত। সমাজে যে ভাষা-বলয় কর্তৃত্ব করছে, যাদের সংস্কৃতি আধিপত্য বিস্তার করে আছে তারই পুন:উৎপাদন এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান। এখানে শত বছর আগের কুষ্টিয়া ছেউড়িয়ার লালন নাই। এখানে যিনি আছেন, তিনি কলকাতার জমিদার বাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লালন, তিনি বর্তমান সময়ের দুই বাংলার পুঁজিপতিদের লালন।

সহায় : ভট্টাচার্য, উপেন্দ্রনাথ (১৯৫৩), বাংলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি (৩য় সংস্করণ), কলকাতা।

অসহায় : রায়চৌধুরী, তপন (২০১০), মনের মানুষ, দেশ পত্রিকা, ১৭ ডিসেম্বর ২০১০, ৭৮ বর্ষ ৪ সংখ্যা, কলকাতা।

স্মৃতিলেখায় সেলিম আল দীন স্মরণ উৎসব by জাহারাবী রিপন

ৎসব ফুরিয়ে গেলে সে উৎসবের আনন্দ কিংবা আমেজ কিছুই থাকে না। কেবল থাকে স্মৃতির স্নায়ুকোষে জমানো কিছু কথার চিত্রলেখা। কিন্তু তা কখনো আভাষিত আবার কখনো অদৃশ্য দৃশ্যচিত্রের অঙ্কনরেখায় নানা বোধের আবহ সৃজন করে মনে। মুকুরে প্রতিবিম্বিত যেন কোনো ছায়াচিত্র।

দেখা-অদেখার অম্বরে তারকাদলের আলোক বিচ্ছুরণে বিম্বিত করে স্মৃতিপুষ্পের স্বর্ণাভ ছবি। সেতারের সোনালি তারে লেগে থাকা যেন কোনো ধ্রুপদ সঙ্গীতের রেশ_ মনে আনে অপার আনন্দ। স্মরণে-বিস্মরণে স্মৃতিরেখায় তবে কোনো উৎসবের দৃশ্যচিত্র অঙ্কন করি।

ঢাকায় 'সেলিম আল দীন স্মরণ_২০১১'-এর আয়োজন। গত ১৪-১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হলো। উৎসবে 'এই দোলনচাঁপা বোধের ভেতর থেকে ফুটবে ভোরের ফুল'_এ সেস্নাগান যেন আমাদেরও বোধ ও বুদ্ধিতে অদেখা অক্ষয় কোনো পারিজাতের ভোর সৃজন করে। নাট্যকার সেলিম আল দীনের লেখা থেকে নির্বাচিত হয়েছে এই সেস্নাগান। কেন? হয়তো আমরা তাঁর মতোই দোলনচাঁপা বোধে কোনো নান্দনিক প্রভাত দেখব বলে। লেখকের বা শিল্পীর দেখা ভোর আর আমাদের দেখা ভোরে তফাৎ খানিক তো থাকবেই। একদা সেলিম আল দীন 'গ্রন্থিকগণ কহে' নাটকে বলেন_ 'দাদা, যে দেখে সে লিখে'। মধ্যযুগের আরেক কবি কৃষ্ণরাম দাস বলেন_'যৎ দৃষ্টং তৎ লিখিতং'। কিন্তু এ দেখা তো কবির দেখা। আমাদের দেখা তো মাত্র তাকানো ভিন্ন কিছু নয়। কী বোধে ভোর দেখি_হয়তো দোলনচাঁপা নয়। তবুও ভোর দেখি_হূদয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি ভোরের ফুল। এমনি এক ফুলগন্ধী ভোরে ১৪ জানুয়ারি, ২০১১ ঢাকার শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে যাত্রা করি। কেন? নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে তাঁর সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করতে। আমাদের এই যাত্রার ভেতরে যুদ্ধংদেহী কোনো অভিপ্রায়ের উন্মাদনা নেই_আছে কেবল নীরবে সমর্পণের অশ্রু ও পুষ্পাঞ্জলি। শোক এখানে শঙ্কা নয় বরং স্মরণে বোধে দোলনচাঁপা ভোর হয়ে ফোটে। শ্রদ্ধার্ঘ্য_নিবেদনের নয়নচাঁপা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে পেঁৗছে আমরা প্রবেশমুখে বাধাপ্রাপ্ত হই। কারণ সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসের বিশেষ আয়োজনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আগমন নির্ধারিত আছে। তার আগে তো সে সাজানো ফটক দিয়ে আমাদের প্রবেশের প্রশ্নই আসে না। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্যাপনের সংশিস্নষ্টজনদের তুলনায় আমরা খুব বেশি নই। কিন্তু কম_তাও বলা যাবে না। স্বপ্নদলের প্রায় পঞ্চাশ জন নাট্যকর্মী_তার প্রধান সম্পাদক জাহিদ রিপন এবং আমি। তবে সংখ্যার চেয়ে নিবেদনের উত্তাপে আমরা গণন সংখ্যার অধিক বলতে হবে। অনন্তরে প্রতিগামী পথ পরিত্যাগ করে আমরা অন্য ফটকের পথ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। সেখানেও আরেক বাধা। আমাদের বাহন বাসের সম্মুখ দিয়ে স্কুলের ছোট্ট শিশুদের সারিবদ্ধ অভিগমনের পথযাত্রা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু তাতে অভিগমনের দৃশ্য ছাপিয়ে যেন শীত ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আর কুয়াশার শুভ্র সন্তরণ খানিক হলেও প্রকট হয়ে উঠেছে। তা শিশুদের উষ্ণ ধমনীর উদ্দামতাকে কোথাও কাবু করতে পারেনি। হয়তো অভিগমন পথের নির্দেশনাতে শিক্ষকের শাসনের রক্তচক্ষুকে মনে রেখেছে এই শিশুরা। আর তা তো রাখতেই হবে। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি_এ যেন নৈমিত্তিকতা। কোথাও কোনো বড় অতিথির আগমন ঘটলেই স্কুলের শিশুদের এমন শীত-গ্রীষ্ম পারায়ে যাবার আমন্ত্রণ আসে। সারিবদ্ধভাবে তাদের শৃঙ্খলা মানতে হয়। কী শীত_কী গ্রীষ্ম! শীতের কুঞ্চন কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহ শিশুদের যেন গায়ে লাগে না। তারা তো আমাদের মতো মানুষ নহে_শিশু!

সে যাই হোক, ক্যাম্পাসে অবতরণের খানিক পরে ডাক এলো_যেতে হবে সেলিম আল দীন সমাধি প্রাঙ্গণে। স্বপ্নদলের নাট্যকর্মী সুকর্নর দেখানো পথে পথে ড্রাইভার বাস নিয়ে সমাধি প্রাঙ্গণে পেঁৗছে গেল। আমরা বাস থেকে নামলাম। নেমেই দেখি_সবেমাত্র নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা থিয়েটার এবং গ্রাম থিয়েটার পুষ্পাঞ্জলি পর্ব শেষ করে নীরবে স্মরণ পথে দাঁড়িয়ে গেছে। নাট্যবর নাসির উদ্দিন ইউসুফ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবীর হিমুসহ ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটারের অনেকেই আছেন। আছেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী পারুল ভাবিও। শোক স্মরণের নীরবতা ভঙ্গ করার দুঃসাহস না দেখিয়ে আমরা সহযাত্রীগণ সকলে সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করলাম। অতঃপর আমাদেরও একই পরিণাম। খানিক দাঁড়িয়ে নীরব অশ্রুপাত। আর তো কিছু নয়। যিনি বিদেহী্ল_ সশরীরে কথা বলছেন না_তাঁকে নিবেদন ও স্মরণের এই তো পথ। হয়তো নীরবতাও কথা বলার এক বিস্ময়কর মাধ্যম বলতে হবে। আমার সে ভোরে তাই মনে হয়েছে।

প্রয়োজনের তাগিদে হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করলেন জাহিদ রিপন। তিনি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের কাছে সমাধি প্রাঙ্গণে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্মরণে উৎসর্গীকৃত সঙ্গীত পরিবেশনার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। সম্মতি এলো। সি্নগ্ধ বাদন আবহে শুরু হলো সঙ্গীত। প্রথমে 'পুণ্যশেস্নাক হে/ সেলিম আল দীন'_এই গান দিয়ে শুরু হলে মধ্যখানে 'মঙ্গল প্রদীপে পূজিব তোমারে/ আর তো কিছুই জানি না'_সুর-তালের শরণ্য আবাহন শুনতে পেলাম। এবং অবশেষে 'হে মানব ভুবনের মৃত অস্থিপুঞ্জ_ঘুমাও/ ধুলিধূম্র মৃত্তিকার দগ্ধ বক্ষে_নিঃসাড় ঘুমাও'_এই গানটির মধ্য দিয়ে জীবিতের উষ্ণ ধমনীতে মৃতের নিঃসাড় হিম স্মৃতিকণার স্পর্শ অনুভব করলাম। যে নেই তাঁর উদ্দেশে গানের গীতিকথার অমৃত উচ্চারণ_তিনি কি শুনছেন? না শুনলে_হায় এ কী এ ব্যর্থ প্রয়াস! তবুও গাইতে হবে_স্মৃতি ও শোকের অদ্বৈত সম্মিলনে_এই তো নিয়তি। সঙ্গীত পর্ব চুকিয়ে সরে এলাম সমাধি প্রাঙ্গণ থেকে_আবার ঢাকা_শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে। সেখানে নানা আকৃতির সেলিম আল দীন প্রতিকৃতিতে সাজানো হলো উৎসব প্রাঙ্গণ। প্যানাফ্লেক্সে নাট্যচার্যের প্রতিকৃতির পাশে তাঁরই লেখা নাটক থেকে সকল শোভন উদ্ধৃতি দৃশ্যমান। কোনো কোনো উদ্ধৃতি অন্তরের ভেতরে শরতের রৌপ্যশীর্ষ কাশবনের দোলা নিয়ে জেগে ওঠে_এই তো সেলিম আল দীন! আবার কোনোটি মাঘের হিম শীতে বহে আনা শীত ও দুঃখ-বাস্তবতার ছবি অঙ্কন করে মনে। বাস্তব বোধে জীবনবাস্তবতার চিত্র পৃথিবীর খুব কম শিল্পীর চারুলেখায় অঙ্কিত হয়েছে_এ সত্য তো আমাদের মানতেই হবে। যদি প্রশ্ন করি কালকে_তবে বলবে সে_মহাকাল কজনকে মনে রেখেছে! বলতে দ্বিধা নেই, সেলিম আল দীন মনে রাখার মতো কিছু শিল্পবাণী লিখে গেছেন_তারই স্বাক্ষর তো স্বপ্নদলের প্যানাফ্লেক্সে উদ্ধৃত এই লেখাগুলো। ভাবতে ভালোই লাগে।

সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। জাতীয় নাট্যশালার উৎসব উদ্বোধনের স্থান পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। মঙ্গল প্রদীপ অপেক্ষমাণ। একটু পরেই জ্বলবে বাতি। অগি্নহীন পিলসুজের মতো দর্শকবৃন্দও অপেক্ষা করছেন। উৎসবের খানিক অগি্ন ও উত্তাপের আকাঙ্ক্ষায়। কখন অনুষ্ঠান শুরুর উদ্বোধন ঘোষণা হবে। দিবসের উপান্তে দিগন্তরেখার আরক্তিম আভা নিয়ে সন্ধ্যা এলো। রাঙা ভোরের ওপিঠ আলো করে। তখনই স্বপ্নদলের পঞ্চ নাট্যকন্যা_মিতা, লাবণী, পারুল, আলো ও সোনালি দশখানি মঙ্গল প্রদীপ হাতে নৃত্যছন্দে ধীর লয়ে গেয়ে উঠলেন_'পুণ্যশেস্নাক হে/ সেলিম আল দীন/ প্রাচ্যমঞ্চের পার্থ হে তুমি/ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনঃ'। তাদের পরনে বাসন্তি বরণ শাড়িতে মরিচ পাড়ের সংযোজন_ফুলহাতা লাল বস্নাউজে যেন উৎসবের আবহ বহে এনেছে। প্রয়াণ উৎসবের আয়োজনে রঙের এই বৈপরীত্য যেন খানিক হলেও ভুলিয়ে দেয় বিয়োগ বেদনা। উদ্ধৃত গানের কথার সঙ্গে কৃষ্ণকাঠি, খঞ্জনি, ঢোল, মন্দিরা, করতাল, হারমোনিয়াম, জিপসি, মার্কাস প্রভৃতি সংগত করলো বাদকদল। গানে, বাদ্যে, নৃত্যে স্মরণের এক অভিনব সঙ্গীত যোজনা। ত্রয়ীর ঐক্যতানে পুরো আসর যেন অভিভূত_স্বপ্নদল এক মনোগ্রাহী সঙ্গীত-কোরিওগ্রাফি প্রদর্শন করল। উক্ত সঙ্গীত-কোরিওগ্রাফির মধ্য দিয়ে উদ্বোধক শিক্ষাবিদ ড. মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম উৎসব আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। অতঃপর আসরে ও চারিধারে নাট্যকর্মী ও আমন্ত্রিক জনাদের হাতে হাতে শত মঙ্গল প্রদীপের প্রজ্জলন শোভাময় হয়ে উঠল। আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসব পরিপূরক সত্তা যেন এক অদ্বৈতের সুতায় বাধা পড়ে গেল। তিনদিন চলবে এই উৎসব।

উদ্বোধনের পরে নাট্যবর নাসির উদ্দিন ইউসুফের আবাহনে মধ্য আসরে এলেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল, অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি ড. আমিনুল ইসলাম, কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী প্রমুখ। কেন? এবার সেলিম আল দীন রচিত ও সুরারোপিত গানের এ্যালবাম 'আকাশ ও সমুদ্র অপার'-এর মোড়ক উন্মোচনের পালা। নাট্যকারের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল যথারীতি মোড়ক উন্মোচন করলেন। শিল্পী ফাহমিদা নবী অনুষ্ঠান সঞ্চালক বাচ্চু ভাইয়ের অনুরোধে 'আমি যতবার উড়াল মেঘেদের ছুঁতে চাই'_ এ্যালবামের এই গানটি গেয়ে শোনালেন। দ্বিতীয়বার সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উৎসবে আরো খানিক আনন্দের মাত্রা যোগ হলো।

অতঃপর সেলিম আল দীনের দুটি নাটকের প্রদর্শনীর আয়োজন। জাতীয় নাট্যশালায় শিমুল ইউসুফের নির্দেশনা ও ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় 'ধাবমান' এবং পরীক্ষণ থিয়েটার হলে রিজোয়ান রাজনের নির্দেশনা ও চট্টগ্রামের প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের প্রযোজনায় 'প্রাচ্য'-র নির্বাক প্রদর্শন সম্পন্ন হলো। 'ধাবমান' নাটকটি অনাকাক্ষিত মৃতু্য ও হত্যার বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নির্দেশক দুরন্ত গতি ও আবেগের অহংকারে নিত্য ধাবমান মৃতু্যকে মঞ্চে উপস্থাপনার প্রয়াস পেয়েছেন। উলেস্নখ্য যে, এ নাটকটি ইতঃপূর্বে বার কয়েক দেখার কারণে দ্বিতীয় নাটকটি দেখতে মনোনিবেশ করলাম। কী আশ্চর্য_ 'প্রাচ্য' নির্বাক নাটকেও কুশীলবদের ভাষাময় শারীরিক অভিব্যক্তিতে যেন সবাক দৃশ্যচিত্রের স্বাদ পাওয়া গেল। খুব সুন্দর নাট্যপ্রযোজনা। নাটকটির অন্তিম পর্বে এসে আমি এক নতুন বিষয়ের সংযোজন লক্ষ করলাম। নাট্যকার নাটকে প্রাচ্য মানবীয় বোধে অন্যায়কারীকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখলেও নির্দেশকের অভিপ্রায়ে তা ভিন্ন বোধের বার্তা বয়ে এনেছে। তিনি এ নাট্য উপস্থাপনায় ক্ষমার চেয়েও প্রান্তিক মানবের অসহায়ত্ব ও শৃঙ্খলিত জীবনায়নের বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এরূপ কর্ম-দৃষ্টান্তে মনে হয়_ নবীন নাট্যপ্রজন্ম সেলিম আল দীনকে নানা ব্যাখ্যা ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে নবরূপে গ্রহণ করেছে। নাটক দেখে আশান্বিত হলাম।

উৎসবের দ্বিতীয় দিবসের অপরাহ্নে ছিল 'সেলিম আল দীনের নাটকে সংলাপ ও সঙ্গীতের দ্বৈতাদ্বৈতবাদিতা' শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন। মূলে প্রবন্ধকার মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সেমিনার। উক্ত সেমিনারের সভাপতি ও সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সেমিনারের বিষয়-দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী লেখক হিসেবে সেলিম আল দীনকে অন্বেষণের প্রয়াস এই প্রবন্ধে অন্বিষ্ট হয়েছে।

অতঃপর সন্ধ্যার সমাগমে পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হলো নাট্যকার সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা বিষয়ক প্রবন্ধ অবলম্বনে নাট্যপ্রযোজনা_ 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি'। পরিবেশনায় স্বপ্নদল। সফল মঞ্চরূপকার জাহিদ রিপনের নিবিড় পরিচর্যায় নির্মিত এ নাট্যে নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেন সামাদ ভুঞা ও রওনক লাবণী। এ নাট্যপ্রযোজনার মধ্য দিয়ে নাট্যকার সেলিম আল দীনের আরেক পরিচয়_ মুক্তিযোদ্ধা এবং অনন্তরে তাঁর প্রবন্ধ থেকে নাট্যরূপের বিনির্মাণের সম্ভাবনায় যেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী আরেক সেলিম আল দীনকে আমরা আবিষ্কার করি। নাটক শেষে উক্ত নাটকের নাট্যরূপকার হিসেবে মঞ্চে আমার ডাক এলো। মঞ্চে আরো এলেন পারুল ভাবি এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাই। উলেস্নখ্য যে, এ নাট্য সেলিম আল দীনের আজীবন শিল্পসঙ্গী নাসির উদ্দিন ইউসুফকে উৎসর্গ করা হয়েছে। নাটক দেখে তিনি মঞ্চ-উপস্থাপনার পাশাপাশি দুই বন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললেন। সেও তবে আরেক স্মৃতিকথার গন্ধ বিলোপন করে মনে। দর্শকবৃন্দ তন্ময় হয়ে শ্রবণ করেন। অতঃপর বিরতি এবং তারপরে নির্দেশক জাহিদ রিপন স্বপ্নদলের পরিবেশনায় এদিন উৎসবে দ্বিতীয় নাট্যপ্রযোজনা 'হরগজ' দেখার আমন্ত্রণ জানান সকলকে।

'হরগজ' নাটকের কাহিনী-পটে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনাশী ভুবনকে বিশ্ব ভাঙনের সমান্তরালে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন নাট্যকার। তরুণ নির্দেশক জাহিদ রিপন তা অত্যন্ত সতর্ক ও সহমর্মিতায় মঞ্চে আনতে সমর্থ হয়েছেন বলতে হবে।

সেদিন দ্যাশ বাংলা থিয়েটার স্টুডিও থিয়েটার হলে সেলিম আল দীন রচিত 'জুলান' নাটক মঞ্চায়ন করে। উলেস্নখ্য যে, দীর্ঘকাল পূর্বে রচিত হলেও দলটি প্রবীর গুহের নির্দেশনায় এই প্রথমবারের মতো নাটকটি মঞ্চে আনলেন। এজন্য অবশ্যই তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।

উৎসবের তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় স্টুডিও থিয়েটার হলে সেলিম আল দীনের রচনা থেকে চমৎকার পাঠ করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের সদস্যরা। এ দিনে সেলিম আল দীন রচিত দুটি নাটকের একটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এবং অপরটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চায়ন করে। প্রথমোক্তটি 'কেরামতমঙ্গল' নাটকের নির্দেশক রেজা আরিফ এবং দ্বিতীয়টি 'পুত্র' নাটকের নির্দেশক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। দুজনই নবীন নির্দেশক। 'পুত্র' নাটক দরশনে বাঙালি প্রান্তিক দম্পতির পুত্র হারানোর বেদনা আমাকেও যেন সমান বেদনাবিদ্ধ করে। রচনা ও নির্দেশনার যুগল সম্মিলনেই হয়তো তা সম্ভব হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও নির্দেশককে অভিনন্দন। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এবং নির্দেশক রেজা আরিফকেও অভিনন্দন। কারণ 'কেরামতমঙ্গল'-এর মতো একটি বিশাল ক্যানভাসে রচিত নাটককে মঞ্চের সীমিত পরিসরে উপস্থাপনা তো কম কথা নয়।

এদিন উৎসবের উপান্তে এসে স্বপ্নদলের কথা আবারও বিশেষভাবে বলতে হয়। উৎসবের শুরুতে এবং শেষে তাদের সঙ্গীত পরিবেশনা মনে রাখার মতো। নাটক সমাপনান্তে স্বপ্নদল পরীক্ষণ থিয়েটার হলের লবিতে শুরু করে সঙ্গীত পরিবেশনা। কিছুক্ষণ। অতঃপর নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লবি থেকে সঙ্গীত সহযোগে নিচে নেমে আসে। সেখানে আরো কিছুক্ষণ সঙ্গীত। এরপর বাচ্চু ভাই উৎসব সমাপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পুনরায় স্বপ্নদলকে সঙ্গীত পরিবেশনে আবাহন করেন। স্বপ্নদল 'মঙ্গল প্রদীপে পূজিব তোমারে/ আর তো কিছুই জানি না'_ এই সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে আবারও নাট্যগুরু সেলিম আল দীনকে স্মরণ করেন। স্বপ্নদলের বছরব্যাপী পরিকল্পিত উৎসবের সেস্নাগান 'স্মরণে নাট্যভাষে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন' যেন আরো একবার আমাদের মনে অজ্ঞাতসারেই প্রবেশ করে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা থিয়েটার এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার-এর যৌথ আয়োজনের এই সফল উৎসবের স্মৃতিলেখা এখানেই শেষ করছি।

আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি থেকে

মর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১১তে প্রকাশিত হবে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় অংশ 'উঁকি দিয়ে দিগন্ত'। বইটি প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার। বইটির দাম রাখা হয়েছে ২৪০ টাকা। ইত্তেফাক সাময়িকীর পাঠকদের জন্য এখানে বইটির চুম্বক অংশটুকু ছাপা হলো।

বলা আমাকে মাটিতে নামিয়েছে কি নামায়নি, ঝড়ের মতো দাশুমাস্টার এসে ঘরে ঢুকলেন। ঠিকমতো আলোগুলো জ্বালানো হয়নি। কোনো দিকে না চেয়ে দাশুমাস্টার বললেন, এই, তোরা দু-ভাই আমার সঙ্গে আয়। আর তোরা সব সোজা বাড়ি চলে যা।

আমাদের হারিকেনের বাতি একদম কমানো। মাস্টারমশাইয়ের পিছু পিছু আমরা দু-ভাই হাঁটছি। চাঁদ নেই, অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসছে। কাত্যায়নী ঠাকরানির মাটির বাড়িটা এদিকের শেষ হিঁদুবাড়ি। ঠাকরানি বহুদিন দেশছাড়া, বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। ওই বাড়ির পরেই খোনা ফকিরের দোকানের পাশ দিয়ে শিবতলার দিকে যাওয়ার গলিরাস্তাটা, তার পরেই মোসলমানপাড়ার শুরু আর শুরুতেই আমাদের ফাঁকা নতুন বাড়ি। এই বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন বিনোদবাবুর কাছ থেকে। সেজন্য এখনো ওটা বিনোদবাবুর বাড়ি। আমরা পুরনো বাড়িতেই থাকি। এ বাড়িটা পড়ে আছে খালি। একটা পেয়ারা গাছ, দু-কোণে দুটো ডুমুরগাছ। গাধাপুইনি, কাঁটানটে আর ঘাসেভরা বাড়িটা। কাছে আসতেই দেখি দেয়াল ঘেঁষে ঠিক কোণের কাছটায় অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছে। কারা আছে, কে আছে বোঝার উপায় নেই। একজন একটু কাছে এগিয়ে এল, দেখলাম শ্রীধর কাকা, তার হাতে একটা পাঁঠা কাটার টাঙি। একবার যেন মনে হল, খোনা ফকিরের বড় ছেলে শঙ্করীদা আর বোধহয় আগুরিদের বেন্দাবনদাকে দেখলাম। সবারই হাতে কিছু-না-কিছু আছে, লাঠি, হুড়কো, বগি_এইসব।

একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে যায়, মোলস্নাদের ছেলে দুটি? দাশুমাস্টার কথা বলে উঠলেন। গলা নয় যেন শানানো ইস্পাত, খবরদার, আমার ছাত্তর ওরা। আমি ওদের বাড়িতে পেঁৗছে দিয়ে আসি।ঃএইখানেই ওদের ছেড়ে দাও মাস্টার, আর এগিয়ো না। মোচনরা সব ওদের আস্তানায় জড়ো হয়েছে।ঃসে আমি দেখছি, দাশুমাস্টার বললেন।

শুকনোর দিনে ধুলোভরা রাস্তায় পা ডুবে যাচ্ছে। এইটুকু রাস্তা, মনে হচ্ছে অনেক দূর। আস্তানায় এসে দেখি সারা মোসলমানপাড়ার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। একদিকে রাস্তার ইটের ভাঙা মিনার, তার মাথায় পাকুড়গাছের চারা আর একদিকে ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে আমরা হা-ডু-ডু, হিঙেডারি খেলি, মাদার মহররম সব সেখানেই শুরু হয়। জায়গাটা এখন মানুষে ভরা। সবার হাতেই বাঁশ, লাঠি, একটা-দুটো কিরিচ। লাঠিওয়ালারাই বেশি। মোসলমানপাড়ার বাকি নেই কেউ; শুধু বাবা, নাজিরবক্স চাচার বুড়ো বাপ_এরকম কয়েকজন নেই। এমনকি লতিফ চাচার মতো আধবয়েসি মানুষটাও কোঁচরভর্তি কি কি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দাশুমাস্টার একেবারে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে বললেন, এই শোনো তোমরা, মোলস্নাবাড়ির ছেলে এই দুটি আমার কাছে পড়তে যায়। ওদের দিয়ে গেলাম। কেউ কোনো কথা বলল না। যা, এখানে দাঁড়াস না, বাড়ি চলে যা, এই বলে মাস্টারমশাই নিজের বাড়ির দিকে ফিরলেন। কেউ একটি কথাও বলল না। ধুলোভরা সাদা অাঁধারে দাশুমাস্টার একবারে মিলিয়ে গেলে একজন বলে উঠল, কপাল ভালো মাস্টারের, ভালোয় ভালোয় ফিরে গেল!

মনে হল, মোসলমানপাড়ার সবাই এসেছে। তবে মোটমাট ক-টাই বা লোক? সবসুদ্ধ এক শ' হয় কি না! লাঠি ঠুকতে ঠুকতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে মলিস্নকবাড়ির ফকির চাচা। তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে খুব খারাপ একটা পচা ঘা। ওই ঘা বহুকাল ধরে শুকোয়নি। পানসে রক্ত গড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে। হাড়-মাংস খসে পড়েছে, আঙুলটার আর সামান্যই বাকি। লোকে বলে কুঠ্ হয়েছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাছে এসে আমাকে দেখে বলল, কি বলব বাপ, আলস্না মেরে রেখেছে, নাইলে ওই কটা হিঁদু মালাউনকে এক লাপটেই সাবড়ে দেতম। লতিফ চাচা কোঁচড়ে কি নিয়ে যেন ঘুরছে, একজন বলল, বালি, সামনা সামনি হলেই হিঁদুগুনোর চোখে বালি ছুঁড়ে একদম কানা করে দেওয়া হবে, তারপর পিটিয়ে, ঠেঙিয়ে কিংবা কুপিয়ে কুপিয়ে মারো কেন আরাম করে। শুনলাম খবর দেওয়া হয়েছে সেই লেঠেলদের গাঁ ধারসোনায়, আসছে তারা সব। অবশ্যি হিঁদুরাও তাদের হিঁদু-গাঁ ক্ষীরগাঁয়ে খবর দিয়েছে। ভয়-পেদো হিঁদুরা আসবে কি-না কে জানে। মোসলমানপাড়া ঢোকার মোড়ে মোড়ে আড়াআড়ি করে গরু-মোষের গাড়ি রেখে দেওয়া হয়েছে। ওইসব পেরিয়ে আসতে আসতেই তাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হবে। ভারি মজা! গাঁয়ে শুধু হিঁদু আর মোসলমানরা আছে! ওহিদ চাচা, বঁ্যাক চাচা, ননু কাকা, ভুতো কাকা, মোবাই শেখ, মনবশ চাচা, ষষ্ঠীদা, পঞ্চাদা, পঞ্চা হাড়ি, চক্কোবত্তি মশাই, আশু ভশ্চায্যি, রাম সামন্ত_এরা কেউ নেই। কোনোদিন ছিলও না। শুধু হিঁদু আর মোসলমান আছে!

পণ্ডিতমশাই বলে গেলেন, আগে বাড়ি যা, কোথাও দাঁড়াবি না। এতক্ষণ আমরা দু-ভাই বোকার মতো ঘোরাঘুরি করছিলাম, শেখদের বাড়ির নাছ-দুয়োরের পাশের গলি দিয়ে বাড়ি যাব, শুনতে পেলাম, ও-বাড়ির একটা ঘর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে মেদিনী ফাটাচ্ছে। দুয়োর খুলে দে, খুলে দে বলছি, এই মা, হারামজাদি, দুয়োর খোল্, মালাউনের বংশ রাখব না, একবার ছেড়ে দে খালি। খুলবি না? এই ভাঙলম দুয়োর! দুমদাম শব্দ আসতে লাগল। ঘরে কিবরিয়া আটক আছে। ও কেমন খেপা সবাই জানে, মহররম খেলতে গিয়ে মানুষ খুন করার জোগাড় করে, মাদার নাচাতে গিয়ে একেকটা বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ও ছাড়া থাকলে এতক্ষণে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত।

ভাত দেওয়ার সময় ফুফু একটি কথা বলেনি। আমরা সবাই মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম। রাত খুব তাড়াতাড়ি নিশুতি হয়ে যাচ্ছিল বলেই বোধহয় আস্তানা আর বিনোদবাবুর বাড়ির কোণ থেকে হলস্না-চিৎকার অনেক স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। এমনকি দু-চারটে কথাও শোনা যাচ্ছিল। ভাতঘর থেকে বেরিয়ে কোনো চাচাকেও দেখতে পেলাম না। জানি না কেউ কেউ আস্তানায় গিয়েছে কিনা।

ঘরে আজ অন্ধকার নীল ফোঁটাটা নেই। আলোই জ্বলছিল। বাবা বিছানার ওপর বসে। মা-ও ঘরে। দেয়ালে একনলা বন্দুকটা ঠেস দিয়ে রাখা, ফ্লুট বাঁশিটা একই জায়গায় রয়েছে, ভেসিলিন-মাখানো খাঁড়াটাও দেয়ালে টাঙানো। বাবা মাকেই বলছিলেন, সন্ধেবেলায় ওবেদ শেখ তার দলিজে বসে ছিল। মোসলমানপাড়া থেকে হিঁদুপাড়ার দিকে গরুর গাড়ি যাওয়ার রাস্তা সে বন্ধ করে দেবে। ওর গোয়ালের একদিকের কোণের দেয়াল গাড়ির চাকার ধাক্কা লেগে বারবার ভাঙছে বলে সে ওপথে গাড়িই যেতে দেবে না। দেয়ালের কোণে একটা খুঁটো পুঁতে দিলেই তো দেয়াল বাঁচে! ক-বার নাকি তেমন খুঁটো পুঁতেছিল, কারা উপড়ে দিয়েছে। সে তাই রাগ করে একটা খুঁটো দিয়েছে দেয়ালের কোণে আরেকটা রাস্তার ঠিক মাঝখানে। এটা সে করতে পারে না, সরকারি রাস্তা তো তুমি বন্ধ করতে পার না! এদিকে রামযুক্ত হাজরার গরুর গাড়ি আসছিল কয়লাটয়লা নিয়ে। হিঁদুপাড়ার রাস্তায় কাদা, সে মোসলমানপাড়া দিয়ে যাবে। রাস্তার খুঁটো দেখে তার মেজাজ খারাপ। ওবেদ তো বসেই ছিল দলিজে, রামযুক্তটা গোঁয়ার, সে তাকে কোনো কথা না বলে রাস্তার মাঝখানের খুঁটোটা উপড়ে ফেলল। বেশ, তাই কর্, খুঁটোটা উপড়ে ফেলে চলে যা, তা না, সে দেয়ালের কোণের খুঁটোটাও তুলে ফেলে দিল। ওবেদ নিজে উঠে এসে রামযুক্তর ঘাড় চেপে ধরল, রামযুক্ত, এই তোর গাড়ি আটকে দেলাম। দেখি তুই কেমন বাপের ব্যাটা, গাড়ি নিয়ে যা দেখি। বোধহয় কিবরিয়া আশেপাশে ছিল, সে এক ছুটে এসে রামযুক্তের গলা ধরে ঝুলে পড়েছে। লেগে গেল ঝটাপটি। রামযুক্ত আমার সঙ্গে যাত্রায় সং-এর পার্ট করত, আমি জানি তার গায়ে খুব বল। এক ঝটকায় কিবরিয়াকে ঝেড়ে ফেলে সে শুধু বললে, গাড়ি যেতে দিবি না? গাড়ি যেতে দিবি না? এই থাকল গাড়ি, যাচ্ছি আমি। শালার নেড়ের খুব বাড় বেড়েছে। শালাদের পাড়া জ্বালিয়ে দোব আজ। এই বলে গাড়ি ওইখানেই রেখে রামযুক্ত চলে গেল। এখন গাড়ি মাঝখানে_এদিকে মোসলমানরা, ওদিকে হিঁদুরা। আমি জানি একটা কিছু ঘটবেই। বাতাসভরা বিষ। নিঃশ্বাস সবাইকেই নিতে হচ্ছে। বিষ ঢুকবে না?

কিশোরী মেয়েটা কখন যে সৈনিক হয়ে গেলাম! by তারামন বিবি বীরপ্রতীক

ইংরেজি তারিখ জানি না। তখন চৈত্র মাস। চারদিকে খালি গুলির শব্দ পাই। সাত ভাইবোন নিয়ে আমাদের অভাবী সংসার। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। আমার বয়স কত হবে? ১৩ কি ১৪। মানুষের বাড়িতে কাজ করি। কাজ জুটলে খাবার জোটে। না হলে উপোস। কিন্তু কাজ নেই গ্রামে। মিলিটারির ভয়ে পালাচ্ছে সবাই।

সেদিন সোমবার হবে, কাজের সন্ধানে বেরিয়েছি। কাজ পাইনি। বাধ্য হয়ে জঙ্গলে মুখিকচু তোলার চেষ্টা করছি। সেখানে উপস্থিত হন দুজন মানুষ। তাঁদের একজন পরিচিত। তাঁর নাম আজিজ মাস্টার, অপরজনকে চিনি না। আজিজ মাস্টার পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সঙ্গের মানুষটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন মুক্তিযোদ্ধা, নাম হাবিলদার মুহিব। তিনি তাঁর ক্যাম্পে একজন রান্না করার জন্য লোক খুঁজছেন। আমি রাজি হই না। তখন তিনি আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যান। ক্যাম্পে কাজ করার কথা শুনে মা প্রথমে আমাকে যেতে দেন না। এরপর অনেক কথাবার্তার মাঝে মুহিব সাহেব ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করার কথা জানালে মা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হন। পরদিন আমি চলে যাই দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। সেখানে রান্নার কাজ করতে থাকি। এরই ফাঁকে একদিন আমাকে এসএমজি ফায়ার করা শেখালেন আমার ধর্ম পিতা মুহিব হাবিলদার। টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য গাছের উঁচু ডালে একটা ঘুঘু পাখিকে দেখিয়ে ফায়ার করার নির্দেশ দিলেন। প্রথম দিনেই সফল হলাম।
যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা : ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ১৪ বছরের কিশোরী তারামন কখন যে সৈনিক হয়ে গেল, তা জানতে পারিনি। জানলাম সেদিন, যেদিন পাকিস্তানি বাহিনী গানবোটে এসে আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করল।
শ্রাবণের দুপুর, প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্যাম্পের সবাই ভাত খাচ্ছিলাম। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মাস্টার আমাকে একটা ভেজা সুপারির গাছে উঠে পাকিস্তানি বাহিনীর কোথাও অবস্থান আছে কিনা, তা দেখার জন্য বললেন। আমি সেই গাছে উঠে দুরবিন দিয়ে নদীর দিকে দেখলাম। ইতিউতি দুরবিন ঘোরাতেই নজর আটকে যায় একটি লঞ্চের দিকে। একটু একটু করে আরো পরিষ্কার নজর এলে বুঝতে পারি এটা শত্রুর গানবোট। এই গানবোটে পাকিস্তানি বাহিনী এগিয়ে আসছে আমাদের ক্যাম্পের দিকে।
সর্বনাশ! চিৎকার করে উঠি_সাবধান পাকিস্তানিরা আসছে...। সবাই ভাত খাওয়া ছেড়ে অস্ত্র হাতে পজিশন নিল। দ্রুত গাছ থেকে নেমেই তাঁদের সঙ্গে আমিও চায়নিজ এসএমজি নিয়ে পজিশনে শুয়ে পড়লাম। শুরু হলো প্রচণ্ড লড়াই। গুলি চালাচ্ছি। ওদের গুলি এসে আমাদের পাশের গাছে লাগছে। গাছের ছোট ছোট ডাল আর পাতা আমার গায়ের ওপড় পড়ছে। আমার ছোড়া একটি গুলি লাগল এক পাকিস্তানি হানাদারের গায়ে। আরো উৎসাহে ম্যাগাজিন লোড করি। ব্রাশফায়ার করি। কাপড় ছেঁড়ার শব্দের মতো গুলি অবিরাম বের হতে থাকে। মাঝে মধ্যে কলজে কাঁপানো হেভি মেশিনগানের আওয়াজ কানে আসছে। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই চলার পর পাকিস্তানি বাহিনী ফিরে যায়। বিজয়ের উল্লাস আর জয়বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় আমাদের ক্যাম্প এলাকা।
আমার আমিকে সেদিন আবিষ্কার করলাম, কাজের মেয়ে থেকে একজন সৈনিক হিসেবে।
এরপর আমরা আর এখানে ক্যাম্প রাখা নিরাপদ মনে করলাম না। দশঘরিয়া থেকে চলে এলাম কেতনটারীতে। সেখানে আসার পর শুরু হলো পাকিস্তানিদের বিমান হামলা। ১০-১২টি করে বোমা ফেলে চলে যায় বিমানগুলো। গোটা গ্রাম প্রায় পুড়ে শেষ। মারা যায় অনেক মানুষ। নির্দেশ দেওয়া হলো বাংকার খোঁড়ার। এক রাতেই ১৫ বাই ১২ ফুট কেটে ফেললাম আমরা। বিমানের শব্দ পেলেই আমরা বাংকারে অবস্থান নিই। সুযোগ পেলেই বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ি। শুরু হয় এক অন্যজীবন।
আমার দুচোখে তখন স্বপ্ন বাসা বাঁধে। দেশ শত্রুমুক্ত হবে, স্বাধীন হবে। আমরা আমাদের সব ভাইবোনসহ গোটা পরিবার পেটপুরে ভাত খেতে পারব।
একদিন দুপুরের দিকে একটা জঙ্গি বিমান এল। এই বিমানটা আগের বিমানগুলোর মতো নয়। এটা থেকে কোনো বোমা ফেলা হলো না। শুধু একটা চক্কর দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমরা গুলি ছুড়তে চাই। কিন্তু বাধা দেন আজিজ মাস্টার। ক্যাম্প থেকে আমাদের জানানো হলো তাঁদের কাছে খবর এসেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। আনন্দে আমার দুচোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করল। ক্যাম্পে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে জয় বাংলা। কণ্ঠ মেলাই আমি...।
আরেক জীবন : অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। শুরু হলো আরেক জীবন। রাজীবপুর ফিরে এলাম। আম্মা ভাইবোনদের ফিরে পেলাম। অভাব আবার আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। কাজ নিলাম অন্যের বাড়িতে। আমার বড় বোনটার বিয়ে হচ্ছিল না। কারণ আমি ক্যাম্পে ছিলাম বলে। সবাই বলে আমি ভালো মেয়ে নই। একদিন এই গ্রামেরই আবদুল মজিদ নামে একজন আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। ১৯৭৫ সাল। ১০১ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয় মজিদের সঙ্গে। অভাব আর নদীভাঙনের শিকার হই বারবার। জীবন যেন আর চলে না। এরই মধ্যে যক্ষ্মা আমার শরীরে বাসা বাঁধে। ওষুধ কেনার টাকা নেই।
শেষ হয় দুঃখের দিন : ১৯৯৫ সাল। এভাবেই কষ্টের জীবন চলার ফাঁকে একদিন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রভাষক বিমল কান্তি দে এসে আমার খবর নেন। আমাকে অনেক প্রশ্ন করার ফাঁকে জানতে পারি, আমি একজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এরপর ভোরের কাগজে ছাপা হয় আমাকে খুঁজে পাওয়ার রিপোর্ট। ঢাকায় নিয়ে যায় উবিনীগ নামের একটি এনজিও। সংবর্ধনা দেয় তারা। ভোরের কাগজ তহবিল গঠন করে আমার জন্য। তারা আমাকে একটি বাড়ি করার জন্য জায়গা ও আবাদি জমি কিনে দেয়। এ জমিতে আরডিআরএস নামের একটি সংস্থা গড়ে দেয় বাড়ি। এরপর একের পর এক আমাকে সংবর্ধনা দেয় বিভিন্ন সংগঠন। সরকার কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে আরাজী পলাশবাড়ীতে জমি দেয়। ২০০৭ সালে সেখানে একটি আধাপাকা বাড়ি তৈরি করেন কুড়িগ্রাম বিডিআরের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুমন বড়ুয়া।
স্বপ্নই থেকে যায় : এখন অভাব আমাকে আর ছুঁতে পায় না ঠিকই, কিন্তু যেভাবে দেশটিকে দেখতে চেয়েছিলাম সেভাবে এখনো দেশটিকে পাইনি। অনেক রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পতাকা যখন রাজাকারের গাড়িতে ওড়ে তখন আক্রোশ আর অপমানে ক্ষুব্ধ হই। এখনো মুক্তিযোদ্ধারা অনাহারে থাকেন। বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আমি এই বাংলাদেশ দেখতে চাইনি। চেয়েছিলাম শত্রুমুক্ত সুন্দর একটি বাংলাদেশ। যেখানে সবাই সুখে থাকবে।
পরিচিতি : তারামন বিবির জন্ম ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে। স্বামী আবদুল মজিদ, পেশায় কৃষক। বাবা মৃত আবদুস সোবাহান, মা কুলসুম বেওয়া। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে।
তারামন বিবি বর্তমানে রাজীবপুর সদরের কাচারিপাড়ায় বাস করছেন। এই বাড়ির ভিটে ও আবাদি জমিসহ প্রায় এক একর জমি ভোরের কাগজ কিনে দেয়। তারপর সেখানে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাড়ি তৈরি করে দেয়। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে সরকার তাঁকে একটি জমি দান করে। এই জমির ওপর কুড়িগ্রাম বিডিআরের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার সুমন বডুয়া একটি আধাপাকা বাড়ি তৈরি করে দেন।
তারামন বিবি বীরপ্রতীক বর্তমানে অসুস্থ। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। প্রতিদিনই তাঁকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।

অনুলিখন : পরিমল মজুমদার।

কে সাধু, কে শয়তান by মহসীন হাবিব

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মারে এডেলম্যানের একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'দ্য পলিটিঙ্ অব মিস ইনফরমেশন' অর্থাৎ, ভুল তথ্যের রাজনীতি। ইংরেজি নাম শুনলেই আমাদের জ্ঞানের জাহাজ মনে করার একটি প্রবণতা আছে। তবে মারের বেলায় এই মনে করার মধ্যে সত্যিই কোনো ভুল নেই।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকিনসন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়িয়েছেন দীর্ঘকাল, রাজনীতি নিয়ে 'দ্য সিম্বলিক ইউসেজ অব পলিটিঙ্'-এর মতো বহু সমাদৃত গ্রন্থ রচনা করেছেন। যাহোক, বিষয় তিনি নন, তাঁর একটি উক্তি। এডেলম্যান তাঁর দ্য পলিটিঙ্ অব মিস ইনফরমেশন গ্রন্থের একটি জায়গায় লিখেছেন, প্রথাগতভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো (পলিটিক্যাল গ্রুপস) এবং ব্যক্তিবিশেষ নিজেদের লাভের জন্য অসঠিক তথ্য ছড়িয়ে থাকে।
মারের কথামতো ধরে নেওয়া যাক, অসঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া গণতন্ত্রেরই একটি কৌশল বা অংশ। কিন্তু এর একটি নূ্যনতম মান থাকতে হয়, থাকাটা বাঞ্ছনীয়। এবং একটি গ্রহণযোগ্য মিথ্যা তৈরি করার ক্ষমতাও থাকতে হয়। বাংলাদেশে যে মিথ্যাচার চলে আসছে, তা স্রেফ হ-য-ব-র-ল ধরনের। অত্যন্ত মোটা দাগের মিথ্যাচার। দুঃখের মূল জায়গাটা এখানেই।
এ মুহূর্তে দেশের মানুষ একটি বিভ্রান্তিতে পড়েছে। মানুষ মুখিয়ে আছে একটি সত্য জানার জন্য_সত্যিই কি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ওভাবে নির্যাতন করা হয়েছে? বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'গ্রেপ্তারের পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গায়ে ব্লেডের আঁচড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে, পায়ের আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে। সকালে (১৬ ডিসেম্বর) ডিবি অফিস থেকে তাঁকে যখন মেডিকেলে নেওয়া হয়, তখন নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, রক্তে জামা-কাপড় ভিজে যাচ্ছিল।' তিনি এই নির্যাতন ইয়াজিদের ইতিহাসকেও ম্লান করে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রায় একই অভিযোগ করেছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ও মেয়ে। তবে গণমাধ্যম নিজেরা এ খবরের দায়িত্ব নেয়নি।
উপরিউক্ত বক্তব্য বেশির ভাগ মানুষ কি মেনে নিয়েছে? মানুষ কি মনে করে, সত্যিই তাঁর নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেওয়া হয়েছে? আবার তাঁর বক্তব্যের অনেক অংশ জনগণ উড়িয়ে দিতেও পারছে না। কারণ, বাংলাদেশের বিগত দিনের রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা নেহাত কম নেই। অন্যদিকে, দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, তিনি একজন সংসদ সদস্য। সেই কথা মাথায় রেখে এবং মানবাধিকারের কথা মনে রেখেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এই বিপরীতমুখী বক্তব্যের নির্লিপ্ত চোখে বিশ্লেষণের ফুরসত আছে বৈকি। বাংলাদেশের পুলিশ অনেক অকাজ-কুকাজের সঙ্গে থাকে_এটা অস্বীকার করার জো নেই। তবে বাস্তবতা যাঁরা জানেন, তাঁরা একমত হবেন, দেশের অনেক সরকারি অফিসের চেয়ে পুলিশ সচেতনভাবে কাগজে-কলমে (যদিও পুলিশের অধিকাংশ কাজ সরেজমিনে; এবং তাদের অপরাধগুলো হয়ে থাকে হাতেনাতে) পরিষ্কার থাকতে চেষ্টা করে। যেমন, দেশে অনেক সরকারি অফিস আছে, যারা এমনকি বরাদ্দকৃত কাগজ-কলম-কালি পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। ভাউচারে স্বাক্ষর করে মাল সরবরাহ না নিয়ে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসে। পুলিশ কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখন অনেকটাই সচেতন। একান্ত চোর জাতীয় অপরাধী ছাড়া পুলিশ যাদের গায়ে হাত তোলে, তাদের ক্ষেত্রে এমন কোনো চিহ্ন রাখে না, যা প্রমাণ করে দেবে, নির্যাতন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তো অনেক বড় ব্যাপার। তাঁকে যদি নির্যাতনই করতে হবে, তাহলে আর যা-ই হোক, পুলিশ ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেবে না, তাঁর পায়ের নখ তুলে নেবে না। তাঁর গা দিয়ে রক্ত পড়ছে আর তাঁকে সেই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে_এমন বোকা অন্তত বাংলাদেশের পুলিশ নয়।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে অন্যদের বেলায় এমন অভিযোগ না উঠে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বেলায় উঠল কেন? এর উত্তর হলো, সাকা চৌধুরীর প্রতি সহানুভূতি তৈরির আর কোনো পথ পৃথিবীর বুকে খোলা নেই।
সম্ভাবনা একটি থেকে যায়। আর তা হলো, অতি উৎসাহী কেউ তাঁকে চোরাগোপ্তা ব্লেড মারল কি? সরকারকে খুশি করতে গিয়ে কেউ তাঁর গায়ে হাত তুলে আশীর্বাদ পেতে চাইল? না, সেখানেও কিছু কথা আছে। তিনি এতটাই কড়া নিরাপত্তার ভেতর ছিলেন যে, একা একা এ কাজ কারো দ্বারা করা সম্ভব নয়।
তবে ঘটনা যেটাই হোক, এ বিষয়ে যে পক্ষই দেশবাসীর সামনে মিথ্যাচার করুক, তারা একটি ভয়ানক অমার্জনীয় অপরাধ করছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হোক, সেখানে বিচার যা হওয়ার হবে। কিন্তু তাঁকে ঘিরে যে মিথ্যাচার চলছে, তা জাতির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য হতাশাজনক প্রভাব ফেলবে।
তবে ব্যক্তি সালাহউদ্দিন চৌধুরীর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ১৯৬৬ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ নটর ডেম কলেজের আই এ ক্লাসের ছাত্র। তখন নটর ডেমের শিক্ষক ছিলেন রেভারেন্ড রিচার্ড ডবি্লউ টিম। সর্বমহলে তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম প্রেমিক ফাদার টিম হিসেবে পরিচিত। একদিন টিম ছাত্রদের মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি ছেলে ভয়ানক চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। ফাদার টিমের মতো শান্ত স্বভাবের মানুষটি রাগান্বিত হলেন এবং বারান্দায় গিয়ে ছেলেটির কবজি শক্ত করে ধরে বললেন,...

ফাদার টিম তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে ------ এ কথাটি লিখেছেন। ১৯৮৫ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় থাকাকালে সাকা চৌধুরী এ কাহিনী ফাদার টিমকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
টিমের কথা তিনি রাখেননি। গত ১৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত সাকা চৌধুরী তাঁর মুখ থামাননি। বহুবার তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কটাক্ষ করার মতো ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছেন, যা দেশের সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আর এ কারণেই হয়তো বিএনপি ছাড়া অন্য কাউকে সাকা চৌধুরীকে নিয়ে মাথাব্যথা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাঁকে নিয়ে কৌতূহল আছে, কিন্তু উদ্বেগ নেই। বরং দেশের মানুষ মুখিয়ে আছে, এরশাদের মন্ত্রী এবং বিএনপির মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে কী কী ঘটিয়েছেন, তা থলে থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায়।
একটি কথা পরিশেষে না বললেই নয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চলেছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সরলমনা রাজনীতি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু ভালোবাসা, ব্যক্তিগত অধিকার, প্রেম এবং আদরের ধমক দিয়ে দেশের মানুষের উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন (যদিও কোন পথে দেশ উন্নতি করবে, তার উপায় জানা ছিল না), যা এক অর্থে দুর্বলতা। কারণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো_রাজনীতিতে থাকবে কূট কৌশল-নিষ্ঠুরতা। বিশ্বাস দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা রাজনৈতিক সমাজের কাছে হাস্যকর। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে কুটিল রাজনীতি এ দেশে শুরু হয়, তার সঙ্গে বাঙালির কখনো পরিচয় ছিল না। যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই পাকিস্তান নিষ্ঠুর ছিল, অবিবেচক ছিল_এত ধূর্ততা দেখাতে পারেনি। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি মাত্র উল্লেখ করা যাক। আজ যেখানে শিশুপার্ক করা হয়েছে, সেই জায়গাটি মুজিবনগরের মতো একটি ঐতিহাসিক স্থান। ওখানেই আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সেখানে থাকার কথা ছিল হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেখানে অতি কৌশলে নির্মাণ করা হয়েছে শিশুপার্ক। এই শিশুপার্ক ভাঙবে কে? শিশুদের মতো নিষ্পাপ সম্প্রদায়কে রাজনীতিতে ব্যবহারের কী কঠিন কৌশল!
অতীতে অনেক জাতীয় নেতাকে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য খেসারত দিতে হয়েছে, যা দেশের সব মানুষের ধারণায় আছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিসের খেসারত দেবেন কিংবা দেবেন না, তা দেখার অপেক্ষায় এখন দেশ।

মুড়াপাড়ায় একদিন by সালেহ শফিক

যেতে দুই ঘণ্টা লেগে গেল। আমি আর অপু আসলে বেড়াতে বের হইনি। আমরা সূত্রাপুর থানার দুই বাসিন্দা 'এই সেই' নানা কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই মাঝেমধ্যে। গত নভেম্বরে ঘামল গার্মেন্টশ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এলে। তারা সরকারনির্ধারিত বেতন কাঠামোয় বেতন চায়।

কিন্তু মালিকের তো টাকার মায়া আছে। তাঁকে শালা-শালি নিয়ে সুইজারল্যান্ড যেতে হয়। খোঁজখবর নিয়ে আমরা ভুলতায় রওনা হলাম সায়েদাবাদ থেকে। বাসটা যাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আমরা ভুলতা নেমে পড়ব। সিনহা গ্রুপের টেঙ্টাইল মিল এলাকা দেখতে দেখতে কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে সিলেট মহাসড়কে উঠি। সড়কের দুই পাশে রিরোলিং মিল, ডাইং ফ্যাক্টরি ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। ভুলতায় এসে দেখি বাজারঘাট ঠিকঠাক চলছে, কোথাও কেউ রাস্তা আটকে বসে নেই। আমরা হতাশ হব কি না মনস্থির করতে পারছিলাম না। বাজারে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, গতকাল রবিনটেক গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ সপ্তাহখানেক সময় চেয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে। আজ তাই গণ্ডগোল নেই। কুছ পরোয়া নাই ভাব নিয়ে মুড়াপাড়া চললাম। রিকশাওয়ালা ২০ টাকায় রাজি হয়ে গেল। মুড়াপাড়ার কথা জেনেছিলাম গাইড ট্যুর সূত্রে। আগে তারা শীতলক্ষ্যা নদী ধরে পর্যটকদের মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ি নিয়ে আসত। দিনে দিনে বেড়ানোর জন্য ঢাকার কাছে এটি ভালো জায়গা। যেতে যেতে জানতে পারি চালক আসলে রবিনটেকের শ্রমিক। যত দিন গার্মেন্ট বন্ধ থাকবে তত দিন রিকশা চালাবে। অপু জিজ্ঞেস করে, আন্দোলন না করে কি সমস্যা মেটানো যায় না? চালক বলে, 'আমরা কি ইচ্ছা কইরা রাস্তায় নামি ভাই?
: এখন যদি পুরাই বন্ধ হয়ে যায়?
: বড়লোকের ট্যাকার মায়া বেশি। বন্ধ করব না।'
রাস্তার দুই ধারে প্রচুর ঝুট (কাপড়ের বাড়তি অংশ) শুকাতে দেওয়া। এ এলাকায় অনেক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। মুড়াপাড়া এসে আবদুল লতিফ জুট মিলের দরজায় নামি। ভেতরে যেতে চাইলে দারোয়ান বলে, মালিক আসছে।
অগত্যা দরজা থেকেই বিদায় হই। জমিদারবাড়ির দিকে যেতে থাকি। পিচঢালা পথ থেকে কাঁচা রাস্তায় নামি আমগাছের সারির ভেতর দিয়ে। সদর দরজা সাদামাটা। তবে বাড়িটি প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নিল। দোতলা বাড়ি বিরাট উঁচু। ইয়া মোটা মোটা গোটাকয়েক সিমেন্টের থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে সবুজে মোড়া মাঠ। মাঠের মাঝখানে বাড়ির দিকে মুখ করে কালো কোট পরে কে যেন বসে আছে! কাছে গিয়ে দেখি রুটি-ভাজি খাচ্ছেন। সালাম দেওয়া থেকে মুখকে বিরত রাখলাম। আলাপে জানলাম তিনি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। বয়স বেশি নয়, মাস দুয়েক হলো এসেছেন, পরিবার এখনো আনেননি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। জানতে চাই, জমিদাররা জাতে কী ছিলেন? কিভাবে পয়সা করলেন? তিনি বলেন, 'আমি এখনো জেনে উঠতে পারিনি।' আমরা বলি, ভেতরে যেতে পারব?
তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলেন। দুটি থামের মাঝখানে কাঠের পাটাতনে পা রাখি। চোখের সামনে ভেতর-বাড়ির উঠান, ডানে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়িই টানল আগে। দোতলার বারান্দা প্রশস্ত, ঘরের দরজা-জানালা কাঠের। দরজার ওপরের প্যানেলে গাঢ় নীল ও লাল কাচের নকশা_ফুল, পাতা, ময়ূর ইত্যাদির। ঘরগুলো বন্ধ। এসব ঘরে এখন কলেজের ক্লাস বসে। বারান্দার দক্ষিণ মাথায় বসার জায়গা আছে। বসে বসে সামনের বড় পুকুর দেখি। আমবাগানও দেখি। এ বাড়ির বিশেষ আকর্ষণ এর বয়সী আমগাছগুলো। তারপর সঙ্গে আনা বিস্কুট খাই। জমিদারবাড়িতে বসে বিস্কুট খাওয়ার বিশেষ আনন্দ আছে। দুপুর গড়িয়ে এলে হাই তুলে উঠে দাঁড়াই। সরু প্যাসেজ ধরে ভেতর-বাড়ির ছাদে যাই। দোতলার ছাদে ওঠার লোহার সিঁড়িটা দেখি ভেঙে পড়ে আছে। কষ্ট পেলাম বড়! ভেতর-বাড়ির ছাদ থেকে উবু হয়ে নিচে উঠান দেখি। দোতলার ছাদে একটা পিরামিড দেখে হৈ হৈ করে উঠি। নিচে নেমে এসে দুর্গামণ্ডপ দেখি। পূর্বদিকের রান্নাঘরটি বেশ বড়। বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছন দিকে যাই। বাগান করার জন্য জায়গা আছে। আছে পুরনো একটি তেঁতুল গাছ। এ দিকটায় কেমন যেন পুরনো পুরনো গন্ধ। এক বৃদ্ধকে দেখি গোসল সেরে আসছেন। বাড়ি তাঁর চাঁদপুর। স্বাধীনতার আগে থেকে এখানে আছেন। কর্তাদের (জমিদার) শেষ পুরুষকে দেখেছেন। তাঁরা সন্দ্বীপ এলাকায় ব্যবসা করতেন। জাতে কায়স্থ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় চলে গেছেন।
আলাপ-সালাপ সেরে আমবাগানের ভেতর দিয়ে সামনে চলে এলাম। পাশাপাশি দুটি মন্দির দেখলাম। একটা মন্দিরের প্রবেশমুখে খিলান আছে, মাথায় গম্বুজও আছে_কোন দেবতার ঠাহর করতে পারলাম না। আরেকটা মন্দির, বোধকরি শিবের হবে। গায়ে অনেক রিলিফ ওয়ার্ক (সিমেন্টে গড়া দ্বিমাত্রিক মূর্তি)_গঙ্গা, সরস্বতী, বরাহ, কূর্ম ইত্যাদি। এই প্রথম যমুনা দেবীর মূর্তিও দেখলাম। তারপর আর কাজ খুঁজে পেলাম না। বাজারে গিয়ে একটি মিষ্টির ঘরে বসলাম। পরোটা-ভাজি সুস্বাদু লাগল। অপু আবার গার্মেন্ট আন্দোলনের খোঁজখবর নিতে গেল। নতুন কিছু জানা গেল না। আমরা নৌকায় শীতলক্ষ্যা পার হয়ে টেম্পুস্ট্যান্ডে গেলাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে পিচঢালা পথ। বাচ্চারা রাস্তার মাঝখানেই ছোটাছুটি করছে। ওদেরই বা দোষ কী! পথ খেয়েছে খেলার মাঠ। জমির দাম এখানে বেলায় বেলায় বাড়ছে। ঝিলের জমিও লাখ টাকা। টেম্পু নামিয়ে দিল চিটাগাং রোডে। ভ্রমণক্লান্ত দুই সূত্রাপুরিয়া ঝিমুতে ঝিমুতে বাড়ির পথ ধরলাম। উল্লেখ্য, মুড়াপাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার একটি গ্রাম। জমিদার বাড়িতে বসেছে বেসরকারি মহাবিদ্যালয়।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী বাসে চড়ে নামতে হবে ভুলতা-গাউছিয়া। ভাড়া ৫০ টাকা। মুড়াপাড়া বাজারে খাওয়ার ভালো আঞ্জাম আছে। শীতলক্ষ্যার তাজা মাছও মিলতে পারে।