Friday, January 21, 2011

নারী নির্যাতন :২০১১ সালের প্রত্যাশা by মেরীনা চৌধুরী

"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার?"_ এই ফরিয়াদ আজকের নয়, অনেকদিন ধরেই নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে আসছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যে কেবল পণ্য, এ কথা মেনে নিতে সমাজ সচেতন ভদ্রবেশী শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী কিংবা কর্তাব্যক্তিদের কোনও দ্বিধাবোধ হয় না বা লজ্জায় একবারও মাথা নত হয় না।

এটাই কি আধুনিকতার পরিশীলিত রূপ? আজকে এ বিষয়টা প্রায় সকলেই বুঝে গেছেন নারীরা কেবল পুরুষের বিনোদনের যন্ত্র মাত্র। কিন্তু আজ তো একবিংশ শতাব্দী। বিজ্ঞানের যুগ। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ, মানুষ শিক্ষায়-দীক্ষায় রুচি সংস্কারে অনেক এগিয়ে। আজকে নারী বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজে- পর্বতের শীর্ষে, আর আকাশপথে এরোপেস্নন- সর্বত্রই পুরুষের সঙ্গে নারীর সহজ যাওয়া-আসা। এমনকি অফিস-আদালতে পুরুষের পাশাপাশি বসে একই কাজের দায়িত্ব পালন করছে। নারীরা আজ সমাজের হালও ধরছেন। অথচ চূড়ান্ত শীর্ষে পেঁৗছে এবং সভ্যতার এই চরম উন্নতির মুহূর্তেও পরম প্রাপ্তির ঝুলিতে কিন্তু এখনও নারীর নিশ্চিত নিরাপত্তা আসেনি। পুরুষের পাশাপাশি বসে কাজ করলেও রেহাইয়ের প্রশ্নে? সেখানে তাকে অনেক সচেতন হতে হচ্ছে। তারা নিজেকে অসহায় ভাবতে থাকেন। শরীরটাকে একটা শামুকের মতো খোলায় আবদ্ধ করে রাখেন। ভয় কখন কী ঘটে যায়, কিছুই বলা যায় না। এই রকম একটা সময়ে পুরুষের অত্যাচারকে নারীরা কীভাবে মেনে নিচ্ছেন তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। নারী আজ যৌন নিগ্রহ, পারিবারিক নির্যাতন থেকে শুরু করে এমন কোনও নির্যাতন-নিপীড়ন নেই যা তাকে সহ্য করতে হচ্ছে না। এ যুগে দাঁড়িয়েও তো আজকের নারীরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে, তারা প্রকৃত অর্থেই দুর্বল। প্রতিবাদের কোনও ভাষা তাদের মুখে নেই।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্যস্ত ঢাকা শহরে জান্তব গর্জনের পাশাপাশি মধ্যরাতেও শোনা যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার পৈশাচিক উলস্নাস। দিকে-দিকে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার একই ছবির পুনরাবৃত্তি। পুরনো লোহায় রাংতা মোড়ানোর মতো। ট্রেনে-বাসে, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সুযোগসন্ধানী পুরুষের দল নারীকে নানারকম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে যৌন নিপীড়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যুগ চিত্রটাই এই রকম। নারী নিগ্রহ- চিরদিনের, চিরকালের। তা সত্ত্বেও কয়েক দশক আগেও নারীর কিছুটা নিরাপত্তা ছিল। স্কুল-কলেজ থেকে বান্ধবীদের সাথে একা নিরাপদে বাড়িতে ফিরে এসেছে। কিন্তু আজ! জীবন এখন প্রতি মুহূর্তে বিপদসংকুল। আমরা যেন আফ্রিকার গভীর অরণ্যে শ্বাপদসংকুল পরিবেষ্টিত হয়ে বাস করছি। নতুন নির্যাতন ইভটিজিং। সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়। এই তিন অবক্ষয় মিলে আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে আমাদের চারপাশে বহু কিশোরী, তরুণী ও যুবতীর মুখ। যারা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মাহূতি দিয়েছেন। তারা আর কেউ নয় আমাদেরই এক একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ কিংবা প্রতিমূর্তি বলা চলে।

আসলে কিছু সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি ও তার আংশিক রূপায়ণ সত্ত্বেও নারীকে অবহেলিত, অনুন্নত সম্প্রদায় হিসাবে ভাবার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে সমাজের সর্বস্তরেই। নারীর প্রতি এই মনোভাব এবং পারিপাশ্বর্িকতা তাদের নৈতিক অবক্ষয় বা অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, দিচ্ছে। অন্য মেয়ে তো দূরের কথা, নিজের পরিবারের মেয়েদের সম্মান দিতেও অধিকাংশ পুরুষ নারাজ। স্ত্রীকেও তারা দেয় না মানুষের মর্যাদা বা সম্মান। অবশ্য এর পিছনে অভাব, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা সবই কাজ করে। এতো গেল সমাজের সেই স্তরের মানুষের কথা_ যারা দরিদ্র্য, যাদের জীবন অভাব সংগ্রামের সঙ্গে লিপ্ত। কিন্তু সমাজের মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেও এই চিত্র দেখা যায়। নৈতিক মূল্যবোধের অবনতি ঘটে অনেক বিত্তবান পরিবারেও।

যাই করা হোক না কেন সমাজ সচেতন ব্যক্তির সংখ্যা বাড়াতে না পরলে মেয়েদের নিরাপত্তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে না। যৌনতাকে ভোগবাদের উপকরণে পরিণত কার পশ্চিমি ধারণা আজ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীমের দেশেও নারীদের স্থায়ীত্বের সাম্মানিক নিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। যৌন বিকারের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক ভয়াবহ জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত এই সমাজ। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও সেই নির্মম সত্যটা বার বার উঁকি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, সভ্যতা এগোয়নি একফোঁটাও। না হলে আমাদের মত সভ্য দেশে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। কেন নারী বিচার পায় না? অথচ "ন্যায় বিচার" পাওয়া দেশের প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে না এড়িয়ে অপরাধীকে একজন অপরাধী বলে উপলব্ধিতে আনতে হবে। স্বগোষ্ঠী বলে সে যেন কোনভাবেই বেকসুর খালাস না পায়। নারীর জন্য শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ দেশ তথা সমাজ গড়তে নারী-পুরুষ উভয়কে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সেইসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিজেকে মানবিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করাই হোক ২০১১ সালের প্রত্যাশা।

No comments:

Post a Comment