Friday, January 21, 2011

বখাটের মোটরসাইকেল চাপা দিল ছাত্রীকে: বাঁ পায়ের দুই হাড় ভেঙে গেছে

ঝোরে কাঁদছে আমেনা। এ কান্না পা ভাঙার অসহ্য ব্যথার জন্য নয়। হতদরিদ্র পরিবারের সংগ্রামী এ মেয়েটির এমন কান্না তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। আমেনার মর্মন্তুদ এ কান্নায় চোখ ভিজছে সহপাঠীসহ হাসপাতালে কর্তব্যরতদেরও।

কখনো নানিকে আবার কখনো প্রিয় বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আমেনা আর বারবার চিৎকার করে বলে উঠছে-‘আমার পা ব্যান্ডেজ করে দেন, আমার সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি ঢাকায় যাব না...।’
কিন্তু আশঙ্কাজনক শারীরিক অবস্থার কারণে চিকিৎসকদের কাছে হার মানল মেয়েটির নিদারুণ এ আকুতি। তাকে পাঠানো হলো ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। পড়ালেখা করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমেনার। কিন্তু বখাটের মোটরসাইকেলে আমেনার সঙ্গে চাপা পড়ল তার সেই স্বপ্নও।
দারিদ্র্যের কারণে ঘর ছেড়ে নানা-নানির কাছে আশ্রয় নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল আমেনা আক্তার। কিন্তু তার এ সংগ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়াল বখাটের উৎপাত। গতকাল বুধবার বখাটের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আমেনার বাম পায়ের দুটি হাড় ভেঙে ও লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। বড় ধরনের ও ব্যয়বহুল একটি অস্ত্রোপচারের জন্য আমেনাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু হতদরিদ্র আমেনার চিকিৎসার খরচ কিভাবে জোগাড় হবে, এ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক থাকায় আমেনা ছোটবেলা থেকেই নানা-নানির কাছে থাকে। দরিদ্র নানা-নানির সংসারে থেকেই গত বছর আমেনা এসএসসিতে ৪.৭০ পেয়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, গতকাল বুধবার দুপুরে উপজেলার নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একাদশ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী আমেনা আক্তার (১৭) সহপাঠীদের সঙ্গে পাশের ভদ্রাসন জিসি একাডেমির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল। তারা গুহবাড়ি এলাকায় পৌঁছলে মিজান আকনসহ তিন বখাটে ইচ্ছাকৃতভাবে আমেনাদের ওপর তাদের মোটরসাইকেল তুলে দেয়। এতে আমেনাসহ তিন ছাত্রী সড়কের পাশে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত আমেনাকে উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে কলেজের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক মিজানকে আটক করে। খবর পেয়ে বখাটেদের পরিচিত লোকজন এসে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে মিজানকে মোটরসাইকেলসহ জোর করে নিয়ে যায়। এ সময় বখাটেদের আক্রমণে আমেনার সহপাঠী হাবিবুর, শাওন, নাসির, জসিমসহ ১০ ছাত্র আহত হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে গাছ ফেলে শিবচর-শরীয়তপুর সড়ক অবরোধ করে। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তরিকুল ইসলাম ও শিবচর থানা পুলিশ এসে এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বখাটে মিজান পাশের জাজিরা উপজেলার সেনেরচরের ডেঙ্গর আকনের ছেলে। আমেনার বাবা হারুন মোল্লা ঢাকায় বাসের হেলপার ও মা পারভীন গার্মেন্টকর্মী।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমেনা বলে, ‘বন্ধু-বান্ধব মিলে পাশের একটি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ওর (মিজান) গাড়ি চালানো দেখে আমরা সড়কটির এক পাশে চলে যাই। এরপরও ও হেলেদুলে চালাতে চালাতে হাসতে হাসতে আমাদের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেয়। সামনে আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি মনে হয় আর পড়তে পারব না। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্বপ্নের শিক্ষক হওয়া আর হলো না আমার।’ আমেনার নানি জয়গুন্নেছা বলেন, ‘আমেনার ছোড সময় থিকাই পড়াশোনার ওপর ঝোঁক। তাই অনেক কষ্টের মধ্যেও আমার কাছেই রাইখা পড়াশোনা করাইতাছি। কী দিয়া ওর চিকিৎসা করামু?’
প্রত্যক্ষদর্শী আমেনার সহপাঠী রোকসানা, সাথী, রোকন, জাহিদ বলেন, ‘কলেজে যাওয়া-আসার সময় সব সময়ই বাইরের ছেলেরা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাত্রীদের বিরক্ত করে। আজ মিজানসহ তিন বখাটে খালি সড়কে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে ছাত্রীদের ওপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিয়েছে। এরপর মিজানকে মোটরসাইকেলসহ আটক করলে প্রায় ২০-২৫ বখাটে আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে ওকে ছিনিয়ে নেয়। হামলায় আমাদের ১০ ছাত্র আহত হয়েছে। অবরোধকারী ছাত্ররা অভিযোগ করে, একদিকে ইভ টিজিং করল, এরপর প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর হামলা করল। আমেনা সম্পূর্ণ সুস্থ ও উপযুক্ত বিচার না হলে আমরা সামনে কঠোর আন্দোলনে নামব।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. অশোক কুমার ভৌমিক বলেন, ‘মেয়েটির বাম পায়ের দুটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে ও হাড় ভেঙে গেছে। দ্রুত উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারলে মেয়েটি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।’ নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘এত বড় একটি ঘটনা ঘটার পর আবার ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে ওরা। শিক্ষার্থীদের আপাতত আশ্বাস দিয়ে অবরোধ তুলেছি। কিন্তু এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও আমেনার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না হলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে পারে।’ তদন্তকারী কর্মকর্তা শিবচর থানার এসআই মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি ইভ টিজিংয়ের চেয়েও ভয়াবহ। মিজানসহ বখাটেরা সম্পূর্ণ ইচ্ছা করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি।’

No comments:

Post a Comment