Friday, January 21, 2011

কথকতা : তথ্য এবং সত্য by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

খনো যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন ইত্তেফাক পড়ি কতদিন ধরে, আমি উত্তর দিই জন্মের পর থেকে। কারণ হল একটু বড় হবার পর পাঠাভ্যাস শুরুর সময় থেকেই তো ইত্তেফাক পড়ি। তাছাড়া আমার দুরন্ত কৈশোর এবং সংগ্রামী যৌবনের শুরুর দিনগুলোতে ইত্তেফাক ছিল অন্যতম রাজনৈতিক গুরু।

সারাদিনের মিটিং-মিছিল শেষে মফস্বল শহরের চায়ের স্টলে গিয়ে কাড়াকাড়ি করে ইত্তেফাক পড়ার স্মৃতি আজো আমাকে রোমাঞ্চিত করে। প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের স্বাধীকার আদায়ের প্রশ্নে অনড় এবং আপোষহীন অবস্থান, সেই সাথে মানিক মিয়ার সময়োপযোগী ধারালো ও বলিষ্ঠ উপ-সম্পাদকীয় দুইয়ের সংমিশ্রণে ইত্তেফাক সেই সময়ে এক প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল বাঙালি জাতিকে। বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির দ্রোহের ইতিহাস লিখতে গেলে ইত্তেফাকের নাম অপরিহার্যভাবে লেখা হবে। তাছাড়া জাতির ক্রান্তিলগ্নে ইত্তেফাকের রিপোর্টিংও অসাধারণ। ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন, সত্তুরের জলোচ্ছ্বাস এবং জাতীয় নির্বাচন, পূর্ববাংলার সরলপ্রাণ বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বৈরী আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে ইত্তেফাকের রিপোর্টিং এবং ছবির স্মৃতি আজো আমার কাছে জ্বলজ্বলে হীরকতুল্য। তারও আগে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অথবা রবীন্দ্র শতবার্ষিকী নিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইত্তেফাকের বলিষ্ঠ ও গণমুখী ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম, পূর্ববাংলা ও বাঙালির জাগরণে ইত্তেফাক অনিবার্য হয়ে আছে।

সেই কোনকাল থেকে জেনে এসেছি টিকাটুলীর মোড়ে ইত্তেফাকের অফিস। পরে ঐ মোড়টার নামই হয়ে গেছে ইত্তেফাকের মোড়। সম্প্রতি ইত্তেফাকের অফিস ঐ মোড় থেকে দূরে চলে গেছে। ইত্তেফাকের মোড় কিন্তু ঠিকই আছে। যেমন আছে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেকদিন পরেও দৈনিক বাংলার মোড়। সম্প্রতি ইত্তেফাক প্রকাশনার মালিকানা চলে এসেছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দায়িত্বে। গণমুখী চরিত্রের আড্ডাপ্রিয় মঞ্জু সাহেবকে আমার ভালো লাগে। তর্কবাজ কিন্তু অপরের যুক্তি শোনার মত ঔদার্য, ভদ্রতা এবং ধৈর্যশীল মানুষ তিনি। গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ততা এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই বোধহয় তিনি স্থবির ইত্তেফাক ভবনের বিনিময়ে বেছে নিয়েছেন চলমান ইত্তেফাক প্রকাশনা। এ জন্য অবশ্যই তাঁকে সাধুবাদ জানাই। কাজটা কঠিন। আবার নতুন করে সংগ্রামের শুরু। তবু তিনি কঠিনকে বেছে নিয়েছেন পরস্পরকে গতিশীল রাখবার জন্য। পুরনো পাঠকদের কাছে এটা কম পাওনা নয়।

পূর্বে ইত্তেফাকের একটা বিশেষ চরিত্র ছিল এই যে উলেস্নখিত দৈনিকে বাসি-তাজা সব খবরই পাওয়া যেতো। ইত্তেফাক তথ্য ছাপার ব্যাপারে কার্পণ্য করত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়তে গিয়ে প্রথমেই লিখেছলাম 'কে কী দেন কবে কোথায় এর তত্ব।' ইত্তেফাকের তথ্যে এই তত্বের সব উত্তরই মিলতো। কিন্তু বর্তমানে অবাধ তথ্যপ্রবাহের পৃথিবীতে চিত্র অনেক পাল্টেছে। দেশ-বিদেশ জুড়ে চলছে রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতার নিত্যচর্চা। স্বল্প শিক্ষিতের দেশে তথ্য পাঠকের জ্ঞান বাড়ায় সত্য, কিন্তু জ্ঞান যদি বোধে না পেঁৗছায় তবে তো প্রকৃত সত্য আবিষ্কৃত হবে না। পাঠকের জানাটা যদি বিক্ষিপ্ত থেকে যায়, থেকে যায় শুধু তথ্য সমাহার এবং বোধের জগৎ যদি পড়ে থাকে অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্ত অবস্থায় তবেতো সেই সত্যের চেহারা কখনোই স্পষ্ট হবে না যাতে দেশ, জাতি, সমাজ এগুবে। আতিশয্যের আস্বাদন গুরুপাক হয়ে বদহজমে রূপ নেবে। এসব কথা ভাবতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা মনে পড়ছে। মানুষের ধর্মে তিনি লিখেছিলেন, 'প্রত্যক্ষ তথ্যকে উপেক্ষা করলে মানুষের চলে না, আবার সত্যকেও নইলে নয়। অন্যান্য বস্তুর মতোই তথ্য মানুষের সম্বল, কিন্তু সত্য তার ঐশ্বর্য।' বর্তমানকালে গণমাধ্যমের হিসেবটা বেশ জটিল। তাই বলছিলাম মঞ্জু সাহেবের নবযাত্রা একটু কঠিন বৈকি। তবু সত্যের লক্ষ্যে পেঁৗছাতে তিনি কঠিনকেই ভালবেসেছেন।

কাজ-কর্মে বাইরে গেলে ইত্তেফাক আগ্রহ নিয়েই পড়ি। আর যেদিন আমার কোনো লেখা ছাপা হয় সেদিন নানা জায়গা থেকে টেলিফোন পাই। তখন বুঝি ইত্তেফাক দেশজুড়ে আছে। থাকবেই বা না কেন! ইত্তেফাকতো বাঙালির দৈনিক। বাংলাদেশেরও।

No comments:

Post a Comment