Monday, February 07, 2011

কিশোরী মেয়েটা কখন যে সৈনিক হয়ে গেলাম! by তারামন বিবি বীরপ্রতীক

ইংরেজি তারিখ জানি না। তখন চৈত্র মাস। চারদিকে খালি গুলির শব্দ পাই। সাত ভাইবোন নিয়ে আমাদের অভাবী সংসার। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। আমার বয়স কত হবে? ১৩ কি ১৪। মানুষের বাড়িতে কাজ করি। কাজ জুটলে খাবার জোটে। না হলে উপোস। কিন্তু কাজ নেই গ্রামে। মিলিটারির ভয়ে পালাচ্ছে সবাই।

সেদিন সোমবার হবে, কাজের সন্ধানে বেরিয়েছি। কাজ পাইনি। বাধ্য হয়ে জঙ্গলে মুখিকচু তোলার চেষ্টা করছি। সেখানে উপস্থিত হন দুজন মানুষ। তাঁদের একজন পরিচিত। তাঁর নাম আজিজ মাস্টার, অপরজনকে চিনি না। আজিজ মাস্টার পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সঙ্গের মানুষটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন মুক্তিযোদ্ধা, নাম হাবিলদার মুহিব। তিনি তাঁর ক্যাম্পে একজন রান্না করার জন্য লোক খুঁজছেন। আমি রাজি হই না। তখন তিনি আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যান। ক্যাম্পে কাজ করার কথা শুনে মা প্রথমে আমাকে যেতে দেন না। এরপর অনেক কথাবার্তার মাঝে মুহিব সাহেব ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করার কথা জানালে মা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হন। পরদিন আমি চলে যাই দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। সেখানে রান্নার কাজ করতে থাকি। এরই ফাঁকে একদিন আমাকে এসএমজি ফায়ার করা শেখালেন আমার ধর্ম পিতা মুহিব হাবিলদার। টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য গাছের উঁচু ডালে একটা ঘুঘু পাখিকে দেখিয়ে ফায়ার করার নির্দেশ দিলেন। প্রথম দিনেই সফল হলাম।
যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা : ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ১৪ বছরের কিশোরী তারামন কখন যে সৈনিক হয়ে গেল, তা জানতে পারিনি। জানলাম সেদিন, যেদিন পাকিস্তানি বাহিনী গানবোটে এসে আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করল।
শ্রাবণের দুপুর, প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্যাম্পের সবাই ভাত খাচ্ছিলাম। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মাস্টার আমাকে একটা ভেজা সুপারির গাছে উঠে পাকিস্তানি বাহিনীর কোথাও অবস্থান আছে কিনা, তা দেখার জন্য বললেন। আমি সেই গাছে উঠে দুরবিন দিয়ে নদীর দিকে দেখলাম। ইতিউতি দুরবিন ঘোরাতেই নজর আটকে যায় একটি লঞ্চের দিকে। একটু একটু করে আরো পরিষ্কার নজর এলে বুঝতে পারি এটা শত্রুর গানবোট। এই গানবোটে পাকিস্তানি বাহিনী এগিয়ে আসছে আমাদের ক্যাম্পের দিকে।
সর্বনাশ! চিৎকার করে উঠি_সাবধান পাকিস্তানিরা আসছে...। সবাই ভাত খাওয়া ছেড়ে অস্ত্র হাতে পজিশন নিল। দ্রুত গাছ থেকে নেমেই তাঁদের সঙ্গে আমিও চায়নিজ এসএমজি নিয়ে পজিশনে শুয়ে পড়লাম। শুরু হলো প্রচণ্ড লড়াই। গুলি চালাচ্ছি। ওদের গুলি এসে আমাদের পাশের গাছে লাগছে। গাছের ছোট ছোট ডাল আর পাতা আমার গায়ের ওপড় পড়ছে। আমার ছোড়া একটি গুলি লাগল এক পাকিস্তানি হানাদারের গায়ে। আরো উৎসাহে ম্যাগাজিন লোড করি। ব্রাশফায়ার করি। কাপড় ছেঁড়ার শব্দের মতো গুলি অবিরাম বের হতে থাকে। মাঝে মধ্যে কলজে কাঁপানো হেভি মেশিনগানের আওয়াজ কানে আসছে। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই চলার পর পাকিস্তানি বাহিনী ফিরে যায়। বিজয়ের উল্লাস আর জয়বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় আমাদের ক্যাম্প এলাকা।
আমার আমিকে সেদিন আবিষ্কার করলাম, কাজের মেয়ে থেকে একজন সৈনিক হিসেবে।
এরপর আমরা আর এখানে ক্যাম্প রাখা নিরাপদ মনে করলাম না। দশঘরিয়া থেকে চলে এলাম কেতনটারীতে। সেখানে আসার পর শুরু হলো পাকিস্তানিদের বিমান হামলা। ১০-১২টি করে বোমা ফেলে চলে যায় বিমানগুলো। গোটা গ্রাম প্রায় পুড়ে শেষ। মারা যায় অনেক মানুষ। নির্দেশ দেওয়া হলো বাংকার খোঁড়ার। এক রাতেই ১৫ বাই ১২ ফুট কেটে ফেললাম আমরা। বিমানের শব্দ পেলেই আমরা বাংকারে অবস্থান নিই। সুযোগ পেলেই বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ি। শুরু হয় এক অন্যজীবন।
আমার দুচোখে তখন স্বপ্ন বাসা বাঁধে। দেশ শত্রুমুক্ত হবে, স্বাধীন হবে। আমরা আমাদের সব ভাইবোনসহ গোটা পরিবার পেটপুরে ভাত খেতে পারব।
একদিন দুপুরের দিকে একটা জঙ্গি বিমান এল। এই বিমানটা আগের বিমানগুলোর মতো নয়। এটা থেকে কোনো বোমা ফেলা হলো না। শুধু একটা চক্কর দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমরা গুলি ছুড়তে চাই। কিন্তু বাধা দেন আজিজ মাস্টার। ক্যাম্প থেকে আমাদের জানানো হলো তাঁদের কাছে খবর এসেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। আনন্দে আমার দুচোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করল। ক্যাম্পে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে জয় বাংলা। কণ্ঠ মেলাই আমি...।
আরেক জীবন : অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। শুরু হলো আরেক জীবন। রাজীবপুর ফিরে এলাম। আম্মা ভাইবোনদের ফিরে পেলাম। অভাব আবার আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। কাজ নিলাম অন্যের বাড়িতে। আমার বড় বোনটার বিয়ে হচ্ছিল না। কারণ আমি ক্যাম্পে ছিলাম বলে। সবাই বলে আমি ভালো মেয়ে নই। একদিন এই গ্রামেরই আবদুল মজিদ নামে একজন আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। ১৯৭৫ সাল। ১০১ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয় মজিদের সঙ্গে। অভাব আর নদীভাঙনের শিকার হই বারবার। জীবন যেন আর চলে না। এরই মধ্যে যক্ষ্মা আমার শরীরে বাসা বাঁধে। ওষুধ কেনার টাকা নেই।
শেষ হয় দুঃখের দিন : ১৯৯৫ সাল। এভাবেই কষ্টের জীবন চলার ফাঁকে একদিন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রভাষক বিমল কান্তি দে এসে আমার খবর নেন। আমাকে অনেক প্রশ্ন করার ফাঁকে জানতে পারি, আমি একজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এরপর ভোরের কাগজে ছাপা হয় আমাকে খুঁজে পাওয়ার রিপোর্ট। ঢাকায় নিয়ে যায় উবিনীগ নামের একটি এনজিও। সংবর্ধনা দেয় তারা। ভোরের কাগজ তহবিল গঠন করে আমার জন্য। তারা আমাকে একটি বাড়ি করার জন্য জায়গা ও আবাদি জমি কিনে দেয়। এ জমিতে আরডিআরএস নামের একটি সংস্থা গড়ে দেয় বাড়ি। এরপর একের পর এক আমাকে সংবর্ধনা দেয় বিভিন্ন সংগঠন। সরকার কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে আরাজী পলাশবাড়ীতে জমি দেয়। ২০০৭ সালে সেখানে একটি আধাপাকা বাড়ি তৈরি করেন কুড়িগ্রাম বিডিআরের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুমন বড়ুয়া।
স্বপ্নই থেকে যায় : এখন অভাব আমাকে আর ছুঁতে পায় না ঠিকই, কিন্তু যেভাবে দেশটিকে দেখতে চেয়েছিলাম সেভাবে এখনো দেশটিকে পাইনি। অনেক রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পতাকা যখন রাজাকারের গাড়িতে ওড়ে তখন আক্রোশ আর অপমানে ক্ষুব্ধ হই। এখনো মুক্তিযোদ্ধারা অনাহারে থাকেন। বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আমি এই বাংলাদেশ দেখতে চাইনি। চেয়েছিলাম শত্রুমুক্ত সুন্দর একটি বাংলাদেশ। যেখানে সবাই সুখে থাকবে।
পরিচিতি : তারামন বিবির জন্ম ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে। স্বামী আবদুল মজিদ, পেশায় কৃষক। বাবা মৃত আবদুস সোবাহান, মা কুলসুম বেওয়া। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে।
তারামন বিবি বর্তমানে রাজীবপুর সদরের কাচারিপাড়ায় বাস করছেন। এই বাড়ির ভিটে ও আবাদি জমিসহ প্রায় এক একর জমি ভোরের কাগজ কিনে দেয়। তারপর সেখানে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাড়ি তৈরি করে দেয়। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে সরকার তাঁকে একটি জমি দান করে। এই জমির ওপর কুড়িগ্রাম বিডিআরের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার সুমন বডুয়া একটি আধাপাকা বাড়ি তৈরি করে দেন।
তারামন বিবি বীরপ্রতীক বর্তমানে অসুস্থ। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। প্রতিদিনই তাঁকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।

অনুলিখন : পরিমল মজুমদার।

No comments:

Post a Comment