Monday, February 07, 2011

কালের যাত্রা by পীষূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পোশাক শ্রমিকদের গানের প্রতিযোগিতামূলক একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। অনুষ্ঠানটির নাম গর্ব। একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং বিজিএমইএ_এই দুটি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজক। শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ ও গীতিকার আসিফ ইকবালের মিলিত উদ্যোগে এবং গানচিলের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান এবং অনুজপ্রতিম বিশ্বজিৎ ও আসিফের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে আমি যখন অনুষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত হই তখন প্রতিযোগিতার কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ৩০ হাজার আগ্রহী পোশাক শিল্পীর ভেতর থেকে ততদিনে বাছাই করা হয়েছে প্রথমে ১৮৩ এবং পরবর্তী সময়ে ৪৩। এই বাছাইয়ের কাজটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে শেষ করেছেন দেশের বেশ কয়েকজন গুণী সংগীতজ্ঞ। শুধু বাছাই নয়, প্রতিযোগীদের পরিচর্যা ও পরিশীলন এবং বড় আসরের প্রতিযোগিতার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে দেশের ৯ গুণী সংগীতজ্ঞ যেভাবে নিরলস শ্রম, অভিজ্ঞতা আর মেধা খরচ করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসা করার মতো। বাণিজ্য-সংস্কৃতির এখনকার সময়ে এই কাজটিকেই বলে 'গ্রুমিং'। শুনতে বেশ আধুনিক লাগে। স্মার্টও লাগে বোধ হয়। আমি যুক্ত হয়েছি প্রতিযোগিতা যখন ৪৩ জনের মধ্যে এসে নেমেছে তখন। আগেই শুনেছিলাম, কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে কি বুঝতাম যে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলো কী অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী! গান শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কী উদাত্ত তাদের কণ্ঠ! গায়কী, মেজাজ আর আত্মবিশ্বাস দেখে কে বলবে যে তারা স্বভাবশিল্পী। মনে হলো দীর্ঘদিন ধরে বুঝি গানের চর্চা আর সাধনা করে আসছেন। তালিম নিয়েছেন বিখ্যাত কোনো গুরুগৃহে। কিন্তু না। এরা কেউই প্রথাগত তালিম নেওয়ার সুযোগই পাননি। প্রত্যেকেই জন্মেছেন পল্লীগ্রামে। বেড়েও উঠেছেন পল্লীর খোলামেলা উদোম আবহে। যেখানে নদীর এ পাড়ে বসে গান শোনাতে হয় ওই পাড়কে। প্রত্যন্ত গ্রামের জীর্ণ মসজিদে মোয়াজ্জিন হয়ে যেখানে খালি গলায় আজান দিয়ে শতেক লোককে নামাজের আহ্বান জানাতে হয়। বয়স্ক মানুষ, মুখে মেহেদী মাখা শ্মশ্রু, সফেদ পোশাক। জিজ্ঞাসা করলাম, মসজিদের মোয়াজ্জিন হয়ে গান গাইতে সমস্যা হয় না? সবাই অন্য চোখে দেখে না? চোখে-মুখে ঈর্ষণীয় সরলতা ছড়িয়ে উত্তর দিলেন, আমি তো গানে গানেই আল্লাহকে ডাকি, নবীজিকে পেতে চাই। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। খুব একটা লেখাপড়া করেননি। অথচ এই জনপদের হাজার বছরের ঐতিহ্যিক জীবনদর্শন যেন মূর্ত হয়ে উঠল ভদ্রলোকের সহজিয়া উত্তরে। সত্যই তো, এটাই তো চিরকাল জেনে এসেছি যে ভাটি অঞ্চলের হাজার বছরের বহতা সমাজে সংগীত অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গান শোনা আর গাওয়াতে পাপ নেই। আনন্দ-বিষাদ, জন্ম-মৃত্যু, উপাসনা, উৎসব-পার্বণ, লোকজ ক্রীড়া ইত্যাদি সবখানেই সংগীত। মাঝি পাল তুলতে তুলতে, রাখাল গরুর পাল মাঠে নিয়ে যেতে যেতে গান করেন। এবড়োখেবড়ো মেঠোপথে চাকায় ক্যাচোর ক্যাচোর শব্দ তুলে ধুলো উড়িয়ে দূরে চলে যায় মহিষের গাড়ি। সব শব্দ ছাপিয়ে অতিদূর থেকে ভেসে আসে গাড়োয়ানের গান।
একজন প্রতিযোগী, এক সময় সিনেমা হলের প্রজেক্টর মেশিন চালাতেন, এখন ঢাকার কাছাকাছি এক পোশাক শিল্পকারখানায় চাকরি করেন। গান অন্তপ্রাণ। হারমোনিয়ামের সুরে গলা সেধে নয়, তিনি গান করতেন প্রজেক্টর মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দের সঙ্গে। গলা তো দরাজ হবেই। একজন প্রায় পড়ন্ত বয়সী পোশাকশিল্পী, নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন। সংসারের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ভ্যানগাড়িও চালান। শান্তির জন্য গানকেই বেছে নিয়েছেন প্রধান অবলম্বন হিসেবে। একজন প্রতিযোগী, একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। কী অবলীলায় তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে হারিনি, সংগীত সাধনাতেও হার মানব না। মহান মুক্তিযুদ্ধ ভদ্রলোককে আত্মবিশ্বাসী করেছে, হার না মানার দীক্ষায় সাহসী করেছে। সেই সঙ্গে জীবনদর্শনে ধারণ করেছেন সততা আর সৎ মানুষ হওয়ার শিক্ষা। মহান বিজয়ের পর কেটে যাওয়া ৪০ বছরে আর ১০ জনের মতো তিনি লোভী হননি, অনৈতিক পথে পা বাড়াননি। নইলে পড়ন্ত বয়সে তাঁকে পোশাক কারখানায় শ্রমজীবী হতে হবে কেন! এ রকম কত যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে গানের এই প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে। কত যে শিখছি, কত কিছুই না জানছি। বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথানত হচ্ছে তৃণমূল থেকে উঠে আসা লড়াকু শিল্পীদের কাছে। ঘরে দারিদ্র্যের কষ্ট, পিতা হারানোর বেদনা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী মাতা, স্বামীর দুর্ব্যবহার, নদীতে লুট হয়ে যাওয়া একমাত্র বসতভিটা ইত্যাদি নানারকম শোক-দুঃখ ভুলে থাকতে এসব স্বভাবশিল্পী কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন গান। ভাগ্যিস তাঁরা এই প্রতিযোগিতায় গান গাইতে এসেছিলেন! নইলে কে চিনত তাঁদের! তবে আমি জানি, দেশের পল্লীমায়ের কোলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন কত না তৃণমূল শিল্পী। অনাদরে, অবহেলায় বুকভরা অভিমান নিয়ে বেঁচে আছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকেরই মাথার ওপর এক টুকরো চাল আছে, কিন্তু ঘরে রান্নার চাল থাকে না। শরীরে রোগের বাসা, চিকিৎসার সাধ্য নেই। স্থানীয় লোভাতুর ক্ষমতাধরদের থাবায় চলে গেছে বংশগত ঠিকানা। তারপর শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব টেলিভিশন-সিনেমা এবং অডিও ক্যাসেটের পরগাছা গান। এতসব দানবের বহুমুখী চাপে টিকে থাকাই তো ভীষণ কষ্টের। তৃণমূল স্বভাবশিল্পীর মৌলিক গান লুট করে এনে নাগরিক সমাজে এখন হচ্ছে কত যে জনপ্রিয় গায়ক! তারা হয়তো জানেই না, শত বছরের পরম্পরায় অনেক কষ্টে টিকিয়ে রাখা গানগুলোর উৎস কি! মৌলিক গানগুলোর সঙ্গে কিভাবে এবং কতখানি জড়িয়ে আছে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য! এসব ক্ষেত্রে করার আছে অনেক কিছু। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কাজের কাজ কিছুই করে না। গৎবাঁধা প্রোগ্রামের বাইরে কার্যকর কিছু করার মতো সদিচ্ছা বা মেধাসম্পন্ন নেতৃত্ব কোথায়! বঙ্গবন্ধু কিন্তু শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৃণমূল শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা, বাংলার চিরায়ত লোকজ শিল্পের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ, বিশ্বমাঝে বাংলার গর্বের সংস্কৃতিকে যথার্থভাবে প্রচার করার জন্য। শুরুতে সেই ভাবেই কাজ হচ্ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে যা কিছু হয়েছে তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কোনো সম্পর্কই নেই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন, অথচ দৃশ্য আগে যা ছিল এখনো তাই। খুব একটা বদল হয়নি।
কালের যাত্রা আজ এ পর্যন্তই।

No comments:

Post a Comment