Monday, February 07, 2011

স্মৃতিলেখায় সেলিম আল দীন স্মরণ উৎসব by জাহারাবী রিপন

ৎসব ফুরিয়ে গেলে সে উৎসবের আনন্দ কিংবা আমেজ কিছুই থাকে না। কেবল থাকে স্মৃতির স্নায়ুকোষে জমানো কিছু কথার চিত্রলেখা। কিন্তু তা কখনো আভাষিত আবার কখনো অদৃশ্য দৃশ্যচিত্রের অঙ্কনরেখায় নানা বোধের আবহ সৃজন করে মনে। মুকুরে প্রতিবিম্বিত যেন কোনো ছায়াচিত্র।

দেখা-অদেখার অম্বরে তারকাদলের আলোক বিচ্ছুরণে বিম্বিত করে স্মৃতিপুষ্পের স্বর্ণাভ ছবি। সেতারের সোনালি তারে লেগে থাকা যেন কোনো ধ্রুপদ সঙ্গীতের রেশ_ মনে আনে অপার আনন্দ। স্মরণে-বিস্মরণে স্মৃতিরেখায় তবে কোনো উৎসবের দৃশ্যচিত্র অঙ্কন করি।

ঢাকায় 'সেলিম আল দীন স্মরণ_২০১১'-এর আয়োজন। গত ১৪-১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হলো। উৎসবে 'এই দোলনচাঁপা বোধের ভেতর থেকে ফুটবে ভোরের ফুল'_এ সেস্নাগান যেন আমাদেরও বোধ ও বুদ্ধিতে অদেখা অক্ষয় কোনো পারিজাতের ভোর সৃজন করে। নাট্যকার সেলিম আল দীনের লেখা থেকে নির্বাচিত হয়েছে এই সেস্নাগান। কেন? হয়তো আমরা তাঁর মতোই দোলনচাঁপা বোধে কোনো নান্দনিক প্রভাত দেখব বলে। লেখকের বা শিল্পীর দেখা ভোর আর আমাদের দেখা ভোরে তফাৎ খানিক তো থাকবেই। একদা সেলিম আল দীন 'গ্রন্থিকগণ কহে' নাটকে বলেন_ 'দাদা, যে দেখে সে লিখে'। মধ্যযুগের আরেক কবি কৃষ্ণরাম দাস বলেন_'যৎ দৃষ্টং তৎ লিখিতং'। কিন্তু এ দেখা তো কবির দেখা। আমাদের দেখা তো মাত্র তাকানো ভিন্ন কিছু নয়। কী বোধে ভোর দেখি_হয়তো দোলনচাঁপা নয়। তবুও ভোর দেখি_হূদয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি ভোরের ফুল। এমনি এক ফুলগন্ধী ভোরে ১৪ জানুয়ারি, ২০১১ ঢাকার শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে যাত্রা করি। কেন? নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে তাঁর সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করতে। আমাদের এই যাত্রার ভেতরে যুদ্ধংদেহী কোনো অভিপ্রায়ের উন্মাদনা নেই_আছে কেবল নীরবে সমর্পণের অশ্রু ও পুষ্পাঞ্জলি। শোক এখানে শঙ্কা নয় বরং স্মরণে বোধে দোলনচাঁপা ভোর হয়ে ফোটে। শ্রদ্ধার্ঘ্য_নিবেদনের নয়নচাঁপা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে পেঁৗছে আমরা প্রবেশমুখে বাধাপ্রাপ্ত হই। কারণ সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসের বিশেষ আয়োজনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আগমন নির্ধারিত আছে। তার আগে তো সে সাজানো ফটক দিয়ে আমাদের প্রবেশের প্রশ্নই আসে না। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্যাপনের সংশিস্নষ্টজনদের তুলনায় আমরা খুব বেশি নই। কিন্তু কম_তাও বলা যাবে না। স্বপ্নদলের প্রায় পঞ্চাশ জন নাট্যকর্মী_তার প্রধান সম্পাদক জাহিদ রিপন এবং আমি। তবে সংখ্যার চেয়ে নিবেদনের উত্তাপে আমরা গণন সংখ্যার অধিক বলতে হবে। অনন্তরে প্রতিগামী পথ পরিত্যাগ করে আমরা অন্য ফটকের পথ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। সেখানেও আরেক বাধা। আমাদের বাহন বাসের সম্মুখ দিয়ে স্কুলের ছোট্ট শিশুদের সারিবদ্ধ অভিগমনের পথযাত্রা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু তাতে অভিগমনের দৃশ্য ছাপিয়ে যেন শীত ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আর কুয়াশার শুভ্র সন্তরণ খানিক হলেও প্রকট হয়ে উঠেছে। তা শিশুদের উষ্ণ ধমনীর উদ্দামতাকে কোথাও কাবু করতে পারেনি। হয়তো অভিগমন পথের নির্দেশনাতে শিক্ষকের শাসনের রক্তচক্ষুকে মনে রেখেছে এই শিশুরা। আর তা তো রাখতেই হবে। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি_এ যেন নৈমিত্তিকতা। কোথাও কোনো বড় অতিথির আগমন ঘটলেই স্কুলের শিশুদের এমন শীত-গ্রীষ্ম পারায়ে যাবার আমন্ত্রণ আসে। সারিবদ্ধভাবে তাদের শৃঙ্খলা মানতে হয়। কী শীত_কী গ্রীষ্ম! শীতের কুঞ্চন কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহ শিশুদের যেন গায়ে লাগে না। তারা তো আমাদের মতো মানুষ নহে_শিশু!

সে যাই হোক, ক্যাম্পাসে অবতরণের খানিক পরে ডাক এলো_যেতে হবে সেলিম আল দীন সমাধি প্রাঙ্গণে। স্বপ্নদলের নাট্যকর্মী সুকর্নর দেখানো পথে পথে ড্রাইভার বাস নিয়ে সমাধি প্রাঙ্গণে পেঁৗছে গেল। আমরা বাস থেকে নামলাম। নেমেই দেখি_সবেমাত্র নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা থিয়েটার এবং গ্রাম থিয়েটার পুষ্পাঞ্জলি পর্ব শেষ করে নীরবে স্মরণ পথে দাঁড়িয়ে গেছে। নাট্যবর নাসির উদ্দিন ইউসুফ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবীর হিমুসহ ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটারের অনেকেই আছেন। আছেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী পারুল ভাবিও। শোক স্মরণের নীরবতা ভঙ্গ করার দুঃসাহস না দেখিয়ে আমরা সহযাত্রীগণ সকলে সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করলাম। অতঃপর আমাদেরও একই পরিণাম। খানিক দাঁড়িয়ে নীরব অশ্রুপাত। আর তো কিছু নয়। যিনি বিদেহী্ল_ সশরীরে কথা বলছেন না_তাঁকে নিবেদন ও স্মরণের এই তো পথ। হয়তো নীরবতাও কথা বলার এক বিস্ময়কর মাধ্যম বলতে হবে। আমার সে ভোরে তাই মনে হয়েছে।

প্রয়োজনের তাগিদে হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করলেন জাহিদ রিপন। তিনি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের কাছে সমাধি প্রাঙ্গণে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্মরণে উৎসর্গীকৃত সঙ্গীত পরিবেশনার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। সম্মতি এলো। সি্নগ্ধ বাদন আবহে শুরু হলো সঙ্গীত। প্রথমে 'পুণ্যশেস্নাক হে/ সেলিম আল দীন'_এই গান দিয়ে শুরু হলে মধ্যখানে 'মঙ্গল প্রদীপে পূজিব তোমারে/ আর তো কিছুই জানি না'_সুর-তালের শরণ্য আবাহন শুনতে পেলাম। এবং অবশেষে 'হে মানব ভুবনের মৃত অস্থিপুঞ্জ_ঘুমাও/ ধুলিধূম্র মৃত্তিকার দগ্ধ বক্ষে_নিঃসাড় ঘুমাও'_এই গানটির মধ্য দিয়ে জীবিতের উষ্ণ ধমনীতে মৃতের নিঃসাড় হিম স্মৃতিকণার স্পর্শ অনুভব করলাম। যে নেই তাঁর উদ্দেশে গানের গীতিকথার অমৃত উচ্চারণ_তিনি কি শুনছেন? না শুনলে_হায় এ কী এ ব্যর্থ প্রয়াস! তবুও গাইতে হবে_স্মৃতি ও শোকের অদ্বৈত সম্মিলনে_এই তো নিয়তি। সঙ্গীত পর্ব চুকিয়ে সরে এলাম সমাধি প্রাঙ্গণ থেকে_আবার ঢাকা_শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে। সেখানে নানা আকৃতির সেলিম আল দীন প্রতিকৃতিতে সাজানো হলো উৎসব প্রাঙ্গণ। প্যানাফ্লেক্সে নাট্যচার্যের প্রতিকৃতির পাশে তাঁরই লেখা নাটক থেকে সকল শোভন উদ্ধৃতি দৃশ্যমান। কোনো কোনো উদ্ধৃতি অন্তরের ভেতরে শরতের রৌপ্যশীর্ষ কাশবনের দোলা নিয়ে জেগে ওঠে_এই তো সেলিম আল দীন! আবার কোনোটি মাঘের হিম শীতে বহে আনা শীত ও দুঃখ-বাস্তবতার ছবি অঙ্কন করে মনে। বাস্তব বোধে জীবনবাস্তবতার চিত্র পৃথিবীর খুব কম শিল্পীর চারুলেখায় অঙ্কিত হয়েছে_এ সত্য তো আমাদের মানতেই হবে। যদি প্রশ্ন করি কালকে_তবে বলবে সে_মহাকাল কজনকে মনে রেখেছে! বলতে দ্বিধা নেই, সেলিম আল দীন মনে রাখার মতো কিছু শিল্পবাণী লিখে গেছেন_তারই স্বাক্ষর তো স্বপ্নদলের প্যানাফ্লেক্সে উদ্ধৃত এই লেখাগুলো। ভাবতে ভালোই লাগে।

সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। জাতীয় নাট্যশালার উৎসব উদ্বোধনের স্থান পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। মঙ্গল প্রদীপ অপেক্ষমাণ। একটু পরেই জ্বলবে বাতি। অগি্নহীন পিলসুজের মতো দর্শকবৃন্দও অপেক্ষা করছেন। উৎসবের খানিক অগি্ন ও উত্তাপের আকাঙ্ক্ষায়। কখন অনুষ্ঠান শুরুর উদ্বোধন ঘোষণা হবে। দিবসের উপান্তে দিগন্তরেখার আরক্তিম আভা নিয়ে সন্ধ্যা এলো। রাঙা ভোরের ওপিঠ আলো করে। তখনই স্বপ্নদলের পঞ্চ নাট্যকন্যা_মিতা, লাবণী, পারুল, আলো ও সোনালি দশখানি মঙ্গল প্রদীপ হাতে নৃত্যছন্দে ধীর লয়ে গেয়ে উঠলেন_'পুণ্যশেস্নাক হে/ সেলিম আল দীন/ প্রাচ্যমঞ্চের পার্থ হে তুমি/ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনঃ'। তাদের পরনে বাসন্তি বরণ শাড়িতে মরিচ পাড়ের সংযোজন_ফুলহাতা লাল বস্নাউজে যেন উৎসবের আবহ বহে এনেছে। প্রয়াণ উৎসবের আয়োজনে রঙের এই বৈপরীত্য যেন খানিক হলেও ভুলিয়ে দেয় বিয়োগ বেদনা। উদ্ধৃত গানের কথার সঙ্গে কৃষ্ণকাঠি, খঞ্জনি, ঢোল, মন্দিরা, করতাল, হারমোনিয়াম, জিপসি, মার্কাস প্রভৃতি সংগত করলো বাদকদল। গানে, বাদ্যে, নৃত্যে স্মরণের এক অভিনব সঙ্গীত যোজনা। ত্রয়ীর ঐক্যতানে পুরো আসর যেন অভিভূত_স্বপ্নদল এক মনোগ্রাহী সঙ্গীত-কোরিওগ্রাফি প্রদর্শন করল। উক্ত সঙ্গীত-কোরিওগ্রাফির মধ্য দিয়ে উদ্বোধক শিক্ষাবিদ ড. মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম উৎসব আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। অতঃপর আসরে ও চারিধারে নাট্যকর্মী ও আমন্ত্রিক জনাদের হাতে হাতে শত মঙ্গল প্রদীপের প্রজ্জলন শোভাময় হয়ে উঠল। আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসব পরিপূরক সত্তা যেন এক অদ্বৈতের সুতায় বাধা পড়ে গেল। তিনদিন চলবে এই উৎসব।

উদ্বোধনের পরে নাট্যবর নাসির উদ্দিন ইউসুফের আবাহনে মধ্য আসরে এলেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল, অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি ড. আমিনুল ইসলাম, কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী প্রমুখ। কেন? এবার সেলিম আল দীন রচিত ও সুরারোপিত গানের এ্যালবাম 'আকাশ ও সমুদ্র অপার'-এর মোড়ক উন্মোচনের পালা। নাট্যকারের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল যথারীতি মোড়ক উন্মোচন করলেন। শিল্পী ফাহমিদা নবী অনুষ্ঠান সঞ্চালক বাচ্চু ভাইয়ের অনুরোধে 'আমি যতবার উড়াল মেঘেদের ছুঁতে চাই'_ এ্যালবামের এই গানটি গেয়ে শোনালেন। দ্বিতীয়বার সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উৎসবে আরো খানিক আনন্দের মাত্রা যোগ হলো।

অতঃপর সেলিম আল দীনের দুটি নাটকের প্রদর্শনীর আয়োজন। জাতীয় নাট্যশালায় শিমুল ইউসুফের নির্দেশনা ও ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় 'ধাবমান' এবং পরীক্ষণ থিয়েটার হলে রিজোয়ান রাজনের নির্দেশনা ও চট্টগ্রামের প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের প্রযোজনায় 'প্রাচ্য'-র নির্বাক প্রদর্শন সম্পন্ন হলো। 'ধাবমান' নাটকটি অনাকাক্ষিত মৃতু্য ও হত্যার বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নির্দেশক দুরন্ত গতি ও আবেগের অহংকারে নিত্য ধাবমান মৃতু্যকে মঞ্চে উপস্থাপনার প্রয়াস পেয়েছেন। উলেস্নখ্য যে, এ নাটকটি ইতঃপূর্বে বার কয়েক দেখার কারণে দ্বিতীয় নাটকটি দেখতে মনোনিবেশ করলাম। কী আশ্চর্য_ 'প্রাচ্য' নির্বাক নাটকেও কুশীলবদের ভাষাময় শারীরিক অভিব্যক্তিতে যেন সবাক দৃশ্যচিত্রের স্বাদ পাওয়া গেল। খুব সুন্দর নাট্যপ্রযোজনা। নাটকটির অন্তিম পর্বে এসে আমি এক নতুন বিষয়ের সংযোজন লক্ষ করলাম। নাট্যকার নাটকে প্রাচ্য মানবীয় বোধে অন্যায়কারীকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখলেও নির্দেশকের অভিপ্রায়ে তা ভিন্ন বোধের বার্তা বয়ে এনেছে। তিনি এ নাট্য উপস্থাপনায় ক্ষমার চেয়েও প্রান্তিক মানবের অসহায়ত্ব ও শৃঙ্খলিত জীবনায়নের বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এরূপ কর্ম-দৃষ্টান্তে মনে হয়_ নবীন নাট্যপ্রজন্ম সেলিম আল দীনকে নানা ব্যাখ্যা ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে নবরূপে গ্রহণ করেছে। নাটক দেখে আশান্বিত হলাম।

উৎসবের দ্বিতীয় দিবসের অপরাহ্নে ছিল 'সেলিম আল দীনের নাটকে সংলাপ ও সঙ্গীতের দ্বৈতাদ্বৈতবাদিতা' শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন। মূলে প্রবন্ধকার মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সেমিনার। উক্ত সেমিনারের সভাপতি ও সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সেমিনারের বিষয়-দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী লেখক হিসেবে সেলিম আল দীনকে অন্বেষণের প্রয়াস এই প্রবন্ধে অন্বিষ্ট হয়েছে।

অতঃপর সন্ধ্যার সমাগমে পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হলো নাট্যকার সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা বিষয়ক প্রবন্ধ অবলম্বনে নাট্যপ্রযোজনা_ 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি'। পরিবেশনায় স্বপ্নদল। সফল মঞ্চরূপকার জাহিদ রিপনের নিবিড় পরিচর্যায় নির্মিত এ নাট্যে নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেন সামাদ ভুঞা ও রওনক লাবণী। এ নাট্যপ্রযোজনার মধ্য দিয়ে নাট্যকার সেলিম আল দীনের আরেক পরিচয়_ মুক্তিযোদ্ধা এবং অনন্তরে তাঁর প্রবন্ধ থেকে নাট্যরূপের বিনির্মাণের সম্ভাবনায় যেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী আরেক সেলিম আল দীনকে আমরা আবিষ্কার করি। নাটক শেষে উক্ত নাটকের নাট্যরূপকার হিসেবে মঞ্চে আমার ডাক এলো। মঞ্চে আরো এলেন পারুল ভাবি এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাই। উলেস্নখ্য যে, এ নাট্য সেলিম আল দীনের আজীবন শিল্পসঙ্গী নাসির উদ্দিন ইউসুফকে উৎসর্গ করা হয়েছে। নাটক দেখে তিনি মঞ্চ-উপস্থাপনার পাশাপাশি দুই বন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললেন। সেও তবে আরেক স্মৃতিকথার গন্ধ বিলোপন করে মনে। দর্শকবৃন্দ তন্ময় হয়ে শ্রবণ করেন। অতঃপর বিরতি এবং তারপরে নির্দেশক জাহিদ রিপন স্বপ্নদলের পরিবেশনায় এদিন উৎসবে দ্বিতীয় নাট্যপ্রযোজনা 'হরগজ' দেখার আমন্ত্রণ জানান সকলকে।

'হরগজ' নাটকের কাহিনী-পটে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনাশী ভুবনকে বিশ্ব ভাঙনের সমান্তরালে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন নাট্যকার। তরুণ নির্দেশক জাহিদ রিপন তা অত্যন্ত সতর্ক ও সহমর্মিতায় মঞ্চে আনতে সমর্থ হয়েছেন বলতে হবে।

সেদিন দ্যাশ বাংলা থিয়েটার স্টুডিও থিয়েটার হলে সেলিম আল দীন রচিত 'জুলান' নাটক মঞ্চায়ন করে। উলেস্নখ্য যে, দীর্ঘকাল পূর্বে রচিত হলেও দলটি প্রবীর গুহের নির্দেশনায় এই প্রথমবারের মতো নাটকটি মঞ্চে আনলেন। এজন্য অবশ্যই তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।

উৎসবের তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় স্টুডিও থিয়েটার হলে সেলিম আল দীনের রচনা থেকে চমৎকার পাঠ করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের সদস্যরা। এ দিনে সেলিম আল দীন রচিত দুটি নাটকের একটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এবং অপরটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চায়ন করে। প্রথমোক্তটি 'কেরামতমঙ্গল' নাটকের নির্দেশক রেজা আরিফ এবং দ্বিতীয়টি 'পুত্র' নাটকের নির্দেশক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। দুজনই নবীন নির্দেশক। 'পুত্র' নাটক দরশনে বাঙালি প্রান্তিক দম্পতির পুত্র হারানোর বেদনা আমাকেও যেন সমান বেদনাবিদ্ধ করে। রচনা ও নির্দেশনার যুগল সম্মিলনেই হয়তো তা সম্ভব হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও নির্দেশককে অভিনন্দন। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এবং নির্দেশক রেজা আরিফকেও অভিনন্দন। কারণ 'কেরামতমঙ্গল'-এর মতো একটি বিশাল ক্যানভাসে রচিত নাটককে মঞ্চের সীমিত পরিসরে উপস্থাপনা তো কম কথা নয়।

এদিন উৎসবের উপান্তে এসে স্বপ্নদলের কথা আবারও বিশেষভাবে বলতে হয়। উৎসবের শুরুতে এবং শেষে তাদের সঙ্গীত পরিবেশনা মনে রাখার মতো। নাটক সমাপনান্তে স্বপ্নদল পরীক্ষণ থিয়েটার হলের লবিতে শুরু করে সঙ্গীত পরিবেশনা। কিছুক্ষণ। অতঃপর নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লবি থেকে সঙ্গীত সহযোগে নিচে নেমে আসে। সেখানে আরো কিছুক্ষণ সঙ্গীত। এরপর বাচ্চু ভাই উৎসব সমাপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পুনরায় স্বপ্নদলকে সঙ্গীত পরিবেশনে আবাহন করেন। স্বপ্নদল 'মঙ্গল প্রদীপে পূজিব তোমারে/ আর তো কিছুই জানি না'_ এই সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে আবারও নাট্যগুরু সেলিম আল দীনকে স্মরণ করেন। স্বপ্নদলের বছরব্যাপী পরিকল্পিত উৎসবের সেস্নাগান 'স্মরণে নাট্যভাষে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন' যেন আরো একবার আমাদের মনে অজ্ঞাতসারেই প্রবেশ করে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা থিয়েটার এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার-এর যৌথ আয়োজনের এই সফল উৎসবের স্মৃতিলেখা এখানেই শেষ করছি।

No comments:

Post a Comment