Sunday, July 03, 2011

পাহাড়ে পিষ্ট মানুষ

ট্টগ্রামে আবারও ভয়াবহ পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। টাইগারপাস বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ও মাটি গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ধসে পড়ে। দুর্ঘটনার পর গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ রয়েছে আরো একজন।
এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বৃষ্টির মধ্যে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু ও ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রতিরক্ষা দেয়ালটি বাটালি হিলের মাটিসহ ধসে পড়ে। এর নিচে প্রায় ২০টি বস্তিঘর চাপা পড়ে। এসব ঘরের বাসিন্দাদের গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। পরে অনেকে অন্যত্র চলে গেলেও বাচ্চু মিয়া, মোহাম্মদ শফিক, আমজাদ হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও হোসনে আরা বেগমের পরিবার আবারও নিজেদের ঘরে ফিরে আসে। গতকাল সকালে আনোয়ার হোসেনের পরিবার ছাড়া বাকি চারটি পরিবারের সদস্যরা মাটিচাপা পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী আরিফা হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শফি মিয়ার স্ত্রীকে ডাকার জন্য এসে দেখতে পাই, পেছনের দেয়ালটি ধসে পড়ছে। আমার চিৎকারে আনোয়ার হোসেনের পরিবারের সাত-আটজন সদস্য ঘর থেকে বের হয়ে এলেও বাচ্চু মিয়া, মোহাম্মদ শফি, আমজাদ হোসেন ও হোসনে আরা বেগমের পরিবারের লোকজন বের হতে পারেনি।'
এরপর স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী রেহানা আকতার (৩৫), বড় মেয়ে শারমিন (১৮), মেয়ে ফাতেমা (১২), ছেলে আজাদ (১০) ও তানজিনার (২) লাশ উদ্ধার করেন। স্ত্রী ও সন্তানদের হারিয়ে শোকাহত বাচ্চু মিয়া বলেন, 'আমি সকালে রিকশা চালাতে চলে গিয়েছিলাম। বড় মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি থেকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) বেড়াতে এসেছিল। এখন আমি সবাইকে হারালাম।'
মাটি চাপা পড়া আমজাদ হোসেন (৪০), তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম (২৭) ও মেয়ে শারমিনের (১২) লাশ দুপুর ২টার দিকে উদ্ধার করা হয়। ধসে যাওয়া প্রতিরক্ষা দেয়াল কেটে এর নিচে পাওয়া যায় মোহাম্মদ শফি (৩৫), তাঁর স্ত্রী মিনু আরা বেগম (২৫), ছেলে মিনহাজ (৮) ও মেয়ে সোনিয়ার (৪) মৃতদেহ। রাত সোয়া ১০টার দিকে উদ্ধার করা হয় দুই শিশু সাজ্জাদ হোসেন (১২) ও মেয়ে সাহেদার (৮) মৃতদেহ। স্থানীয় লোকজন সন্ধ্যায় জানায়, এই দুই শিশুর মা মাটির নিচে তখনো চাপা পড়ে আছেন। রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। এর আগে ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১১ জনের মৃত্যুর পর চট্টগ্রামে গতকাল আবারও বড় ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটল। বাটালি হিল ধসে প্রাণহানির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাটালি হিলের পাশে রেলওয়ের জায়গায় বেশ কয়েকটি পরিবার অবৈধ ঘর তুলে বসবাস করছে। তাদের উচ্ছেদের জন্য সিটি করপোরেশন অভিযান পরিচালনা করলেও তেমন কোনো ফল হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা মীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সরকারি জায়গায় থাকব না তো কোথায় থাকব! সিটি করপোরেশন বৃহস্পতিবার আমাদের এখান থেকে তুলে দিলেও আশ্রয় নেওয়ার জন্য স্কুল খুলে দেয়নি। স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক পরিবার আবার আগের জায়গায়ই ফিরে গিয়েছিল।'
গতকালের দুর্ঘটনার পর প্রথম উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। এরপর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সেবক, রেড ক্রিসেন্টের কর্মী এবং সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরাও উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপপরিচালক রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের চারটি ইউনিট উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে। দেয়ালের নিচে চাপা পড়া আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে পাঁচ ঘণ্টা পর আহতাবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।'
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মঞ্জুর আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ বসতির লোকজনকে বৃহস্পতিবারও উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকে পরে ফিরে আসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।' অন্যদিকে জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমদ বলেন, 'প্রবল বৃষ্টির কারণে উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য বারবার মাইকিং করা হয়েছে। এর পরও অনেকে থেকে যাওয়ায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।'
স্থানীয় লোকজন পাহাড়ের প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। তবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, 'আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দেয়ালের পাশের মাটি সরে যাওয়া এবং বৃষ্টির পানি নামতে না পারার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে।'
বস্তিঘরেই নিভল প্রাণ : মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। শেষ অবলম্বন ছিল বস্তির ৩০০ টাকায় ভাড়া নেওয়া একটি ছোট কক্ষ। সেখানে গাদাগাদি করে চলত জীবনযাপনের মরিয়া চেষ্টা। সেই শেষ আশ্রয়স্থল বস্তিঘরেই নিভে গেল চার পরিবারের ১৪টি মানুষের প্রাণ।
বাটালি হিলের ধস বাচ্চু মিয়ার পরিবারের স্ত্রী, সন্তানসহ পাঁচজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। রিকশা চালানোর সময় সকাল ৭টার দিকে পাহাড়ধসের খবর পান বাচ্চু মিয়া। পরে স্ত্রী-সন্তানের লাশ দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। বাচ্চু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিয়ে করার পর আট থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখিনি। এরপর প্রথম স্ত্রী রেনু বেগম আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করায়। এর এক বছর পর সংসার আলো করে সন্তান আসে। আজ (শুক্রবার) পাহাড়চাপায় আমার জীবন আবার অন্ধকার হয়ে গেছে।'
ধস ঠেকাতে পারেনি প্রতিরক্ষা দেয়াল : বাটালি হিলের ধস ঠেকাতে গত বছরের প্রথম দিকে ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। প্রায় ৩০ ফুট প্রস্থ ও ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের দেয়ালটি গতকাল পাহাড়ধস ঠেকাতে পারেনি। বরং এটি ভেঙে পড়ায় ক্ষতির মাত্রা বেশি হয়েছে বলে অভিযোগ করে এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মঞ্জুর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিরক্ষা দেয়াল নিয়ে এলাকাবাসী যে অভিযোগ করছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। নির্মাণকাজে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বৃহস্পতিবার ঝুঁকিপূর্ণ ওই এলাকায় আমি নিজে গিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। তার পরও লোকজন আবার সেখানে ফিরে আসে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই সবার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা থেকে সরে যাওয়া উচিত।'
প্রতিরক্ষা দেয়ালটি নির্মাণকাজের ঠিকাদার গিয়াস আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা গত বছরের প্রথম দিকে কাজ শেষে সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দিই। তখন ত্রুটিপূর্ণ কাজ করার অভিযোগ কেউ করেনি। এখন একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর সবাই নির্মাণকাজে ত্রুটির কথা বলছে। আমরা যে জায়গায় দেয়ালটি নির্মাণ করি, তার নিচ থেকে মাটি কেটে ঘর তৈরি করায় সেটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়সহ দেয়ালটি ধসে পড়তে পারে।'
নিহত প্রত্যেকের জন্য ১০ হাজার টাকা অনুদান : পাহাড়ধসে নিহত প্রত্যেকের জন্য ১০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের দ্রুত উচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব পাহাড়ের মালিক এ নির্দেশ অমান্য করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি বৈঠকে জেলা প্রশাসক এ নির্দেশ দেন। গত বছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার এক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পাহাড়-মালিকদেরই ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা সেটা বাস্তবায়ন করেননি। তাঁরা ব্যর্থ হলে পাহাড়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে।'
বৈঠকে আরো চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেগুলো হলো_দুর্যোগকবলিত এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে পিডিবি, বাটালি হিল এলাকার ধসে যাওয়া দেয়াল দ্রুত অপসারণ করবে সিটি করপোরেশন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনে পাঠদান বন্ধ রেখে গৃহহীনদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং চাপা পড়া অন্য তিনজনকে দ্রুত উদ্ধারের ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। এ ছাড়া পাহাড়ধসের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) এহসান এ ইলাহীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

No comments:

Post a Comment