Monday, February 07, 2011

লালনের ননী চুরি, গৌতম ঘোষের ছলচাতুরি by বিধান রিবেরু

যার মৃতু্য তারিখ একশো বছর পার করে ফেলে, বিশেষ উদ্যোগ না থাকলে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত উদ্ধার করা কষ্টকর, আর তিনি যদি হন লালনের মতো দার্শনিক বাউল, প্রচারবিমুখ, তাহলে অনেক কাহিনীই কল্পনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সেটা হয়ে ওঠে মিথ। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন ফকির মারা যাওয়ার ১৪দিন পর 'হিতকরী' পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়, সেখানে বলা হয়_'ইঁহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না, শিষ্যেরা হয়ত তাঁহার নিষেধক্রমে, না হয় অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।' (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৬৭৪) যদিও এই পত্রিকায় 'সাধারণে প্রকাশ' দোহাই দিয়ে লালন ফকিরকে কায়স্থ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। তবে সেটা নিশ্চিত নয় বলেই তারা বলেছে 'সাধারণে প্রকাশ'। অতএব লালন হিন্দু ঘরের না মুসলমানের তা নির্দিষ্ট করে বলতে যাওয়ার মধ্যে একটা সামপ্রদায়িক গন্ধ যেমন থাকে তেমনি সেই তর্কে যাওয়া মূঢ়তারও প্রকাশ বৈকি।

অসামপ্রদায়িক মানসিকতার লালনকে নিয়ে তবুও টানাহেঁচড়া থামে না। সমপ্রতি লালনকে নিয়ে মুক্তি পাওয়া গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ সেই রকমই সামপ্রদায়িকতা ও মূঢ়তা চোখে পড়ে। এবং আমাদের পীড়া দেয়। লালনের জাতধর্মকে প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে ছবিটি যদি করা হতো, তাহলে ছবির জাত কি চলে যেত?

চলচ্চিত্রে শুরুর দিকে আমরা দেখি কিশোর লালন কবিরাজকে গান শোনাচ্ছে, 'আর আমারে মারিস নে মা, ঃননী চুরি আর করবো না'। কবিরাজ ও তার পরিবারের সঙ্গে গঙ্গা স্নানে যাওয়ার আগে নিছক এই গানটি পরিবেশনার মাধ্যমে সনাতন ধর্মের একটা আবহ সৃষ্টির চেষ্টা এখানে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একদিকে পুণ্য অর্জনের জন্য যাত্রা, অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণের আকুতি। কিন্তু কেউ কি হলফ করে বলতে পারে, লালনের জলবসন্ত হওয়ার আগে এই গান রচিত হয়েছিলো। তাছাড়া তখন তো লালনের গান সংগ্রহ করে তেমন কেউ ছিলো না। যেহেতু বাউল হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের পরই। যদি বলি, বাউল ধর্মকে গ্রহণ করার পর এই গানের সৃষ্টি? তাহলে কি বিশ্বাস করা যায়, শুধু কৃষ্ণের ক্ষমা প্রার্থনা রাষ্ট্র করার জন্যই এই গান বেঁধেছিলেন লালন? না।

আমরা মনে করি, লালনের এই গানে 'মা' পরমেশ্বরেরই একটা মেটাফোর। আর 'ননী' কামুক ভোগবিলাসি জীবনের এক অসাধারণ রূপান্তর। এই ভবে ভোগবিলাস যেমন আছে, তেমনি আছে পরমেশ্বরের সাধনা। শুদ্ধ ভোগবিলাসে ভাগ্যের রূপান্তরে পরমের মার খাওয়ার দৃশ্যকল্পই কি লালন এই গানে ধরতে চাননি? লালন গবেষকরা এই প্রশ্নের মীমাংসা করবেন। কিন্তু লালনের গানের শ্রোতা হিসেবে আমরা মনে করি, নেহায়েৎ কৃষ্ণ বন্দনার জন্য লালন এই গান রচনা করেননি। তাতে কি, সিনেমাটোগ্রাফার কাম পরিচালক গৌতম ঘোষ অবলীলায় ঐ 'ধর্মীয়' গানটি 'হিন্দু' লালনকে দিয়ে গাইয়ে নিয়েছেন।

বাউল ও লালন বিষয়ক পণ্ডিত অধ্যাপক উপেন্দ্রকিশোর ভট্টাচার্য বাউলদের 'মনের মানুষ' সম্পর্কে বলেন_

"মানব-দেহস্থিত পরমতত্ত্ব বা আত্মাকে বাউল 'মনের মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। আত্মাকে 'মানুষ' বলার তাৎপর্য মনে হয় এই যে, আত্মা মানবদেহকে অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছেন ও মানবদেহের সাধনার দ্বারাই তিনি লভ্য এবং এই মানবাকৃতি তাঁহারই রূপ মনে করিয়া বাউল তাঁহাকে 'মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। এই মানুষ অলক্ষ্য অবস্থায় হূদয়ে বা মনে অবস্থান করিতেছেন, বোধহয় এই কল্পনা করিয়া তাহারা তাঁহাকে 'মনের মানুষ' বলিয়াছে। এই আত্মাকে তাহারা 'মানুষ', 'মনের মানুষ', 'সহজ মানুষ', 'অধর মানুষ', 'রসের মানুষ', 'ভাবের মানুষ', 'আলেখ মানুষ', 'সোনার মানুষ', 'সাঁই' প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত করিয়াছে।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৪০)

লালন যেমনটা বলেন:

"এই মানুষে আছে, রে মন,

যারে বলে মানুষ রতন, লালন বলে পেয়ে সে ধন

পারলাম না রে চিনিতে।।"

(ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৫৯৪)

দুঃখের বিষয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে ভিত্তি করে নির্মিত গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ সেরকম কোনো আত্মঅনুসন্ধানের হদিসই মেলে না। যা মেলে সে শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করা একদল কামুক নারী এবং 'পালের গোদা' লালন। অবশ্য বিচ্ছিন্ন জঙ্গলে আস্তানা গাড়ার আগে দেখানো হয় সিরাজ সাঁই লালনকে এক নারীর কাছে পাঠাচ্ছেন 'নারীসঙ্গ' পাওয়ার জন্য। সেই নারীর যে মুখভঙ্গি ও সংলাপ সেটাকে দর্শক কি বলবেন? 'অমাবস্যায় পূর্ণিমা' জাগানোর নারীর কামুক অনুরোধে বিবাহিত লালন সাড়া দেন। গৌতম ঘোষের ছবি অনুযায়ী লালন তখনো লালন হয়ে ওঠেননি। তবে 'হয়ে' ওঠার প্রক্রিয়া চলছে। প্রশ্ন হলো, গৌতম ঘোষের সিরাজ সাঁইয়ের কি আর কোনো তরিকা ছিলো না? বাউল ধর্মের গূহ্য ও গূঢ় বিষয়কে এভাবে যৌনতার মোড়কে আনা ব্যবসায়িক চাতুরি ছাড়া আর কি? বাউল ধর্মে অমাবস্যাকে দেখা হয় ঘোর অন্ধকার কামের সময় হিসেবে, আর পূর্ণিমাকে ধরা হয় প্রেমের মেটাফোর। "কামের স্বরূপকে বাউলরা নিরবচ্ছিন্ন দেহ-ভোগের অন্ধকারময় শক্তি বলিয়া বুঝিয়াছে। এই 'অমাবস্যা'র মধ্যেই তাহাদের 'পূর্ণচন্দ্র' উদিত হয়। এই পূর্ণচন্দ্র 'সহজ মানুষ' বা 'অধর মানুষ', ইনিই প্রেম-স্বরূপ।ঃ এই 'অধর মানুষ' বা পরমাত্মা সহস্রারে অটল-রূপে বিরাজিত। ইনি এই যোগের সময় রস-রূপে প্রকৃতি-দেহে ক্রীড়া করেন এবং পূর্ণভাবে মূলাধারে প্রকৃতির কারণ-বারিতে আবিভর্ূত হন। এই আবির্ভাবকে তারা পূর্ণিমার যোগ বলে। ইহাই বাউলদের 'অমাবস্যার পূর্ণচন্দ্র উদয়'। এই সময় তাহাদের 'অমাবস্যা-পূর্ণিমা'র একত্র যোগ। এই যোগের তৃতীয় দিন বা কোনো সমপ্রদায়ের মতে চতুর্থদিনে 'মানুষ ধরা'র প্রশস্ত দিন।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৯১) এতো দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার একটাই কারণ, আমরা বলতে চাই বাউল ধর্ম ও তার জীবনাচরণ সাধারণের চেয়ে ভিন্ন, তাদের রয়েছে গোপন দর্শন ও চর্চা। 'নারীসঙ্গ' ও 'অমাবস্যায় পূর্ণিমা'য় চোখেমুখে কামুকতা ও পোশাকে নগ্নতা এনে পরিচালক ঘোষ যে দোষ করেছেন তা স্খলন হবে কিনা তার জবাব প্রকৃত বাউলরাই দিতে পারবেন। আমরা তো সামান্য মাত্র! এই চলচ্চিত্রে নারীকে এমন 'ভোগ্যপণ্য' ও 'কামুক'রূপে আনা হয়েছে একাধিকবার।

ছবিতে কলমি নামের এক নারী চরিত্র রয়েছে। দেখা যায় আখড়ার প্রথম নারী সদস্য সে। এক মুসলমানকে বিয়ে করে সে পালিয়ে এসেছে। তার অভিযোগ লালনের গৌতম ঘোষ কথিত 'দোস্ত' কালুয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই সে ঐ কাজ করেছে। কিন্তু এরও আগে সে একজন ব্রাহ্মণের স্ত্রী। গৌতম ঘোষের 'আনন্দবাজারে' এসে সেই নারী এমনই কাম তাড়নার শিকার হয় যে সে একবার কালুয়ার দিকে ঝোঁকে তো আরেকবার গভীর রাতে লালনের ঘরে প্রবেশ করে। লালনের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করে বলে 'তোমার শরীর জেগে উঠেছে', 'আমার জ্বালা মিটাও গো সাঁই'। এই কলমিকেই আবার লালন পরামর্শ দেন কালুয়াকে 'নারীসঙ্গ' দেয়ার জন্য।

আরেক নারীকে দেখা যায়, বিধবা হওয়ায় যাকে 'সতীদাহ' প্রথায় জীবন্ত পোড়ানো হচ্ছিলো। সেই নারীকে লালন ও তাঁর শিষ্যরা রক্ষা করে এবং কথিত 'আনন্দবাজারে' ঠাঁই দেয়। সেই নারীকে আবার কলমি লালনের কাছে পাঠায়। 'সেবা' করার জন্য। লালন আবার সেই নারীকে সাধনসঙ্গিনী করে দেন তাঁরই শিষ্য দুন্দু শাহ-এর। আখড়ায় আরেক নারীর দেখা মেলে। ইনি গ্রামীণ চেকের জামা পরা নারী বাউল। প্রকৃত নাম বিবি রাসেল। উনার জীবনের এক ট্র্যাজেডির কথা পরিচালক বলেন, এবং সেখানেও যৌনতা, ট্র্যাজেডিটা হলো ব্রাহ্মণের দ্বারা এই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো। যে মুহূর্তে এই সত্যটা দর্শকের কাছে উন্মোচিত হয়, সেটি যে নিছক হাল্কা ও সস্তা হাততালির জন্য পরিচালক করেছেন তা পরিষ্কার। নয়তো, মোলস্না ও ব্রাহ্মণের সঙ্গে বাহাসে যখন লালন 'কুলিয়ে' উঠতে পারছিলেন না তখন সেই নারী-বাউল ধর্ষণের কথা বলে ব্রাহ্মণের চোখা মুখ ভোঁতা করে দেবে কেন? এরপর লাঠালাঠির দৃশ্যে মোলস্না ও ব্রাহ্মণের হাত ধরাধরি করে পুকুরে নেমে যাওয়ার দৃশ্যটি এতোটাই স্থূল কমেডি যে দেখলে বিরক্তি ধরে যায়।

কথা হচ্ছিলো নারী ও কাম নিয়ে। বাউল ধর্মের যে সাধনা সেটি বাইরের মানুষের পক্ষে বোঝা অতো সহজ নয়। কাম মানুষের প্রবৃত্তি। জীবনকে যুক্ত করে সাধনা করতে হলে, পরমের কাছে পেঁৗছুতে হলে কামকে বাদ দেয়া যায় না। তবে নারী সেই সাধনার 'বস্তু' নয়, 'সঙ্গী'। বাউলদের কাম সম্পর্কিত নানা বিষয় হুট করে বাইরের মানুষের কাছে প্রকাশ হলে ভুল বোঝার অবকাশ আছে। আর তাই, বাউলরা প্রায়ই বলেন, "আপন ভজন-কথা না কহিবে যথা-তথা, আপনাতে আপনি হইবে সাবধান।" এই গোপনীয়তা বাউলরা ধর্মাদেশের মতোই রক্ষা করেন। বাউল গবেষক ভট্টাচার্য আমাদের জানান, তিনি রাঢ়ের বাউলদের মুখে অনেকবার শুনেছেন: "যে জানে না উপাসনা, সে যেন পদ্মলোচনের পদ শোনে না।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৬৯) দুঃখের বিষয়, না জেনে ও না বুঝে, উড়ে এসে জুড়ে বসে, 'পদ্মলোচনের পদ' নিজেরা শুদ্ধ শোনেননি, আমাদেরও শোনানো ও বোঝানোর কাজটি করতে চেয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলী ও গৌতম ঘোষ। তাঁদের এই লালনকে শুনে এবং বুঝে ভারতের বুদ্ধিজীবী তপন রায়চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন "ছবিটি শ্রেষ্ঠ অর্থে ধর্মগ্রন্থ" হয়ে উঠেছে। (রায়চৌধুরী ২০১০: ৫৪)

'মনের মানুষ' চলচ্চিত্রে জমিদার ও ভূস্বামীদের মিত্র হিসেবে লালনকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শ্রেণীচরিত্রই শুধু নয়, আপন ছলচাতুরিকেও প্রকাশ করেছেন ঘোষ-গং। প্রান্তিক মানুষের সম্রাট লালনকে, সাধনার গোপনীয়তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যৌনতার মোড়কে যেভাবে তারা উপস্থাপন করেছেন, তাতে লালন পরিণত হয়েছেন পণ্যে, যেভাবে নারীরাও এখানে পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত। সমাজে যে ভাষা-বলয় কর্তৃত্ব করছে, যাদের সংস্কৃতি আধিপত্য বিস্তার করে আছে তারই পুন:উৎপাদন এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান। এখানে শত বছর আগের কুষ্টিয়া ছেউড়িয়ার লালন নাই। এখানে যিনি আছেন, তিনি কলকাতার জমিদার বাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লালন, তিনি বর্তমান সময়ের দুই বাংলার পুঁজিপতিদের লালন।

সহায় : ভট্টাচার্য, উপেন্দ্রনাথ (১৯৫৩), বাংলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি (৩য় সংস্করণ), কলকাতা।

অসহায় : রায়চৌধুরী, তপন (২০১০), মনের মানুষ, দেশ পত্রিকা, ১৭ ডিসেম্বর ২০১০, ৭৮ বর্ষ ৪ সংখ্যা, কলকাতা।

No comments:

Post a Comment